ইসলামে সংশয়প্রবণতা এবং সংক্রামক রোগ

।। মুফতিয়ে আযম মুহাম্মদ আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (দা.বা.) ।।

لاَ عَدْوَى، وَلاَ طِيَرَةَ، وَلاَ هَامَةَ فى الاسلام
ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার অভাবে মুসলিমসমাজে আজকাল বহু মানুষের মধ্যে সংশয়প্রবণতা জেঁকে বসেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইসলামের পূর্বে, আরবের লোকেরা সফর মাসে কোনো কাজ করত না। তারা মনে করত, এটা অপয়া মাস। এ মাসে কিছু করলে তাতে লাভ হবে না, বরং এ মাসের কারণে ক্ষতি হতে পারে।
একইভাবে তৎকালীন আরবরা শাওয়াল মাসে বিবাহ-শাদি করাও কল্যাণকর মনে করত না। অথচ হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, ‘আমার বিবাহ হয়েছিল শাওয়াল মাসে’।

এ ছাড়াও আরবদের মাঝে বহু সংশয়ধর্মী বিশ্বাস ছিল। ‘লা-আদওয়া’ (কোনো ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নেই) শীর্ষক হাদীসে সেসব ধারণা খ-ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব বিশ্বাসের উপর আমল করা যাবে না। কারণ, এগুলো এসেছে জাহিলী যুগ থেকে।

বর্তমান সমাজেও বহু বিষয়ে সংশয়বাদ ব্যাপকতর হয়ে গেছে। যেমন, অমুক পাখি ডাকলে অতিথি আসে, শিশুরা ঘর ঝাড়– দিলে অতিথি আসে, হাত চুলকালে অর্থ-কড়ি আসে ইত্যাদি। এজাতীয় অনেক সংশয়মূলক ধারণা আমাদের সমাজে বহু আগ থেকে চলে আসছে। তন্মধ্যে কোনো রোগ ছোঁয়াচে বা সংক্রামক হওয়ার বিশ্বাসও একটি। আরবিতে এ ধারণাকে বলা হয় ‘আদওয়া’।

আল্লাহর রাসূল (সা.) অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় এ সংশয়বাদিতা ও ছোঁয়াচে বা সংক্রামক হওয়ার ধারণা খ-ন করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

عن أبى هريرة رضى الله قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: لا يعدي شيء شيئا، فقال أعرابي يا رسول الله البعير الجرب الحشفة بذنبه فتجرب الإبل كلها فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فمن أجرب الأول؟ لا عدوى ولا صفر، خلق الله كل نفس وكتب حياتها ورزقها ومصائبها.
عن السائب بن يزيد رضى الله ولا صفر وَلاَ هَامَةَ ولا يعدي سقيم صحيحا.
وعن أبى هريرة رضى الله لا عدوى وَلاَ طِيَرَةَ، وَلاَ هَامَةَ ولا صفر، فقال أعرابي يا رسول الله البعير الجرب الحشفة بذنبه فتجرب الإبل كلها، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فمن أجرب الأول؟

এ সকল হাদীস থেকে জানা গেল যে, ইসলামী শরীয়াতে একজনের রোগ অন্যজনের দেহে প্রবেশ করার কোনো ভিত্তি নেই। এটা নিরেট সংশয়প্রবণতা। কিন্তু এর বিপরীতে কিছু হাদীস দ্বারা জানা যায়, রোগ-ব্যাধি সংক্রামক হয়। যেমন- সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে-
فرمن المجذوم كما تفر من الاسد ‘কুষ্ঠরোগী থেকে সেভাবে পালাও যেভাবে বাঘ থেকে পলায়ন করো’।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- لا يوردن الممرض على المصح ‘কখনোই অসুস্থ উটকে সুস্থ উটের কাছে রাখা যাবে না’।

এমনিভাবে মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, এক কুষ্ঠরোগীকে আল্লাহর নবী বার্তাবাহকের মাধ্যমে সংবাদ দিয়েছিলেন- انا قد بايعناك فارجع আমরা তোমাকে বাইয়াত করেছি, তুমি ফিরে যেতে পারো।

এখন বাহ্যত প্রথমোক্ত ‘লা-আদওয়া’ (কোনো সংক্রামক ব্যাধি নেই) শীর্ষক হাদীসের সাথে দ্বিতীয়োক্ত ‘ফিররা মিনাল মাজযুম’ (কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করো) শীর্ষক হাদীসের মধ্যে সংঘর্ষ বা বিরোধ দেখা যাচ্ছে। এর সমাধান কী? আশা করি জানিয়ে বাধিত করবেন।

ইতি- রাজাখালী মসজিদের কতিপয় মুসল্লি, রাজাখালী, চট্টগ্রাম।

উপর্যুক্ত প্রশ্নসমূহের উত্তর

বিসমিহি তাআলা ওয়া আউনিহি।

হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণ উল্লিখিত হাদীসের বিরোধ নিরসনে বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। যথা-

১. সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা কিরমানী (রহ.) ‘লা-আদওয়া’র ব্যাখ্যায় লিখেছেন-
قال الكرمانى فى شرح صحيح البخارى فى شرح قوله: “لا عدوى” اى لا عدوى لطبعه ولكن بقضاء الله تعالى واجراء العادة، فلهذا نهى اى عن إيراد الممرض على المصح، وقال فر من المجذوم.

নিজ ক্ষমতা ও সৃষ্ট স্বভাব হিসেবে কোনো রোগই সংক্রামক বা ছোঁয়াচে নয়। বাহ্যিকভাবে যা-ই দেখা যাক, মূলত তার পেছনে থাকে আল্লাহর আদেশ ও ইচ্ছা। আর এ কারণেই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ উটকে সুস্থ উটের সাথে রাখতে নিষেধ করেছেন এবং কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করতে বলেছেন, যাতে এমন না হয় যে, আল্লাহর আদেশে একের রোগ অন্যের দেহে প্রবেশ করল, আর তোমরা মনে করলে অমুক রোগী থেকে রোগটা ছড়িয়েছে।

অর্থাৎ- অধিকাংশ লোক যে রোগ-ব্যাধিকে সংক্রামক মনে করে, হাদীসে তা খ-ন করা হয়েছে। আসলে বিষয়টি এমন নয়। কোনো রোগ নিজে নিজে রোগী থেকে ছড়াতে পারে না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহর আদেশে ছড়াতে পারে।

২. আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন-
قال الحافظ ابن حجر في شرح النخبة والأولى في الجمع أن يقال إن نفيه صلى اللّه عليه وآله وسلم للعدوى باق على عمومه وقد صح قوله لا يعدي شيء شيئًا… قال وأما الأمر بالفرار من المجذوم فمن باب سد الذرائع لئلا يتفق للشخص الذي يخالطه شيء من ذلك بتقدير اللّه تعالى ابتداء لا بالعدوى المنفية فيظن أن ذلك بسبب مخالطته فيعتقد صحة العدوى فيقع في الحرج فأمر بتجنبه حسمًا للمادة

আল্লামা ইবনে হাজার এখানে যা বুঝাতে চেয়েছেন তা এই যে, বিরোধপূর্ণ উপর্যুক্ত দুই হাদীসের মধ্যে সমন্বয় করার সর্বোত্তম পন্থা হল, রোগ-ব্যাধি সংক্রামক না হওয়ার যে ঘোষণা আল্লাহর রাসূল (সা.) দিয়েছেন, তা আপন স্থানে মৌলিক অর্থে সঠিক। অর্থাৎ একজন থেকে অন্যজনের দেহে রোগ প্রবেশ করার নিজস্ব ক্ষমতা অস্বীকার করা হয়েছে। সুতরাং রোগ নিজে নিজে কোথাও ছড়াতে পারে না। কিন্তু জাহিলী যুগের লোকেরা ব্যাপকভাবে রোগ ছোঁয়াচে বলে ধারণা করতো। হাদীসে এ আকীদাকে ভ্রান্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

মোটকথা, ‘কোনো রোগ সংক্রমণ করে অন্যের দেহে প্রবেশ করে না’, আল্লাহর নবী (সা.)এর এ বাণী আপন স্থানে সর্বজনস্বীকৃত ও সম্পূর্ণ সঠিক।

আরও পড়তে পারেন-

আর ‘কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করো’ বলে তিনি যে আদেশ করেছেন, তা মূলত ঐসব লোকের জন্য, যারা আল্লাহর সিদ্ধান্ত অনুসারে কোনো কুষ্ঠরোগীর সংশ্রবে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারা যেন এ ধারণা না করে যে, সংক্রামক ব্যাধি আক্রমণ করেছে অথবা অমুকের কারণে আমার দেহে এ রোগ এসেছে। এভাবে সে সংক্রমণকে সঠিক মনে করে নিজের আকীদা-বিশ্বাসে বিভ্রান্ত হবে। তাই ‘কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করো’ বলে রোগ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। প্রত্যেক মুসলমানের অন্তর থেকে বিশ্বাস করা উচিত যে, রোগ আল্লাহ তাআলাই দেন এবং তিনিই সুস্থতা দান করেন। তবে রোগ থেকে পলায়নের নির্দেশ দিয়ে নবীজি (সা.) ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করেছেন। যাতে সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগের ধারণা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

৩. ইমাম নববী (রহ.) এ হাদীসের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন-
يؤكد على أن العدوى المنفية فى عدوى الأمراض بطبعها دون سبب اخر، أما انتقال أسباب هذه الأمراض فتمرض بفعل الله لا بطبعها، فيؤدى الاعتقاد بالعدوى فيكفر.

লা-আদওয়া শীর্ষক হাদীসে রোগ-ব্যাধি সংক্রামক না হওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তার দ্বারা মূলত রোগের নিজস্ব ক্ষমতা অস্বীকার করা হয়েছে। সুতরাং যদি কেউ মনে করে যে, রোগ তার নিজ ক্ষমতায় যেখানে খুশি যেতে পারে, আল্লাহর আদেশের আনুগত্যের প্রয়োজন হয় না, তাহলে সেটা হবে শিরক। তবে আল্লাহর আদেশে রোগ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ আল্লাহর আদেশের অনুগত থেকে; স্বাধীনভাবে নয়। এটা ভিন্ন বিষয়।

মোটকথা, ‘লা-আদওয়া’ শীর্ষক হাদীসটি ব্যাপক অর্থেই থাকবে। অর্থাৎ কোনো রোগই নিজ ক্ষমতা বা ইচ্ছায় কাউকে প্রভাবিত করতে পারে না। আল্লাহর আদেশে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। হাদীসে সেটা অস্বীকার করা হয়নি।

৪. কোনো কোনো মুহাদ্দিস এই দুই বিরোধপূর্ণ হাদীসের মধ্যে এভাবে সমন্বয় করেছেন যে, ‘লা-আদওয়া’ শীর্ষক হাদীসে অস্বীকার করা হয়েছে রোগের নিজে নিজে সংক্রামক হওয়ার বিষয়টি। জাহিলী যুগের লোকেরা এমনটাই বিশ্বাস করত।

অন্যদিকে, অপর হাদীসে কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়নের আদেশ এজন্য দেয়া হয়েছে যে, কোনো কোনো রোগ সংক্রমণের কারণ হয়ে থাকে। অর্থাৎ সুস্থ ব্যক্তি অসুস্থ ব্যক্তির সংশ্রবে আসাকে আল্লাহ তাআলা একটি পৃথক কারণ বানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং হতে পারে আল্লাহর আদেশেই রোগীর রোগ অন্যের দেহে ছড়িয়ে পড়বে। তাই হাদীসে তার থেকে দূরে সরে যেতে বলা হয়েছে।

তবে এটা কোনো অবধারিত বিষয় নয় এবং সব ক্ষেত্রে এমনটি ঘটাও আবশ্যক নয়। কেননা, অনেক সময় দেখা যায়, অসুস্থ ব্যক্তির সংশ্রবে বা সেবা-শুশ্রƒষায় থাকার পরেও সুস্থ ব্যক্তির দেহে তার রোগ সংক্রমিত হয় না।

‘শারহু নুখবাতিল ফিকারে’ বলা হয়েছে-
ووجْهُ الجمعِ بينَهُما أَنَّ هذهِ الأمراضَ لا تُعْدي بطبْعِها، لكنَّ الله سبحانَه و تعالى جَعَلَ مُخالطةَ المريضِ بها للصَّحيحِ سبباً لإعدائِهِ مَرَضَه.
ثمَّ قد يتخلَّفُ ذلك عن سبَبِه كما في غيرِهِ من الأسبابِ، كذا جَمَعَ بينَهما ابنُ الصَّلاحِ تَبعاً لغيرِه

এখানে চিন্তা করলে দেখা যাবে, রোগ-ব্যাধি যদি সংক্রামক হয়ও, তবে সেটা ভিন্ন কোনো কারণের ভিত্তিতে হবে না; বরং আল্লাহর আদেশের ভিত্তিতে হবে।

আর যদি কারণের সাথে আল্লাহর আদেশ যুক্ত না হয়, তাহলে কারণ কারণের জায়গাতেই পড়ে থাকবে, তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে না। ফলে রোগও সংক্রমিত হতে পারবে না।

পক্ষান্তরে যদি কারণের সাথে আল্লাহর আদেশ যুক্ত হয়, তাহলে রোগ সংক্রমিত হবে। অন্যথায় সংক্রমিত হবে না। কেউ জানে না, কখন কারণের সাথে আল্লাহর আদেশ সংযুক্ত হবে, আর কখন সংযুক্ত হবে না। সুতরাং বিনা প্রয়োজনে রোগীর সংশ্রবে যাবে না। প্রয়োজন হলে যেতে পারে, হাদীসে তা নিষেধ করা হয়নি। তবে আকীদা সঠিক রাখতে হবে। অর্থাৎ রোগ নিজ ক্ষমতায় সংক্রমণ করতে পারে না, বরং আল্লাহর আদেশে সংক্রমিত হয়। এই আকীদা নিয়ে প্রয়োজনবশত রোগীর পাশে গেলে অসুবিধা নেই। সুতরাং চিকিৎসার প্রয়োজনে ডাক্তার, সেবা-যত্নের প্রয়োজনে আত্মীয়স্বজন রোগীর পাশে যেতে পারবে। এতে বরং আরো সাওয়াব পাওয়া যাবে।

আক্রান্ত-এলাকায় যেতে কেন নিষেধ করা হয়েছে?

আক্রান্ত-এলাকায় গেলে দুর্বল ঈমানদারদের ঈমান নষ্ট হতে পারে। আর তা এভাবে যে, মুশরিকরা মনে করে, কিছু কিছু রোগ নিজে নিজেই সংক্রমিত হয়। কিন্তু ইসলাম এটা বলে না। ইসলামের আকীদা হল, সমস্ত রোগ আল্লাহর আদেশের অনুগামী। যেখানে তিনি আদেশ করবেন, রোগ সেখানেই যাবে।

সুতরাং কোনো মুসলমান যদি মনে করেন যে, অমুক স্থানে যাওয়ার ফলে কিংবা অমুকের সাথে সাক্ষাতের ফলে আমার রোগ হয়েছে, তাহলে এটা হবে একধরনের শিরক। এই শিরক থেকে বাঁচানোর জন্যই নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, রোগাক্রান্ত এলাকায় যেয়ো না। নতুবা আল্লাহর উপর তোমাদের ভরসা নষ্ট হয়ে যাবে। তোমরা মনে করবে, রোগ আল্লাহর আদেশে আসেনি, অমুক স্থানে যাওয়ার কারণে এসেছে। আর এর দ্বারা তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞানী।

ওয়াস সালাম- বান্দা মুহাম্মাদ আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (আফাল্লাহু আনহু), মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ এবং পরিচালনা পরিষদের প্রধান- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।