আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’

।। কাজী হামদুল্লাহ ।।

ইতিহাসের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত ইসলামকে নিয়ে যত ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছে, অন্য কোন মত ও মতবাদ কিংবা ধর্ম হলে নির্ঘাত অনেক আগেই বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু মহান আল্লাহর বিশেষ কৃপা আছে বলেই টিকে আছে ইসলাম। আশা করি এবং দৃঢ় বিশ্বাস করি, এভাবেই কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে।

ইসলামকে নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করে থাকে, এদের মধ্যে বিশেষত দু’টি দল রয়েছে। এক দল সরাসরি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, অন্যদল ইসলামেরই মুখোশ পরে নামে-বেনামে কাজ করে যাচ্ছে। যারা মুখোশ পরে ইসলামের নামেই ইসলামের শেকড় কাটার চেষ্টা করছে, এদের মধ্যে একটি পুরাতন ফিরকার নাম ‘আহলে কুরআন’।

সম্প্রতি ফিরকাটি নতুনরূপে নতুন পদ্ধতি নিয়ে আমাদের সমাজে কাজ করছে। ‘মুনকিরীনে হাদীস’ হলেও এরা নিজেদেরকে পরিচয় দেয় ‘আহলে কুরআন’ বলে। যদিও এদের মৌলিক সবকিছুই কুরআনবিরোধী। কুরআন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এদের চিন্তাধারা এবং দাবি-দাওয়া।

পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ তাঁর দরসে তিরমিযিতে বলেন, এই শ্রেণির লোকগুলো পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হয়ে তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট। কিন্তু তাদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিশ্বনবীর জীবনসংশ্লিষ্ট হাদীসগুলো। যদি তারা কোনভাবে এই হাদীসকে পথ থেকে সরাতে পারে, তাহলে নিজেদের মনোবাঞ্ছা পূরণে কোন বাঁধা থাকবে না। তাই বিভিন্ন উদ্ভট যুক্তির মাধ্যমে তারা হাদীসকে নাকচ করে দিতে প্রয়াসী হয়।

আল্লামা তাকী উসমানী বলেন, তাদের তিনটি মৌলিক আকিদা বা বিশ্বাস রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা হাদীসকে অগ্রহণযোগ্য বলে থাকে। এ তিনটি ভ্রান্ত বিষয়ের মাধ্যমেই তারা সরলমনা মুসলমানদের বোকা বানাচ্ছে।

এগুলোর মধ্যে একটি হল, তারা বলে থাকেন, আল্লাহ তাআলা নবীকে পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে কুরআন পৌঁছানোর জন্য এবং কুরআন শেখানোর জন্য। সুতরাং حسبنا كتاب الله বা আমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট। কুরআনের আনুগত্য এবং কুরআনী নির্দেশনার অনুসরণ আমাদের জন্য ওয়াজিব। তবে রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণের কোন দরকার নেই। কুরআন ছাড়া অন্য কোনকিছু মানা যাবে না, অন্য কারো ইত্তিবা ও ইতাআত গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআনকে আল্লাহ তাআলা সহজও করে দিয়েছেন। যার ঘোষণা তিনি নিজেই দিয়েছেন, ولقد يسرنا القرآن ‘আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি’। এজন্য কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবেও হাদিসের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।

তাদের এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তানের বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী (রহ.) পুরো কুরআন মাজিদকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। পরে এ ব্যাপারে তিনি কুরআনুল কারীম থেকে মোট ১১০টি আয়াত বের করতে সক্ষম হয়েছেন। এসব আয়াতে কুরআনের পাশাপাশি রাসূল তথা রাসূলের হাদীস মানার কথাও বলা হয়েছে। সেইসব আয়াত থেকে অল্প কিছু আয়াতের মাধ্যমে এখানে আহলে কুরআনদের চিন্তার অসারতা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আয়াতগুলো ভালভাবে বুঝলে আপনার মনে হবে, যেন স্বয়ং কুরআনই আহলে কুরআনদের বলছে- ‘তুমি মিথ্যাবাদী’।

আয়াত-১
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
“রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা”। (সূরা হাশর- ৭)।

আরও পড়তে পারেন-

এই আয়াতে ما একটি শব্দ আছে। একে الما للموصولة বলে। যা আয়াতের অর্থে ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য এসেছে। অর্থাৎ রাসূল যা দেন বা নিষেধ করেন তা ব্যাপক। কুরআন এবং হাদীস দু’টোই এখানে শামিল। কেননা, এই ما দ্বারা ওহীর কথা বলা হয়েছে। আর ওহী দুই প্রকার। এক. যে ওহীর শব্দ এবং অর্থ সবই আল্লাহর নির্ধারণকৃত। রাসূল তা শুধু তিলাওয়াত করে শুনিয়ে দেন এবং বুঝিয়ে দেন। দুই. যে ওহীর অর্থ ও মর্ম আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে দেন। তবে শব্দ নির্ধারণের এখতিয়ার থাকে রাসূলের। প্রথম প্রকারকে বলে ‘ওহীয়ে মাতলু’ যা কুরআন। দ্বিতীয় প্রকারকে বলে ‘ওহীয়ে গাইরে মাতলু’; অন্য ভাষায় একেই বলা হয় হাদীস।

উল্লিখিত আয়াতে ما ব্যাপক অর্থে হওয়ায় উভয় ওহীই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের পাশাপাশি হাদীসকেও মানতে হবে। এটা কুরআনেরই একটি হুকুম।

আয়াত-২
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
হে নবী, বলে দিন- যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান- ৩১)।

এই আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর ভালবাসা পেতে হলে রাসূলের অনুসরণ করতে হবে। জীবনের পাপ মোচন করতে হলে রাসূলের অনুসরণ করতে হবে। আর এ দু’টি জিনিসের মাধ্যমেই মানুষ মুক্তি পাবে। অর্থাৎ- ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির জন্য রাসূলের আনুগত্য বাধ্যতামূলক। আর রাসূলের আনুগত্য দুইভাবে হয়ে থাকে- ওহীয়ে মাতলু’ এবং ওহীয়ে গাইরে মাতলু’ দ্বারা। উল্লিখিত আয়াতের ‘ইত্তিবা’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে উভয় ওহী তথা কুরআন ও হাদীস দু’টোকেই শামিল করে।

তাফসীরে তাবারীতে বলা হয়েছে, রাসূলের যুগে কিছু লোক বলতে লাগলো- نحن نحب ربنا আমরা আমাদের রবকে ভালবাসি। তাফসীরে ওয়াজিয এবং তাফসীরে বাগবীতে বলা হয়েছে যে, এই লোকগুলো ছিল কুরাইশের মূর্তিপূজক। আল্লাহর রাসূল যখন তাদেরকে মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করলেন, তখন তারা বলতে লাগলো- আমরা আল্লাহকে পাওয়ার জন্যই মূর্তিপূজা করছি। আল্লাহ তাআলা তাদের উদ্দেশ্যে উল্লিখিত আয়াত নাযিল করে জানিয়ে দিলেন যে, আল্লাহকে ভালবাসার আলামত শুধু আল্লাহ আল্লাহ করা নয়, মূর্তিপূজায় লিপ্ত হওয়া নয়। বরং রাসূলের আনুগত্য করাই আল্লাহকে ভালবাসার নিদর্শন। তাবারী এটাই বলেছেন- فجعل إتباع نبيه محمد صلى الله عليه وسلم علما لحبه و عذاب من خالفه এ আয়াতের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর আনুগত্যকে খোদাপ্রেমের নিদর্শন বানানো হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণকে শাস্তির নিদর্শন করা হয়েছে।

আয়াত-৩
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
“নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম অনুপম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং অধিক পরিমাণ আল্লাহকে স্মরণ করে”। (সূরা আহযাব- ২১)।

এই আয়াতের মধ্যে ‘উসওয়াতুন হাসানা’ দ্বারাও ওহীয়ে গাইরে মাতলু’ তথা হাদীস অনুসরণের কথা এসেছে। তাফসীরে ইবনে কাসীরে বলা হয়েছে-
هذه الآية الكريمة أصل كبير في التأسي برسول اللّه صلى اللّه عليه وسلم، في أقواله وأفعاله وأحواله
অর্থাৎ- ‘এ আয়াত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সমস্ত কথা, কাজ ও অবস্থা অনুসরণযোগ্য হবার একটি বড় প্রমাণ’।

আয়াত- ৪
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
“তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন কথা বলেন না; বরং তিনি তা-ই বলেন, যা আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে তাঁকে জানাতে বলেন”। (সূরা নাজম-৩-৪)।

এই আয়াতের মধ্যেও যে ওহীর কথা এসেছে তার অর্থ ব্যাপক। অর্থাৎ ‘ওহীয়ে মাতলু ও গাইরে মাতলু’ তথা কুরআন ও হাদীস দু’টোই শামিল। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, তিনি যা কিছুই বলেন, আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ীই বলেন।
এ আয়াতে ‘ওহীয়ে গাইরে মাতলু’ তথা হাদীস সম্পর্কে তাফসীরে রাযিতে এসেছে-

{هو} ضمير معلوم أو ضمير مذكور ؟. نقول : فيه وجهان : أشهرهما : أنه ضمير معلوم وهو القرآن . كأنه يقول : ما القرآن إلا وحي ৃ والوجه الثاني : أنه عائد إلى مذكور ضمناً وهو قول النبي صلى الله عليه وسلم وكلامه . وذلك لأن قوله تعالى : { وَمَا يَنطِقُ عَنِ الهوى } في ضمنه النطق ، وهو كلام وقول ، فكأنه تعالى يقول : وما كلامه وهو نطقه إلا وحي

তাফসীরের সারাংশ অনুবাদ: এই আয়াতে هو সর্বনামটি যমীরে মা’লুম নাকি যমীরে মাযকুর? (সহজ ভাষায় যমীরে মা’লুম হল, যার মারজা বা উদ্দিষ্ট পূর্বে উল্লেখ নেই তবে জানা আছে। আর যমীরে মাযকুর হল, যার মারজা পূর্বে উল্লেখ আছে।) এখানে দু’টি দিকই নেয়া যায়। প্রসিদ্ধতম দিক হল, এটা যমীরে মা’লুম, অর্থাৎ- কুরআনুল কারীম। যেমন, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ما القرآن إلا وحي “কুুরআন ওহী ছাড়া অন্য কিছু নয়”। দ্বিতীয় দিক হল, এটা যমীরে মাযকুর। অর্থাৎ যার মারজা’ পূর্বে অভ্যন্তরীণভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সেটা হল, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা তথা হাদীস। আর এটা এজন্যই যে, পূর্বের আয়াত وَمَا يَنطِقُ عَنِ الهوى এর মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে نطق এসেছে, যা কালাম ও কওলের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন আল্লাহ বলেছেন- وما كلامه وهو نطقه إلا وحي “তিনি ওহী ছাড়া কথাবার্তা বলেন না”।

উল্লিখিত চারটি আয়াতের প্রত্যেকটি আয়াতের মাধ্যমে এই বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় রাসূল এবং হাদীসে রাসূলকে মান্য করা বাধ্যতামূলক করেছেন। এরপরও কেউ যদি বলে যে, আমি কেবল কুরআনকেই মানবো, হাদীস মানার কোন প্রয়োজন নেই, তাহলে সে হয়তো জ্ঞানহীন কিংবা জ্ঞানপাপী। এদের থেকে সাবধান থাকা সকল মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।

লেখক: সম্পাদক, প্রবচন সাহিত্য সাময়িকী।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।