‘ইসলামে হিজাব আবশ্যকীয় বিধান নয়: কর্নাটক আদালতের এ কেমন মিথ্যাচার ও দুর্বৃত্তপনা!

।। তারেকুল ইসলাম ।।

মাসিক মুঈনুল ইসলামের গত সংখ্যায় কর্নাটকের হিজাব-বিতর্ক নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করেছিলাম। এ বছরের শুরুতে কর্নাটক রাজ্যের একটি সরকারি কলেজে হিজাব ও বোরকা পরা ছাত্রীদের ঢুকতে না দিলে সেটার প্রতিবাদে তারা আন্দোলনে নামে। হিজাব পরার অধিকারের দাবিতে কয়েকজন মুসলিম ছাত্রী কর্নাটকের উচ্চ আদালতে মামলা করে। তখন উচ্চ আদালত এক অন্তর্বর্তী আদেশে বলেছিল, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হিজাবসহ কোনো ধরনের ধর্মীয় পোশাক পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা যাবে না। সম্প্রতি সেই উচ্চ আদালতের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মামলা নিষ্পত্তি করেছে এই বলে যে, ইসলামে হিজাব কোনো আবশ্যকীয় বিধান নয়।

উচ্চ আদালতের এই বক্তব্যের প্রথম সমস্যা হচ্ছে, হিজাবকে নিছক পোশাক হিসেবে দেখা। ইসলামে হিজাব ও বোরকা শুধু পোশাক মাত্র নয়। বরং সেটা পর্দার প্রতীক। পর্দার সেন্স থেকে বিষয়টিকে বুঝতে হবে। পর্দার সেন্স বাদ দিলে হিজাব-বোরকা নিছক পোশাকি কালচার বা পোশাকি ফ্যাশনের বিষয়বস্তু হয়ে পড়বে। সে কারণে আকর্ষণীয় টাইটফিট বোরকাও পর্দার মূল্যবোধ ধারণ করতে পারে না। ইসলামে পর্দার উদ্দেশ্য বলতে যা বুঝায়, সেটাই ধর্মীয় মূল্যবোধ হিসেবে হিজাব ও বোরকার উদ্দেশ্য হতে হবে। পর্দার মূল উদ্দেশ্য, অশ্লীলতা ও কামুক নজর থেকে নারীদের নির্বিশেষে হেফাজত করা। সুতরাং, আল্লাহর ফরজ হুকুম ‘পর্দা’ মানার ক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েদের জন্য হিজাব-বোরকা ধর্মীয়ভাবে একটি আবশ্যিক পোশাক। এছাড়া, নাগরিকদের যেকোনো ধরনের ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধিবিধান মেনে চলার স্বাধীনতা ও অধিকার ভারতের সংবিধানে সংরক্ষিত। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী সাংবিধানিক মূলনীতির থোড়াই কেয়ার করে একে একে মুসলমানদের সব অধিকার কেড়ে নিতে চায়। মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে তারা এককভাবে হিন্দু মহাভারত কায়েমের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। ফলে ভারতে মুসলমানরা দিন দিন নি¤œ শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন-

অন্যদিকে পশ্চিমারা নিজেদের উদার ও মানবিক দাবি করলেও মুসলিমদের বেলায় তারা হয়ে পড়ে সঙ্কীর্ণ। জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও নরওয়েসহ বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে হিজাব ও বোরকাকে আইন করে ব্যান করা হয়েছে তাদের তথাকথিত সেকুলার মূল্যবোধ রক্ষার স্বার্থে। এমনকি আইন লঙ্ঘন করলে জরিমানার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। অথচ প্র্যাকটিসিং খ্রিস্টান ও ইহুদি নারীরাও মাথায় স্কার্ফ বা হেডকভারিং পরে থাকে। তাদের জন্য কিন্তু সেই আইন প্রযোজ্য নয়। তার মানে, এটা যে সেকুলারিজমের মুখোশে ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী বর্ণবাদী আইন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হিজাব ব্যান করার পেছনে ইসলামোফোবিয়া তথা ইসলামবিদ্বেষ মূল অনুঘটক। ইউরোপে হিজাব-বোরকা পরিহিত নারীদের প্রায়ই বর্ণবাদী হামলা ও কটাক্ষের শিকার হতে হয়। কার্যত ব্যাপারটা যেন এমন- উদারতা, মানবিকতা, নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার মুসলমান বাদে আর সব ধর্মাবলম্বীর জন্য সুরক্ষিত।
এছাড়া উগ্র সেকুলারিজমের কারণে হিজাব ও বোরকা মুসলিম মেয়েদের জন্য নানা ধরনের ক্রাইসিসও তৈরি করেছে। বোরকা-হিজাব পরা মুসলিম মেয়েদের প্রতি সেকুলারদের বর্ণবাদী আচরণ খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেকুলার জনপরিসরে তাদেরকে ঘৃণাবশত ‘অপর’ করে দেখা হয়। আমাদের দেশকে বলা হয় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে ক্লাসরুমে প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দ্বারা প্রায়ই হিজাব-বোরকা পরিহিত ছাত্রীরা বর্ণবাদী আচরণ, তিরস্কার ও অসম্মানের শিকার হন। আর প্রয়াত রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী মিতা হকদের মতো কথিত সেকুলার বাঙালি জাতিবাদীরা হিজাব ও বোরকা পরিহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস খুঁজে পান। অর্থাৎ, হিজাব-বোরকা পরলে বাঙালি পরিচয় থাকে না। যেমনটা দাড়ি-টুপিতে তারা মুসলমানিত্ব দেখে, বাঙালিত্ব দেখে না।

এক কথায়, তারা টিপ, সিঁদুর, ধুতি ও হিন্দু কালচারে বাঙালিত্ব খুঁজে পায়। সেকুলার প্রগতিবাজদের কাছে হিজাব-বোরকা পরা মেয়েরা ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘ভিনদেশি’ হিসেবে বিবেচিত হয়!

২০২০ সালের শেষের দিকে আমাদের দেশে একজন বোরকা পরা মা তার ছেলেকে নিয়ে একটি মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। সেটার একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। তখন সেই ছবি নিয়ে সেকুলার প্রগতিবাজরা বিতর্ক তুলেছিল। বিবিসি বাংলা এ বিষয়ে একটা রিপোর্টে লিখেছিল, ‘মা আর সন্তানের খেলার ওই মুহূর্তটিকে ছাপিয়ে আলোচনা শুরু হয় ওই নারীর পোশাক নিয়ে। ওই নারী বোরকা পরিহিত হওয়ার কারণে অনেকে তার সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, তার মধ্যে তারা “বাংলাদেশি মা”কে খুঁজে পাননি। অনেকে আবার বলেছেন যে এটা পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের ছবি’ (১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, বিবিসি বাংলা)। অথচ ঢাকার পল্টন এলাকা থেকে সেই ছবিটি তুলেছিলেন ডেইলি স্টারের একজন সাংবাদিক। হিজাব-বোরকার প্রতি অসহিষ্ণুতা যে মূলত ইসলামোফোবিয়াপ্রসূত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

যাই হোক, ইসলাম প্রধানত মাহরাম ও গায়রে মাহরামের মধ্যে পর্দার বিধান মানাকে ফরজ করেছে। তা সেটা চাদর, ওড়না, হিজাব ও বোরকাÑ যেকোনো পোশাকেই হোক। পোশাক মুখ্য নয়। মুখ্য হলো পর্দা। পর্দার বিধানের কারণেই হিজাব-বোরকার গুরুত্ব। নারীর পোশাকে পর্দার মূল্যবোধের পরিচয় থাকতে হবে। হিজাব-বোরকা পোশাকি ফ্যাশন বা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নয়। উদারনৈতিক বয়ানে হিজাব-বোরকা ব্যক্তিগত পছন্দ, ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা অধিকারের ইস্যু হলেও ইসলামে মেয়েদের জন্য এটি একটি অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় অনুশাসন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
Email: tareqislampt
@admin_767

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।