আলেম-ওলামা ও মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নয়। তারা এদেশেরই ভূমিজাত। এদেশেরই নাগরিক। এদেশের ধর্মপ্রাণ গণমানুষের সাথে তাদের চিরায়ত আত্মিক সম্পর্ক। তারা মাদরাসায় দ্বীনশিক্ষা দিয়ে আলেম তৈরি করে, ফলে সমাজে দ্বীনশিক্ষা ও দ্বীনি চেতনার প্রসার অব্যাহত থাকে। মসজিদে খেদমত করার মাধ্যমে তারা ইবাদত-বন্দেগির সামাজিক রূপ ও সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখে। আর বিশেষ করে ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে তারা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে দ্বীনি চেতনা ও অনুভূতি যিন্দা রাখে। ওয়ায-মাহফিল এদেশের মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওয়াজ-মাহফিলের ব্যাপ্তির কারণে বিভিন্ন জাহেলি প্রথা ও সেকুলার সমাজব্যবস্থার দিনদিন অপনোদন ঘটছে এবং এর পরিবর্তে ইসলামী অনুভূতি ও সংস্কৃতির সর্বব্যাপী বিকাশ ঘটছে, যা ইসলামবিদ্বেষী সেকুলার প্রগতিশীলদের জন্য অস্বস্তিকর। সে কারণে তারা সবসময় কথিত ‘মৌলবাদ’, ‘ধর্মান্ধতা’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতা’র ভুয়া জিগির তুলে ইসলাম ঠেকানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় ইদানিং ওয়াজ-মাহফিল বন্ধ করে কিংবা ওয়াজ-মাহফিলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আলেম-ওলামার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
অথচ বাংলাদেশের সংবিধান এদেশের প্রতিটি নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। এছাড়া ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ এবং ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘের গৃহীত ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি’র ১৯নং ধারায় বিনা বাধায় এবং বিনা কর্তৃত্ব ও অনুমতিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কাজেই, আলেম-ওলামা কিংবা ভিন্ন মতাবলম্বীদের ‘অপরায়নে’র (Othering) মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা বেআইনি এবং সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার হিসেবে দেশের প্রতিটি নাগরিকের ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা’র নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। সুতরাং, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারের প্রবর্তিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা, সংবিধানের ২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা আছেÑ ‘মৌলিক অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য আইন বাতিল হইবে’। আর সংবিধানে ওই ৩৯ নং অনুচ্ছেদ ‘মৌলিক অধিকারে’র আওতাভুক্ত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে এর খসড়া প্রকাশকালীনই বাক-স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে সাব্যস্ত করেছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক (৩০ জানুয়ারি ২০১৮, যুগান্তর)। সংসদে গৃহীত হওয়ার পর থেকে এই আইনের খড়গে পড়ে সাহসী সাংবাদিক থেকে শুরু করে অনেক ইসলামী বক্তাকেও জেলে যেতে হয়েছে। আজ ভিন্ন মতাবলম্বী আলেমদের কণ্ঠরোধ করার জন্য ওয়াজ-মাহফিলের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান বিভিন্ন সময় বলেছেন, ওয়াজ-মাহফিলে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া যাবে না কিংবা বরদাশত করা হবে না। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত প্রকাশের অধিকার সাংবিধানিকভাবে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। ওয়াজ-মাহফিল একটি উন্মুক্ত গণপরিসর। সেখানে আলেমরা ধর্মীয় বয়ানের পাশাপাশি রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে পারবেন না- এমন কথা দেশি-বিদেশি কোনো আইনে বলা নেই। তবে হ্যাঁ, কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভয়ে কেউ ব্যক্তিগতভাবে কোথাও রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। কিন্তু ওয়াজ-মাহফিলের মতো একটি উন্মুক্ত, স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাগমের মধ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া যাবে নাÑ এমন ফ্যাসিস্ট নির্দেশনা আমরা বিবেকবান হিসেবে সমর্থন করতে পারি না; যা কিনা মানুষের মতপ্রকাশের মতো একটি মৌলিক অধিকার হরণকারী। যেকোনো বিষয়ে মতপ্রকাশের অধিকার সবার জন্যই সমান। তবে শুধুমাত্র ‘অবমাননা’ প্রশ্নে আমরা নীতিগতভাবে তথাকথিত ইসলামবিদ্বেষী মুক্তমনাগিরির বিপক্ষে। গঠনমূলক সমালোচনাকে আমরা সবসময় স্বাগত জানাই। কিন্তু তথাকথিত ‘মুক্তমনা’ ও ‘মুক্তচিন্তা’র নামে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), উম্মাহাতুল মুমিনীন ও কুরআনের অবমাননা এবং মাদরাসা ও আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রোপাগান্ডা ও ঘৃণার চর্চা সমর্থনযোগ্য নয়। খোদ জাতিসংঘের একটি ফোরাম ধর্মাবমাননাকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ সাব্যস্ত করে একটি রেজুল্যুশনও পাশ করেছিল (২৭ মার্চ ২০০৯, রয়টার্স)।
যা হোক, আমরা মনে করি, ওয়াজ-মাহফিলে যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা প্রদান মতপ্রকাশের অধিকার হরণের শামিল। এই নতুন বছরে সাংবিধানিক অধিকার বিবেচনায় দেশে মতপ্রকাশের চর্চা অব্যাহত রাখতে ওয়াজ-মাহফিলে হস্তক্ষেপ করা বা বাধা দেয়া থেকে বিরত থাকলে সরকার ও প্রশাসন এক্ষেত্রে বিতর্ক ও নিন্দা এড়াতে পারবে বলে আমরা মনে করি।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/