ইবরাহীম (আ.)কে পিতার গৃহ ত্যাগের নির্দেশ

।। আল্লামা মুফতি জসীমুদ্দীন ।।

মহান আল্লাহ সূরা মারয়ামের ৪৬-৫০ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-
قَالَ أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آلِهَتِي يَا إِبْرَاهِيمُ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا (৪৬) قَالَ سَلَامٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا (৪৭) وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَأَدْعُو رَبِّي عَسَى أَلَّا أَكُونَ بِدُعَاءِ رَبِّي شَقِيًّا (৪৮) فَلَمَّا اعْتَزَلَهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَكُلًّا جَعَلْنَا نَبِيًّا (৪৯) وَوَهَبْنَا لَهُمْ مِنْ رَحْمَتِنَا وَجَعَلْنَا لَهُمْ لِسَانَ صِدْقٍ عَلِيًّا (৫০)

তরজমা: (৪৬) তার পিতা বলল, ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে বিমুখ? তুমি যদি এর থেকে নিবৃত্ত না হও, তবে আমি অবশ্যই তোমার উপর পাথর নিক্ষেপ করব। আর এখন তুমি চিরদিনের জন্য আমার থেকে দূর হয়ে যাও। (৪৭) ইবরাহীম বলল, আপনার প্রতি (বিদায়ী) সালাম। আমি আমার প্রতিপালকের কাছে আপনার মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করব। নিঃসন্দেহে তিনি আমার প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। (৪৮) আমি আপনাদের থেকেও পৃথক হয়ে যাচ্ছি এবং আপনারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করেন তাদের থেকেও। আমি আমার প্রতিপালককে ডাকতে থাকব। আমি আমার প্রতিপালককে ডেকে ব্যর্থকাম হব না। (৪৯) সুতরাং যখন সে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে (অর্থাৎ যেই প্রতিমাদেরকে) ডাকত তাদের থেকে পৃথক হয়ে গেল, তখন আমি তাকে ইসহাক ও ইয়াকুব (এর মতো সন্তান) দান করলাম এবং তাদের প্রত্যেককে নবী বানালাম। (৫০) এবং তাদেরকে দান করলাম আমার রহমত আর তাদের দিলাম সমুচ্চ সুখ্যাতি। (সূরা মারয়াম)।

তাফসীর: গত সংখ্যার তাফসীরে হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর পিতা আযরকে দরদমাখা কণ্ঠে যে নসীহত করেছেন, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পিতা আযর নবী ইবরাহিমকে কী উত্তর দিয়েছেন, তা এখানে আলোচনা করা হবে।

তার পিতা বলল, ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে বিমুখ? তুমি যদি এর থেকে নিবৃত্ত না হও, তবে আমি অবশ্যই তোমার উপর পাথর নিক্ষেপ করব। আর এখন তুমি চিরদিনের জন্য আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও। অর্থাৎ, আমি আমার উপাস্যদের নিন্দা-অপমান বরদাশত করতে পারবো না। তুমি যদি তাদের নিন্দা করা থেকে বিরত না হও, তাহলে আমি তোমার উপর পাথর নিক্ষেপ করবো এবং কঠিন শাস্তি দিবো। তার চেয়ে ভালো হয়, এর আগেই তুমি আমার সম্মুখ থেকে দূর হয়ে যাও, অন্য কোথাও চলে যাও।

হযরত ইবরাহীম (আ.) পাথরের জবাব ফুল দিয়ে দিলেন। তিনি পিতা আযরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার প্রতি (বিদায়ী) সালাম। আমি আমার প্রতিপালকের কাছে আপনার মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করব। নিঃসন্দেহে তিনি আমার প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। আমি আপনাদের থেকেও পৃথক হয়ে যাচ্ছি এবং আপনারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করেন তাদের থেকেও। আমি আমার প্রতিপালককে ডাকতে থাকব। আমি আমার প্রতিপালককে ডেকে নিরাশ হবো না।

আরও পড়তে পারেন-

পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি

হযরত ইবরাহীম যখন দেখলেন, তাঁর দরদী নসীহতের বিপরীতে পিতার পক্ষ থেকে পাথর বর্ষিত (বিরূপ প্রভাব) হচ্ছে, তখন তিনি শেষ কথা হিসেবে পিতাকে সালাম বললেন এবং পিতার কাছ থেকে পৃথক হওয়ারও (হিজরত করার) ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। হযরত ইবরাহীমের এই সালাম, বিদায় এবং পৃথক হওয়ার সালাম। অর্থাৎ- যখন আপনার সাথে আমার মতের মিল হচ্ছে না, সুতরাং আপনাকে সালাম, আপনার কাছ থেকে আমি পৃথক হলাম। এখানে ফিকহি মাসআলা- কাফেরকে সালাম দেওয়া যাবে কি যাবে না? সেই প্রসঙ্গ নিয়ে আসা উচিত হবে না।

হযরত ইবরাহীম (আ.) একজন বড় নবী ও আল্লাহ তাআলার খলীল হওয়া সত্ত্বেও তিনি এ কথা বলেননি যে, আল্লাহ তাআলা আমার দুআ কবূল করবেনই; বরং তিনি বলেন, আমি আশা করি আমার রবকে ডেকে ব্যর্থ ও বঞ্চিত হবো না। অর্থাৎ আমার একাকিত্বেও তিনি আমাকে সাহায্য করবেন- এখানে আমাদের জন্য অনেক বড় আদব রয়েছে।

শেষ পর্যন্ত হযরত ইবরাহীম (আ.) পিতা ও পিতার পরিবার ত্যাগ করে হিজরত করলেন। বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাঁকে রহমত ও বরকত দ্বারা আবৃত করে নিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, সুতরাং যখন সে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে (অর্থাৎ যেই প্রতিমাদেরকে) ডাকত তাদের থেকে পৃথক হয়ে গেল, তখন আমি তাকে ইসহাক ও ইয়াকুব (এর মতো সন্তান) দান করলাম এবং তাদের প্রত্যেককে নবী বানালাম। এবং তাদেরকে দান করলাম আমার রহমত আর তাদের দিলাম সমুচ্চ সুখ্যাতি। অর্থাৎ ইবরাহীম আ. যখন পরিবার ছেড়ে হিজরত করলেন, আল্লাহ তাআলা তাঁকে উত্তম পরিবার ও সন্তান-ছেলে ইসহাক (আ.) এবং নাতি ইয়াকুব (আ.) দান করলেন। তাঁর বংশে অনেক নবী প্রেরণ করেছেন, তাঁদের উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত যাদের নাম সম্মানের সাথে উচ্চারিত হতে থাকবে। হযরত ইবরাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকুব এই তিন নবীর নাম মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান প্রত্যেকেই সম্মান এবং মর্যাদার সাথে উচ্চারণ করে। মুসলমানগণ প্রত্যেক নামাযেই তাদের উপর দরুদ পড়েন।

এখানে বড় সন্তান হযরত ঈসমাইল (আ.) (আ.)এর আলোচনা করা হয়নি। কারণ, তিনি শৈশবেই হযরত ইবরাহীম থেকে আল্লাহর নির্দেশে পৃথক (মক্কায় হিজরত) হয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে হযরত ইসহাক শাম দেশে পিতা ইবরাহীমের সাথেই ছিলেন।

হযরত ইবরাহীম (আ.)এর এই ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মক্কার মযলুম মুসলমানদের সাথে ভালোভাবে মিলে যায়। মক্কায় মুসলমানদের আত্মীয়-স্বজনরা ছিল মুশরিক। আযর হযরত ইবরাহীমের সাথে যে আচরণ করত, মক্কার মুশরিকরাও মুসলমানদের সাথে সেই আচরণ করত। শেষ পর্যন্ত মক্কায় মুসলমানগণের জীবন সঙ্কীর্ণ হয়ে গেলে তারা সেই কাজই করে, যা হযরত ইবরাহীম (আ.) করেছিলেন। মুসলমানগণ প্রথমে মক্কা থেকে হাবশায় হিজরত করেন, এরপর মদীনায়। হিজরতের পর আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের উপর বরকত নাযিল করেন। আনসার এবং মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে দেন। এমন ভাতৃত্ববোধ যা রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ের চেয়েও বেশি ছিল।

লেখক: মুহাদ্দিস, মুফতি ও নায়েবে মুহতামিম- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।