।। আবু তালহা তোফায়েল ।।
আত্মহত্যা করা ইসলামে সুস্পষ্টভাবে হারাম। হাদীসে আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির ব্যাপারে জাহান্নামের কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বরাতে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর সাত লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। অর্থাৎ- প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। (২০২২-এ জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট মতে প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে)।
১৭ই জুন ২০২১ সালে প্রকাশিত উক্ত প্রতিষ্ঠানের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৯ সালে এসে এই আত্মহত্যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ লক্ষ ৩ হাজারে। আত্মহত্যার প্রবণতা সম্পর্কে গবেষণাটি বলছে ২০১৯ সালে মোট আত্মহত্যার ৭৭% স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঘটেছে।
তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, এই আত্মহত্যার কবল থেকে বাদ পড়েনি আমাদের বাংলাদেশও। পরিসংখ্যানের দিকে নজর রাখলে মনে হবে, এই আত্মবিধ্বংসী পথে যেনো প্রতিযোগিতামূলকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান গুরুর তথ্য মতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৯ হাজার ৩১০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। ২০২০ সালে এসে এই পরিসংখ্যানটি ১১ হাজার ২৫৯-এর কোটায় এসে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশী তরুণদের সংগঠন আচল (ধপযড়ষ) ফাউন্ডেশনের আত্মহত্যা বিষয়ক তথ্য আমাদেরকে আরও চমকে দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত মাত্র একবছরে বাংলাদেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে নারী আত্মহত্যা করেছেন ৮ হাজার ২২৮ জন, এবং ৬ হাজার ২০৮ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। সংস্থাটি আরও বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে ৪৪.৩৬ শতাংশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু ঢাকায় আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে দুই হাজার ১৬৬টি এবং ২০২১-এ ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মাত্র এক বছরে এতবেশি পরিমাণ আত্মহত্যার ঘটনা জাতির জন্য সত্যিই এক অশনিসংকেত। এছাড়াও ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত মানবিক সহায়তা হেল্পলাইন সেন্টার ‘কান পেতে রয়’র কাছে আত্মহত্যার ইচ্ছে প্রকাশ করে ১২ হাজার ৭৬৪টি কল আসে।
প্রিয় পাঠক! বিশ্বব্যাপী ও জাতীয় স্তরে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক বিশ্লেষকরা বিশ্লেষণ করেছেন। আত্মহত্যার বিভিন্ন কারণ তারা উল্লেখ করলেও একটি বিষয় সবাই এড়িয়ে গেছেন। আর তা হলো পশ্চিমা ভোগবাদি চিন্তার প্রসার এবং শিক্ষা ব্যবস্থা।
আরও পড়তে পারেন-
- কওমি মাদ্রাসা: সামাজিক পুঁজি ও দারিদ্র্য বিমোচন
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
- সুখময় দাম্পত্য জীবনের নববী রূপরেখা
পশ্চিমা ভোগবাদি সমাজ ব্যবস্থা আজকের প্রজন্মের ভেতর জীবন সম্পর্কে খুবই ঠুনকো এক মোহ সৃষ্টি করেছে। তাদের ভেতর এই চিন্তা বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড, মিউজিক, মুভি, গেইমিং ভোগবিলাস নিয়ে পড়ে থাকাটাই জীবন। পশ্চিমা আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদি শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান তরুণদের সামনে সফলতার মানদণ্ডই পাল্টে দিয়েছে। নৈতিকতা ও রূহানিয়তবিহীন সফলতার পেছনে শিক্ষার্থীদের ঠেলে দিচ্ছে এই শিক্ষা ব্যবস্থা।
তরুণরা ভুলতে বসেছে, জীবনের একটা মূল্য আছে। এই জীবন মহান রবের দেয়া আমানত। এটিকে যেথায় সেথায় নষ্ট করা যাবে না।
পশ্চিমা কালচার তরুণদের সামনে ডিপ্রেশনের হাজারটা কৃত্রিম ফিলিংস তৈরি করছে। যার দরুন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মুখেও আজ ডিপ্রেশনের কথা শুনা যায়। ভোগবাদী, উচ্চ বিলাসী, উদাসীন ও কাল্পনিক জীবনে সামন্য হোচট খেলেই তারা ডিপ্রেশন ফিল করছে। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় সস্তা জনপ্রিয়তা লাইক-কমেন্ট-শেয়ার অপ্রাপ্তিতেও আজকের প্রজন্ম ডিপ্রেশনে ভোগে। পরিবারের সামান্য কলহ থেকে কেউ কেউ জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে বসছে।
আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদি শিক্ষা ও সংস্কৃতি মানুষের ভেতর থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নষ্ট করে দিয়েছে। আর সেটা হলো তার রবের সাথে যোগাযোগ, দ্বীনের সাথে তার সম্পর্ক, আখেরাতের প্রতি তার বিশ্বাস।
আত্মহত্যা থেকে বেঁচে থাকার জন্য দ্বীনি চেতনার চেয়ে কার্যকরী আর কোনো মাধ্যম নেই। কারণ দ্বীন তাকে এই অনুগতি দান করবে যে, তার জীবনের একটি লক্ষ্য আছে এবং তার চূড়ান্ত একটি আশ্রয়স্থল আছে। তার দুঃখবেদনাকে একান্ত শেয়ার করার একজন পবিত্র সত্তা আছেন- যিনি তার জীবনের জন্য সর্বোত্তম ফয়সালাটি করতে পারবেন।
ইসলাম বিপদাপদের সময় মানসিক শক্তির জন্য যে অস্ত্রটি দিয়েছে, তার নাম হলো ‘সবর’ তথা ধৈর্য্য। বিপদের সময় সবর ধারণ ও আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করা ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এমনকি আল্লাহ তাআলা অধিকাংশ নবী রাসূলকে এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে প্রতিপালন করেছেন। এজন্যই দেখা যায়, নাস্তিকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে- যেসব দেশে দ্বীনি চেতনা বেশি মজবুত, সেসব দেশে আত্মহত্যার কেইস কম। বিশেষত দ্বীনদার শ্রেণির মাঝে আত্মহত্যার হার ১% এরও নীচে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দ্বীনি চেতনা মানুষকে দুঃখ হতাশা কাটিয়ে তুলতে মানসিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করে। এজন্য আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধে দ্বীনি চেতনাকেই সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা হিসেবে দাবি করে গবেষণাটির ইতি টানা হয়।
প্রিয় পাঠক! আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে হলে আমাদেরকে সর্বপ্রথম পশ্চিমা ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে না বলতে হবে, পুঁজিবাদি আত্মকেন্দ্রিকতা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে আখেরাতমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের সন্তানদের ভেতর দ্বীনি চেতনাকে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করতে হবে। দ্বীনি মোটিভেশনের মাধ্যমে প্রত্যেকের মানসিক স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে হবে, যেনো পশ্চিমা পোষা কালচার কারও মানসিক স্বাস্থ্যকে অসুস্থ করে তুলতে না পারে; সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ডিপ্রেশন আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাঁদেরকে মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ রাখতে হবে, তাঁর প্রতি পূর্ণ ভরসা রাখতে হবে এবং জীবন যাপনকে ইসলামসম্মতভাবে সাজাতে হবে। তাহলেই সকল দুশ্চিন্তা, হতাশাবোধ এবং মানসিক অস্থিরতা ইনশাআল্লাহ কেটে যাবে।
তাই আসুন, বিজাতীয় ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলি, বস্তুবাদী এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করতে সচেতনতা গড়ে তুলি। সর্বোপরি পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া ভোগবাদি অভিশপ্ত জীবন থেকে ফিরে এসে আল্লাহর আবদিয়ত ও প্রশান্তিময় জীবন ব্যবস্থা ধারণ করি।
লেখক: তরুণ আলেম, সাংবাদিক।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/