।। আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ জসীমুদ্দীন ।।
মহান আল্লাহ সূরা মারইয়ামের ৬৪-৬৫ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-
وَ مَا نَتَنَزَّلُ اِلَّا بِاَمۡرِ رَبِّکَ ۚ لَهٗ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡنَا وَ مَا خَلۡفَنَا وَمَا بَیۡنَ ذٰلِکَ ۚ وَ مَا کَانَ رَبُّکَ نَسِیًّا ﴿ۚ۶۴﴾ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَهُمَا فَاعۡبُدۡهُ وَ اصۡطَبِرۡ لِعِبَادَتِهٖ ؕ هَلۡ تَعۡلَمُ لَهٗ سَمِیًّا ﴿۶۵﴾
অনুবাদ: (৬৪) (এবং ফেরেশতাগণ তোমাকে বলে) আমরা আপনার প্রতিপালকের হুকুম ছাড়া অবতরণ করি না। যা কিছু আমাদের সামনে যা কিছু আমাদের পেছনে এবং যা কিছু এই দু’য়ের মাঝখানে আছে, তা সব তাঁরই মালিকানাধীন। তোমার প্রতিপালক ভুলে যাওয়ার নন। (৬৫) তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মালিক এবং এই দুইয়ের মাঝখানে যা আছে তারও। সুতরাং তুমি তাঁর ইবাদত করো এবং তাঁর ইবাদতে অবিচল থাকো। তোমার জানা মতে তার সমগুণ সম্পন্ন কেউ আছে কি?
তাফসীর: প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও সাহাবীগণ অত্যন্ত দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছিলেন। নবী কারীম (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ সর্বক্ষণ ওহীর অপেক্ষা করতেন। এর সাহায্যে তাঁরা নিজেদের মাঝে উদ্ভূত যে কোন সংকটের সমাধান ও পথের দিশা পেতেন এবং মানসিক প্রশান্তি ও সান্ত¡নাও লাভ করতেন। ওহীর আগমনে যতোই বিলম্ব হচ্ছিল ততোই তাদের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিল। আলোচ্য আয়াতে রয়েছে এতো লম্বা সময় ধরে জিবরীল (আ.)এর নিজের না আসার ওজর, আল্লাহর পক্ষ থেকে সান্ত¡না বাণী এবং এসঙ্গে সবর ও সংযম অবলম্বন করার উপদেশ ও পরামর্শ।
শানে নুযুল: ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বর্ণনা করেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জিবরীল (আ.)কে বলেন, আপনি আমার কাছে যতো বার আসেন তার চেয়ে আরো বেশি বার সাক্ষাত করেন না কেন? ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, তখন
وَ مَا نَتَنَزَّلُ اِلَّا بِاَمۡرِ رَبِّکَ ۚ لَهٗ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡنَا وَ مَا خَلۡفَنَا وَ مَا بَیۡنَ ذٰلِکَ ۚ وَ مَا کَانَ رَبُّک نَسِیًّا
এ আয়াতটি নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৩২১৮)।
একথা বলার কারণ হলো, একদা জিবরীল (আ.) আসতে বিলম্ব করেন। তাই নবী (সা.) তাঁর সাথে বেশি বেশি সাক্ষাত লাভের কামনা করে এ উক্তি করেন।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, জিবরীল (আ.) সহ যে কোন ফেরেশতা আল্লাহ তাআলার নির্দেশের অবাধ্য হন না। যেমন- ফেরেস্তাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
لَّا یَعۡصُوۡنَ اللّٰهَ مَاۤ اَمَرَهُمۡ وَ یَفۡعَلُوۡنَ مَا یُؤۡمَرُوۡنَ ﴿۶﴾
অর্থাৎ- “যারা অমান্য করে না আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন তা এবং তাঁরা যা করতে আদিষ্ট হন তাই করেন”। (সুরা তাহরীম, ৬ আয়াত)।
مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡنَا وَ مَا خَلۡفَنَا আয়াতে ‘যা কিছু আমাদের সামনে আছে, আর যা আমাদের পেছনে আছে’। এখানে ‘যা কিছু সামনে’ বলতে পৃথিবীর কথা বুঝানো হয়েছে এবং ‘যা কিছু পেছনে’ বলতে কিয়ামত দিবস পরকালকে বুঝানো হয়েছে।
وَمَا بَیۡنَ ذٰلِکَ এখানে হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম যে দুইবার সিঙ্গায় ফুঁ দেবেন তার মধ্যবর্তী সময়ের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের সম্মুখে দুনিয়াতে ও পরকালের যা কিছু রয়েছে। দুনিয়াতে অতীতে যা পার করে এসেছি এবং দুনিয়াতে ভবিষ্যতে যা কিছু হবে সব কিছুই আল্লাহ তাআলার জ্ঞানের আওতাধীন। আল্লাহ তাআলা কিছুই ভুলে যান না, স্থান কাল সব কিছুই সমান তাঁর কাছে। মানুষের দৃষ্টিতে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত কাল রয়েছে, কিন্তু আল্লাহ তাআলার কাছে সবই সমান।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
আপনার রব বিস্মৃত হবার নয়। তিনি ভুলে যান না। মহান আল্লাহ তাঁর ওয়াদাপূর্ণ করবেন। তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করবেন এবং তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদেরকে রক্ষা করবেন এটাই মূল কথা। তিনি কোন কিছুই ভুলে যান না। সুতরাং তাড়াহুড়ো বা জিবরীল (আ.)কে না দেখে বিচলিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাঁর কিতাবে যা হালাল করেছেন তা হালাল আর যা হারাম করেছেন তা হারাম। যে সমস্ত ব্যাপারে চুপ থেকেছেন কোন কিছু জানাননি সেগুলো নিরাপদ। সুতরাং সে সমস্ত নিরাপদ বিষয় তোমরা গ্রহণ করতে পার, কেননা আল্লাহ ভুলে যাওয়া কিংবা বিস্মৃত হওয়ার মতো পরিস্থিতি থেকে পবিত্র। তার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করলেন। (মুস্তাদরাকে হাকিম- ২/৩৭৫, ইবনে কাসীর)।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যা হালাল বা হারাম ঘোষণা করেছেন সেগুলোও আল্লাহর পক্ষ থেকেই। কারণ, রাসূল নিজ থেকে কিছুই করেননি। শরীয়তের প্রতিটি কর্মকান্ড আল্লাহর নির্দেশেই তিনি প্রবর্তন করেছেন। যেহেতু তিনি আসমান জমিন সব কিছুর মালিক, সেহেতু একমাত্র তাঁরই ইবাদত করো এবং ইবাদতে ধৈর্যধারণ করো ও ইবাদতের উপর অবিচল থাকো।
যেমন অন্যত্র আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ اۡمُرۡ اَهۡلَکَ بِالصَّلٰوۃِ وَ اصۡطَبِرۡ عَلَیۡهَا ؕ
এবং তোমার পরিবারবর্গকে নামাযের আদেশ দাও এবং তাতে অবিচল থাক। (ত্বা-হা- ১৩২)।
এখানে سَمِیًّا শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ‘সমমান’ এটা আশ্চর্যের বিষয় বটে, মুশরিক ও প্রতিমা পূজারীরা যদিও ইবাদতে আল্লাহ তাআলার সাথে অনেক মানুষ, ফেরেশতা পাথর ও প্রতিমাকে অংশীদার করেছিল এবং তাদেরকে ‘ইলাহ’ তথা উপাস্য বলত; কিন্তু কেউ কোন দিন কোন মিথ্যা উপাস্যর নাম আল্লাহ রাখেনি। এ জন্যেই বলা হচ্ছে যে, কেউ কি আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকে এ নামে ডেকেছে?
সৃষ্টিগত ও নিয়ন্ত্রণগত ব্যবস্থাধীনেই দুনিয়াতে কোন মিথ্যা উপাস্য কখনোই ‘আল্লাহ’ নামে অভিহিত হয়নি। তাই এই প্রসিদ্ধ অর্থের দিক দিয়েও আয়াতের বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট যে, দুনিয়াতে আল্লাহর কোন সমমান নেই। নাম ও গুণাবলীতে আল্লাহ তাআলার সমতুল্য বা সমকক্ষ আর কেউই নেই। অর্থাৎ তিনি হচ্ছেন আল্লাহ, তোমাদের জানামতে দ্বিতীয় কোন আল্লাহ আছে কি? যদি না থাকে এবং তোমরা জানো যে নেই, তাহলে তোমাদের জন্য তাঁরই বন্দেগী করা এবং তাঁরই হুকুমের দাস হয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোন পথ থাকে কি? তোমরা তাঁর জন্য নির্দিষ্ট কোন নাম ও গুণ অন্যকে দিও না। সৃষ্টি জগতের কোন নাম-গুণ তাঁর জন্য সাব্যস্ত করো না। সুন্দর সুন্দর নাম ও গুণাবলী সমূহ তো একমাত্র তাঁরই জন্য। তিনিই এসব গুণে গুণান্বিত হওয়ার বাস্তবিক হকদার। যাদের কোন গুণ নেই, কাজ নেই, যাদের নামের বাস্তবতাও নেই, তারা নিজেরাও অস্তিত্বহীন হওয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। যখন তাঁর সমমান ও সমতুল্য আর কেউ নেই, তখন তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্যও নেই। কাজেই আমাদের উচিত একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করা এবং ইবাদতে ধৈর্যধারণ করা।
লেখক: মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসিসির ও সহযোগী পরিচালক, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/