আদমশুমারিতে শিক্ষাগত যোগ্যতার অবমূল্যায়ন

।। বিনতে এন, এম, জাহাঙ্গীর ।।

কোন দেশের বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ গণনাকেই মূলত আদমশুমারি বলা হয়। সাধারণত জনসংখ্যার সরকারি গণনাকেই আদমশুমারি হিসেবে গণ্য করা হয়। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদমশুমারি নির্দিষ্ট সময়ে একটি জনগোষ্ঠী বা দেশের জনসংখ্যা গণনার সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ, তথ্য একত্রীকরণ এবং জনমিতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্যাদি প্রকাশ করা বোঝায়।

জনশুমারির বৈশিষ্ট্য:

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম আদমশুমারি হয়। আদমশুমারি সাধারণত ১০ বছর পর পর করা হয়। বাংলাদেশও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পরিসংখ্যান আইন অনুসারে আদমশুমারিকে ‘জনশুমারি’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। জনশুমারির বৈশিষ্ট্যসমূহ-

* প্রতিটি ব্যক্তির তথ্য গণনা।

* একটি চিহ্নিত এলাকায় সামষ্টিক গণনা।

* একই সঙ্গে সারাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা।

* নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠান।

জনশুমারিতে যা থাকে

জনশুমারিতে প্রত্যেকের নাম, বয়স, শিক্ষাগতযোগ্যতা, ব্যাংক হিসাব, বিকাশ (থাকলে), পরিবারের সদস্য ইত্যাদি তথ্য নেয়া হয়ে থাকে। এবারের জনশুমারিকে ‘ডিজিটাল জনশুমারি’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ, অন্যান্য বার হাতে-কলমে হিসেব সংগ্রহ করলেও এবার ট্যাবের মাধ্যমে কর্মীরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাতে সাথে সাথেই প্রত্যেকের তথ্য মূল সার্ভারে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।

সরকারী-বেসরকারী মাদরাসার শিক্ষাগত যোগ্যতার স্থান নেই

আজকের আলোচ্য বিষয় জনশুমারির একটি নির্দিষ্ট তথ্য ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ নিয়ে। ডিজিটাল জনশুমারিতে ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ সহ বেশ কিছু তথ্য ট্যাবে এমসিকিউ আকারে লেখা আছে (নারী কর্মীর পাশে দাঁড়িয়ে যতটুকু দেখা সম্ভব হয়েছে। সবগুলো এমসিকিউ আকারে কিনা, তা সঠিক বলতে পারছি না)। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু অপশন দেয়া আছে। সেখান হতে আপনার তথ্যটি সিলেক্ট করা হবে। নিজ হাতে কিছু টাইপ করা যাবে না। খুবই ভালো, সময়-সাশ্রয় বটে! শিক্ষাগত যোগ্যতার স্থানে সাধারণ শিক্ষাগত যোগ্যতার বেশ কিছু অপশন রয়েছে। যেমন- প্রাথমিক, এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স, মাস্টার্স, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি।

একজন মাদরাসা শিক্ষার্থী মেয়েকে বলা হলো শিক্ষাগত যোগ্যতা? তার আব্বু বললেন, দাওরায়ে হাদীস। কুরআনের হাফেযা, শোনানি চলছে। কর্মীর নিরুত্তাপ জবাব, না এমন অপশন নেই! বাধ্য হয়ে ‘মাস্টার্স’ অপশন সিলেক্ট করতে হলো তাকে।

২০১৭ সালে দাওরায়ে হাদীসকে সরকার মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি দেয়। আর এটা সকলেরই জানা যে, তা হচ্ছে আরবির উপর মাস্টার্স। জেনারেল শিক্ষার মাস্টার্স ও আরবী মাস্টার্স এ  যদি  তফাত  না  থাকতো, তবে আলেমগণ ‘আল হাইআতুল উলইয়া’ গঠন করতেন না আলাদাভাবে। জেনারেল শিক্ষাবোর্ড হতেই গ্রহণ করা হতো স্বীকৃতির সনদ । আরো বেশ কিছু কারণেই আলাদাভাবে ‘হাইআতুল উলইয়া’ বোর্ড গঠন করা হয় উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে। একদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দাওরায়ে হাদীসকে আলাদা একটি শিক্ষা হিসেবে মর্যাদাগত স্বীকৃতি দিয়েছেন। অপরদিকে সরকারি জনশুমারিতে শিক্ষাগত যোগ্যতার স্থানে ‘দাওরায়ে হাদীস’ এর অপশন অনুপস্থিত!

পূর্ণ কুরআন বুকে ধারণ করে হাজার হাজার শিশু-কিশোর ‘হাফেযে কুরআন’ হচ্ছেন, অথচ সেখানে ‘হাফেযে কুরআন’ এর অপশনও দেখা যায় না! খুবই দুঃখজনক ব্যাপার! এমনকি সরকারি যে মাদরাসাগুলো রয়েছে, তাদেরও শিক্ষাগত যোগ্যতার আলাদা সম্মাননা নাম রয়েছে। দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল। সরকারস্বীকৃত মাদরাসা হওয়ার পরও তাদের যোগ্যতার স্থানগুলোর কোন অপশন রাখা হয়নি শিক্ষাগত যোগ্যতা ক্যাটাগরিতে।

আরও পড়তে পারেন-

মাদরাসাগুলোতে ধর্মীয়, নীতি-নৈতিকতার শিক্ষার প্রাবল্যতা রয়েছে (প্রয়োজনীয় জেনারেল শিক্ষা-পাঠও রয়েছে)। একজন মানবকে সত্যিকারার্থে ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ, প্রচার-প্রসার, গবেষণা ইত্যাদির বিকল্প নেই। আর এই মহান কাজগুলোর সিংহভাগ আঞ্জাম দিচ্ছেন মাদরাসা-শিক্ষা গ্রহণকারীগণ।

ধর্ম বা ধর্মীয় শিক্ষা কী?

আমাদের সমাজে সাধারণত ধর্মীয় জ্ঞান বলতে কিছু ইবাদত, উপদেশ ইত্যাদিকেই মনে করা হয়। একজন মানুষের সবকিছুই ইবাদত হতে পারে, যদি তা ধর্মীয় নীতি মতো হয়ে থাকে। আমাদের ইসলাম ধর্ম মানে- ‘জন্ম-হতে মৃত্যু মানবের প্রতিটি কাজ সুন্দর-শালীন, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন, আল্লাহর সৃজিত সর্বোত্তম উপায়ে যাপন করা’। ব্যাস এই হলো ইসলাম। একজন মানুষের ব্যক্তিজীবনের সব ব্যক্তিগত কাজ, পারিবারিক জীবনে পরস্পরের হক, সহমর্মিতা, হৃদ্যতা, ক্ষমাশীল হওয়া, সামাজিক জীবনে উত্তম হিসেবেই নিজেকে উপস্থাপনমূলক আচরণ, প্রতিবেশির হক, দেশ-জাতির সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা, অন্যায়ের প্রতিহত পদ্ধতি, রাষ্ট্রীয়জীবনে রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রজাদের হক আদায়, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এমন প্রত্যেকটি বিষয়েই আল্লাহ তাআলা সুন্দর পদ্ধতি আমাদের দিয়েছেন। যাতে আমরা সেভাবে নিজেদের পরিচালনা করে ভাল থাকতে পারি ও ভাল রাখতে পারি নিজেদের। কারণ, যে আল্লাহ আদম গড়েছেন, তিনিই তো জানেন তাদের পরিচালনার নীতি কেমন হওয়া উচিত।

সুতরাং ধর্ম জীবন হতে বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। বরং ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে নীতিবান, আদর্শবান হিসেবে গড়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করে। সবচেয়ে সুন্দর ও সঠিক পদ্ধতির ধর্মীয় পাঠদান মাদরাসাগুলোতেই হয়ে থাকে। আর এ ক্ষেত্রে কওমী মাদরাসাগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।

পরিসংখ্যান বলছে, মাদরাসা শিক্ষার্থী বেড়েই চলছে

সম্প্রতি মাদরাসা শিক্ষার্থীর পরিমাণ বাড়ছে। গত বছর ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের (আইইডি) উদ্যোগে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা করা হয়। তাতে দেখা যায়, প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ভর্তির হার কমেছে বেশ অনেক। অপরদিকে মাদরাসাগুলোতে যেখানে ২০২০ সালে ৫ বছরের শিশু ভর্তির হার ছিল সাড়ে ৮ শতাংশ। সেটি গত বছর বেড়ে হয় সাড়ে ৯ শতাংশ। এছাড়াও ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের ভর্তির হার ২০২০ সালে ছিল ১১ শতাংশ। এক বছরে (২০২১) তা বেড়ে হয় ১৪.১ শতাংশ। করোনার আগ থেকেই কওমী, হাফেজিয়া ও নূরানী মাদরাসায় শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে অনেক।

‘সাধারণ’ শিক্ষার স্তরগুলো যদি ‘‘শিক্ষাগত যোগ্যতার’’ অপশন হিসেবে থাকতে পারে, তবে যে ‘বিশেষ’ শিক্ষাধারা মানুষকে নীতিবান করছে, আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সংরক্ষণ, প্রচার ও গবেষণা করছে; তাদের এই মহান যোগ্যতা ‘শিক্ষাগত যোগ্যতার’’ অপশনে কেন রাখা হচ্ছে না! যে শিশু-কিশোর আল্লাহর কালাম পুরোটা বুকে ধারণ করে “আমি  কুরআন নাযিল করেছি আমিই এর হিফাজতকারী” আল্লাহর এই বাণী রক্ষায় সাধনা করেছে; তার ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ কী হবে?! সে কোন অপশন সিলেক্ট করবে? তাহলে সে কি নিরক্ষর হিসেবেই পরিগণিত হবে?!

আমি সংক্ষেপে কয়েকটি হাদীস পেশ করতে চাই-

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “নক্ষত্রের মাঝে চাঁদের মর্যাদা যেমন অতুলনীয়, সমস্ত মানুষের মাঝে আলেমের মর্যাদাও তেমনি অবর্ণনীয়”। (সুনানে তিরমিযী ও আবু দাউদ)।

আবু দারদা (রাযি.) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই ইরশাদ করতে শুনেছি যে, আলেমের মৃত্যু এমন এক মুসীবত, যার কোন প্রতিকার  হতে পারে না এবং এমন ক্ষতি যা পূরণ হতে পারে না। আর আলেম এমন এক তারকা যা (মৃত্যুর কারণে) আলোহীন হয়ে গিয়েছে। একজন আলেমের মৃত্যু অপেক্ষা গোত্রের মৃত্যু অতি নগণ্য বিষয়। (বাইহাকী শরীফ- ২৬৪/২)।

“যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করেছে, সংরক্ষণ করেছে ও হিফয রেখেছে, আর হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম জেনেছে; আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তাঁর পরিবারের ‘জাহান্নাম অবধারিত’ হয়ে গেছে এমন দশ জনকে মুক্তির জন্য সুপারিশ কবূল করবেন।” (শুআবুল ঈমান, হাদিস- ১৯৪৭, জামে তিরমিযী)।

“কিয়ামতের দিন ‘সাহেবে কুরআন’ (হাফেয)-কে বলা হবে, কুরআন পড়তে থাকো এবং তারতীলের সাথ পাঠ করো যেমন দুনিয়ায় তারতীলের সাথে পাঠ করতে। নিশ্চয়ই তোমার মর্যাদার আসন হবে, তোমার পঠিত আয়াতের শেষপ্রান্তে”। (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী ও আবূ দাউদ)।

হাফেযে কুরআন ও উলামায়ে কেরাম এর ফযীলত সম্পর্কে এমন অসংখ্য হাদীস রয়েছে। জাগতিক সকল শিক্ষার ঊর্ধ্বে ‘বিশেষায়িত’ করা হয়েছে এই শিক্ষাকে। জাগতিক জেনারেল শিক্ষার অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমরা তা অকপটে স্বীকার করি। তবে কুরআন-হাদীসের যে অপার্থিব জ্ঞান, তার শ্রেষ্ঠত্ব মর্যাদার সর্বোচ্চতায়। আর এই শ্রেষ্ঠত্ব-বাণী উচ্চারিত হয়েছে স্বয়ং নবীজির যবানে, আরো রয়েছে কুরআনুল কারীমে।

সরকারের কাছে আমাদের বিনীত আহ্বান থাকবে, সঠিক যোগ্যতাকে সঠিক মূল্যায়ন সকলেরই কাম্য। আমরাও আশা করব, পরবর্তী জনশুমারি বা এ ধরনের যে কোন স্থানে ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ এর স্থানে মাদরাসা পড়–য়াদের নিজ যোগ্যতায় জাতীয়ভাবে নথিভুক্ত হওয়ার সুযোগ দিবেন। আলিয়া-কওমী সব মাদরাসার অপশন রাখাই আমাদের আবেদন। পড়ালেখা নিয়ে সকলেরই স্বপ্ন থাকে। একজন মাদরাসা পড়–য়া শিক্ষার্থী মাস্টার্স/অনার্স লেখার চেয়ে হাফেযে কুরআন/দাওরায়ে হাদীস পরিচয় দিতেই পরম তৃপ্তি বোধ করে থাকে। হৃদয়ে অনুভব করে প্রশান্তির আবহ। আমি নিজেও মাদরাসার শিক্ষার্থী। নিজের অনুভূতির গভীরতা হতেই আমার সামান্য এই আরয। আমার বিশ্বাস, এটা প্রতিটি শিক্ষার্থীরই মনের আহ্বান।

[২০ যিলহজ্জ, ১৪৪৩ হিজরী]

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।