।। মাওলানা ইসহাক ওমর কাসেমী ।।
৯ মুহাররম ১৪৪৩ হিজরীর (১৯ আগস্ট ২০২১ খ্রিস্টাব্দ) দিনের শুরুর ভাগ ছিল অন্যান্য দিনের মতই। সবাই আপন আপন কাজে ব্যস্ত। কেউ অফিসে, কেউ পড়ার টেবিলে। দুপুর ঠিক বারোটার দিকে একটা সংবাদ সবাইকে কাঁদিয়ে দিল। সংবাদটি বাংলার মুসলিম উম্মাহ, বিশেষভাবে দারুল উলূম হাটহাজারীর উপর বজ্রের মত আঘাত হানল। এমন একটা সংবাদ শোনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না। সংবাদটা আলোকজ্জ্বল একটা দিনকে মুহূর্তেই অন্ধকারে পরিণত করে দিল। ৯ মুহাররম ১৪৪৩ হিজরী (১৯ আগস্ট ২০২১ খ্রিস্টাব্দ) রোজ বৃহস্পতিবার, দুপুর ১২টা, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর শায়খুল হাদীস, শিক্ষা পরিচালক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সংগ্রামী আমীর, এ দেশের লাখো-কোটি তাওহিদী জনতার হৃদয়ের স্পন্দন, বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রাহিমাহুল্লাহ) দেশের আলেম সমাজ ও তাওহিদী জনতাকে শোক সাগরে ভাসিয়ে, ক্ষণস্থায়ী জীবনকে চির বিদায় জানিয়ে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান।
মৃত্যু মানুষের জন্য অবধারিত এবং নির্ধারিত। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যুর ক্ষত উম্মাহকে বহু দিন বয়ে চলতে হয়। কিছু মানুষের শূন্যতা উম্মাহ যুগ যুগ ধরে অনুভব করে। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.)এর মৃত্যুর ক্ষত এখনো তাজা রয়ে গেছে, ঠিক এমন সময় শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর মত উম্মাহর দরদী রাহবার, হাদীস জগতের স¤্রাট এবং দারুল উলূম হাটহাজারীর একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের বিদায়, এটা মুসলিম উম্মাহর জন্য এমন এক ব্যাপকতর ক্ষতি এবং শূন্যতা, যা সহজে পূরণ হবার নয় । যে বিচ্ছেদ যুগ যুগ পর্যন্ত উম্মাহ অনুভব করবে।
শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)। একাধারে তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত শায়খুল হাদীস তথা হাদীস বিশারদ, নাস্তিক-মুরতাদদের মূর্ত আতঙ্ক, বাংলার জনপ্রিয় দ্বীনি সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আমীর, দারুল উলূম হাটহাজারীর শিক্ষা পরিচালক, উম্মাহর দরদী অভিভাবক, কারা নির্যাতিত মযলুম জননেতা। কোটি কোটি তাওহিদী জনতার হৃদয়ের স্পন্দন এবং ইসলামী অঙ্গনে প্রেরণার বাতিঘর।
জন্ম এবং বংশ পরিক্রমাঃ
শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) ৮ অক্টোবর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে (২৩ মুহাররম ১৩৭২ হিজরী) চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বাবুনগরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা- মাওলানা আবুল হাসান (রহ.) ছিলেন সমসাময়িক যুগের একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং ফক্বীহ। দারুল উলূম হাটহাজারীর প্রবীণ শিক্ষক। মিশকাতুল মাসাবীহ-এর কালজয়ী ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তানযীমুল আশতাত’ (আরবী-উর্দু)এর লেখক। মাতা- সাইয়্যেদা ফাতেমা বিনতে শাহ হারুন বাবুনগরী (রহ.)। যিনি ছিলেন তাঁর সময়ের একজন মহিয়সী নারী। বিখ্যাত ওলী, জামিয়া আযীযুল উলূম বাবুনগরের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আল্লামা হারুণ বাবুনগরী (রহ.)এর জৈষ্ঠ্য কন্যা। আল্লামা বাবুনগরী (রহ.)এর বংশ সামাজিকভাবে ছিল উঁচু স্তরের। একই সাথে তাঁর পিতা-মাতা উভয়ের বংশ পরিক্রমায় কয়েক পুরুষ পর্যন্ত আলেম এবং ওলী-বুযূর্গ অতিবাহিত হয়েছিল। এই পবিত্র এবং বরকতময় বংশে জন্ম গ্রহণকারী আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ. সারা বিশ্বে ইলমে দ্বীনের দ্যুতি ছড়িয়েছেন।
শিক্ষা-দীক্ষাঃ
৫ বছর বয়সে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)কে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী জামেয়া আযীযুল উলূম বাবুনগরে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তিনি মকতব, নাযেরা, হেফজসহ প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তাঁর হিফজের শিক্ষক মাওলানা আযহারুল ইসলাম ধর্মপুরীর কাছে পবিত্র কুরআন এক বৈঠকে সম্পূর্ণ মুখস্ত শুনিয়েছিলেন।
এরপর তাঁর সম্মানিত পিতা বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা আবুল হাসান (প্রকাশ, আবুল সাহেব রহ.)এর সাথে উপমহাদেশের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উম্মুল মাদারিস, আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে চলে আসেন। এখানে হযরতের মুহতারাম আব্বাজানের তারবিয়াতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাফিয়া থেকে তাকমীল (দাওরায়ে হাদীস) পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৩৯৭ হিজরী (১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ) সনে তিনি দাওরায়ে হাদীসে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
দারুল উলূম হাটহাজারীতে হযরতের উল্লেখযোগ্য উস্তাদগণের মধ্যে ছিলেন- তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল কায়ইয়ুম (রহ.), মাওলানা হাফিজুর রহমান পীর সাহেব (রহ.), মাওলানা হামেদ সাহেব (রহ.), মাওলানা আবুল হাসান (রহ.) মুফতিয়ে আযম মুফতী আহমাদুল হক (রহ.), আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) প্রমুখ।
উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সফরঃ
দারুল উলূম হাটহাজারীর নির্ধারিত পড়াশোনার সমাপ্তি করে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাকিস্তান সফর করেন। সেখানে ঐতিহাসিক দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বিন্নুরি টাউনে উচ্চতর হাদীস বিভাগের (উলূমুল হাদীস) দুই বছরের কোর্স সম্পন্ন করেন। কোর্স শেষে নির্ধারিত গবেষণাপত্র জমা দিয়ে তিনি ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেন। উচ্চতর হাদীস বিভাগে অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী (রহ.)এর কাছে সহীহ বুখারী এবং বিখ্যাত ফকীহ মুফতী ওলী হাসান টুংকি (রহ.)এর কাছে সুনানে তিরমিযী পুনরায় পূর্ণাঙ্গরূপে পড়েন। বিন্নুরি টাউনে তাঁর উল্লেখযোগ্য উস্তাদগণের মধ্যে বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুর রশীদ নুমানী (রহ.), মাওলানা ইদরীস মিরাঠী (রহ.) মাওলানা ইসহাক সিন্ধীলভী (রহ.) ছিলেন অন্যতম।
এছাড়া পাকিস্তান অবস্থানকালে তিনি বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিসীনগণের কাছ থেকে হাদীসের সনদও লাভ করেন।
আধ্যাত্মিক সাধনাঃ
১৯৭৮ সালে মাওলানা আব্দুল কাদের রায়পুরী (রহ.)এর উত্তরসূরী মাওলানা আব্দুল আজিজ রায়পুরী (রহ.) বিন্নুরী টাউনে আগমন করলে তাঁর কাছে বায়আত গ্রহণ করেন এবং কিছুকাল তাঁর সান্নিধ্যে ছিলেন। বাংলাদেশে তিনি শায়খুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)এর দুই শিষ্য- ১. শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) এবং ২. মাওলানা আব্দুস সাত্তার (রহ.) থেকে খেলাফত/ইজাযত পেয়েছেন। এছাড়া মুফাক্কিরে ইসলাম মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)এর খলীফা মাওলানা সুলতান যওক নদভী (হাফি.)এর কাছ থেকেও তিনি খেলাফত পান।
তাদরীসী ময়দানেঃ
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে করাচী থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষে মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন জামিয়া আযীযুল উলূম বাবুনগরে সিনিয়র শিক্ষক পদে যোগদান করেন। জামিয়া বাবুনগরে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা ২৪ বছর তাফসীর, হাদীস, ফিকহ এবং ইলমে নাহুর জটিল কিতাবসমূহ দক্ষতা এবং সুনামের সাথে পাঠদান করেন। ১৪০৩-০৪ হিজরী শিক্ষাবর্ষে তিনি বাবুনগর মাদ্রাসায় বাংলাদেশে সর্বপ্রথম উচ্চতর হাদীস গবেষণা বিভাগ চালু করেন।
দারুল উলূম হাটহাজারীতেঃ
হযরতের ইলমি দক্ষতা এবং পাঠদানের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.)এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে সিনিয়র মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন। হাটহাজারীতে তিনি আমৃত্যু মিশকাত শরীফ প্রথম খন্ডের দরস দিয়েছেন। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মুসলিম শরীফ (উভয় খন্ড), তিরমিযী শরীফ প্রথম খন্ড, মুয়াত্তা মুহাম্মদ, শরহে আক্বায়েদ, সুল্লামুল উলূম, মুখতাসারুল মাআনী এবং আকীদাতুত তাহাভীর দরস দিয়েছেন। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) বার্ধক্যজনিত অসুস্থ হয়ে পড়লে বুখারী শরীফ দ্বিতীয় খন্ডের দরস আল্লামা বাবুনগরীর হাতে অর্পণ করেন। সেসময় হাজারো তালিবুল ইলমের সামনে তিনি আল্লামা বাবুনগরীকে ‘হাফিযুল হাদীস’ এবং ‘শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস’ উপাধিতে ভূষিত করেন। একই বছর আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) চিকিৎসার জন্য মালয়েশিয়া গমন করলে বুখারী শরীফ প্রথম খন্ডের দরসও কিছুদিনের জন্য হযরতের উপর সোপর্দ করেন। ইলমে হাদীসের দরসের পাশাপাশি তিনি দারুল উলূম হাটহাজারীর পরিচালনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ২০১৭ থেকে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি দারুল উলূম হাটহাজারীর মুঈনে মুহতামিম (সহকারী পরিচালক) পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.)এর ইন্তিকালের পর তিনি জামিয়ার প্রধান শায়খুল হাদীস এবং নাযেমে তালিমাতের (শিক্ষা পরিচালক) দায়িত্ব পালন করেছেন। ইন্তিকাল অবধি তিনি এসব দায়িত্বে অধিষ্ঠ ছিলেন।
মাসিক মুঈনুল ইসলামের সম্পাদকঃ
বাংলাদেশের প্রাচীনতম বহুল প্রচারিত দ্বীনি সাময়িকী, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুখপত্র মাসিক মুঈনুল ইসলামের দীর্ঘদিনের সম্পাদক ছিলেন শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.)। তাঁর ইন্তিকালের পর জামিয়ার মজলিসে ইদারি সর্বসম্মতিক্রমে আল্লামা বাবুনগরীকে মাসিক মুঈনুল ইসলামের সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করেন। দায়িত্বপ্রাপ্তির পর থেকেই তিনি নিয়মিত মুঈনুল ইসলাম কার্যালয়ে সময় দিতেন। পত্রিকা সংক্রান্ত খোঁজ-খবর এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন। পত্রিকায় প্রতিমাসে কোন কোন বিষয়ে লেখা থাকা দরকার এবং কী কী লেখা যাচ্ছে তার পূর্ণ খোঁজ নিতেন। ইন্তিকাল অবধি তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
ইলমে হাদীসের মুকুটহীন সম্রাটঃ
অধ্যাপনা তথা ইলমে হাদীসের ময়দানে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তিনি ছিলেন এই ময়দানের শাহসওয়ার। মুকুটহীন স¤্রাট। আল্লামা আহমদ শফি (রহ.)এর মত ব্যক্তিত্ব তাঁকে ‘হাফিযুল হাদীস’ এবং ‘শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস’ উপাধি দিয়েছিলেন। হাদীসের কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয়গুলো তিনি সুন্দর, সহজ এবং প্রাঞ্জল ভাষায় তালিবুল ইলমদেরকে বুঝিয়ে দিতেন। যার ফলে তাঁর দরসে তালিবুল ইলমগণের বিপুল উপস্থিতিতে দরসগাহ কানায় কানায় ভরে যেত। অনেক সময় তিল ধারণে ঠাঁই পর্যন্ত পাওয়া যেত না।
তিনি যখন হাদীসের দরস শুরু করতেন, পুরো দরসগাহজুড়ে তখন পিনপতন নিরবতা বিরাজ করত। নবীজির হাদীস সমূহকে তিনি যুগোপযোগী ভাষায় বুঝাতেন। যার ফলে তাঁর দরস যে শুধু তালিবুল ইলমগণ সহজে আয়ত্ব করে নিতে পারত তা নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্যও বুঝতে কষ্ট হতো না। জান্নাত-জাহান্নাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা সংশ্লিষ্ট হাদীসসমূহ আসলে তিনি অঝোরে কাঁদতেন। ঈমান-কুফর এবং হক-বাতিল সম্পর্কিত কোনো হাদীস আসলে তিনি সেক্ষেত্রে বলিষ্ঠ কণ্ঠে স্পষ্ট ভাষায় হকের বিষয়টি তুলে ধরতেন। এক্ষেত্রে তিনি কারো রক্তচক্ষুর পরোয়া করতেন না। হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি প্রতিটি মাসআলার ক্ষেত্রে ইমামগণের ফিক্বহি মতামতগুলো দলীলসহ তুলে ধরতেন। শেষে দলীলের আলোকে বিশুদ্ধ মতকে প্রধান্য দিতেন। প্রত্যেকটি হাদীসের উপর তিনি পর্যাপ্ত আলোচনা করতেন।
আরও পড়তে পারেন-
- মুসলমানদের জন্য রোগ-ব্যাধিতে চিকিৎসা করানো সুন্নাত
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- মাহে মুহাররম ও আশূরা: করণীয় ও বর্জনীয় আমলসমূহ
দরস এবং ইলমুল হাদীসের আদবের প্রতি তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন। দরস শুরু হওয়ার পর অসময়ে কেউ দরসে প্রবেশ করে কিংবা কথা বলে মনযোগ নষ্ট করলে তিনি খুবই রাগ করতেন। হাদীসের ইবারত (টেক্সট) পড়ার সময় কোনো তালিবুল ইলম ভুল করলে তিনি কঠিনভাবে সতর্ক করতেন। সীমা অতিক্রম করলে পরীক্ষামূলক ভাবে কিছু শাস্তিও দিতেন। যাতে করে তালিবুল ইলমের হৃদয়ে ইলমে হাদীসের আযমত স্থান করে নেয়। দরস-তাদরীসের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা এবং সময় নষ্ট তিনি কোনোভাবেই সহ্য করতেন না। তাঁর দরসের গ্রহণযোগ্যতা আল্লাহ তায়ালা বাংলাদেশ ছড়িয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করে দিয়েছিলেন। নিয়মিত তালিবুল ইলমগণের পাশাপাশি প্রতিদিন অনেক মেহমান এবং সাধারণ মুসল্লীগণকেও তাঁর দরসে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যেতো।
দরস এবং তালিবুল ইলমদের হকের ব্যাপারে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। সপ্তাহে অগণিত মাহফিল এবং সফরের দাওয়াত থাকা সত্ত্বেও তিনি ছাত্রদের হক নষ্ট হওয়ার ভয়ে সাধারণত সপ্তাহের শুরুতে এবং মাঝে কোন দাওয়াত গ্রহণ করতেন না। বরং বৃহস্পতিবার ও জুমাবার দাওয়াত গ্রহণ করতেন। অনেক সময় দরসের গুরুত্ব বিবেচনা করে গভীর রাতে সফর থেকে ফিরে আসতেন। এরপর সকালে বিশ্রাম না নিয়ে দরস দিতেন।
দাওয়াত ও আত্মশুদ্ধির ময়দানেঃ
ইলমে হাদীসের দরসদানের পাশাপাশি তিনি দাওয়াত এবং আত্মশুদ্ধির ময়দানেও সরব বিচরণ করতেন। প্রতিবছর সমগ্র বাংলাদেশজুড়ে হাজারো ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে তিনি মানুষকে নসীহত করতেন। যৌবনকালে পার্বত্য অঞ্চলে তিনি পায়ে হেঁটে বিভিন্ন মাজমায় গিয়ে দ্বীনি আলোচনা করতেন। বার্ধক্যে এসে অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি নিয়মিত দাওয়াতের কাজ করতেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের কাদিয়ানি, খ্রিস্টান মিশনারী এবং ভ্রান্ত ফিরকার কর্মকা- সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। তালিবুল ইলম এবং সাধারণ মানুষকে এসব ফিতনা সম্পর্কে তিনি প্রায় সময় আলোচনা করতেন। সেসব অঞ্চলে গিয়ে দ্বীনি খেদমত করার জন্য তিনি উলামায়ে কেরামকে উৎসাহ যোগাতেন। হযরতের এই দ্বীনি দাওয়াতের পরিসর মুসলিম অমুসলিম সবার মাঝে বিস্তৃত ছিল। হযরতের আলোচনা এবং ব্যক্তিত্বের প্রতি মুগ্ধ হয়ে অনেক অমুসলিম তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
শাপলার ঐতিহাসিক মহাজাগরণ এবং হেফাজতে ইসলামঃ
২০১৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের কথিত কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের নামে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। প্রথম দিকে আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের নামে হলেও পরর্তীতে এর সক্রিয় নেতাকর্মীরা সামাজিক মাধ্যম এবং ব্লগে মহান আল্লাহ তাআলা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলামের বিধানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কটূক্তি এবং বিষোদ্গার শুরু করে। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবির আড়ালে পুরো দেশজুড়ে ইসলাম নির্মূলবাদী নাস্তিক-মুরতাদরা তাদের মিশন বাস্তবায়নের হীন চক্রান্তে মেতে উঠে। হুমকির মুখে পড়তে শুরু করে মুসলিম উম্মাহর ঈমান-আকীদা। নাস্তিক-মুরতাদদের এসব আস্ফালনের বিরুদ্ধে সেসময় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ব্যানারে ১৩ দফা দাবি নিয়ে নবীজির ইজ্জত, ইসলাম ও মুসলমানদের সম্মান এবং স্বাধীনতা রক্ষার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেন। আল্লামা আহমদ শফি (রহ.)এর ঈমানী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বাহু ছিলেন শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)। বিশ্ব দেখেছিল, সেদিন আল্লামা আহমদ শফি এবং আল্লমা জুনায়েদ বাবুনগরীর ডাক সমগ্র বাংলার আনাচে-কানাচে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল এবং ৫-৬ মে স্বাধীন বাংলার স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যে আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশে ইসলাম নির্মূলবাদী নাস্তিক-মুরতাদদের প্রকাশ্য আস্ফালন ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। সেসময় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা আমীর ছিলেন আল্লামা আহমদ শফি (রহ.)। মহাসচিব ছিলেন শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)। তের সালের ৬ মের পরেও হেফাজতে ইসলাম রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যু (শিক্ষানীতি, নারী অধিকার, নবীজির বিরুদ্ধে কটূক্তি, ইসরাইল এবং ভারতীয় আগ্রাসন) নিয়ে রাজপথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছিল। এসব আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আল্লামা আহমদ শফি এবং আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)।
২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.)এর ইন্তিকাল হলে সর্বসম্মতিক্রমে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর নির্বাচিত হন শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)।
কারাগারে একজন মযলুম জননেতাঃ
২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই মে গভীর রাত। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে রাসূলের ইজ্জত রক্ষায় আন্দোলনরত লাখো নবীপ্রেমী তাওহিদী জনতার উপর গভীর রাতে নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসলীলা চালানো হয়। যেখানে অনেক উলামা-সাধারণ জনতা শাহাদতবরণ করেন। অনেকেই আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে যান। একই সাথে হাজারো উলামায়ে কেরামকে অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারের প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ এবং নানাবিধ নিপীড়নের সম্মুখীন করা হয়। শাপলা চত্বরের নিষ্ঠুর গণহত্যার পরের দিন পুরান ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজত মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)কে। বয়োবৃদ্ধ এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ এই আলেমে-দ্বীনকে দিনের পর দিন রিমান্ডে নির্যাতন করা হয়। কারাগারের অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক সময়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি সে সময় তাঁর বেঁচে থাকা নিয়েও গভীর সংশয় তৈরি হয়। সরকার তখন তড়িঘড়ি তাঁকে জামিন দিলে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ঢাকার বারডেম এবং চট্টগ্রামের সিএসসিআরে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হলে তিনি হাটহাজারীতে ফিরে আসেন।
আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাঃ
এমনিতে হাদীস জগতের একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস হিসেবে ইলমী মহলে তাঁর সুনাম এবং জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। একই সাথে হকের পক্ষে এবং বাতিলের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হওয়ার কারণে মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল অভাবনীয়। ২০১৩ সালের নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া এবং যালিমের কারাগারে দীর্ঘদিন নির্যাতিত হওয়ার পর থেকেই তিনি বাংলার প্রতিটি মুসলমানের ভালোবাসার পাত্র এবং হৃদয়ের স্পন্দন হিসেবে পরিণত হন। তিনি যেখানেই সফর করতেন সেখানেই উলামা-তুলাবা এবং জনসাধারণের ভীড় লেগে যেত। তাঁর জনপ্রিয়তার সর্বশেষ উদাহরণ নামাযে জানাযার দৃশ্য। যেখানে গভীর রাতেও দেশের দূর-দূরান্ত থেকে লাখো মানুষ অংশগ্রহণ করে।
লেখালেখি এবং প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ
পাঠদানের ময়দানে হযরত যেরকম একজন শাহসওয়ার ছিলেন, অনুরূপভাবে আরবী, উর্দু, বাংলা তিন ভাষায় লেখনীর ময়দানেও তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী লেখক। ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে তিনি দ্বীনি দাওয়াতের অংশ হিসেবে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তাঁর আরবী এবং উর্দু লিখিত গ্রন্থ এবং প্রবন্ধসমূহ ইলম এবং সাহিত্যের খোরাক। ভারতের বিখ্যাত আরবী সাময়িকী আল-বা’সুল ইসলামী এবং দারুল উলূম দেওবন্দের ঐতিহাসিক মাহনামা দারুল উলূমে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। এছাড়া আরবের বহুল প্রচারিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সে সময় তিনি লেখালেখি করতেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এবং মাসিক মুঈনুল ইসলাম ও মাসিক মদিনায় তিনি প্রবন্ধ লিখতেন। যা থেকে লাখো পাঠক পরিতৃপ্ত হতেন। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি তিনি তিন ভাষায় স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
১. সীরাতুল ইমাম আদ-দারামী ওয়াত্তারিফু বিশুয়ুখিহি (আরবী)। এই গ্রন্থটি তিনি পাকিস্তানে উলূমুল হাদীসের উপর উচ্চশিক্ষা অর্জনকালীন সময়ে গবেষণাপত্র হিসেবে লিখেছিলেন।
২. আত-তাওহীদ ওয়াশ শিরক ওয়া আকসামুহুমা (আরবী)। তাওহীদ, শিরক এবং তাদের প্রাকারসমূহের উপর আরবী ভাষায় লিখিত এই গ্রন্থটি খুবই উপকারী। এ গ্রন্থটি আরবের স্বনামধন্য একটি প্রকাশনী থেকে ছাপা হয়েছিল।
৩. দাড়ি আওর ইসলাম (উর্দু/বাংলা)। ইসলামে দাড়ির বিধান নিয়ে উর্দু ভাষায় তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেছেন; যা বাংলায়ও অনুদিত হয়েছে।
৪. ইসলাম আওর সাইন্স (ইসলাম এবং বিজ্ঞান) উর্দু
৫. বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)
৬. মুকাদ্দিমাতুল ইলম (উর্দু)
৭. মুকাদ্দিমা তানযীমুল আশতাত (উর্দু)
৮. খুতবার ভাষা (বাংলা)।
এছাড়া সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিশেষভাবে কিছু দিন পূর্বে তাঁর মুসলিম শরীফের তাকরীর সংকলন প্রকাশ করা হয়। (কলেবর সংক্ষিপ্ত রাখতে এখানে সবিস্তারে আলোচনা করা যাচ্ছে না)।
উর্দু এবং আরবী কাব্য চর্চাঃ
আরবী উর্দু এবং বাংলার গদ্য ভাষায় লেখালেখির পাশাপাশি তিনি আরবী উর্দু এবং ফার্সি ভাষার একজন দক্ষ কবিও ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি উর্দু এবং ফার্সি ভাষায় অসংখ্য কবিতা/গজল রচনা করেছেন। আল্লামা বাবুনগরী (রহ.)এর কাব্যিক উপাধি ছিল ‘শওক’। এক সময় এ নামে তিনি অনেক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এ নাম ব্যবহার বন্ধ করে দেন। দারুল উলূম হাটহাজারীকে নিয়ে রচিত ঐতিহাসিক তারানায়ে দারুল উলূম তাঁর কলমেরই সার নির্যাস ছিল।
ব্যক্তিগত জীবনঃ
আল্লামা বাবুনগরী (রহ.)এর স্বভাব ছিল ফারুকী স্বভাবের। অনিয়ম কোনোভাবেই তিনি সহ্য করতেন না। বাতিলের সঙ্গে কোনো প্রকার আপোষ করতেন না। আল্লাহ তায়ালা তাঁর চেহারায় এক ধরনের অভিব্যক্তি দিয়েছিলেন, যার ফলে কাছের দূরের সকলেই তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েই কিছু বলতে সহজে সাহস করতেন না। কিন্তু তিনি যখন কারো সাথে কথা বলতেন, কাছে টেনে নিয়ে আপনজনের মত কথা বলতেন।
ছাত্রদেরকে আদর-স্নেহ এবং ভালোবাসা দিয়ে বুকে আগলে নিতেন। তাঁর অন্যতম একটি গুণ হচ্ছে, তিনি কোনো সময় কোনো কারণে কারো সাথে একটু শক্ত আচরণ করলে সাথে সাথে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতেন। চাই উক্ত ব্যক্তি ছাত্র হোক কিংবা কর্মচারী, বড় হোক কিংবা ছোট। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে ছাত্রদেরকে খুবই উৎসাহ দিতেন। প্রায় সময় মেধাবী এবং মেহনতী ছাত্রদেরকে পুরস্কৃত করে উৎসাহ যোগাতেন।
দান-সদাকাহঃ
হযরতের পুরো জীবন ছিল একজন প্রকৃত মুসাফিরের প্রতিচ্ছবি। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর না কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স ছিলো, না কোনো ব্যবসা। দ্বীনি খেদমতের মাধ্যমে তিনি যা ভাতা ও হাদিয়া পেতেন, তা দু’হাত ভরে গরীব-অসহায়দের মাঝে দান করতেন। বিশেষকরে গরীব মেধাবী তালিবুল ইলমদেরকে তিনি ডেকে ডেকে টাকা-পয়সা, কাপড়, কিতাব ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করতেন। কোনো ছাত্র কিংবা তাদের আত্মীয় অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য খরচ দিতেন। নওমুসলিমরা সাহায্যের জন্য আসলে দু’হাত ভরে তাদের সহযোগিতা করতেন।
পরিবার পরিজনঃ
তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে পৈত্রিক পরিবারে হযরত ছিলেন সবার বড়। অপর দুই ভাইও আলেম হয়ে মাদারিসে দ্বীনিয়ার খেদমতে আছেন। দুই বোনও ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত ধর্মভীরু ও পরহেযগার।
দাম্পত্য জীবনে তিনি ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানার চৌধুরীপাড়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবার মাওলানা সোলাইমান চৌধুরী (রহ.)এর জৈষ্ঠ্য কন্যাকে বিয়ে করেন। আল্লাহ তাআলা হযরতের সংসারে আলোকিত করে পাঁচটি কন্যা সন্তান এবং একমাত্র পুত্র সন্তান দান করেন। কন্যাগণ প্রত্যেকেই আলেমা, দ্বীনদার, পরহেযগার। একমাত্র পুত্র সন্তান হাফেয মাওলানা সালমান (সাল্লামাহু) গত বছর বাবুনগর মাদরাসা থেকে তাকমীল (দাওরায়ে হাদীস) উত্তীর্ণ হন। আল্লাহ তায়ালা তাঁদের প্রত্যেকের জীবনে বরকত, সুস্থতা এবং হায়াতে তাইয়্যিবা দান করুন।
ইন্তিকাল এবং দাফন পরবর্তী সময়ঃ
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে নানা রোগ-ব্যাধি হযরতের শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতন সহ্য করার পর থেকে তিনি শারীরিকভাবে অনেকটাই অক্ষম হয়ে পড়েন। কারো সাহায্য এবং হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না। একই সাথে জীবনের শেষ বছরে তিনি মানসিকভাবে খুব চাপে ছিলেন। ডায়াবেটিস ইত্যাদি ছিল অনিয়ন্ত্রিত। এছাড়া কিডনির সমস্যাও ছিল। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত হাসপাতাল ছিল তাঁর বাসস্থানের মত। প্রতি মাসেই চেকাপের জন্য মেডিকেল যাওয়া লাগত। দৈনন্দিন ৪০/৫০টি ঔষধ গ্রহণ করতে হত।
ইন্তিকালের ১০ দিন আগে ৮ আগস্ট তিনি কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের প্রথম ডোজ নিয়েছিলেন। এরপর চোখের ছানি অপারেশন হয়। এর মাত্র কয়েক দিন পরেই গত ৯ মুহাররম ১৪৪৩ হিজরী রোজ বুধবার সকালের দিকে শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল। কথাবার্তাও বলছিলেন। শরীরে ঠান্ডা অনুভব করার কারণে খাদেমকে বলেছিলেন, গায়ে চাদর মুড়িয়ে দেওয়ার জন্য। সাড়ে দশটার দিকে খাদেম ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য রুমে প্রবেশ করলে দেখেন, হযরতের শারীরিক অবস্থা অস্বাভাবিক এবং অনেকটাই অচেতন দেখাচ্ছিল। দ্রুত এম্বুলেন্সযোগে হাটহাজারীর আলিফ হাসপাতালে নিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয়। এরপর পরই চট্টগ্রামের সিএসসিআর হাসপাতালে নেওয়া হলে দুপুর ১২টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে বলেন, হযরত দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে মহান রবের সান্নিধ্যে পৌঁছে গেলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
ইন্তেকালের সময় হযরতের বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। হযরতের ইন্তেকালের সাথে সাথে বাংলার আকাশ থেকে ইলমে হাদীসের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র যেন খসে পড়ল। বাংলার মানুষ একজন যোগ্য এবং দরদী রাহবারের ছায়া থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে গেল। হযরতের ইন্তেকালে উম্মুল মাদারিস হাটহাজারী, হেফাজতে ইসলাম এবং তাওহীদী জনতার জন্য এক অপূরণীয় শূন্যতা রেখে গেল। আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.)এর ইন্তেকালের পর মাত্র এক বছরের মাথায় দারুল উলূম হাটহাজারী এই মহামূল্যবান রত্নকে হারিয়ে ফেলে।
হযরতের ইন্তিকালের সংবাদ মুহূর্তেই দেশ ছড়িয়ে সমগ্র বিশ্বে পৌঁছে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে ইন্তিকালের সংবাদ, হযরতের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং জানাযা পরবর্তী সংবাদগুলো গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা হয়। চতুর্দিকে এক শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একের পর এক আসতে থাকে শোকবার্তা। সারা দেশের আলেম ও ছাত্র-জনতার স্রোত হাটহাজারী অভিমুখী হয়ে যায়। জামিয়া কর্তৃপক্ষ হযরত (রহ.)এর পরিবারের অভিভাবকদের সাথে পরামর্শ করে দারুল উলূম হাটহাজারীতে সন্ধ্যা সাতটায় জানাযার সময় নির্ধারণ করে। কিন্তু সারাদেশ থেকে জানাযায় শরীক হতে ভক্তবৃন্দের আবেগের দিক বিবেচনা করে পুনরায় পরামর্শক্রমে হযরতের নামাযে জানাযা রাত এগারোটায় পেছানো হয়।
লাখো তাওহিদী জনতা শেষবারের মত হযরতকে একবার দেখার জন্য হাটহাজারীতে ভীড় করতে থাকে। লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় হাটহাজারীতে হযরতের মামা আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর ইমামতিতে নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার পর জামিয়ার নিজস্ব কবরস্থান ‘মাকবারায়ে জামিয়া’তে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.)এর পাশে উম্মাহর এই রত্নকে চিরদিনের জন্য দাফন করা হয়। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) এবং শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) দুজনই জীবদ্দশায় একসাথে হাদীসের ময়দান এবং ঈমানী আন্দোলনে ছিলেন। ইন্তেকালের পরও কবর জগতে উভয়জনকে আল্লাহ তায়ালা পাশাপাশি করে রেখেছেন। হাশরের দিনও উভয় হযরতকে যেন আল্লাহ তাআলা জান্নাতের আ’লা মাকামে পাশাপাশি থাকার ফায়সালা দেন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক- আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং সহকারী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/