।। জহির উদ্দিন বাবর ।।
মিডিয়ার চরিত্রই হলো সবসময় যার কাটতি ভালো সেটার পেছনে ছুটে বেড়ানো। আর এটা করতে গিয়ে অনেক সময় নৈতিকতার যে মানদ- আছে সেটা অতিক্রম করে। আন্তর্জাতিক পেশাদার গণমাধ্যম কিছু কিছু জায়গায় নৈতিকতার মানদ- পুরোপুরিই অনুসরণ করে। আবার কিছু কিছু জায়গায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা লঙ্ঘন করে। তবে আমাদের দেশের মিডিয়া বা গণমাধ্যম তা অহরহ লঙ্ঘন করে। মূলত মিডিয়ার নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই। যারা পরিচালনা করেন তাদের চাওয়ার ভিত্তিতেই পরিচালিত হয় মিডিয়া। এজন্য মিডিয়ার হর্তাকর্তাদের যারা পছন্দনীয় তাদের অনেক বড় ভুল ও পদস্খলনও চোখে পড়ে না। আবার যাদেরকে তারা পছন্দ করেন না তাদের পান থেকে চুন খসলেই আচ্ছামতো ধরে। সাধারণ বিচারে আমাদের দেশের গণমাধ্যমের চরিত্র মোটামুটি এটাই।
বরাবরই এদেশের মিডিয়ার একটি বড় কাটতির বিষয় আলেম-উলামা, মসজিদ-মাদরাসা, দ্বীনদার মানুষেরা। এই শ্রেণিটি সামান্য ভুল করলেও মিডিয়ার কাছে ‘মহাঅন্যায়’ হিসেবে ধরা পড়ে। এর মূল কারণ হলো, ওই মিডিয়া যারা পরিচালনা করছেন, অন্য অর্থে যারা সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত তাদের সিংহভাগ এই শ্রেণিটিকে দেখতে পারে না। মসজিদ-মাদরাসা, দ্বীনদার মানুষেরা তাদের যেন গলার কাঁটা! এজন্য সুযোগ পেলেই তারা ওই শ্রেণিটিকে ঘায়েল করেন। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। সাংবাদিকদের মধ্যেও অনেকেই আছেন এই শ্রেণিকে মন থেকেই পছন্দ করেন। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম।
আমাদের দেশে তিন ধারার শিক্ষা রয়েছে। একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখবেন, মিডিয়া সবসময় কওমি ধারার শিক্ষাব্যবস্থাকেই ঘায়েল করতে চায়। বাকি দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতি পেলেও সেটা তাদের চোখে খুব বড় করে ধরা পড়ে না। কিন্তু কোনো কওমি মাদরাসায় সামান্য একটু ত্রুটির খবর পেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে মিডিয়া। এর কারণ হলো, বাকি দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে কওমি ধারার নেতিবাচক সংবাদের কাটতি বেশি। আবার এই ধারার ইতিবাচক সংবাদ প্রচারে মিডিয়ার আগ্রহ একেবারেই কম। এর যে কাটতি নেই বিষয়টি এমন না। তবে ওই যে মিডিয়াচালকরা তাদের পছন্দের অঙ্গন নয় এটা। এজন্য তাদের ইতিবাচক কোনো সংবাদ আসুক সেটা অনেকটা ইচ্ছে করেই ছাপিয়ে যাওয়া হয়।
বছর-দুয়েক আগে আন্তর্জাতিক কয়েকটি মিডিয়ায় কওমি মাদরাসা নেতিবাচক শিরোনামে উঠে আসে। কওমি মাদরাসা- গুলোতে বলাৎকারের মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এবং সেটা নিয়ে ভেতরেরই কেউ কেউ সোচ্চার হচ্ছেন বলে তাদের খবরের ভাষ্য। যাকে কেন্দ্র করে এই খবর প্রচার হয়েছে সে একসময় কওমি মাদরাসাতে পড়েছে। অনেকটা ‘ঘরের কথা পরের কাছে বলা’র মতো করে সে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে পর্যন্ত স্টেটমেন্ট দিয়েছে। এতে সেই ছেলেটি একটি শ্রেণির অনেক বাহবা কুড়ালেও মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের ঘৃণা ও ধিক্কার পেয়েছে। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো এমনিতেই সবসময় ওঁৎ পেতে থাকে ইসলামপন্থিদের কোনো নেতিবাচক খবর পাওয়া যায় কি না!
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় নেতিবাচক খবর আসবে আর তারা সেটা ফলাও করে প্রচার করবে না, তা হয় না। সুতরাং আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো খুব জোরেশোরে প্রচার করেছে, কওমি মাদরাসাগুলো বলাৎকারে ভরে গেছে! এর বিহিত কী! এতো অপকর্ম যেখানে হয় সেই শিক্ষাব্যবস্থা থাকারই দরকার নেই! কথিত বুদ্ধিজীবীরা এমন দাবি তুলেছে সেটাও দেখেছি। অথচ বিশ^বিদ্যালয় যখন বেশ্যাখানায় পরিণত হয়; সেখানে যখন ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে উৎসব পালিত হয়, আবরারের মতো নিরীহ ছেলেদের পিটিয়ে মারা হয়, তখন কেউ এই দাবি তুলে না এই শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া উচিত!
আরও পড়তে পারেন-
আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
মুমিন জীবনে নামাযের গুরুত্ব
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
কওমি মাদরাসায় এ ধরনের অপরাধ যে দুই-চারটি হয় না সেটা বলছি না। এর সঙ্গে যারা জড়িত তারাও রক্তে-মাংসে মানুষ, তাদেরও পদস্খলন হতে পারে। এ ধরনের টুকটাক ঘটনার খবর আমরাও পাই। যারা এসবের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হওয়া জরুরি। কিন্তু সার্বিক বিচারে যে অপরাধটির কথা বলা হচ্ছে সেটার পরিমাণ কি এতোই বেশি যে, সেটা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে তুলে ধরতে হবে! ঘরোয়া বিভিন্ন প্রোগ্রামে এসব প্রসঙ্গ আসতে পারে। কিন্তু ‘ঘরের কথা পরের কাছে বলে’ যারা হিরো বনে যাওয়ার ভয়ংকর পথ বেছে নিচ্ছেন তাদের পরিণতি খুব একটা ভালো হয় না। এর দ্বারা কারও কারও সাময়িক বাহবা কুড়াতে পারেন, কিন্তু আল্লাহর অগণিত প্রিয় বান্দার চক্ষুশূল হওয়ার পরিণতি দুনিয়া-আখেরাতে নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। এর দুই-একটি নজির আমাদের চোখের সামনেই আছে।
[ দুই ]
আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৫০ বছর পেরিয়েছে। এই সময়ে দেশে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকা-ের ডাটা কোথাও না কোথাও সংরক্ষিত আছে। যে কেউ গবেষণা করে দেখতে পারেন, এই সময়ে কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা কী পরিমাণ অন্যায়কাজ করেছেন আর বাকি অন্য ধারার শিক্ষিতদের অপরাধের চিত্রটা কী! আমার দৃঢ় বিশ^াস, অন্য ধারার শিক্ষিতদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ অপরাধী পেলে কওমি মাদরাসায় সেই ভাগটি এক দুই ভাগের বেশি নয়। সাধারণ ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে অপরাধ সংঘটিত হয় এর ছিঁটেফোঁটাও হয় না কওমি মাদরাসায়। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যে পরিমাণ অনিয়ম আর অসততার আশ্রয় নেয়, এর সঙ্গে কওমি পড়–য়াদের তুলনাই চলে না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে একজন ছাত্র প্রতিদিন যে অন্যায় কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়ায় কওমি পড়ুয়া অনেকে সারা জীবনেও কোনোদিন সেই অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত হন না। অপরাধের পরিমাণ দিয়ে বিচার করলে সাধারণ ধারার ধারেকাছেও নেই কওমি ধারা।
কিন্তু এরপরও মাদরাসাপড়ুয়া এবং আলেম-উলামার নেতিবাচক কোনো সংবাদ পেলে আমাদের মিডিয়া যতটা আগ্রহের সঙ্গে যতটা ফলাও করে প্রচার করে, সেটা অন্য কোনো ধারার ক্ষেত্রে করে না। এর কারণ হলো, এই আইটেমটির কাটতি বেশি। একজন হুজুর কোনো অপরাধ করেছেন সেই খবরটি একজন পাঠক-দর্শক কিংবা শ্রোতা যতটা কৌতূহলের সঙ্গে গ্রহণ করে তা সাধারণ কোনো মানুষের ক্ষেত্রে করে না। এজন্য মিডিয়াগুলো এই ধরনের আইটেম পেলে কিছুটা রঙ লাগিয়ে বাহারি আঙ্গিকে উপস্থাপন করে। এ ধরনের দুই একটি ঘটনা পরপর ঘটলে সবাই মনে করতে থাকে হায় হায় হুজুররা এতো অপকর্ম করে! অথচ তাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি অপকর্মকারীরা আমাদের আশপাশে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদেরকে আমরা অপরাধীই মনে করছি না।
আলেম-উলামা বা মাদরাসা সংশ্লিষ্ট কেউ অন্যায় করলে সেটা গোপন রাখার কথা আমি বলছি না। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে কিছু গোপন করতে চাইলেও এখন অনেক কিছু সম্ভব নয়। আমি বলছি শুধু এসব খবরে মিডিয়া যতটা মাতামাতি করে আসলে বিষয়টা ততটা সিরিয়াস না। এটা সত্য, সাদা কাপড়ে দাগ লাগলে সেটা চোখে পড়ে বেশি। স্বাভাবিকভাবেই আলেম-উলামা বা মাদরাসাপড়ুয়া কেউ অপরাধ করলেও সেটা সবার চোখে পড়ে বেশি। কারণ, এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ আলেম-উলামা ও মাদরাসাপড়ুয়াদের প্রতি অন্যরকম ধারণা পোষণ করে। এটা তাদের ভালোবাসার দাবি। নিজেরা যত অন্যায়ই করুক মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্র কিংবা কোনো মাওলানা সাহেব সামান্য কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে যাক সেটা তারা প্রত্যাশা করে না। তারা এটা ভুলে যান, ইমাম-মুয়াজ্জিন কিংবা মাদরাসাপড়ুয়া একজন মাওলানা সাহেবও তাদের মতোই রক্তে-মাংসের মানুষ। শয়তান যেমন তাদের ধোঁকা দিয়ে অন্যায় কাজে লিপ্ত করে, সেই চেষ্টা মাওলানা সাহেবদের ক্ষেত্রে আরও জোরালোভাবে করে। যদিও শয়তান বেশিরভাগের ওপর সফল হতে পারে না, দুই চারজনের ওপর মাঝে মাঝে সফল হয়ে যায়।
তবে এক্ষেত্রে মসজিদ-মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। প্রবৃত্তির পাগলা ঘোড়া যেন কোনোভাবেই তাদেরকে বিপথগামী না করতে পারে; শয়তানের প্ররোচণায় যেন কোনোভাবেই পদস্খলন না হয় সেটার সুরক্ষা তাদের নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহর ভয় এবং বুজুর্গানে দ্বীনের সান্নিধ্য হতে পারে এর বড় সুরক্ষা। এজন্য মসজিদ-মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের আত্মসংশোধনের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। মাদরাসার ছাত্ররা যেন কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে না পারে সেই দিকে লক্ষ রাখতে হবে কর্তৃপক্ষকেই। অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া সহজ এমন পরিবেশ ও ব্যবস্থা সঙ্কুচিত রাখলে অনেক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে বেঁচে যাওয়া সম্ভব। মসজিদ-মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের সবসময় সতর্ক থাকা দরকার, যাতে সুযোগসন্ধানী মিডিয়া কোনোভাবেই তাদের ওপর শ্যেনদৃষ্টি ফেলতে না পারে। অনেক সময় বাড়তি সতর্কতা অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করে। এই অঙ্গনকে নিন্দুকদের শকুনি দৃষ্টি থেকে হেফাজতের ব্যবস্থা সংশ্লিষ্টদেরই করতে হবে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক- ঢাকা টাইমস; সম্পাদক- লেখকপত্র।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/