অতি ফ্যাশনপ্রিয়তা: হারিয়ে না যায় যেন বিশ্বাসের স্বকীয়তা

।। বিনতে এন. এম. জাহাঙ্গীর ।।

সময়ের স্রোত যত বয়ে যায়, ভাসতে থাকে ফ্যাশন ও আধুনিকতা। গতকালের ফ্যাশনের স্থান দখল করে নেয় নব-বাহারী স্টাইল। এভাবেই পরিবর্তনের চক্রে আবর্তিত হতে থাকে ফ্যাশন। আর পরিবর্তনের হাওয়ায় দুলতে থাকি আমরাও; বিশেষ করে মেয়েরা।

ফ্যাশন হল যুগের রঙিন রূপ। সময়ের সাথে তাই বৈচিত্রময় হয় ফ্যাশন। আজকের নন্দিত ফ্যাশন আগামীকালের বাতায়নে রূপ নিচ্ছে ‘ওল্ড ফ্যাশন’ হিসেবে। আর শূন্যস্থান পূরণে উদ্ভাবিত নব-ফ্যাশন বরিত হচ্ছে ‘লেটেইস্ট ফ্যাশন’ শিরোনামে। আবার ফ্যাশনের হালযামানায় সর্বশীর্ষে পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির। ‘ওয়েস্টার্ণ কালচার’ যেন সামাজিক, পারিবারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র, এমনকি ফ্যাশনকেও চরম দাপটে নিয়ন্ত্রণ করছে! ‘পশ্চিমাপ্রীতি’ আমাদের এতটাই সম্মোহিত করেছে যে, ‘পরিচয়পত্রে’ মুসলিম হলেও, জীবনের অধিকাংশ জুড়েই বিরাজ করছে পশ্চিমা রীতিনীতি ও ফ্যাশন প্রকৃতি। ফলশ্রুতিতে ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন অনেক ক্ষেত্রেই অপরিচিত এবং ‘সেকেলে’ মনে হচ্ছে। রঙিন চশমাধারীর কাছে যেমন সবকিছুই রঙিন মনে হয়, পশ্চিমার হলুদ সভ্যতাবাদীর কাছেও তাই ইসলামপরিপন্থি পশ্চিমা সংস্কৃতিগুলো ‘ফ্যাশন ও আধুনিকতা’’ হিসেবে বড় চমকদার ও রঙিন। উন্নতির পথে যেন সর্বকাঙ্খিত সিঁড়ি। কবির ভাষায়-

خرد کا نام جنوں پڑ گیا جنوں کا خرد
جو چاہے آپ کا حسن کرشمہ ساز کرے

“বিবেক-বুদ্ধি পাগলামি; আর
পাগল হল বুদ্ধিমান,
আজব তোমার শিল্প-কৌশল,
আজব তোমার অবদান”!
আমাদের আইডল বা আদর্শ কে?

সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে ফ্যাশনরীতি। কখনও এই নায়িকার চুল কাটিং, কখনও অমুক অভিনেত্রীর পোশাক ফ্যাশন অনুসরণ করতে যেয়ে আমরা যেন চরম অস্থির হয়ে পড়ছি। এদের অনুসরণ করলে কী হবে? হয়ত সাময়িক কিছু দিন ‘হলুদ সভ্যতাবাদী’ কিছু ব্যক্তির বাহবা পাওয়া যাবে। স্থায়ী কোন ভাল পরিণতির আশ্বাস নেই এ পথে। তবু কেন আমরা তাদের অনুসরণ করি। কারণ, আমরা অনেকেই তাদের সেলিব্রেটি জ্ঞান করি। যাদের অধিকাংশের চরিত্রে নিষ্কলুষতা নেই, নেই রমণীসূলভ লাজুকতা। তারা কি করে হয় সেলিব্রেটি! তারা তো আলোর নয়; বরং আধাঁরের ফেরিওয়ালা। আমাদের আদর্শ তবে কে? কেইবা আমাদের আলোর বার্তাবাহক? কুরআনে কারীমে রবের ঘোষণা-

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُوا اللهَ وَ الْيَوْمَ الْأخِر وَ ذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا

‘বস্তুত তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ- ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ তাআলা ও কিয়ামত দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহ তাআলাকে অধিক স্মরণ করে’। (সূরা আহযাব, ২১)।

আরও পড়তে পারেন-

আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
মুমিন জীবনে নামাযের গুরুত্ব
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি

আমাদের বিশ্বাসের স্থান হল ইসলাম। কুরআনে আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের জন্য অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করে দেয়ার পর আর বিতর্কের সুযোগ নেই। আমরা তো মুসলিম বা (রবের জন্য) আত্মসমর্পিত। অস্থিরচিত্তে মডেলদের ফ্যাশনের পেছনে ছুটেফেরারও বোধহয় প্রয়োজন নেই বোন। ইসলামে প্রত্যেকটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ও মূলনীতি দেয়া হয়েছে। আসুন, হালযামানার বেশ কিছু ফ্যাশন পর্যবেক্ষণ করে দেখি, ইসলামের সাথে তা আদৌ যুৎসই কিনা।

পোশাকের ফ্যাশন
হালযামানায় গোড়ালি ঢেকে প্যান্ট পরা ছেলেদের অন্যতম ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মেয়েরা পরছে টাখনু-উন্মুক্ত আঁটোসাটো পাজামা। কখনও দিঘল-বিস্তৃত পাজামা; যাতে টাখনু তো খুলছেই, অসতর্কতায় সতরের বেশ খানিক অংশ উন্মুক্ত হতেও দেখা যাচ্ছে অনেকের। এ ব্যাপারে আমাদের ‘সর্বোন্নত আদর্শ’ (সা.)এর নির্দেশনা জেনে আসা যাক-

১. নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘অহংকারবশত যে (পুরুষ) ব্যক্তি তার পোশাক টাখনুর নিচে ঝুলাবে, মহান আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না’। নবীজির সম্মানিতা স্ত্রী হযরত উম্মে সালামা (রাযি.) বললেন- ‘তবে মেয়েরা তাঁদের (পোশাকের) আঁচলের কী করবে?’ নবীজি বললেন- ‘মেয়েরা স্বাভাবিকের চেয়ে এক বিঘত বেশি ঝুলিয়ে পরবে’। উম্মে সালামা (রাযি.) বলেন- ‘এর পরেও যদি কারো পা দেখা যায়?’ নবীজি বললেন- ‘তাহলে এক হাত পর্যন্ত ঝুলাবে। এর অধিক নয়’। (তিরমিযী- ১৭৩১, নাসায়ী- ৫৩৩৬, মুসনাদে আহমাদ- ২/৫)।

বিধর্মী বা পুরুষসদৃশ পোশাক

আজকাল অনেক বোনের মাঝে ভিন্ন ফ্যাশনে এতটাই আগ্রহী দেখা যায়, তাদের পোশাকের প্রথম দর্শনে ছেলে নাকি মেয়ে; ঠাহর করাটাই বড় দুষ্কর হয়ে পড়ে। ছেলেদের টি-শার্ট, গেঞ্জি, শর্ট টপস-টাইস অবলীলায় পরিধান করে বাইরে বেরুচ্ছেন। শালীন পোশাক অবশ্যই সকলের কাম্য। ফ্যাশন অনুসরণ করতে যেয়ে আল্লাহ প্রদত্ত রমণীয় লাজ-সৌন্দর্যতা পরিহার করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। আর যে পোশাক বিধর্মীদের ‘ধর্মীয় পোশাক’ হিসেবে স্বীকৃত, তা পরিধান করা হতে বেঁচে থাকাও একজন মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব।
২. যে নারী পুরুষসদৃশ পোশাক পরেন এবং যে পুরুষ নারীসদৃশ পোশাক পরিধান করেন, নবীজি (সা.) তাদের উপর লা’নত করেছেন।

সাজসজ্জা ও চলনভঙ্গির ফ্যাশন

মানুষের সৌন্দর্যের প্রধান প্রকাশ মুখাবয়ব। বর্তমানে শুধু প্রসাধনী ব্যবহার করেই নয়, বরং সার্জারীর মাধ্যমে চেহারাকে সৌন্দর্য্যরে প্রচেষ্টাও চলছে। বছর দুয়েক আগে এক বিদেশিনী মেয়ের ব্যাপারে পত্রিকায় সংবাদ এসেছিল। যে কিনা নিছক সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নাক-সার্জারী করেছিল। পরিণতিতে নাক আগের চেয়েও অসুন্দর হয়ে, চেহারাটাই কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেছে। আর স্বদেশ-বিদেশ সবখানেই এখন ভ্রু-প্লাক করার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। অনেকেই আবার শরীরে ট্যাটু (উল্কি) এঁকে দেহকে নকশাদার বানাতে উদগ্রীব। এ যেন নিজ দেহের সাথে একপ্রকার নিষ্ঠুরতা-নির্দয়তা। এব্যাপারে দয়ার আধার নবীয়ে আরাবী (সা.)এর সতর্কবাণী-

২. হযরত ইবনে মাসঊদ (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ অভিশাপ করেছেন ঐ নারীদের, যে নারী উল্কি আঁকে ও যার দেহে অঙ্কন করা হয় এবং যারা কৃত্রিম চুল ব্যবহার করে (যারা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মাঝে বিকৃতি সাধন করে)। (আবু দাঊদ)।

সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে নবীজি (সা.)এর পবিত্র যবান নিঃসৃত বাণীসমূহ আজ আমাদের সামনে দিবালোকের ন্যায় সমুদ্ভাসিত। যেন নবীজি আজকের যামানার দৃশ্যগুলো স্বচক্ষে দেখছেন ও বড় দরদ নিয়ে সতর্ক করেছেন, প্রিয় উম্মতদের। উচুঁ করে মাথা বাঁধার ফ্যাশনও সর্বত্র বহুল ছড়াছড়ি। পাতলা পোশাকের আধিক্য জামা হতে শুরু করে বোরকার কাপড়েও বিদ্যামান। এক অদ্ভূত নগ্ন সংস্কৃতি দিন দিন আমাদের পেয়ে বসছে। অথচ নবীজি (সা.) এমন নারীদের জন্য কী কঠিন হুঁশিয়ার বাণীই না বলেছেন-

৩. হযরত আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, দুই শ্রেণির জাহান্নামীকে আমি এখনও দেখিনি। ১. ঐসব (অহংকারী ও যালেম) লোক, যাদের সাথে গরুর লেজসদৃশ চাবুক থাকবে। আর তারা তা দিয়ে মানুষকে আঘাত করবে। ২. ঐসব নারী, যারা (পাতলা ফিনফিনে) পোশাক পরিহিতা হয়েও (যেন সম্পূর্ণ) উলঙ্গ, পর পুরুষকে আকর্ষণকারিণী এবং নিজেও আকৃষ্ট। তাদের মাথা (এর সাজের ফ্যাশন) বুখতী উটের (এদিক-ওদিক) হেলানো কুঁজের মত। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ এত এত (অর্থাৎ অনেক) দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়। (মুসলিম- ৩৯৭১, মুসনাদে আহমাদ- ৮৩১১)।

বর্ণিত হাদীসসমূহে আমরা যে বিষয়গুলো জানতে পারলাম- নারীরা পুরুষদের সাদৃশ্যপূর্ণ পোশাক পরিধান না করা। ভ্রু-প্লাক না করা ও অন্যকেও ভ্রু-প্লাক করে না দেয়া।

পাতলা পোশাক পরিহিতা, পরপুরুষকে আকৃষ্টকারিণী, অন্যদের নিজের ফ্যাশনের দিকে ধাবিতকারিণী এবং উচুঁ করে মাথা বাঁধা নারীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি (আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি এতটাই নারাজ হবেন যে,) জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।এই আকর্ষিত করার অন্যতম আরেকটি কারণ, তীব্র ঘ্রাণযুক্ত পারফিউম। (সা.)এর আরেকটি হাদীস এর সমর্থন করে-

৪. নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন- ‘নারী যখন আতর-খুশবু মেখে পুরুষদের মজলিসের পাশ দিয়ে যায় (আর সে নিজ সৌন্দর্য দেখাতে চায়), তখন সে এরূপ এরূপ অর্থ্যাৎ যিনাকারিনী’। (তিরমিযী, মিশকাত)।

অন্যদের ভাল বিষয়ে আকর্ষিত করার ব্যাপারে নবীজির বাণী-

৫. নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি অপরকে ভাল কাজে আহ্বান করবে, সে উক্ত কাজ সম্পাদনকারীর মত সাওয়াব পাবে’।

ফ্যাশনপ্রিয় মুসলিমদের ব্যাপারে বড় আক্ষেপ নিয়ে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেছেন-
وضع میں تم ہو نصاریٰ تو تمدن میں ہنود
یہ مسلماں ہیں جنہیں دیکھ کے شرمائیں یہود

‘আকৃতিতে খ্রিস্টান,
কালচারে হিন্দু-জাতি;
এ কেমন মুসলমান,
যাদের দেখে লজ্জায় মরে ইহুদী’!

নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি যেই জাতির অনুসরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে’।
সুতরাং তুমি কাদের কাফেলায় নাম লেখাতে চাও বোন। আজকের তথাকথিত ‘সেলিব্রেটিদের’ নাকি নববী পরশ-ধন্যা নিষ্কলুষ খাদিজা, আয়িশা, ফাতিমাদের (রাযি.) মহিয়সী কাফেলায়!

হে আমার বোনেরা! আধাঁরের ফেরিওয়ালাদের বিপরীতে আমরা হই আলোর ফেরিওয়ালা। আধাঁরের ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে আমরা কতকে এগিয়ে আসি নূরের প্রদীপ হাতে। ওরা যদি হয় পাশ্চাত্যপূজারী, আমরা হব আল্লাহর অনুসারী। নগ্নতা-ফ্যাশনের অমাবস্যায় আমরা যেন হয়ে উঠি ‘পূর্ণ চাঁদ’। তবেই জগতময় ছড়িয়ে পড়বে রূপালি জোৎস্না। ফিরে আসবে শালীনতার সোনালি আলোকবর্তিকা। (ইনশাআল্লাহ)।

লেখক: ওয়াপদা কলোনী, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে।
ইমেইল- jahangirbwdb63@gmail.com

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।