।। মুশতারী তাসনীম মুন্নী ।।
বিশাল আর বিস্তৃত আসমানে শুভ্র সফেদ এক চিলতে চাঁদের মাধ্যমে আগমন হয় রহমত বরকতের ধারায় মাগফিরাত নিয়ে পবিত্র মাহে রমযান। রমযান শুধু রহমত বরকত আর মাগফিরাতের নয়। রমযান আত্মশুদ্ধি আর সংযমের অন্যতম নাম। রমযান আসে দেশে দেশে, আসে পাড়ায় মহল্লায় ঘরে ঘরে আনন্দ নিয়ে, ইবাদতের বার্তা নিয়ে, আসে তিলাওয়াতের সুরে সুরে।
রমযানের বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক প্রশান্তির পরশ। রোযা একটি মনোদৈহিক ইবাদত। একজন পুরুষের মতো ফরয এই বিধানে নারীর অংশগ্রহণও সমভাবে প্রযোজ্য। একজন নারীর জন্য ফরয ইবাদতে রয়েছে উচ্চতর মর্যাদা।
হাদীসে বলা হয়েছে, “কোনো নারী যদি পাঁচওয়াক্ত নামায পড়ে, রমযান মাসে রোযা রাখে, নিজের ইজ্জত ও সম্ভ্রম হেফাযত করে, স্বামীর আনুগত্য করে থাকে, তাহলে সেই নারীর জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন খুলে দিবেন। ওই নারী যেই দরজা দিয়ে খুশি সেই দরজা দিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন”। (সুনানে তিরমিযী)।
সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ আমাদের জন্য কত বড়ো মর্যাদা রেখেছেন। তাহলে আমরা কেনো এই পূর্ণ অর্জন হতে গাফেল হবো। একজন নারীর ঘর-সংসার আর সন্তান সামলে রমযানে কীভাবে সংশোধন, সংযম আর ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে আজকে তারই কিছু ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আসি অন্তরে রমযান নিয়ে। পবিত্র এ মাসে আল্লাহ স্বয়ং শয়তানকে বন্দি করে রাখেন। আমাদের নফসকে সর্বাবস্থায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নফস চাইবে রমযান শেষে ঈদ শপিং জমিয়ে হোক। আর নফসকে কন্ট্রোল করে একজন নারী চাইবেন চাঁদরাতসহ নিজের ইবাদাতের পাল্লা ভারী করতে। সবসময় হারাম হতে নিজেকে বিরত রাখা। রমযানের পবিত্রতা যেনো কোনও হারাম কাজ, কথা কিংবা ভাবনা দিয়ে নষ্ট না করি।
পরনিন্দা কিংবা গীবত হতে দূরে থাকা। সারাদিন আল্লাহর খুশির জন্য না খেয়ে, আল্লাহর হুকুম রক্ষা করতে শরীরকে সংযত রাখতে গিয়ে আমরা যেনো যবানকে হালকা না করি। পরনিন্দা কিংবা গীবতের দ্বারা রমযানের শিক্ষা অবহেলা না করি।
নামায ও তিলাওয়াত এই দুই দিয়ে রমযানের শুদ্ধতা অর্জন করি। সংসারী এক নারীর দিনের শুরুর দিকে কাজকর্ম কম থাকে। তখন নিজেই সময় বের করি এবং বেশি বেশি তিলাওয়াতের দ্বারা হৃদয় শুদ্ধ করি। ক্লান্ত দেহে নামায হতে যেনো কিছুতেই বিচ্যুত না হই সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাটতে বসতে ছোট ছোট দোয়া, যিকির কিংবা দুরূদ পড়তে থাকি। যবান এতে করে সংযত থাকবে। যবানের নিয়ন্ত্রণে এরচেয়ে উত্তম পদ্ধতি আর কিছু নেই।
বর্তমান আধুনিক যুগের কল্যাণে আমাদের সবার হাতেই পৃথিবী তথা স্মার্টফোন। আমরা এই স্মার্টফোনের ভাইরাস তথা অশ্লীল বিনোদন হতে নিজেকে, নিজের চোখকে হেফাযতে রাখি।
বাবা, ভাই কিংবা স্বামীর অনুমতিতে দান সদকা বাড়িয়ে দিন। রোযাদার অসহায়, দুর্বল কিংবা রুগ্ন ব্যক্তির পাশে সাধ্যমতো দাঁড়াতে সচেষ্ট থাকি। একটি খেজুর কিংবা একটু প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিংবা নগদ অর্থ, পোশাক দিয়ে হলেও এগিয়ে যাই। দান সদকা এমনভাবে দিন, যাতে ডান হাতের দান সম্পর্কে বাম হাত না জানে।
ক্রোধ সংযত করুন। এজন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চান। নিজেকে কোমল রাখুন। অধীনদের সাথে সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় কথা বলুন।
সম্ভব হলে শেষ দশ দিন কিংবা শেষ তিনদিন ইতিকাফ করুন। ঘরের এক কোণে, নিরব সুন্দর পরিবেশে। যেখানে কেবল ইবাদাতের উদ্দেশ্য থাকে। হৃদয়ে থাকে কবর হাশর আখিরাতের ভয়। ইতিকাফ আপনাকে শুদ্ধ করতে সহায়ক হবে, যদি আপনার উদ্দেশ্য হয় সহীহ।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- মাহে রমযান: সিয়াম সাধনা, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
এবার আসি অন্দরে রমযান নিয়ে। রমযান আসা মানেই ঘরের কর্তার একটু আধটু বাড়তি কেনাকাটা আর গিন্নির রান্নাঘরের তোড়জোড় বেড়ে যাওয়া। আসুন এখানে নিজেকে কীভাবে পরিচালনা করবো একটু ভেবে নেই।
শুরুটা হয় সাহরি দিয়ে। আপনার সাহরি মেন্যু তৈরিতে অবশ্যই খেয়াল রাখুন, যা তৈরি করেছেন তা সবার রুচিমতো হয়েছে কি-না।
সারাদিনের জন্য আহার বন্ধ রেখে যেই রবের সন্তুষ্টি অর্জনে আপনার প্রিয়জন রোযা রাখবেন, আপনিও সেহেতু প্রিয়জনের প্রিয় আহারের ব্যবস্থা করুন সাধ্যমতো। শেষটা হয় ইফতারির প্রতীক্ষা থেকে। আপনিও রোযা রেখে, সারা বিকেল ধরে চুলোর আগুনে প্রিয়জনের জন্য ইফতারি তৈরি করছেন। এজন্যে অবশ্যই আপনার সওয়াবের খাতা ভারী হবে। তবে আপনাকে অবশ্যই বয়সভেদে সবার জন্য চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত যতটুকু সম্ভব মেন্যুতে রাখুন।
আপনি মা, আপনার অধীন আপনার সন্তান। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রমযানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বলুন। হোক গল্পাকারে কিংবা মাথায় হাত বুলিয়ে। আস্তে আস্তে একটি দুটি তিনটি করে রোযায় অভ্যস্ত করুন।
রোযার সময় সংযম সাধনাও আপনার থেকেই শিখবে। সংসার আর সামাজিক প্যারায় নিজের সন্তানকে রমযানের শিক্ষা হতে কখনোই দূরে রাখবেন না।
অনেক মাকেই দেখা যায়, সন্তানের এক্সাম আছে, কোচিং আছে, সামনে ফিউচার। তাই রোযার ধকল সামলে পড়তে পারবে না। এতে আপনিই আপনার সন্তানের পথভ্রষ্ট হবার জন্য দায়ী থাকবেন। ইহকালীন শিক্ষার জন্য পরকালীন ফরয ইবাদত বাদ দেবার কোনও যৌক্তিকতা কোথাও নেই।
হ্যাঁ, আপনার সন্তানের রাতের পড়াশোনা দিনের প্রথমার্ধে শেষ করান। ছোট হতে অভ্যস্ত করান। তখন আর রমযান পালনে সন্তানের পড়াশোনা মোটেও ব্যাহত হবে না। আমরা দুনিয়া অর্জনে অন্ধ না হয়ে আখিরাত অর্জনে আগ্রহী হই।
সন্তানকে তিলাওয়াতের জন্য উৎসাহ দিন। বকাঝকা না করে প্রথমে আহ্বান করুন, কোমলতার পরিচয় দিন। এরপরও কথা না শুনলে শাসন করুন শুদ্ধভাবে, অশ্লীলভাবে নয়।
পরিবারের বয়স্ক ও রুগ্ন ব্যক্তির প্রতি আলাদা যতœ নিন। অনেক বয়স্কদের শারীরিক সমস্যার দরুন রোযা রাখা সম্ভব হয় না।
চেষ্টা করুন তাদের পরিমিত আহারে যেনো ঘাটতি না আসে। তাদের রোগ ব্যাধিতে বিরক্ত না হয়ে শ্রদ্ধাবোধ আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সেবা করুন। বিনিময় তো আখিরাতে আছেই।
রমযানে কাজের চাপ বাড়তি থাকে। যেই কাজ আগেভাগে গুছিয়ে নেয়া যায় অলসতা না করে গুছিয়ে নিন। ইফতারির বাসন-বাটি সম্ভব হলে রান্নাঘরে বা টেবিলে আলাদা করে রাখুন। ফলে প্রচুর ফরমালিন থাকে, ঘুম হতে জেগেই মিনিমাম ঘণ্টা দুয়েক বড়ো বল অথবা পরিষ্কার পাত্রে ভিজিয়ে রাখুন।
রোযাদারের জন্য শরবত এক তৃপ্তির উপকরণ। এখানে আপনি প্রতিদিন একই আইটেম না রেখে কখনও ফলের জুস করে নিন, কখনও লেবু চিনি কিংবা রুহ আফজা নিন, কখনও চিড়ে-গুড়ের সমন্বয়ে শরবত করুন, কখনও ইসবগুল, তোকমা দিয়ে করুন, কিংবা কখনও আপনার নিজস্ব আইটেমে শরবত করুন।
চিনি বা মিষ্টি পরীক্ষার জন্য কতগ্লাস পানিতে কতটুকু চিনি বা গুঁড় প্রয়োজন আগেভাগেই প্র্যাক্টিস করে নিন।
রমযানে রান্নায় একটু আলাদাভাবে বৈচিত্র আনুন। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, অতিমাত্রায় কিছু করতে গিয়ে ইবাদতের ঘাটতি যেনো না হয়।
ইফতারিতে পরিবারের মাহরাম সবাই একসাথে বসুন। একটি বড় প্লেট রাখুন। সম্মিলিত আহারে সুন্নাত বজায় রাখুন। পরিবারের একজন আরেকজনের প্রতি এখান হতেই আন্তরিকতা সৃষ্টি হবে।
মোটকথা, রমযানে নারীর সর্বদাই ব্যস্ততা। কখনো ইবাদতে, কখনও রোযাদার প্রিয়জনদের খেদমতে। আমাদের রমযানের গুরুত্ব জানতে হবে, এর পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে, গোটা পরিবারকে রমযানের মূল শিক্ষা নিয়ে পুরোটা বছর এগিয়ে নিতে হবে। রমযান শুধু অনাহারী থাকাই নয়, রোযা আপনার যবানে, আপনার জীবনে সর্বক্ষেত্রে তাৎপর্য বহন করে। সুতরাং মাহে রমযান হোক আমাদের জান্নাতের পাথেয়। হোক আত্মশুদ্ধি ও সংযম সাধনার। রমযানের পবিত্রতা দিয়েই আমাদের জীবন ও সংসার জড়িয়ে রাখি উদ্যমে।
লেখক: সমাজ চিন্তক।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/