আদর্শ পরিবার গঠনে চল্লিশটি নসীহত
– হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ওমর
সকল প্রশংসা সেই মহান রাব্বুল আলামীনের তরে, যিনি অসীম নিয়ামত দান করেছেন আমাদেরকে। তন্মধ্যে বড় নিয়ামত হল বাড়ী-ঘর ও পরিবার। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন- “আর আল্লাহ্ করে দিয়েছেন তোমাদের গৃহকে অবস্থানের জায়গা।” (সরা নাহল- ৮০)।
অগণিত দরূদ ও সালাম সেই মহান বার্তাবাহকের প্রতি, যিনি ইরশাদ করেছেন- “ফিত্নার সময় পুরুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হল তার বাড়ী।” তিনি আরও ইরশাদ করেছেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবেন, সে তার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করেছে কি-না। আরো জিজ্ঞেস করবেন পুরুষদেরকে তার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে।” আর রহ্মত ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর পবিত্র আল্ ও আসহাবগণের উপর এবং সকল অনুসরণকারীদের উপর।
বর্তমানে মুসলমানরা পরিবার পদ্ধতিকে দরে ঠেলে দিয়ে বিজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি অবলম্বনের নামে উলঙ্গ ও বেহায়াপনা গ্রহণ করে মহাবিপদ জাহান্নামের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। এহেন বিপদ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কুরআন-হাদীসের আলোকে নিজ নিজ পরিবার পরিচালনার উদ্দেশ্যে চল্লিশটি নসীহত বর্ণনা করা হচ্ছে।
(১) বাড়ীঃ পরিবার গঠনের একটি অপরিহার্য অংশ হচ্ছে বাড়ী। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- বাড়ী করার পূর্বে প্রতিবেশীর নৈতিকতা দেখা প্রয়োজন। কারণ, এক প্রতিবেশীর প্রভাব অপর প্রতিবেশীকে প্রভাবান্বিত করে। এ জন্য রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ দোয়া পাঠ করতেন- “হে আল্লাহ্! আপনার নিকট পানাহ্ চাই মন্দ প্রতিবেশী থেকে স্থায়ী বসত বাড়ীতে।” (বুখারী শরীফ)। বাড়ীটি মসজিদের সন্নিকটে হওয়া উত্তম। এতে করে অনেক নেক আমল করা সহজ হয়। যেমন, জামাআতে নামায পড়া, বাচ্চাদের কুরআন শিক্ষা দেওয়া, আযান শুনে মহিলাদের সময় মত নামায পড়তে পারা ইত্যাদি। বাড়ীতে পর্দার ব্যবস্থা করতে হবে। গৃহে মহিলাদের নামাযের জন্য ১টি স্থান নির্ধারিত করে নেওয়া উচিত। বাড়ীর পরিবেশকে পরিস্কার রাখা বাঞ্ছনীয়।
(২) বাড়ীর কর্তাঃ আদর্শ পরিবার গঠনে যেমন বাড়ী অপরিহার্য তেমনি একজন আদর্শ কর্তাও অপরিহার্য। কর্তাকে পরিবার পরিচালনায় একজন বিচক্ষণ অতন্দ্র প্রহরির ন্যায় সজাগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কুরআনী ইল্মই একমাত্র সঠিক পথনির্দেশনা দিতে পারে। তাই কর্তাকে কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
(৩) আদর্শ রমণীঃ আদর্শ পরিবার গঠনের জন্য একজন আদর্শ রমণী অপরিহার্য। কুরআন-হাদীসে আদর্শ নারীকে বিবাহ করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সর্বোত্তম সম্পদ হল নেক আমলধারী স্ত্রী। তোমরা এমন মহিলাকে বিবাহ কর যে মুসলিমা, মু’মিনা, ধৈর্যশীলা, তাওবা কারীনী, নামাযী, পর্দানশীলা, পরহেযগার। ফলশ্রুতিতে এরূপ স্ত্রী তোমার অনুপস্থিতিতে তার নিজের নফ্স এবং তোমার সম্পদ হিফাযত করবে নিঃসন্দেহে। এরূপ স্ত্রী থেকে ভাল সন্তান আশা করা যায়।
(৪) আদর্শ সন্তানঃ আদর্শ সন্তান পেতে হলে আদর্শ শিক্ষা দিতে হবে। আর সন্তানের প্রথম শিক্ষার স্থান হল মা। তাই মাকে যেমন নিজের আমল ভাল করতে হবে তেমনি সন্তানকেও আদর্শ শিক্ষা দিতে হবে। অন্যথায় হাশরের দিন মা-বাবাকে দায়ী করা হবে। তাই সন্তানের প্রতি সর্বদা তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে অসৎ সংস্পর্শে না পারে। অবশ্যই তাদেরকে নামাযী বানাতে হবে। একমাত্র দ্বীনি শিক্ষাই পারে শিশুকে আদর্শ চরিত্রের অধিকারী ও আমলী করে গড়ে তুলতে। আজকের শিশুরাই আগামী দিনে আদর্শ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে। আজকের আদর্শ শিশু দ্বারাই আগামী দিনে সমাজ-রাষ্ট্রে শান্তি আসবে। তাই পরিবারের কর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, “হে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই কঠোর অগ্নি হতে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর।” (সরা তাহরীম- ৬)।
(৫) যিকরঃ সর্বদা আল্লাহ্র যিক্র দ্বারা আপন গৃহকে যিন্দা রাখতে হবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে গৃহে আল্লাহ্র যিক্র হয় না আর যে গৃহে যিক্র হয়, এতদুভয় গৃহ মুর্দা ও যিন্দার ন্যায়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আজ অনেক মুসলিম পরিবারেই আল্লাহ্র যিক্র নেই, আছে নাচ-গান আর শয়তানী কর্মকান্ডের সমাহার। কাজেই গৃহকে যিন্দা করতে হলে তাতে কুরআনের তিলাওয়াত, নামায, তা’লীম, ইসলামী বই-পুস্তকের পাঠ চালু করতে হবে।
(৬) বলা বানানোঃ বসত গৃহকে ক্বিবলা বানানোর অর্থ হল, গৃহের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট স্থানে নামায চালু করা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন- “তোমাদের গৃহগুলোকে ক্বিবলা বানাও এবং তাতে নামায কায়েম কর।” (সরা ইউনুস- ৮৭)। হাদীস শরীফে আছে, তোমাদের গৃহকে কবর বানিয়ো না। যেমন- কবর ১টি গৃহ, তাতে মানুষ আছে কিন্তু কোন যিকর নেই। আমাদের গৃহ যেন এমন না হয়। ফরয নামায মসজিদে আদায়ের পর সুন্নাত-নফল নিজ নিজ গৃহে আদায় করবে।
(৭) বিসমিল্লাহ আমলঃ প্রতিটি কাজ বিসমিল্লাহ্ বলে আরম্ভ করলে তাতে বরকত হয়। হাদীসে আছে, কোন ব্যক্তি যখন বিসমিল্লাহ্ বলে গৃহে প্রবেশ করে, গৃহের যাবতীয় কর্ম বিসমিল্লাহ্ পাঠের মাধ্যমে আরম্ভ করে, শয়তান বলে সে গৃহে আমার স্থান নেই, আমার খাবার নেই। বিসমিল্লাহ্র আমল না থাকলে শয়তান বলে সেই গৃহে আমার স্থানও আছে, খাবারও আছে। কাজেই প্রত্যেকটি কাজের প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ্ পাঠ করা উচিত।
(৮) প্রস্থানের সময় দোয়াঃ নিুোক্ত দোয়াটি পড়ে যে ব্যক্তি আপন গৃহ থেকে বের হবে আল্লাহ্ তআলা তাকে হিফাযতের যিম্মাদার হয়ে যান। দোয়া- “বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহি লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্।”
(৯) মিসওয়াকঃ মিসওয়াকের অপরিহার্যতা অনেক ব্যাপক। দাঁত পরিস্কারের অপরিহার্যতা আমরা যেমন অনুভব করি ঠিক তেমনি মিসওয়াক। মিসওয়াক দ্বারা দাঁতের অনেক উপকার হয়। সাথে সাথে রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি সুন্নাত যিন্দা হয়। রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই গৃহে প্রবেশ করতেন প্রথমে মিসওয়াক করতেন। মিসওয়াক করে নামায আদায় করলে নামাযের মর্তবা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
(১০) সরা বাক্বারাহ্র তিলাওয়াতঃ যে গৃহে সরা বাক্বারাহ্ নিয়মিত তিলাওয়াত করা হয় শয়তান সে গৃহ থেকে দরে অবস্থান করে। এক হাদীসে আছে, ঐ গৃহে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না। বিশেষ করে সরা বাক্বারাহ্র শেষ দুই আয়াত অবশ্যই প্রতি দিন পাঠ করা উচিত।
(১১) পারিবারিক শিক্ষাঃ পরিবারের কর্তার দায়িত্ব হল সবাইকে আদর্শ শিক্ষা দেওয়া, সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা। ইমাম কাতাদাহ্ (রাহ্.) বলেন, আল্লাহ্র ইবাদতের দিকে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে, সৎকাজের আদেশ করবে। পাপ কাজে বাধা প্রদান করবে। ইমাম যাহ্হাক (রাহ্.) বলেন, মুসলমানের দায়িত্ব হল, নিজ নিজ পরিবার-পরিজনকে আল্লাহ্র বিধি-বিধানগুলো শিক্ষা দেওয়া। হযরত আলী (রাযি.) বলেন, পরিবারের লোকদের ইল্মে দ্বীন শিক্ষা দাও এবং আদব শিক্ষা দাও।
(১২) ইসলামী পাঠাগারঃ ইসলামী শিক্ষার সহায়ক হিসেবে বাড়ীতে একটি ইসলামী পাঠাগার থাকা অতিব প্রয়োজন। সে পাঠাগারে ইসলামের সহীহ্ আক্বীদা, তাফ্সীর, হাদীস, জীবনী, ইতিহাস, ফিক্বাহ্ প্রভৃতি বিষয়ক প্রয়োজনীয় বই-কিতাব এবং ইসলামী পত্রপত্রিকা থাকা আবশ্যক। বই-পুস্তক এমনভাবে সাজিয়ে রাখতে হবে, যেন সহজেই হাত বাড়ালে পাওয়া যায়।
(১৩) দৈনন্দিন তা’লীমঃ প্রতিটি গৃহে দৈনিক একবার কিতাবী তা’লীম চালু করা উচিত। পরিবারের ছোট-বড় সবাইকে নিয়ে বসে ধর্মীয় বই-পুস্তক বিশেষ করে সাহাবায়ে কিরামের ঘটনাবলী পড়ে শোনানোর নিয়ম চালু করা বাঞ্ছনীয়।
(১৪) আলেমে দ্বীনের আগমনঃ সময় সময় হক্কানী আলেম ও বুযুর্গানে দ্বীনের বাড়ীতে আগমন ঘটলে বাড়ীতে নর বৃদ্ধি পায়। তাদের নিকট থেকে দ্বীনের অনেক বিষয় অবগত হওয়া যায়।
(১৫) অনুমতিঃ কারো বাড়ীতে বা গৃহে প্রবেশ কালে প্রথমে মালিকের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন এবং এটি সুন্নাত। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ “হে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না যে পর্যন্ত না আলাপচারিতা বা সালামের মাধ্যমে অনুমতি প্রদত্ত হয়।” (সরা নরঃ ২৭)।
(১৬) পানাহারের অনুমতিঃ বিনা অনুমতিতে কারো কিছু খাওয়া বা ব্যবহার করা নাজায়েয। তবে এমন কিছু আত্মীয়-স্বজনের গৃহে বিনা অমুতিতে খাওয়া জায়েয যারা এতে অসন্তুষ্ট বা বিরক্ত হবে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ “তোমরা খেতে পারবে তোমাদের গৃহে, তোমাদের পিতা-মাতাদের গৃহে, তোমাদের ভাই-বোনদের গৃহে, তোমাদের চাচা-ফুফুদের গৃহে, তোমাদের খালা-মামাদের গৃহে, সেসব গৃহে যেগুলোর চাবির মালিক তোমরা অথবা তোমাদের সেসব বন্ধুদের গৃহে যারা এতে নারাজ হবে না।” (সরা নরঃ ৬১)।
(১৭) তিন সময়ে অন্যের কক্ষে প্রবেশ নিষেধঃ এই তিনটি সময় সাধারণতঃ নিদ্রার সময়। নিদ্রা অবস্থায় বেপর্দা হওয়ার আশঙ্কা আছে তাই সতর্কতা হিসেবে তখন প্রবেশ করা নিষেধ। এগুলো হল, (১) ফজরের পূর্বে, (২) দুপুর বেলা নিদ্রার সময়, (৩) ঈশার পর নিদ্রার সময়। এর কারণ হল, যেন কারো অশোভনীয় অবস্থার উপর নজর না পড়ে। তবে বেশী প্রয়োজন হলে তিন বার অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবে।
(১৮) কারো গৃহে উঁকি দেওয়াঃ কারো গৃহে উঁকি দেওয়া নিষেধ। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, কেউ যদি বিনা অনুমতিতে উঁকি দেয়, তার চক্ষু নষ্ট করে দাও। এতে কোন ক্বিছাছ নেই, জরিমানাও নেই।
(১৯) স্ত্রীর প্রতি শাসনঃ স্ত্রী যদি দুষ্টু প্রকৃতির হয়, তাকে আদর করে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনতে চেষ্টা করবে। প্রয়োজন হলে বিছানা পৃথক করে দিবে। এমনকি মৃদু প্রহার করবে। তবে চেহারায় যেন কোন দাগ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
(২০) খোলা আকাশের নীচে শয়নঃ খোলা আকাশের নীচে শয়ন করা উচিত নয়। কারণ এতে যে কোন বিপদ আসতে পারে বিশেষ করে দুশমন সুযোগ পেয়ে আঘাত হানতে পারে। একইভাবে খোলা ছাদে ঘুমানো নিষেধ। বিশেষ করে যে ছাদের চার পাশ দেওয়াল ঘেরা নয় তাতে নিদ্রা যাওয়া নিষেধ। কারণ, নিদ্রা অবস্থায় গড়িয়ে নীচে পড়ে যেতে পারে। হাদীসের ভাষ্য মতে এরূপ ব্যক্তি কারো দায়িত্বে নয়।
(২১) পরামর্শ করাঃ যে কোন বিষয়ে পরামর্শ করা সুন্নাত। সরা শরার ৩৮ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ মু’মিনদের প্রত্যকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত নিবে। পরিবারের কর্তার উচিত, যখন কোন কাজ সামনে আসে, তখন পরিবারের সচেতন সদস্যদেরকে নিয়ে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এতে আল্লাহর রহমত আসবে।
(২২) মতানৈক্যঃ অনেক সময় সংসারে মতানৈক্য দেখা দেয়। তখন সেই মতানৈক্য অত্যন্ত নম্রতা-ভদ্রতা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে মিমাংসা করা উচিত। ধৈর্যের সাথে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে নিলেই শান্তি স্থাপিত হবে।
(২৩) শালীনতাঃ ইজ্জত-সম্ভ্রম ও শালীনতা রক্ষার্থে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখবে। অশালীন ও অশ্লীল বাক্য প্রকাশ করবে না। কারণ গৃহে ছোট বাচ্চরা থাকে, তারা অতি অনুকরণ প্রিয়। তাই সতর্ক থাকতে হবে যেন তাদের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া না পড়ে। মাতা-পিতা ও বড়দের গোপনীয়তা যেন ছোটদের সামনে প্রকাশ না পায়। লজ্জা ঈমানের অঙ্গ, লজ্জাহীনতা দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
(২৪) গৃহকর্তা অতন্দ্র প্রহরীঃ বাড়ীর কর্তাকে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে বিচক্ষণতার সাথে সব দিক লক্ষ্য রাখতে হবে। বাড়ীতে যেন কোন বেআমল লোক প্রবেশ না করে। বিশেষ করে বেপর্দা মহিলা যারা পর্দাহীন অবস্থায় রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে তারা যেন গৃহে প্রবেশ না করে সেদিকে খেয়াল রাখবে। এতে অনেক বিপদ আগমন করে। অনেক সময় শান্তির সংসারকে অশান্ত করে তুলে। এমনিভাবে আপন পরিবারের কেউ যেন মন্দ পরিবেশে না যায় সেটি গৃহকর্তাকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
(২৫) মাতা-পিতার সন্তুষ্টিঃ সবসময় মাতা-পিতাকে রাজিখুশী রাখতে চেষ্টা করতে হবে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো। (সরা নিসাঃ ৩৬)। রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- আল্লাহ্র সন্তুষ্টি তোমার মাতা-পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত।
(২৬) গোপনীয়তাঃ রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ক্বিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি আল্লাহ্র নিকট সবচেয়ে খারাপ বলে চিহ্নিত হবে যে স্বামী- স্ত্রীর গোপন কথা প্রকাশ করে। স্বামী- স্ত্রীর মতানৈক্য এবং গৃহের গোপন বিষয় প্রকাশ করতে নেই। এতে শয়তান সুযোগ পায়। যে ব্যক্তি অন্যের গোপনীয়তা রক্ষা করবে হাশরের দিন আল্লাহ্ তার গোপনীয়তা রক্ষা করবেন।
(২৭) মধুময় ব্যবহারঃ সবার সাথে মধুময় ব্যবহার করা উচিত। কেউ অশালীন ব্যবহার করলে ধৈর্য ও শালীনতা দিয়ে তার উত্তর দেওয়া উচিত। অশ্লীল বাক্যালাপ পরিহার করা উচিত।
(২৮) সাহায্য করাঃ পরিবারের একে অপরের কাজে সাহায্য করা উচিত। হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবারের বিভিন্ন কাজ নিজ হাতে করতেন। স্ত্রীদের কাজে সাহায্য করতেন। নামাযের সময় হলে নামাযের জন্য চলে যেতেন।
(২৯) বিছানা পৃথক করাঃ সাত বছর বয়সের বাচ্চাদের বিছানা পৃথক করে দিতে হবে। এক চাদরের নীচে দু’জন শয়ন করতে হাদীসে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে, চাই তারা পুরুষ হোক বা নারী।
(৩০) সাবধানতাঃ পরিবারের কর্তার উচিত গৃহে একটি শাসন দন্ড ঝুলিয়ে রাখা, যাতে মারের ভয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবাই হুঁশিয়ার থাকে। হাদীসে আছে, একটি লাঠি গৃহের এমন স্থানে ঝুলিয়ে রাখবে যেন সবার নজরে পড়ে। এতে সবার জন্য আদব রয়েছে।
(৩১) ইসলামী পোশাকঃ পরিবারের সকলকেই ইসলামী পোশাক-পরিŽছদ গ্রহণ করা জরুরী। এ ব্যাপারে বিশেষ করে মহিলাদের সাবধান থাকতে হবে। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন- “…. এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে…। (সরা নূর- ৩১)। এমন কাপড় পরিধান করা নিষেধ যদ্বারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকৃতি প্রকাশ পেয়ে যায়। যারা এরূপ কাপড় পরিধান করবে তারা বেহেশতের গন্ধও পাবে না।
(৩২) সন্তান জন্মঃ যে গৃহে সন্তান জন্ম হয় সে গৃহে রহ্মত ও বরকত নাযিল হয়। হাদীসে বর্ণিত আছে, দুর্বলদের উসীলায় তোমাদেরকে রিযিক দেওয়া হয়। কন্যা সন্তান শান্তি লাভের উপায়, জান্নাত লাভের মাধ্যম এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের উসীলা। ফেরেশ্তারা ঐ গৃহের জন্য দোয়া করে যে গৃহে কন্যা সন্তান জন্ম হয়।
(৩৩) সামর্থ অনুযায়ী খরচ করাঃ সংসারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণার্থে সামর্থ অনুযায়ী খরচ করা উচিত। এতে রয়েছে বিরাট সাওয়াব। অপর দিকে যেমন কৃপণতা করা নিষেধ তেমনি অপব্যয় করাও নিষেধ।
(৩৪) সুস্বাস্থ্যঃ সর্বদা গৃহকর্তাকে সতর্ক থাকতে হবে, পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাথে সাথে সুচিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রুষার ব্যবস্থা করতে হবে। ডাক্তারী চিকিৎসার সাথে সাথে কুরআনী চিকিৎসা চালানো উত্তম। হাদীসে আছে, কেউ অসুস্থ হলে সরা ফালাক, নাস ও ফাতেহা পাঠ করে ফুক দিবে, আল্লাহ্ শেফা দান করবেন।
(৩৫) প্রতিবেশীর হকঃ সাধ্যমত প্রতিবেশীর হক আদায় করতে হবে। তাদের সুখে-দুঃখে শামিল হতে হবে। যথাসাধ্য সাহায্য-সহায়তা করতে হবে।
(৩৬) কানাকানিঃ কয়েকজন একত্র অবস্থায় একজন আরেক জনের সাথে কানেকানে কথা বলা নিষেধ। এর দ্বারা পরস্পরের মধ্যে নানা সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এমনভাবে কথা বলা নিষেধ যদ্বারা অন্যকে অবজ্ঞা করা হয়।
(৩৭) স্বর্ণ ব্যবহার করাঃ মহিলাদের স্বর্ণ ব্যবহার করা বৈধ। তবে পুরুষের জন্য অবৈধ। জনৈক লোকের হাতে স্বর্ণের আংটি দেখে রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার আংটি খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন। আর বলেন, তোমরা কি চাও আগুনের টুকরো হাতে রাখতে?
(৩৮) প্রাণীর ছবিঃ যে কোন ধরনের প্রাণীর ছবি গৃহে রাখা যাবে না। কারণ, যে গৃহে প্রাণীর ছবি ও কুকুর থাকে সে গৃহে রহ্মতের ফেরেশ্তা প্রবেশ করে না। একইভাবে মুসলমানের গৃহে অমুসলমানের স্মৃতিচিহ্ন রাখা নিষেধ।
(৩৯) গীবত-শিকায়াতঃ গীবত করা মহাপাপ। গীবত বা কারো অগোচরে তার সমালোচনা করলে নিজের নেক আমল নষ্ট হয়ে যায়। হাদীসে বর্ণিত আছে, গীবতকারী তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত ভক্ষণ করে। অন্য এক হাদীসে আছে, কেউ অন্যের দোষ ঢেকে রাখলে হাশরের দিন আল্লাহ্ তার দোষ ঢেকে রাখবেন।
(৪০) ধমপানঃ বাড়ীতে ধমপান সর্বোতভাবে বর্জনীয়। এতে আর্থিক অপচয়, স্বাস্থ্যের ক্ষতি, পরিবেশ দষণ হয়। এছাড়াও ধমপানের বিভিন্ন প্রকার অপকারিতা রয়েছে।
শেষ কথাঃ তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হাদীসে আছে, হযরত রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সন্ধ্যার সময় ছোট বাচ্চাদের গৃহে আটকে রাখবে। এ সময় শয়তান চলাফেরা করে। এক ঘণ্টা রাত হওয়ার পর তেমন অসুবিধা নেই। রাতে ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে। বাসনপত্র ঢেকে রাখবে। ঢেকে রাখার কিছু না পেলে অন্তত এক টুকরো লাকড়ী হলেও তার উপর রেখে দিবে। বাতি নিভিয়ে দিবে। আল্লাহ্র নাম স্মরণ করবে।
হে আল্লাহ্! উপরোক্ত বিষয়গুলোর উপর আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন॥