রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের, সকল দেশের, সকল ধর্মের-গোত্রের, সর্বস্তরের মানুষের জন্য অনুপম-উত্তম, সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ মানব। মুসলিম থেকে অমুসলিম, পূর্ব থেকে পশ্চিম, স্বাক্ষর থেকে নিরক্ষর, সবার কাছে সর্বজনস্বীকৃত মহামানব, আদর্শ সমাজ গঠনের কান্ডারীও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রত্যেক ধর্মের মানুষের জান-মাল ও ইজ্জতের হেফাযতের জন্য দিয়েছেন সঠিক নির্দেশনা। সে নির্দেশনার ভিত্তিতে লাখো-কোটি মানুষ এসেছে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।
হযরত আবু বকর (রাযি.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন অমুসলিমকে হত্যা করলো, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (মুসনাদে আহমদ)।
অপরদিকে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা (মূর্তিপূজক) ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কারণ, তারা সীমালংঘনকারী, অজ্ঞতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে। (আনআম- ১০১)।
অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের নিজেদের দেশ থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেননি। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। (সূরা মুমতাহিনা, আয়াত- ৮)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদীনায় রাষ্ট্র কায়েম করলেন, তখন সেখানে খাযরায, ইহুদি-খ্রিস্টান ও অন্যান্য গোত্র- ধর্মের লোকজন ছিল। কিন্তু সবাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শান্তি নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনের। তাদের ইজ্জত আব্রু এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করেননি।
হযরত সুফিয়ান ইবনে সালাম (রাযি.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- জেনে রেখো, কোনো মুসলিম যদি অমুসলিম নাগরিকের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন করে, তার কোন অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোন জিনিস বা সহায় সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়, তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমি তাদের বিপক্ষে অমুসলিমদের পক্ষে অবস্থান করবো। (আবু দাউদ- ৩০৫২)।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ইসলাম কখনও অন্য ধর্মের উপর আঘাত করে না, অন্য ধর্মাবলম্বী ও গোত্রের লোকদেরকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে না এবং তাদের উপর জুলুম করে না। এ দেশের মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকজন হাজার বছর ধরে যে যার ধর্ম পালন করে আসছে। পরস্পরের প্রতি সহনশীল, সহানুভূতি, দয়া ও পরোপকারিতার রীতি চলে আসছে শত শত বছর ধরে। মুসলমান মাত্রই তাদের প্রিয়নবী (সা.)এর আদর্শকে বুকে ধারণ করে, লালন করে, চর্চা করে। এভাবেই আখেরাতের পথকে মসৃণ করে।
আরও পড়তে পারেন-
আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
মুমিন জীবনে নামাযের গুরুত্ব
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
ইতিহাসে মাঝেমধ্যে আন্তঃধর্মীয় সংঘাত বা ঘৃণা সৃষ্টির নযির যে নেই তা নয়। তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী ও মুনাফেক, অমুসলিম চক্রান্তকারীদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। যুগে যুগে তারা এই ধর্মীয় সংঘাতকে উসকে দেয় এবং ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। যদি রাষ্ট্র এবং প্রশাসন এসব কুলাঙ্গারদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে, তবে এর লাগাম টেনে ধরা সম্ভব মনে করি। পাশাপাশি মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে কেউ যাতে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সেদিকে কঠোরভাবে দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, কোন মুসলমান আল্লাহ তাআলা ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং পবিত্র কুরআনের অবমাননা, বেইজ্জতি বরদাশত করবে না, এটাই চিরন্তন নীতি। মুসলমানদের এই আবেগকে পুঁজি করে কেউ যেনো তাদেরকে বিভ্রান্ত না করে, সেজন্য প্রশাসনকে পরিস্থিতি দায়িত্বশীলতার সাথে সামাল দিতে হবে ।
শ্রীলঙ্কায় মুসলিমবিদ্বেষী আইন
খবরে প্রকাশ, শ্রীলঙ্কায় গরু জবাই নিষিদ্ধের খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মূলত শ্রীলংকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের লক্ষ্য করেই এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কারণ, শ্রীলংকায় সংখ্যালঘু মুসলমানরাই গরুর গোস্তের প্রধান ভোক্তা। শ্রীলঙ্কার বর্তমান রাজাপাকসে সরকার ক্ষমতাগ্রহণের শুরু থেকে মুসলিমবিদ্বেষী নীতি গ্রহণের জন্য বিশ^ব্যাপী সমালোচিত হয়েছে। ইতিপূর্বেও তার সরকার বিভিন্ন সময় মুসলিম বিদ্বেষী বহু আইন প্রণয়ন করেছে। গরুর মাংস বিক্রি ও তার জবাইয়ের উপরে নিষেধাজ্ঞার প্রথম প্রস্তাব উঠেছিল ২০০৯ সালে ক্যান্ডি শহরে। তখন গরু জবাই নিষিদ্ধের দাবিতে মুসলিমবিদ্বেষী এক বৌদ্ধ ভিক্ষু নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে কট্টরপন্থী দুটি সিংহলি বৌদ্ধ সংগঠন গরু জবাই নিষিদ্ধের দাবিকে আন্দোলনের প্রধান বিষয়ে পরিণত করে।
এরপর ২০১৯ সালে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৫০ জন নিহত হওয়ার পর মুসলিম নারীদেরকে টার্গেট করে বোরকা বা মুখ ঢাকা পড়ে এমন পোষাক নিষিদ্ধ করে শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে সরকার এবং ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে বোরকা নিষিদ্ধের আইন অনুমোদন দেয় দেশটির মন্ত্রিসভা। আবার ৯ ডিসেম্বর ২০২০ সালে ২০ বছর বয়সী এক মুসলিম শিশুকে বাবা-মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও দাহ করায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দার জন্ম নেয় সারা বিশ্বে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ হয় বিশ্বজুড়ে ‘স্টপফোর্সডক্রিমেশন’ এই হ্যাশট্যাগে। করোনাকালীন সময়ে ১০৭ জন মুসলমানের লাশ দাফন করতে না দিয়ে জোর করে পুড়িয়ে ফেলে। শুধু তাই নয় মুসলিমদের ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী তাদের দাফন-কাফনের মৌলিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়। এক পর্যায়ে বিশ^ব্যাপী সমালোচনার মুখে মুসলমানদের লাশ দাফনের জন্য জায়গা বরাদ্দ হয় ভারত মহাসাগরের মান্নার উপসাগরের পরিত্যক্ত ইরানাথিবু দ্বীপটি। মূলত বৌদ্ধ উগ্রজাতীয়তাবাদ তাদের বর্ণবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে।
উপরের কয়েকটি ঘটনা থেকেই সহজে বুঝা যায়, শ্রীলঙ্কান মুসলিমরা ভালো নেই। অবশ্য মুসলিমরা কোনো দেশে, কোনো জনপদেই নিজেদের অধিকার নিয়ে নিজেদের ধর্মীয় অধিকার নিয়ে চলতে পারছে না। সারা বিশ্বে বর্তমানে একটি জনগোষ্ঠী সবার হাতে, সব জনপদে, সর্বক্ষেত্রে নিগৃহীত, লাঞ্ছিত-অপমানিত। মুসলিম হওয়াটাই যেন তাদের বড় অপরাধ।
২ কোটি ১০ লাখ লোকের বৌদ্ধ সংখ্যগরিষ্ঠ দেশটিতে ১০% মুসলিম আর ৭০% বৌদ্ধ। প্রায় ২০ লাখের উপরে মুসলিম জনগোষ্ঠী। অথচ সেখানে তারা ভিনদেশী, পরদেশী জনগোষ্ঠীর মত প্রতিহিংসা এবং বিদ্বেষের শিকার। সময় এসেছে প্রতিবাদের। সারা বিশ্বের মুসলমান আজ নিগৃহীত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত। নিজভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। জোরপূর্বক তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ষড়যন্ত্রমূলক অজুহাত দাঁড় করিয়ে নির্বিচার গণহত্যা চালানো হচ্ছে। কথায় কথায় তাদের মানবাধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এসব নিপীড়নের ঘটনায় মুসলমানরা যতই চুপ থাকছে, ততই আগ্রাসি থাবার নিষ্পেশন যেন বেড়েই চলেছে। তাই এসবের প্রতিকারে প্রতিটি মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং নেতাদেরকে নিজেদের কর্তব্যবোধ পালন ও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
ইরাক হামলা, পাওয়েল ডকট্রিন ও অগ্নিগর্ভ মধ্যপ্রাচ্য
সম্প্রতি মারা গেছে ইরাক যুদ্ধের অন্যতম হোতা এবং তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিং পাওয়েল। ঊনিশে মার্চ ২০০৩ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মুসলিম বিশে^র সম্ভাবনীয় ও অফূরন্ত তেল ভা-ারের দেশ ইরাক হামলার জন্য এই যুদ্ধের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন এবং চাপিয়ে দেয়া ১৮ মাসের যুদ্ধে তখনকার প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতন হয়। পাওয়েল মতবাদের উন্মেষ ঘটে ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়। ইরাক যুদ্ধের জন্য তিনি অনেক সমালোচিত হন। লাখ লাখ ইরাকির মৃত্যুর জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন অন্যতম হোতা। ইতিহাসে তিনি লাখ লাখ ইরাকি মুসলিমকে হত্যার জন্য ঘৃণিত ও নিন্দিত হয়ে থাকবেন।
ঠিক এ বছরই ইরাক যুদ্ধের অন্যতম কুখ্যাত সেনা কমান্ডার তৎকালীন মার্কিন সেনাপ্রধান রামসফেল্ড মারা যান। তার নির্দেশে ইউএসএ’র কারাগারে শত শত বন্দী নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন । বন্দীদের ২০ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের নিয়ম তৈরি করেছিলেন তিনি। কিউবার নির্জন দ্বীপের গুয়ানতানামো বে এবং ইরাকের কুখ্যাত আবু গারিব কারাগারে বন্দীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করেছিল। বিভিন্ন জরিপে এ পর্যন্ত এক লাখ থেকে ১০ লাখেরও বেশি মুসলিম নিহত হয়েছে ইরাক যুদ্ধে। ভুল গোয়েন্দা তথ্য এবং নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য একটি সাজানো গোছানো ও সমৃদ্ধ মুসলিম দেশকে নরক করে তুলেছিলেন এই তিন বৈশ্বিক যুদ্ধবাজ নেতা। আর এজন্যই ইরাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সম্প্রতি নিজ দেশে ক্যালিফোর্নিয়ায় এক অনুষ্ঠানে তারই স্বদেশী যুদ্ধবিরোধী একজন কর্মী প্রভাষক স্পার্ক প্রেসিডেন্ট বুশকে গ্রেফতারের জোর দাবি তোলেন। যিনি মানবতার নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের সূচনা করেছিলেন তিনিও হয়তো পৃথিবীতে বেশি দিন বেঁচে থাকবেন না। কিন্তু থেকে যাবে তার নিষ্ঠুরতা এবং ইতিহাস হয়ে থাকবেন তিনি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি বিনষ্টকারী, মুসলমান হন্তারক ধিকৃত একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। আর পরকালের হিসাব তো আল্লাহ তাআলাই ভালো নিতে জানেন।
গ্রন্থনায়- মাওলানা শফিকুল ইসলাম আমিনী
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/