মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
পৃথিবীর তাবৎ আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সবই মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ নেয়ামত। যার শোকরিয়া আদায় করা প্রতিটি বান্দার জন্য আবশ্যক।
কেননা, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো তবে তোমাদের (নিয়ামত) আরও বাড়িয়ে দেবো। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (সূরা ইবরাহিম- ৭ আয়াত)।
শোকরিয়ার সর্বনিম্ন স্তর হলো, আল্লাহর নেয়ামতকে সঠিক স্থানে ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা, আল্লাহর নাফরমানিতে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা।
গুগলের প্রতিষ্ঠাতা মি. ল্যারি পেইজ এবং সের্গেই ব্রিন তাদের কোম্পানির একটি মূলমন্ত্র ঠিক করেছেন, ‘ডোন্ট বি ইভিল’ যার অর্থ হলো, মন্দ হইয়ো না। তাদের এই মূলমন্ত্রটি প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি চূড়ান্ত দিকনির্দেশনাও বটে। এটি প্রযুক্তি ব্যবহারের দুটি শর্তের একটির সঙ্গে আংশিক মিলে যায়। প্রযুক্তিকে (আল্লাহর নেয়ামতকে) আল্লাহর নাফরমানি তথা কোনো মন্দ কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
আল্লাহর নেয়ামতের সঠিক ব্যবহারও শোকরিয়ার একটি স্তর। কিন্তু তাতে এতটাই মগ্ন হওয়া যাবে না যে নেয়ামতদাতাকেই ভুলিয়ে দেয়। (এটি প্রযুক্তি ব্যবহারের দ্বিতীয় শর্ত, যা মুফতি আজম মুফতি শফী (রহ.) তার গ্রন্থ ‘আলাতে জাদিদ কে শরয়ী আহকাম, পৃ. ১৫’ এ উল্লেখ করেছেন)।
মনে রাখতে হবে, প্রতিটি জিনিসেরই ভালো-খারাপ দিক রয়েছে। মানুষ চাইলে তাকে যে কোনো পথে ব্যবহার করতে পারে। প্রযুক্তিও তার ব্যতিক্রম নয়। এটিকে যেমন ইসলামের খেদমতে/দাওয়াতি কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। আবার খারাপ পথেও এটি ব্যবহার করা যায়। জানার বিষয় হলো, আমরা প্রযুক্তিকে কোন কাজে ব্যবহার করছি?
যেমন- আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স প্রযুক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনেক গবেষণা ও কাজকে সহজ করেছে, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ভয়াবহ বিপর্যয়েরও বার্তা দিচ্ছে। এর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটানোর সুযোগ রয়েছে, তেমনি এর অপব্যবহারে বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার দ্বার উম্মোচিত হয়েছে।
এআই-এর ডিপ মাইন্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেমন মানুষের চোখের জটিল রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। মানুষের সেবা করা সম্ভব হচ্ছে। তেমনি এআই-এর ডিপফেক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির মানুষ বহু ধরনের প্রতারণা করছে। মানুষের নকল ছবি/ভিডিও তৈরি করে তাদের বিপদে ফেলে দিচ্ছে, অনেক সময় অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি মানুষকে হেনস্তা করার জন্য এটি ব্যবহার করে পর্ণোগ্রাফি তৈরি করে তা ইন্টারনেটে পর্যন্ত ছড়িয়ে দিচ্ছে। ডিপফেক দিয়ে বানানো ছবি বা ভিডিও এতটাই নিখুঁত হয় যে, মানুষ দ্বিধায় পড়ে যায় এবং প্রতারিত ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে বিশ্বাস করে নেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া স্পষ্টভাবে হারাম তথা নিষিদ্ধ। নিম্নে কুরআন-হাদিসের আলোকে এর কারণগুলো তুলে ধরা হলো-
নকল ছবি ও ভিডিও তৈরি নিষিদ্ধ: ডিপফেক ব্যবহার করা হয়, কারো ছবি বা ভিডিও নকল করে হুবহু তার চেহারার মডেল তৈরি করার জন্য। ২০১৯ সালে গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে টেলিনর রিসার্চের ভাইস প্রেসিডেন্ট বিয়র্ন হ্যানসেন বলেছেন, ডিপফেক কনটেন্টগুলো এতটাই অত্যাধুনিক হবে যে, ডিজিটাল বিশ্বের কোনটা আসল, কোনটা নকল তা আলাদা করা কঠিন হয়ে যাবে।
উন্নত অ্যালগরিদম সহজেই জাল ছবি ও ভিডিও তৈরি করতে পারবে। এভাবে মানুষের প্রতিকৃতি বা ছবি বানানো ইসলামে হারাম। হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘হযরত আবদুল্লাহ (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, অবশ্যই কিয়ামত দিবসে মানুষের মধ্যে (কঠিন) শাস্তি ভোগকারী হবে ছবি তৈরিকারীরা’। (মুসলিম, হাদিস- ৫৪৩০)।
মুফতিয়ানে কেরাম পাসপোর্ট, ভিসা বা পরিচয়পত্রের মতো বিশেষ জরুরতের ক্ষেত্রে ছবির অনুমতি দিলেও স্বাভাবিকভাবে মানুষ বা কোন প্রাণীর ছবি ও ভিডিও চিত্র ধারণ হারাম ফতোয়া দিয়ে থাকেন। তাহলে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে কোন মানুষের নকল বা জাল ছবি ও ভিডিও তৈরি করা- যেখানে মানুষকে ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি ও প্রতারিত করার আশঙ্কা প্রবল; এটা তো জায়েয হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
মানুষকে জিম্মি করা হারাম: ডিপফেক ব্যবহার করে অন্যের আপত্তিকর ছবি-ভিডিও বানিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া হারাম।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; কিন্তু পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা করা জায়েয’। (সূরা নিসা, আয়াত- ২৯)।
সম্ভ্রমহানি করা: ডিপফেক ব্যবহার করে অনেক সময় মানুষের ভুয়া ছবি বা ভিডিও বানিয়ে তার সম্ভ্রমহানি করা হয়। ইসলাম এই কাজকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। কেউ যদি এ ধরনের কাজে লিপ্ত হয়ে যায়, তার উচিত অবশ্যই ভুক্তভোগীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া, তা না হলে কিয়ামতের দিন এর চরম মূল্য দিতে হবে। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার আগে, যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো সৎকর্ম থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ তার কাছ থেকে নেওয়া হবে; আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ নিয়ে তা তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে’। (সহীহ বুখারি, হাদিস- ২৪৪৯)।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করা: অনেক সময় এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, সন্দেহ, অবিশ্বাস তৈরি করা হয়। স্বামী বা স্ত্রীকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য কোন দুরাচার ভুয়া ছবি/ভিডিও, অডিও তৈরি করে অপব্যবহার করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এই কাজটিও জঘন্য অপরাধ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা এ ধরনের মানুষরূপী শয়তানদের নিন্দা করে বলেছেন, ‘তারা ফেরেশতাদ্বয়ের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যা দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতো’। (সূরা বাকারা, আয়াত- ১০২)।
উপরিউক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায়, যে কোনো উপায়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর চেষ্টা করা মহান আল্লাহ পছন্দ করেন না; বরং এ ধরনের কাজ করে বড়জোর শয়তানের কাছে প্রিয় হওয়া যায়, যা আখিরাত ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট।
হযরত জাবির (রাযি.) বর্ণনা করেছেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ইবলিস (শয়তান) সমুদ্রের পানির ওপর তার সিংহাসন স্থাপন করে। অতঃপর মানুষের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য সেখান থেকে তার বাহিনী চারদিকে প্রেরণ করে। এদের মধ্যে সে শয়তানই তার কাছে সর্বাধিক সম্মানিত যে শয়তান মানুষকে সবচেয়ে বেশি ফিতনায় নিপতিত করতে পারে। তাদের মধ্যে একজন ফিরে এসে বলে, আমি এরূপ এরূপ ফিতনা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছি। তখন সে (শয়তান) প্রত্যুত্তরে বলে, তুমি কিছুই করনি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তারপর এদের অপর একজন এসে বলে, আমি মানব সন্তানকে ছেড়ে দিইনি, এমনকি দম্পতির মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ করে দিয়েছি। রাসূল (সা.) বলেন, শয়তান এ কথা শুনে তাকে কাছে বসায় আর বলে, তুমিই উত্তম কাজ করেছো। বর্ণনাকারী আমাশ বলেন, আমার মনে হয় জাবির (রাযি.) এটাও বলেছেন যে, অতঃপর শয়তান তার সঙ্গে আলিঙ্গন করে। (মিশকাত, হাদিস, ৭১)।
যারা মহান আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে, তারা কখনো নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হ্যাকিংয়ের আশ্রয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। শুধু হ্যাকিং কেন, কোনো পন্থায়ই তারা এ কাজে লিপ্ত হতে পারে না। মহান আল্লাহ সবাইকে এ ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করুন। হিদায়াত দান করুন।
ফিতনা ছড়ানো নিষিদ্ধ: অনেক সময় এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে কোনো সম্মানিত ব্যক্তির জাল ছবি ভিডিও বানিয়ে এমনভাবে প্রচার করা হয়, যার ফলে সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, আবার অনেক সময় ধর্মীয় দাঙ্গাও লেগে যায়। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য এভাবে ফিতনা ছড়ানোও নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ফিতনা হত্যা থেকেও গুরুতর অন্যায়’। (সূরা বাকারা, আয়াত- ২১৭)।
বিদ্রূপ করা নিষিদ্ধ: অনেক সময় আবার মানুষের জাল ছবি, ভিডিও বা অডিও বানানো হয় শুধু তাকে উপহাস করার জন্য। মানুষকে উপহাস করাও ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনরা কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ কোরো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা না করে, তারাই জালেম’। (আল-হুজুরাত, আয়াত- ১১)।
অশ্লীলতা ছড়ানো হারাম: অনেক সময় এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করা হয়- পর্ণো ভিডিও তৈরি করার জন্য। ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন অপরিচিত মানুষের ছবি ডাউনলোড করে কারসাজির মাধ্যমে পর্নো ভিডিও বানিয়ে সেগুলো আবার ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয় অর্থ উপার্জনের জন্য, যা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্যতম অপরাধ। এখানে একদিকে যেমন ব্যক্তির হক নষ্ট করা হচ্ছে, অন্যদিকে অশ্লীলতা ছড়ানো হচ্ছে, যার দুটোই ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। পবিত্র কুরআনে অশ্লীলতা ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না’। (সূরা- নূর, আয়াত- ১৯)।
পবিত্র কুরআনের এই আয়াতে অশ্লীলতার আরবি শব্দ ‘ফাহেশা’ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা ইত্যাদি। আবার পবিত্র কুরআনের কোনো কোনো জায়গায় ব্যভিচারকেও ‘ফাহেশা’ বলা হয়েছে। যেমন- সূরা বনি ইসরাঈলে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না, নিশ্চয়ই তা অশ্লীল ও মন্দ পথ’। (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত- ৩২)।
লেখক: তরুণ আলেম, ইসলামী আইনবিশারদ ও সাংবাদিক।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/