।। কাজী হামদুল্লাহ ।।
দেশে গত বেশ কিছুদিনের সংবাদপত্রসমূহ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রতিনিয়তই প্রিয়জনের হাতে হত্যার শিকার হচ্ছে প্রিয়জনরা। ঘটনাগুলোর নিষ্ঠুরতায় এখন ভাববার সময় এসেছে, কেন এসব ঘটনা বারবার দেখতে হচ্ছে এবং শুনতে হচ্ছে আমাদেরকে।
কয়েকদিন আগেই রাজধানীর কদমতলীতে ট্রিপল মার্ডারের কথা আমরা কমবেশি অনেকেই জানি। ঘাতক মেহজাবিন তার মা-বাবা ও ছোট বোনকে হত্যা করে নিজেই ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে বলে, ‘মা-বাবা ও ছোট বোনকে হত্যা করেছি। আপনারা আসেন। আমাকে ধরে নিয়ে যান।’ এরও কয়েকদিন আগে কুষ্টিয়ায় নিজের স্ত্রী ও সৎ ছেলেসহ তিনজনকে প্রকাশ্য সড়কে গুলি করে হত্যা করেছে খোদ পুলিশেরই এক এএসআই।
রাজধানীতে এক স্ত্রী নিজের সিএনজিচালক স্বামীকে হত্যা করে লাশ ছয় টুকরা করেছে। গত জানুয়ারি মাসে নিজের জা আর ভাসুরকে ফাঁসাতে গিয়ে এক মাসের শিশুপুত্রকে পানিতে ফেলে হত্যা করেছে গোপালগঞ্জের এক পাষ- মা। একই মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজশাহীর পুঠিয়ায় টাকা-পয়সার জন্য নিজের স্ত্রী ও পাঁচমাসের শিশুকন্যাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে এক নিষ্ঠুর যুবক। ঢাকার গুলশানে এক ভাতিজি তার ফুফু নিকিতাকে শিলপাটার শিল দিয়ে আঘাত করে এবং বটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। গত ২০ মে ঢাকার দক্ষিণখানে আলোচিত আজহারুল ইসলাম হত্যাকা-ের ঘটনা আমরা অনেকেই জানি। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, আলোচিত এই হত্যাকা-ের সাথে নিহতের স্ত্রী জড়িত ছিলো। তার কথাতেই হত্যার পর আজহরুল ইসলামের লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে সাত টুকরা করে সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো।
এভাবে আরও বহু ঘটনার কথা বলা যাবে। ঘটনাগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মানুষ এখন চরম পর্যায়ের নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। ফলে আপনজনের হাতেই খুন হচ্ছে আপনজন। নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে নিকটতমরাই। নিজের ঘরের পরিবেশেই কেউ আর নিশ্চিন্তে ঘুমানোর সুযোগ থাকছে না। এর ভয়ানক পরিণতি চিন্তা করে শঙ্কিত দেশের সচেতনমহল।
কেন এমন ঘটনা বাড়ছে?
গবেষকরা বলছেন, এসবের পেছনে এককভাবে কোন নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করা মুশকিল। কেননা, প্রত্যেক ঘটনার ধরন এক হলেও এসবের কারণ হয়ে থাকে ভিন্ন ভিন্ন। কোথাও পরকীয়া, কোথাও পারিবারিক সম্পত্তি, আবার কোথাও অযথা ভুল-বোঝাবুঝি এবং কোথাও নিছক হতাশাবোধ থেকেই এসব ঘটছে। তবে সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে একেক ঘটনার কারণ ভিন্ন ভিন্ন হলেও সব ঘটনার সবচেয়ে বড় এবং মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জনগণের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা এবং মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের যে অভাব ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির খপ্পরে পড়ে মানুষের কাছ থেকে উধাও হয়ে গেছে নীতি-নৈতিকতা, সামাজিকতা ও মানবিকতা। তাদের মতে, এসবের (নীতি-নৈতিকতা, সামাজিকতা ও মানবিকতার) ছায়ায় বেড়ে ওঠা মানুষ কখনই কোন অপরাধে জড়াতে পারে না।
আমাদের দেশ ও সমাজ থেকে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ যে হারিয়ে যাচ্ছে বা গেছে, তা কিন্তু একদিনেই হয়নি। একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তা ধীরে ধীরে হচ্ছে।
বিষয়টি বোঝার জন্য সমাজবহির্ভূত কাজের কিছু বিষয় আমাদের বুঝতে হবে। সমাজবিজ্ঞানের বেসিক থিউরির একটি মৌলিক বিষয় হলো, তারা প্রথমেই সমাজবহির্ভূত কাজগুলোকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলেছে। এর একাংশকে তারা বলছে বিচ্যুতি এবং অপর অংশকে বলছে অপরাধ। অন্যভাবে তারা বিষয়টিকে এভাবে বলে যে, সমাজবহির্ভূত যেসব কাজের জন্য শাস্তি নেই তা বিচ্যুতি এবং যার জন্য শাস্তি রয়েছে তা অপরাধ।
ওই সমাজবিজ্ঞানিরাই আবার বলছেন, অপরাধের সূত্রপাত হয় বিচ্যুতি থেকেই। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে তো বুদ্ধিমান ও বিবেকবানের কাজ হওয়া উচিত প্রথমেই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু সেটা হচ্ছে না; বরং আইনে বিচ্যুতির কোন শাস্তিই নেই। যার ফলে ক্রমশ বেড়ে চলেছে অপরাধ।
অনেকেরই হয়তো জানতে ইচ্ছে করছে, বিচ্যুতি জিনিসটা আসলে কী! চলুন তাদের ভাষাতেই দেখে আসি তারা বিচ্যুতি বলতে কী বোঝাতে চান-
তারা বলছেন, “প্রতিটি সমাজই নির্দিষ্ট একটি সামাজিক শৃঙ্খলা, রীতিনীতি, আচরণবিধি এবং মূল্যবোধ অনুসরণ করে চলে। কিন্তু সমাজের সব সদস্যই এটি মেনে চলতে পারেন না। মাঝে মধ্যে তারা সামাজিকভাবে অপ্রত্যাশিত আচরণ প্রদর্শন করে থাকেন। সাধারণভাবে সমাজের বিধি লঙ্ঘন করে সামাজিক রীতিনীতি বহির্ভূত আচরণকে বিচ্যুত আচরণ বলে থাকেন সমাজবিজ্ঞানীরা। যেমন- বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা-যতœ না করা, প্রাতিষ্ঠানিক কাজে অবহেলা করা, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া ইত্যাদি”।
আরও পড়তে পারেন-
- পাশ্চাত্য শিক্ষা বনাম কওমী শিক্ষা
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- ইসলামে সংশয়প্রবণতা এবং সংক্রামক রোগ
আমাদের ছেলেমেয়ে বা ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময় আমাদের বা বড়দের কথা শোনে না। এটাও একটি বিচ্যুতি। কিন্তু আইন এক্ষেত্রে তাদের শাস্তি দেয়াকে অবৈধ করে রেখেছে। অর্থাৎ কোন শিক্ষার্থী শিক্ষকের কথা না শুনলেও তাকে আইনগতভাবে কোনরূপ শাস্তি দেয়া যাবে না। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রহারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ সমাজবিজ্ঞান বলছে- এরকম সাধারণ বিচ্যুত আচরণ থেকেই অপরাধের সূচনা হয়। আজ যে কিশোর বিচ্যুত আচরণ করছে, কাল সে-ই অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এভাবেই দীর্ঘপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজের মানুষ নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে জড়িয়ে পড়ে নানান অপরাধে।
আমরা শুরুতেই কিছু ঘটনা দেখেছি, যেখানে নিজের পরিবারের সদস্যরাই অপর সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যার কথা জেনেছি। বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় এর আরও একটি কারণ বলা হচ্ছে, ‘মানুষের মধ্যে ভোগবাদী চিন্তাধারা বৃদ্ধি পাওয়া’। পাশ্চাত্য সমাজ-সংস্কৃতিতে এই ভোগবাদী দর্শনের কারণে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সেখানকার মানুষ এখন আর সংসারজীবন বা পারিবারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। ফলে ‘লিভ টুগেদার’ সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেকে তো এমনও আছে যে, তারা বিয়ে করলেও আলাদা থাকে এবং সন্তান গ্রহণ করে না। তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার অজুহাত এবং অতিআত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী চিন্তা থেকেই তারা এমনটি করে বলে গবেষণায় জানা যায়। তাদের বক্তব্য, সন্তান বা সংসারের জন্য আমি নিজের স্বাধীনতা কেন খর্ব করবো? কেন নিজের জীবনের উপভোগ্যতাকে বাধাগ্রস্ত করবো?
পাশ্চাত্যের এই সংস্কৃতি আমাদের সমাজেও দিনদিন বাড়ছে। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের দেশ ও সমাজে এই দর্শন ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, সন্তান কিংবা সংসার, তথা পরিবারসহ সবকিছুর আগে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। আর এ কারণেই আমাদের পারিবারিক বন্ধন আশঙ্কাজনক হারে দিনদিন ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত এবং নৃশংস অজস্র ঘটনা।
অপরদিকে চলমান সময়ে এসব ঘটনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, করোনার কারণে মানুষ এখন ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে মানুষের চাকরি তথা রিজিকে হাত পড়েছে। তারা আয়-রোজগারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেও পাচ্ছে না কোন সমাধান। ফলে অনেকে আর্থিকসহ জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে হতাশা ও সংকটে ভুগছে। এসবে ধৈর্যচ্যুতির কারণে অল্পতেই সহিংস হয়ে উঠছে মানুষ। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে।
সেই সাথে বিচারহীনতা এবং অপরাধীকে বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ দেয়ার একটি বিষয়ও জড়িত রয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, দেশের বেশির ভাগ অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, ভিকটিম তার উপযুক্ত বিচার না পাওয়া এবং অপরাধী অপরাধ করেও আয়েশী চলাফেরা করার সুযোগ পাওয়া।
দেশের জনপ্রিয় একটি দৈনিক পত্রিকার এক উপ-সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, “কোনো অপরাধী যদি অপরাধ করে শাস্তি না পায়, ভুক্তভোগীরা যদি সুবিচার না পায়, তবে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে উঠবে। এতে অপরাধীরা আরও বেশি অপরাধ করতে উৎসাহ পাবে এবং এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে আইন আছে; সঠিক বাস্তবায়ন নেই, এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। অনেক ক্ষেত্রে আবার কিছু দুর্বল আইনের কারণেও অপরাধীরা অপরাধ করার উৎসাহ পায়”।
অপরাধ বৃদ্ধির আরও একটি কারণ দেখা যায়, “মামা-খালুর ছত্রছায়া”। অনেক অপরাধী এই ভেবেই অপরাধে জড়ায় যে, ‘আমার উপরে পাওয়ার বা ক্ষমতা আছে। আমি যা-ই করি না কেন, কেউ আমাকে কিছুই করতে পারবে না। নেতা আমাকে ছাড়িয়ে নেবে’।
অনেকসময় অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতির বিষয়টাও মুখ্য হয়ে ওঠে। দেখা যায়, অনেক ভিকটিম আইনের দ্বারস্থ হয়ে মাসকে মাস ঘুরতে থাকে, কিন্তু প্রশাসন বিষয়টাকে গায়েই লাগায় না। তারা ‘আজ নয় কাল’ বলে বলে সময়ক্ষেপণ করে অপরাধীকে আরও অপরাধের সুযোগ দেয়। অন্যদিকে ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কা থেকে বিচারপ্রত্যাশী নিজেই প্রতিকারের ব্যবস্থা নিজের হাতে তুলে নেয়।
এছাড়া আইনের লোকেরা কিছু কিছু অপরাধীকে এমনভাবে আইনের ষোল আনা দেখায় যে, সেই আইন দেখার পর জেদ করেই অনেকে নিজের অপরাধ বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ, অনেক অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য জেলে ভরা হয়। কিন্তু সেখানে তাকে আইন বহির্ভুতভাবে এমন টর্চার করা হয় যে, জেল থেকে বের হয়ে সে আরও বড় অপরাধী বনে যায়।
মোটকথা, অপরাধ বৃদ্ধিতে আইন দু’ভাবে দায়ী হয়; প্রথমত অনেকের ক্ষেত্রে নানান কারণে আইনের কোনও প্রয়োগই হয় না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আইন যতটুকু বলে অপরাধীকে তার চেয়েও বেশি শাস্তি দেয়া হয়। বলতে গেলে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। ফলে কোনভাবেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসছে না; বরং দিন দিন বাড়ছে।
বোঝা যাচ্ছে, পারিবারিক বা সামাজিকভাবে অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে কারণ কেবল একটি নয়, বিভিন্ন কারণেই এসব ঘটনা বেড়ে চলেছে। সুতরাং সব বিষয় নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে। নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ হ্রাসের পাশাপাশি মহামারি করোনায় যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে প্রশাসনকে যেমন জনসম্পৃক্ত হতে হবে, তেমনি দেশে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিপাত করতে হবে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা এবং সামাজিক-মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে। একজন মানুষের মধ্যে যখন এই কয়েকটি জিনিস পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকবে, যেকোন পরিস্থিতিতে সে নিজেকে অপরাধ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। অন্যথায় যতই সুশাসন আর আইন প্রতিষ্ঠা করা হোক না, কোন কিছুই কাজে আসবে না।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/