ইসলামের পরিবেশ সুরক্ষা নীতি: আমাদের করণীয়

।। মাওলানা মুহাম্মদ নোমান আল-আযহারী ।।

১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রতি বছর ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখন থেকে সারাবিশ্বের মত বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচিতে দিবসটি পালিত হয়ে আসলেও দেশটিতে পরিবেশ দূষিত হওয়ার মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শিল্প বর্জ্য, মেডিক্যাল বর্জ্য, প্রাণিজ এবং অন্যান্য বর্জ্য-সহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ যেন আজ স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে- যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের উপর। জলবায়ুর প্রতিকূল প্রভাবও পরিবেশের উপর পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন প্রাণীর জটিল ও কঠিন রোগ দেখা দিচ্ছে। পরিবেশের উপর জলবায়ুর প্রভাবের জন্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত, খাদ্যাভাবজনিত রোগ-সহ নানা জটিল ও অপরিচিত রোগ হয়ে থাকে। বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। আর বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বিশ্বের ১৭৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে পেছনে বাংলাদেশের অবস্থান। গত এক যুগে দূষণ ও পরিবেশের বিচারে বাংলাদেশ পিছিয়েছে।

পরিবেশের বিপর্যয় মানে জীবনের বিপর্যয়। এগুলো অত্যন্ত ভয়ংকর পরিণতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। যার কিছুটা আমরা এরই মধ্যে টের পেতে শুরু করেছি। শীত-বর্ষা-গ্রীষ্মের মৌসুম প্রায় উলট-পালট হয়ে গিয়েছে। বর্ষার ভরা মৌসুমে খরার মুখে পড়ে পুড়ছে দেশের সবুজ মাঠ। আবার শীতের মৌসুমে ঘন বৃষ্টি এবং জলোচ্ছ্বাসের মতো ঘটনাও ঘটছে প্রতি বছর। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে কৃষিকাজে। গ্রাম বাংলার চিরাচরিত ফসলের মৌসুমগুলো যেন আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে।

এই বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংস্থার উদ্যোগে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সেগুলো কেবল কিছু নাম সর্বস্ব কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকছে। সরকার থেকে জনগণ- কেউই পরিবেশ বিষয়ক নির্দেশনাগুলোকে আমলে নিচ্ছে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসন আর পুঁজিবাদী শকুনদের কায়েমি স্বার্থের কাছে বিকিয়ে দেয়া হচ্ছে দেশ, জাতি এবং আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।

পরিবেশ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Environment. এর অর্থ বেষ্টন করা বা ঘেরা। পরিবেশ বলতে আমরা আমাদের পারিপার্শ্বিক জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতিগত সকল উপাদানের যৌথ প্রভাব ও পারস্পারিক অবস্থানকে বুঝে থাকি। ড. এফ. এম. মনিরুজ্জামান বলেন, “আমরা আমাদের চারপাশে যা দেখি বা যে সমস্ত জটিল উপাদানসমূহ বা বস্তু সম্ভার আমাদের স্বাস্থ্য, ভাল-মন্দ ও সুখ-দুঃখের উপর কর্তৃত্ব করে, তা দিয়েই গড়ে উঠে আমাদের পরিবেশ। এক কথায় প্রকৃতির সঙ্গে জীব জগতের যে সম্পর্ক ও সহাবস্থান, মূলত তাকেই পরিবেশ বলা হয়”।

মানুষের চারপাশে প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট অন্যান্য উপাদান মিলে গড়ে ওঠে পরিবেশ। যদি কোনো কারণে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের কাক্সিক্ষত মাত্রা বিনষ্ট হয় বা পরিবেশ জীব জগতের জন্য অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠে, সেই অস্বাস্থ্যকর অবস্থাকে পরিবেশ দূষণ বলে। পরিবেশ দূষণের জন্য পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ দু’ধরনের কারণ শনাক্ত করেন। প্রাকৃতিক কারণ ও মানবসৃষ্ট কারণ। পরিবেশ দূষণের জন্য যে সব প্রাকৃতিক কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী, তার মধ্যে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প ইত্যাদি অন্যতম। পরিবেশ দূষণের মানবসৃষ্ট কারণগুলো হচ্ছে- বনভূমি উজাড় বা বৃক্ষ নিধন, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি দূষণ, আর্সেনিক দূষণ ইত্যাদি।

ইসলামের পরিবেশ সুরক্ষা নীতি

পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার জন্য জনগণকে সচেতন করা, পরিবেশ সুস্থ রাখা ও পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ইসলামে। পরিবেশ সুরক্ষায় ইসলামের কিছু খন্ডিত বক্তব্য এবং দু’চারটি নীতিকথা উল্লেখ করার চেয়ে এই প্রসঙ্গে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ মৌলিক দর্শনটা কি- সেটা তুলে ধরা বেশি জরুরি মনে করছি। ইসলামের ‘পরিবেশ সুরক্ষা নীতি’ মূলত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ‘নির্দেশনা ও বিশ্বাসে’র উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন-

১. আকীদায়ে তাওহীদ। তাওহীদের মর্মকথা হচ্ছে, বান্দার সকল কিছুর মালিক এক আল্লাহ। তিনিই তাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই রিযিক দেন। তিনিই তার সকল কল্যাণ সাধন করেন। তিনই জীবন-মৃত্যু সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক। অতএব, সে তার প্রতিটি কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির পরোয়া করতে বাধ্য। প্রতিটি পদক্ষেপে মহান রবের নির্দেশ মতো চলা তার তাওহীদের দাবি। তিনি ব্যতীত আর কারো সামনে সে মাথা নোয়াতে পারে না। এভাবেই ‘তাওহীদ’ একজন মুসলিমের পুরো জীবনকে, জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং তার চতুর্পাশের পরিবেশের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা কি- সেই ব্যাপারে পূর্ণ সতর্ক থাকা এবং সে অনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালিত করা একজন তাওহিদবাদী মুসলমানের ঈমানী দায়িত্বের অংশ। পরিবেশ বিনষ্টকরণে যে যতোটুকু দায়ী থাকবে, সে ততটুকুই যেন ঈমানের ভিত্তিমূলে আঘাত করলো।

২. ‘তাওহীদ’-এর বিশ্বাস থেকে আরেকটি বিশ্বাস উদ্ভুত হয়; সেটা হচ্ছে, ‘খিলাফত ও আমানত’। এর সারমর্ম হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা যত মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে একমাত্র মানুষেরই অনুভূতি শক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি রয়েছে। এজন্যই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ আর অন্যান্য সৃষ্টিকূলের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেটা হচ্ছে জ্ঞান। এই জ্ঞানের কারণে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে খলীফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে ফাসাদ ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আর আমরা আপনার হামদসহ তাসবীহ পাঠ করি এবং পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি তা জানি, যা তোমরা জান না। (সূরা বাকারা- ৩০ আয়াত)।

অতএব, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে এই পৃথিবীকে ‘তা’মীর’ করার জন্য। সকলের জন্য উপযুক্ত এবং বাসযোগ্য করে এই পৃথিবীকে গড়ে তোলার জন্য। এমনকি আল্লাহ প্রথম দিকে এমন অনেক নবী পাঠিয়েছিলেন, যাদের দায়িত্ব ছিলো কেবলমাত্র মানুষকে ব্যাবহারিক বিষয়াদি শিক্ষা দেয়া। মানুষের ‘খলীফা’ বা প্রতিনিধি হওয়ার ধারণা থেকে আরেকটি প্রসঙ্গ সামনে আসে, সেটা হচ্ছে ‘আমানত’। অর্থাৎ- যেহেতু মানুষ এই ভূমিতে আল্লাহর প্রতিনিধি, তাই তার হাতের নাগালের সকল সম্পদ, সহায়-সম্পত্তি এবং পরিবেশ-প্রকৃতি সবকিছুই তার হাতে মহান রবের পক্ষ হতে প্রদত্ত আমানত। সে এগুলোর সার্বভৌম বা একচ্ছত্র মালিক নয়। বরং প্রকৃত মালিক আল্লাহ। এগুলো তাকে সাময়িকভাবে ব্যাবহার করার জন্য দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এগুলো অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করা হবে। এমন কি সে তার নিজের শরীর এবং জীবনেরও প্রকৃত মালিক নয়। বরং সেটাও তার কাছে রক্ষিত আমানত। এই কারণেই তার আত্মহত্যা করার অনুমতি নেই। সুতরাং সে কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছে মতো এসব  সম্পদে  বা  প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বরং এগুলো ব্যাবহার করার ক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মানতে হবে, যাতে সে তার কর্মের কারণে নিজের ক্ষতি সাধন করার পাশাপাশি অন্যের ক্ষতি সাধন না করে। তার হাতের গচ্ছিত সম্পদ এবং চতুর্পাশের পরিবেশ প্রকৃতিকে যাতে সে অন্যের ব্যাবহারের উপযোগী অবস্থায় রেখে যেতে পারে।

অধিকন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিবেশকে একেবারে দুর্বোধ্য করেও সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ মানুষকে পরিবেশ-প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি ‘ইলমে’র অমূল্য সম্পদ দান করেছেন। যাতে মানুষ তার লব্দ জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে সৃষ্টিজগতের রহস্য ও গূঢ়তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে পারে। কুরআন মাজিদের ৭৫৬টি আয়াতে আল্লাহ তাআলার কুদরতের নিদর্শনা নিয়ে গবেষণার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

মানুষ এসব নিয়ে যখন চিন্তা গবেষণা করবে, তখন যেমন তার আল্লাহ তাআলার কুদরত ও অসীম ক্ষমতার প্রতি ঈমান মজবুত হবে, তেমনি মাখলুকাতের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের উপলব্ধি জন্ম নেবে এবং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক সুন্দর হবে। এভাবেই বান্দার মাঝে  ‘খিলাফত’, ‘আমানত’ এবং ‘ইলম’ এর সমন্বয়ে পরিবেশের প্রতি একটি পরিপূর্ণ দায়িত্বশীল মূল্যবোধ গড়ে উঠে।

৩. ‘হুকুকুল ইবাদ’। সবার প্রতি ন্যায়সংগত ও যথাযথ কর্তব্য পালন ইসলামের পরিভাষায় ‘হুকুকুল ইবাদ’ হিসেবে পরিচিত। সে হিসেবে প্রকৃতি এবং আপনার চতুর্পাশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আপনার যেমন অধিকার রয়েছে, তদ্রুপ অন্যেরও সমান অধিকার রয়েছে। সেগুলোর সুরক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব না দেয়া হলে সেটা পরের হক বিনষ্ট করার মতো মারাত্মক গোনাহ হিসেবে বিবেচিত হবে। ইসলামের নীতি অনুযায়ী বান্দার হকের প্রতি পূর্ণ সচেতন থাকা নৈতিকতা ও সচ্চরিত্রের আওতায় পড়ে। এসব নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব এতই যে, ইসলামে আল্লাহর ইবাদতগুলোর পাশাপাশি জোর দেওয়া হয়েছে হুকুকুল ইবাদ বা মাখলুকাতের প্রাপ্য আদায়ের উপর। আর একজন মানুষের জীবনে তার স্রষ্টার প্রতি করণীয় ও সৃষ্টি জগতের প্রতি কর্তব্য ছাড়া আর কিইবা থাকতে পারে!  সুতরাং এ ব্যাপারে জাতিসংঘ কনভেনশন বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার নির্দেশনা ও সনদের চেয়ে মুসলিম উম্মাহর জন্য বেশি দাবি রাখে ইসলামের শিক্ষা। ভূগোলকের নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষার জন্য ইসলামে রয়েছে সর্বজনীন শিক্ষার গুরুত্ব। মানবজাতির পার্থিব জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও সাফল্যের চূড়ান্ত নির্দেশনা গ্রন্থ কুরআনুল কারিমে এবং আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের নমুনা রাসূল (সা.) এর সুন্নাহে মানুষ, সৃষ্টিকূল, প্রকৃতি ও এসবের মধ্যকার সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, সুস্পষ্ট করা হয়েছে পরিবেশ নীতি, যা পালন করা মানুষের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে গণ্য।

৪. ‘আদল ও ই’তিদাল’ তথা উপযুক্ততা ও ভারসাম্য। মহান সৃষ্টিকর্তা সকল কিছুকে অত্যন্ত সাজুয্যভাবে এবং ভারসাম্যপূর্ণরূপে সৃষ্টি করেছেন। সবকিছুকে পরিমান মতো সৃষ্টি করেছেন। বাতাসের মধ্যে গ্যাসের ভারসাম্য রেখেছেন। নাইট্রোজেন শতকরা ৭৮, অক্সিজেন ২১ ও অন্যান্য গ্যাসের পরিমাণ ১ ভাগ। অক্সিজেনের পরিমাণ যদি কম বা বেশি হয়ে যায়, তাহলে সৃষ্টিজগতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। অতএব, আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, সুস্থ জীবনযাপনের স্বার্থে প্রকৃতির এই ভারসাম্যকে রক্ষা করা। এমন যেকোন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা যেগুলো পরিবেশের ভারসাম্যকে নষ্ট করে। কারণ, এর ফল অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে থাকে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মানুষ নিজেরাই এ বিপর্যয় ডেকে আনছে। গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানার বর্জ্য, আবহাওয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনো-অক্সাইডের মতো মারাত্মক গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। কিন্তু গাছপালা লাগানো বা বনায়নের প্রতি উৎসাহ না দিয়ে বরং তা কেটে ফেলে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।

অতএব, পৃথিবীর রক্ষা ও পরিবেশের নিরাপত্তা প্রযুক্তির সঙ্গে নয়, বরং মানুষের আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাইরের সঙ্গে নয়, ভেতরের সঙ্গে এবং শরীরের সঙ্গে নয়, আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত। পৃথিবীর সব বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে মানুষের বস্তুতান্ত্রিকতা, যা স্রষ্টা ও ধর্মের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে জন্ম নিয়েছে। সুতরাং এ বিপর্যয় রোধ করার জন্য শুধু বস্তুতান্ত্রিক কর্মকৌশল কার্যকর হবে না। মানুষ যখন সদা সর্বত্র বিরাজমান সত্তা অর্থাৎ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সম্পর্ক কায়েম করবে, তার আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী পৃথিবীতে বিরাজিত আল্লহার নেয়ামতগুলো ভোগ ও ব্যবহার করবে, তখনই পৃথিবীর বিপর্যয় রোধ হবে।

অতএব, ইসলামি জীবন দর্শনে পরিবেশ নৈতিকতার দিক হলো, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগৎ ও এখানকার প্রতিটি বস্তু একটি বিশেষ মাত্রা, পরিমাণ ও অনুপাতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের দায়িত্ব এ মাত্রা রক্ষা করা। এটি অনর্থক নয়। বরং এই অনুপাত ও ভারসাম্য রক্ষার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। মানুষের জন্যই সৃষ্টিজগতের এ ভারসাম্য মেনে চলা কল্যাণকর, আর তা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।

৫. ‘ইস্তেহসান’। এর সারকথা হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত সকল নিয়ামতকে সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতিতে ব্যাবহার করা। এমনভাবে ব্যাবহার না করা- যার দরুন উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয়। কিংবা আপনি উপকৃত হলেও সেটা অন্যের ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথবা সেটার কারণে পরিবেশদূষণের মতো ঘটনা ঘটে। ফিকহে ইসলামির বড় একটি অংশ এই নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আপনি নদী-নালার পানি এমনভাবে ব্যাবহার করতে পারবেন না, যার কারণে অন্যের ফসল শুকিয়ে মরে যায়। আপনি এমন কোন কলকারখানা স্থাপন করতে পারবেন না, যা পাশে বসবাসরত মানুষের ক্ষতির কারণ হয়।

৬. হালাল-হারাম। ইসলামে হালাল হারামের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর সাথে পরিবেশ প্রকৃতিও জড়িত। অর্থাৎ- আল্লাহ যা কিছু হারাম করেছেন সেগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই বান্দার জন্য কোন অকল্যাণ রয়েছে। আল্লাহ সবকিছু নিজেই সৃষ্টি করেছেন। তাই তিনিই এগুলোর উপকার এবং অপকারীতার ব্যাপারে সম্যক জ্ঞাত। আল্লাহ বলছেন, “তিনিই কি সর্বাধিক জ্ঞাত নন; যিনি সৃষ্টি করেছেন?” (সূরা মুলক- ১৪ আয়াত)।

অতএব, আল্লাহ যেসকল কাজকর্ম হারাম করেছেন বা যেসকল পদ্ধতিকে হারাম করেছেন, সেগুলোর মধ্যে বান্দার পার্থিব ক্ষতিও নিহিত রয়েছে। তাই হারাম কর্মে লিপ্ত হওয়ার পরিণতি কেবল ‘গুনাহ’-এর মধ্যেই সীমিত নয়; বরং এর পার্থিব রিয়েকশনও রয়েছে। সুতরাং পরিবেশ- প্রকৃতির ক্ষেত্রেও হালাল-হারামের বিষয়টির প্রতি পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। পরিবেশ-প্রকৃতির সাথে যদি আমরা হারাম পদ্ধতিতে আচরণ করি, তাহলে তা আমাদের জন্য আল্লাহর অসন্তুষ্টির পাশাপাশি পার্থিব গজবও ডেকে আনবে।

৭. ‘ইসরাফ’ না করা। আরবী ‘ইসরাফ’ (إسراف) শব্দের অর্থ হল- সীমালঙ্ঘন, অপচয়, অপব্যয়, অমিতব্যয়, বাড়াবাড়ি, মাত্রাতিরিক্ততা, অপরিমিতি ইত্যাদি। ইসলাম একদিকে যেমন হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জনের নির্দেশ দিয়েছে, অপরদিকে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ বৈধ পথে ব্যয় করারও নির্দেশ দিয়েছে। মানব সমাজে অর্থ ও সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয় ও অপব্যয় আজ একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অথচ ইসলাম এটিকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলছেন, ‘তোমরা এগুলির ফল খাও যখন তা ফলবন্ত হয় এবং এগুলির হক আদায় কর ফসল কাটার দিন। আর তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’। (আন’আম- ৬/১৪১)।

অতএব, প্রাকৃতিক যেকোন সম্পদ ভোগ করার ক্ষেত্রে কোনভাবেই সীমালঙ্ঘন করা যাবে না। করলে তার পরিণতি খারাপ হতে বাধ্য। উদাহরণস্বরূপ পানির কথা বলা যেতে পারে। পানির অপব্যয় সামনে কী পরিমাণ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে- সেটা বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে উঠে এসেছে।

এভাবেই তাওহীদ, খেলাফত, আমানত, হক্কুল ইবাদ, ই’তিদাল, ইস্তিহসান এবং হালাল-হারামের সমন্বয়ে ইসলামের ‘পরিবেশ সুরক্ষা নীতি’ গড়ে উঠেছে। মোটাদাগে ইসলামের পরিবেশ-নীতিকে বুঝতে হলে এই বিষয়গুলোকে সামনে রাখতে হবে।

পরিবেশ সুরক্ষা ও ফিকহে ইসলামী:

ফিকহে ইসলামির কায়দাগুলো (মূলনীতিগুলো) এমনভাবে গঠন করা হয়েছে, যাতে সেগুলো বান্দার গোটা জীবনকে ব্যাখ্যা এবং পরিচালিত করতে পারে।

আমরা যদি ফিকহের মৌলিক কাওয়ায়েদগুলো দেখি, তাহলে সেখানেও দেখতে পাব যে সেগুলোর মধ্যে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি সুপ্তভাবে বিদ্যমান। নিম্নে এরকম কয়েকটি নীতি উল্লেখ করা হলো-

১. ্রالضرر يزال

অর্থাৎ- ক্ষয়ক্ষতিকে অপসারণ/বিলুপ্ত করা যাবে। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের সম্পদ ইচ্ছে মতো ভোগ-দখল করতে পারবে। তবে শর্ত হচ্ছে, এর কারণে যাতে নিজের বা অন্যের কোন ক্ষতি না হয়। যদি এমন কিছু হয়, তাহলে সরকার বা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ তাকে সে কাজ থেকে বাধা দিতে পারবে।

২. ্রدرء المفاسد مقدم على جلب المنافع

অর্থাৎ, ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা উপকার লাভ করার চেয়ে শ্রেয়। সুতরাং যদি কেউ নিজে উপকৃত হওয়ার জন্য পরিবেশ প্রকৃতিকে কিংবা নিজের সম্পদকে এমনভাবে ব্যাবহার করে যার দ্বারা লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি, কিংবা তার লাভ হলেও অন্যের ক্ষতি হওয়ার আশংকা প্রবল; তাহলে সে এই কাজ পরিহার করতে বাধ্য। তাকে এই কাজ থেকে বিরত রাখার অধিকার সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষের আছে।

৩. ্রالضرر لا يزال بضرر مثله

অর্থাৎ- কোন ক্ষতিকে তার সমপরিমাণ ক্ষতি দ্বারা অপসারণ করা যাবে না। অতএব, কেউ যদি ক্ষতিকর কোন কাজ করে, সেটাকে অপসারণ/বিলুপ্ত করার জন্য এর চেয়েও বড় কোন ক্ষতিকর কর্ম করা যাবে না। কেউ যদি কার্বন উদগীরণ করে এমন কোন কারখানা তৈরি করে, সেটাকে উৎখাত করার জন্য সেখানে ময়লার ডিপো তৈরি করা যাবে না।

৪. تحمل الضرر الخاص لدفع ضرر عام

অর্থাৎ, সর্বসাধারণকে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য কারো ব্যক্তিগত ক্ষতিকে মেনে নেয়া। অতএব, কারো ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবহার করার কারণে যদি সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়ে, তাহলে তাকে সেই সম্পদ ব্যবহার করা থেকে বাধা প্রদান করা যাবে।

এরকম আরও কয়েকটি মূলনীতি হচ্ছে-

الضرر يزال بقدر الإمكان. / الضرر الأشد يزال بالأخف. /

يختار أهون الشرين أو أخف الضررين. / الموازنة بين المصالح. / ما جاز بعذر بطل بزواله. / ما يؤدي إلى الحرام فهو حرام. / ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب.

পরিবেশ সুরক্ষায় ইসলাম:

মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। সে হিসেবে মানুষের চলাফেরা, আচার-ব্যবহার, আখলাক-চরিত্র, রুচিবোধ, মননশীলতা- সবকিছু শ্রেষ্ঠ হবে, এটাই স্বাভাবিক। একই সঙ্গে মানুষ সামাজিক জীব, মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে; তাই মানুষের নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি জীবনকে আরও সুন্দর ও উপভোগ্য করার জন্য সামাজিক পরিবেশের উন্নতি করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা এবং সুন্দর পরিবেশ তৈরির জন্য যুগে যুগে আল্লাহপাক নবী-রাসূলদেরও নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি হযরত নূহ (আ.)এর পূর্ব পর্যন্ত নবীদের প্রধান কাজ ছিল মানব বসবাসের উপযোগী সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা। ইসলামের উদ্দেশ্যও হলো ‘দুনিয়ার শান্তি ও পরকালে মুক্তি’।

আরও পড়তে পারেন-

আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য চারপাশে যা কিছু আছে- আলো, বাতাস, পানি, বায়ু, গাছগাছালি; সবই মহান আল্লাহর দান। এর কোনোটির অপ্রতুলতা আমাদের কখনও কখনও চিন্তায় নিমজ্জিত করে। আজকের বিশ্বব্যাপী ভাইরাসের চিকিৎসায় অক্সিজেন একটি নিয়ামক শক্তি। এই অক্সিজেনের সম্পর্ক কিন্তু গাছের সঙ্গে। আমাদের শরীর থেকে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, গাছ তা গ্রহণ করে আমাদের অক্সিজেন দিয়ে সাহায্য করে। এই গাছ সম্পর্কে কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘আর তিনিই ওই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেছেন, তারপর আমি তা দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদের চারা উদ্গত করেছি, তারপর তা থেকে সবুজ গাছপালা জন্মিয়েছি, যা থেকে আমি থরে থরে বিন্যস্ত শস্যদানা উৎপন্ন করি’। (সূরা আনআম- ৯৯)।

বলা বাহুল্য, পরিবেশ রক্ষায় গাছের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানীদের মতে, একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সে দেশের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা জরুরি। বনভূমি না থাকলে সেখানে দেখা দেবে উষ্ণতা। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবেশ। মানুষের জন্য পৃথিবী হবে ধু-ধু বালুচর, আর হবে বসবাসেরঅনুপযোগী। এ জন্য ইসলাম ১৫০০ বছর আগেই গাছ লাগানোর প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছে।

হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে- কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারাও থাকে যা রোপণ করা যায়, তবে সে চারাটি রোপণ করবে’। (বুখারি- ৪৭৯)।

এমনকি বিশ্বনবী গাছের চারা রোপণের কাজটিকে সদকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবীজি বলেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে অথবা ক্ষেতখামার করে, অতঃপর তা থেকে মানুষ কিংবা পাখি বা কোনো জন্তু ভক্ষণ করে, সে ব্যক্তি তা থেকে সদকার সওয়াব পাবে’। (মুসলিম- ৪০৫০)। এতে বোঝা যায়, মহানবী গাছ লাগানোর প্রতি কতটা তাগিদ দিয়েছেন।

আব-হাওয়া বা জল-বায়ু আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত:

আমাদের প্রকৃতির প্রধান ও শ্রেষ্ঠ অংশ হলো ‘আব-হাওয়া’ তথা পানি ও বাতাস। এ দুটি উপাদান আমাদের প্রতিনিয়ত প্রয়োজন। তাই পানি ও বাতাস দূষণমুক্ত রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও সামাজিক কর্তব্য। ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য, এ গ্রহের নিরাপত্তার জন্য আমাদের জল-বায়ু সংরক্ষণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি তোমাদের মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতেই তোমাদের আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন’। (সূরা হুদ, আয়াত- ৬১)। পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে পৃথিবীকে আবাদ উপযোগী রাখতে হবে। পরিবেশ যখন সংরক্ষিত থাকবে না, তখন পৃথিবীতে আবাদ হবে না এবং বসবাসের উপযোগী থাকবে না।

পৃথিবী বাসযোগ্য থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু হলো পানি। আল্লাহ তাআলা পানি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ষাট জায়গায় বলেছেন। পানি ছাড়া আমাদের জীবন অচল, তাই বলা হয় পানির অপর নাম জীবন। পানি আল্লাহর দেওয়া এক শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। সুতরাং এই নিয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রাণবান সবকিছু পানি হতে সৃষ্টি করেছি’। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত- ৩০)। পানি হচ্ছে প্রাণ সৃষ্টির মূল উপাদান, এই উপাদান সংরক্ষণ করার জন্য কুরআনে কারিমে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

জীববৈচিত্র্য এবং আমাদের পরিবেশ:

উর্বর পলিমাটির জমি এবং উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে খুবই সমৃদ্ধ। এদেশে উদ্ভিদের প্রজাতি সংখা ৬ হাজারের বেশি। এদেশের বনভূমি এবং জলাভূমি প্রায় ১,৬০০ প্রাণীতে সমৃদ্ধ। একেক প্রাজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদ  হতে আমরা একেক ধরনের উপকরণ পাই। এসব উপকরণ শুধু যে আমাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছে- তা নয়; আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও অসামান্য ভূমিকা পালন করছে।

পরিবেশ সুরক্ষা এবং প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করা আমাদের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই জরুরি। ইসলাম এই দিকটির উপরেও সমান গুরুত্ব দিয়েছে। হালাল প্রাণী ছাড়া অন্য কোন প্রাণীকে ততক্ষণ পর্যন্ত হত্যা করার অনুমতি দেয়নি; যতক্ষণ না সেটা মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কেবল আত্মরক্ষার নিয়মের অংশ হিসেবে অন্যান্য উপায়-উপকরণ গ্রহণের ন্যায় হারাম প্রাণী হত্যা করার অনুমতি দিয়েছে। ইসলামে কোন প্রাণীর মাংস খাওয়া হারাম করার অর্থ এই নয় যে, সেগুলো ঘৃণিত কিংবা হত্যাযোগ্য; বরং এমনও হতে পারে যে, সেগুলো পরিবেশ-প্রকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। অতএব, যখন এগুলোকে হত্যা করা হয় তখন প্রকৃতিতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে।

হাদীসে রাসূলে চার প্রকারের প্রাণীকে হত্যা করার ব্যাপারে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এগুলো হচ্ছে- পিঁপড়া, মৌমাছি, হুদহুদ এবং শ্রাইক (চিল জাতীয় এক প্রাজাতির পাখি)। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস- ৫২৬৭)।

এমনকি রাসূল (সা.) অযথা কোন প্রণীকে কষ্ট দিতেও নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, দয়াবানদের উপর রহমানও দয়া করবেন। পৃথিবীতে যারা বসবাস করে তাদের উপর দয়া করো, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের উপর দয়া করবেন। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস- ১৯২৪)।

এখন অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে যে কীটনাশক ব্যাবহার করা হচ্ছে, সেগুলোও প্রকৃতির উপর অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর ফলে উপকারী ব্যাকটেরিয়া এবং পোকামাকড়গুলোকেও নিধন করা হচ্ছে, যার কারণে মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। পরাগায়ন ব্যাহত হয়ে ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে।

পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতাঃ

পরিবেশের সঙ্গে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যেমন পানি হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রধান উপাদান। পানি ছাড়া গাছপালা, বন-বনানী, নদী-নালা, পশু-পাখিসহ প্রাণীজগতের কল্পনাও করা যায় না। পানির অস্তিত্ব প্রাণীর অস্তিত্বের পূর্বশর্ত। সেই পানি কিন্তু সবচেয়ে বেশি পবিত্র, অর্থাৎ পানি নিজে পবিত্র এবং অন্যকেও পবিত্র করতে সক্ষম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তিনিই (মহান আল্লাহ) স্বীয় অনুগ্রহের প্রাক্কালে সুবার্তাবাহী বায়ু প্রেরণ করেন এবং আমি (আল্লাহ) আকাশ হতে পবিত্র (ও পবিত্রকারী) বারি বর্ষণ করি। যা দ্বারা আমি মৃত ভূমিকে জীবিত করি এবং আমার সৃষ্টির বহু জীবজন্তু ও মানুষকে উহা পান করাই’। (সূরা ফুরকান, আয়াত- ৪৮-৪৯)।

পরিবেশদূষণ ও অপরিচ্ছন্নতাঃ

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুন্দর পরিবেশের প্রথম বৈশিষ্ট্য। তাই পুকুরের পানি, নদীর পানি, আবদ্ধ জলাশয়ের পানি যেন দূষিত না হয়, সে জন্য প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘আবদ্ধ পানি ও জলাশয়ের পানিতে তোমরা প্রস্রাব করবে না। প্রস্রাব করে তোমরা পানিকে দূষিত করে সেখানে আবার গোসল করবে না’। (মুসলিম শরিফ, হাদিস- ৪২৪)।

প্রতিটি মানুষের সুস্থতার জন্য পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত পানির প্রয়োজন সর্বাগ্রে। তাই মহানবী (সা.) পানিকে পবিত্র রাখতে এবং পানিকে সংরক্ষণ করতে বলেছেন; কোনোভাবেই যাতে পানি অপবিত্র ও দূষিত হতে না পারে। কারণ দূষিত পানির মাধ্যমে পানিবাহিত রোগ সৃষ্টি হতে পারে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘খবরদার! তোমরা পানির মধ্যে নিশ্বাস ত্যাগ করবে না বা ফুঁ দেবে না’। (সহীহ বুখারী- ১৫৩)। এই হাদিসটিতে খাওয়ার পানির কথা বলা হয়েছে। কারণ মানুষের নিশ্বাসের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়; যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন সা’দ (রাযি.)এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন সা’দ অযূ করছিলেন। নবীজী (সা.) এ সময় তাকে বললেন, পানির এমন অপব্যয় করছো কেন? সা’দ বললেন, অযূর মধ্যেও কি অপব্যয় হবে? নবীজী বললেন, অবশ্যই। যদি তুমি বহতা নদীতেও অযূ করো। (ইবনে মাজাহ, হাদীস- ৪২৫)।

অতএব, আমাদের উচিত পানিকে দূষণমুক্ত রাখা এবং পানির অপচয় রোধ করা। পানির পাশাপাশি আরও যত প্রাকৃতিক সম্পদ আছে- সবকিছুর যথাযথ ব্যবহার, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করে আমরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করলে মানব সভ্যতায় নেমে আসবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে জলে ও স্থলে বিপর্যয় ঘটেছে’। (সূরা রুম- ৪১)।

আল্লাহ তাআলা চান মানুষ সুন্দর পরিবেশে পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করুক। সৈয়দ তানতাভী (রহ.) লিখেছেন, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের মধ্যে পাঁচ শতবার পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য উৎসাহিত করেছেন। পবিত্রতা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ব্যতীত সুন্দর পরিবেশ কল্পনা করা যায় না। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ’। (মুসলিম শরীফ, হাদীস- ২২৩)।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরও ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের উঠান-আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখো’। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস- ২৭৯৯)। প্রিয় নবী (সা.) আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র, তিনি পবিত্রতাকে ভালোবাসেন’। (প্রাগুক্ত)। এ ছাড়া কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরও ভালোবাসেন’। (সূরা বাকারা, আয়াত- ২২২)।

মোটকথা, পৃথিবীকে রক্ষা করার পূর্বশর্ত পৃথিবীর যিনি স্রষ্টা ও নিয়ন্তা, তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর বিধান পালনের অঙ্গীকার করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যই সব ক্ষেত্রে কল্যাণ ও মুক্তির একমাত্র উপায়। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন তা সত্য, সামষ্টিক জীবনেও তা অনস্বীকার্য। পৃথিবীর সব মানুষ যখন তা উপলব্ধি করবে, তখনই তাদের কল্যাণ সাধিত হবে।

লেখক: অনার্স- ধর্মতত্ত্ব, আল-আযহার ইউনিভার্সিটি, মাস্টার্স- শরীয়া ইসলামিয়া, কায়রো ইউনিভার্সিটি এবং সিনিয়র শিক্ষক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।