কওমি মাদ্রাসা: সামাজিক পুঁজি ও দারিদ্র্য বিমোচন

।। ড. মারুফ মল্লিক ।।

সোশ্যাল ক্যাপিটাল বা সামাজিক পুঁজি; এটা অপেক্ষাকৃত একটি নতুন ধারণা। অনেকের কাছেই এটা এক ধরনের অর্থহীন ধারণা মনে হবে। সমাজ কীভাবে পুঁজি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষ করে পুঁজিবাদের এই রমরমা যুগে। পুঁজির প্রচলিত সংজ্ঞার সঙ্গে সামাজিক পুঁজির ধারণা খুব বেশি যায় না। অনেকেই মনে করেন সামাজিক সম্পর্ক ও ঘটনাবলীর অতীব সরলীকরণ হচ্ছে সামাজিক পুঁজির ধারণা। সামাজিক পুঁজির নানা ধরনের সংজ্ঞা রয়েছে। সামাজিক পুঁজি বলতে আমি যেটা বুঝি তা হচ্ছে, সামাজিক সম্পর্কের ভেতর থেকে সৃষ্টি হওয়া ফলাফল- যা সামাজের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটা সামাজিক সম্পর্ক ও কাঠামোর উপর নির্ভরশীল। ফলে সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের উপর ভিত্তি করে সম্মিলিত যে শক্তি সমাজে গড়ে উঠে তাই সামাজিক পুঁজি এবং পুঁজি বা শক্তিকে ব্যবহার করে সমাজে ও অর্থনৈতিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন করা সম্ভব ও অপেক্ষাকৃত সহজতর।

আমাদের দেশে সামাজিক পুঁজির বড়, তাৎপর্যপূর্ণ ও এক অদেখা ভূবন হচ্ছে কওমি মাদ্রাসাগুলো। মাদরাসাগুলোকে নিয়ে এভাবে আমরা কখনো চিন্তা করিনি। কিন্তু সারাদেশে কওমি মাদরাসাগুলোর মাধ্যমে এই সামাজিক পুঁজির বিকাশ ঘটছে। মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধ ও পারস্পরিক সুদৃঢ়ভাবে সংযুক্ত। আমাদের অনেকেই মূলত কওমি মাদরাসা বলতে বর্তমানে হেফাজতে ইসলামকেই বুঝি এবং তাদের কর্মসূচিকে বিবেচনায় নেই। সন্দেহ নেই হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে কওমি মাদরাসাগুলো শক্তিশালী চরিত্র হিসেবে রাজপথে সাম্প্রতিক সময়ে আবির্ভুত হয়েছে। তবে দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উদ্যোগ বাস্তবায়নে মাদ্রাসাগুলোর জোরালো অবস্থান কখনই বিস্তারিতভাবে বলা হয়নি। অথবা তাদের সামাজিক পুঁজির কার্যকারিতা নিয়ে আমাদের এক ধরনের নাক সিটকানো ভাব রয়েছে। কিন্তু পথ চলার শুরু থেকেই মাদ্রাসাগুলো সামাজিক পুঁজি হিসাবে বিকশিত হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মাদ্রাসাগুলোর এক ধরনের রাজনৈতিক পরিচয় আমরা দেখতে পাই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন বা রাজনৈতিক শক্তির বাইরেও মাদ্রাসাগুলোর সামাজিক শক্তি রয়েছে। যা আমরা সামাজিক পুঁজি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

দেশ থেকে গরিবী হটাতে এনজিও মডেল নিয়ে কাজ করেছিলাম গত কয়েক মাস আগে। দারিদ্র্য বিমোচনে এনজিও মডেল কতটা কার্যকর এ বিষয়ে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদেরও পড়িয়েছিলাম। বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত ও উদাহরণ দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি এনজিও মডেলের ব্যর্থতা ও সফলতা নিয়ে। এনজিওগুলো মূলত সমাজের তৃণমূলে কাজ করে। সামাজিক পূঁজির ধারণাটা মূলত এনজিওগুলোও আলোচনায় নিয়ে এসেছে। সামাজিক পুঁজি বা সোশ্যাল ক্যাপিটালকে ব্যবহার করে এনজিওগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। আগেই বলেছি, সামাজিক পুঁজি বলতে এখানে সমাজের তৃণমূলে সম্মিলিত জনতার সংঘবদ্ধ শক্তিকে বিবেচনা করা হয়েছে। সারাদেশে এনজিওগুলোর কোটি কোটি সুবিধাভোগী ও কর্মী রয়েছে। এরা সম্মিলিতভাবে বিশাল শক্তি হিসাবে সমাজ রূপান্তরে কার্যকর শক্তি হিসাবে আবির্ভুত হতে পারে।

গত কয়েকদিন ধরে এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে একটা চমৎকার তথ্য পেলাম। তথ্য পাওয়া বলতে একজনের কাছ থেকে ধারণা পেয়ে একটু খোঁজ নিলাম। বিষয়টা হচ্ছে, দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে শক্তিশালী সামাজিক পুঁজির উপস্থিতি রয়েছে। এই পুঁজিকে ব্যবহার করে সামাজিক উদ্যোগ, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এনজিওর চেয়ে কওমি মাদ্রাসাগুলোর ভূমিকা অধিক ও বেশি কার্যকর। সামাজিক উদ্যোগ, শিক্ষাদান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে কওমি মাদ্রাসাগুলোর নিজস্ব একটা উন্নয়ন মডেল আছে। এই মডেল নিয়ে খুব বেশি আলাপ আলোচনা হয় না আমাদের সমাজে। মাদ্রাসাগুলোকে অনেকেই সেকেলে, ধর্মব্যবসায়ীদের আস্তানা, জঙ্গী তৈরির কারখানা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু এর পুরো কাঠামো এবং সমাজে এর প্রভাব নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা হয় না।

কওমি মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে সামাজিক পুঁজির বিকাশ

বস্তুত: সামাজিক পুঁজি ও সামাজিক বিনিয়োগের (সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট) সফল উদাহরণ হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা। সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি ও এই পুঁজির বিনিয়োগ নিজস্ব ব্যবস্থায় করে থাকে কওমি মাদ্রাসাগুলো। শুরু থেকেই কওমি মাদ্রাসাগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি দেখভাল করে। প্রথমত, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানদের মাদ্রাসাগুলো বিনামূল্যে পাঠদান, বইপত্র ও শিক্ষাউপকরণ সরবরাহ, আবাসন সুবিধাদানসহ খাবার প্রদান করে। শিশু হিসাবে মাদ্রাসায় প্রবেশ করে হাফেজ, আলেম, মাওলানা, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির হিসাবে বের হয়ে সারা দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষকতা শুরু করেন। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। মসজিদের ইমাম, খতীব ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেন এবং এই শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরিই সামাজিক দানের উপর নির্ভরশীল। মূলত যাকাত, ফেতরা, কুরবানীর পশুর চামড়াসহ বিভিন্ন জনের স্বতঃস্ফূর্ত দান ও সহায়তায় এসব মাদ্রাসা চলে। এটাকে সামাজিক দান বলা হলেও মূলত এটা সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট। সমাজ নিজস্ব উৎস থেকে সংগৃহিত সম্পদ এখানে বিনিয়োগ করে। এর বাইরে সরকার বা বিদেশে বসবাসকারী প্রবাসীদের কাছ থেকে কিছু কিছু অনুদান পায়। কিন্তু পুরো মাদ্রাসা ব্যবস্থার জন্য এটা নিতান্তই নগণ্য।

তাই অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসা মাতৃ ও পিতৃস্নেহের সমন্বয়ে শিশুদের পাঠদান ও অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করে। মাদ্রাসায় একই সঙ্গে প্রি স্কুলিং, স্কুল ও আফটার স্কুল কেয়ার বা স্কুল ও ডে কেয়ারের, এমনকি আবাসিক সুবিধাও আছে। ফলে অভিভাবকদের অনেকেই শিশুকে মাদ্রাসায় দিয়ে কাজে যেতে পারেন স্বাচ্ছন্দে। বিশেষ করে মহিলা শ্রমিকদের এটা বিশেষ সুবিধা সৃষ্টি করেছে। বাচ্চা লালন পালনে আলাদা অর্থ কিংবা শ্রম লাগে না।

মাদ্রাসার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সরকারি স্কুলের চেয়ে ভালো। একটা উদাহরণ দেই। সরকার স্কুল ফিডমিল চালু করার জন্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা খরচ করছে। ২০১৩ সালে শুরু হলেও ৯ বছর পরও সরকার সব স্কুলে এই কর্মসূচি শুরু করতে পারে নাই। এই উদ্যোগে সরকার বিশ্বব্যাংকের সহায়তা পেয়েছে। আমাদের আমলারা বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন ফিডমিল সরাসরি দেখে শিক্ষা লাভের জন্য। কিন্তু কাজ হয়নি। বর্তমানে সরকার স্কুল ফিডমিল চালুর জন্য ২,৫০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পে খিচুড়ির প্রস্তাব নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়েছে। এই বছরের কোনো এক সময় এই প্রকল্প শুরু হতে পারে।

আর বিপরীতে কওমি মাদ্রাসার দিকে নজর দিন একটু। দেখবেন এই মাদ্রাসাগুলোতে কমবেশি ২০ লাখ শিক্ষার্থী আছে। এদের বেশির ভাগই আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনবেলাই এরা মাদ্রাসায় নিজস্ব ব্যবস্থায় খাওয়া দাওয়া করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে ফিডমিলের মডেল আমাদের হাতের সামনেই আছে। আর সরকার এত এত দক্ষজনবল দিয়ে কর্মসূচি মাঠে নামাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।

চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু কওমি মাদ্রাসা শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগ শূন্য। সরকার ও বেসরকারি এনজিওর শূন্য বিনিয়োগে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের এমন এন্ড টু এন্ড মডেল বিরল এবং এই মডেল খুবই টেকসই। সামাজিক উন্নয়নের একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে কওমি মাদ্রাসাগুলো। কওমি মাদ্রাসার নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাকে যুক্ত করা গেলে এ থেকে আরো বহুমুখী সুফল পাওয়া যাবে।

কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে এনজিওর তুলনা কেন?

উন্নয়ন ধারণায় এনজিওদের তৃতীয় চাবি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। প্রথমটি হচ্ছে সরকার। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বেসরকারি খাত। গত শতকের ৭০ এর দশকে এনজিওর দ্রুত বিকাশ ঘটলেও ৯০ এর পর থেকে স্থানীয় রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক নেগোশিয়েশন্সে এনজিওদের প্রভাব বাড়তে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এনজিওদের প্রেশার গ্রুপ হিসাবে বিবেচনা করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এদের নন স্টেট অ্যাক্টর বলে বিবেচনা করা হয়।

রাজনীতিতে এনজিওদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির কারণে গবেষকরা এ বিষয়ে নানা কাজ করছেন। এদের মধ্যে অক্সফোর্ডের অধ্যাপক অ্যান্ড্রিউ হুরেল অগ্রগণ্য। বলতে পারেন আমি তার দ্বারা কিছু প্রভাবিত। আমার ডক্টরাল থিসিস লিখার সময় তার সঙ্গে কয়েকবার আলাপও হয়েছে। থিসিসে ছোট একটি চাপ্টার লিখেছি, জলবায়ু রাজনীতিকে কীভাবে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে এনজিওরা।

আরও পড়তে পারেন-

কওমি মাদ্রাসা ও এনজিও; উভয়েই একে অপরের সমালোচনায় মুখর থাকে। মাদ্রাসাগুলো মনে করে এনজিওরা সমাজ ও ধর্মকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে ধর্মান্তকরণের। অপরদিকে এনজিওরা মনে করে মাদ্রাসগুলো নারী স্বাধীনতা ও অধিকারের পথ রুদ্ধ করে রাখছে। সমাজে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা তৈরিতে মাদ্রাসাগুলোর ভূমিকা জোরালো। মূলত মুখোমুখি অবস্থানে থাকার কারণেই দুই প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করার আগ্রহ। এই দুইটি প্রতিষ্ঠান বিপরীত অবস্থানে থেকে কীভাবে কাজ করে, একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তা দেখার জন্য দারিদ্র্য বিমোচনে দুই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে লিখেছি স্বল্প পরিসরে। এ নিয়ে বিস্তারিত কাজ করার সুযোগ আছে। বলা দরকার, মাদ্রাসাগুলো বলে কয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করে না। তবে মাদ্রাসার সামাজিক অর্থনীতি আছে। মাদ্রাসাগুলোকে ঘিরে বড় অংকের অর্থ সক্রিয় থাকে। এই ভাবনা থেকেই দুইটি প্রতিষ্ঠানের তুলনা করা হয়েছে। সমাজে যে কোনো দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তুলনা হতে পারে যদি কোনো না কোনো ভাবে ওই দুইটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত বা বিপরীত অবস্থানে থাকে।

মাদ্রাসা এনজিও; সবাই দানের অর্থেই চলে

এটা সত্য, এসব প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের দান খয়রাতেই চলে। কিন্তু কেবল মাদ্রাসার ক্ষেত্রেই বলা হয় এরা দান খয়রাতের পয়সায় চলে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাইকিং করে অর্থ উত্তোলন করে, তাই একে আমরা ভিক্ষাবৃত্তি মনে করি। আর কর্পোরেট লোকজন অনলাইনে ব্যাংক ট্রান্সফার করে বিধায় বিদ্যানন্দকে অর্থ দান করাকে ডোনেশন বলি। আর বিদেশ থেকে টাকা পায় বলে এনজিওর অর্থকে আমরা ফরেন এইড বলি। তিনটাই কার্যত ভিক্ষা বা দানের টাকা। কারিতাস বা ওয়াল্ড ভিশন মূলত জার্মান চার্চের পয়সায় চলে। এই চার্চগুলো বিভিন্নভাবে মানুষজনের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। উত্তোলন করা অর্থ এরা বিভিন্ন দেশে পাঠায় চ্যারিটির কাজে। মাদ্রাসার হুজুররা যেভাবে টাকা তুলে এরাও একইভাবে তুলে থাকে। চার্চে প্রার্থনার সময় থলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে টাকা তুলে। শহরের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে টাকা নেয়। ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছ থেকে ধর্মকর আদায় করে। আমাদের হুজুরা বার্ষিক ওয়াজমাহফিল করে মাদ্রাসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করে। আর বিভিন্ন বার্ষিক সভা সেমিনার করে ফাদাররা ফান্ড রেইজ করে। ক্যাথলিক চার্চের এরকম দুই একটি অনুষ্ঠানে আমার যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছিল।

ইহলৌকিক কাজকর্মকে নিরুৎসাহিত করে মাদ্রাসাগুলো

অনেকেই এ ধরনের মন্তব্য করেন। এটা ভুল ধারণা। মাদ্রাসাগুলোতে ইসলামিক থিওলজি পড়ানো হয়। থিওলজি পঠন পাঠের ফলাফলের প্রয়োগ কিন্তু ইহজগতেই করা হয়। পরকালে এই জ্ঞানের প্রয়োগ সম্ভব নয়। ইসলাম বৈরাগ্যবাদকে সমর্থন করে না। বরং আমল করতে বলে। আমল মানে কেবল নামায, রোযা, হজ্জ বা যাকাত দেয়াই না। বরং পুরো জীবনটাই আমলে পরিপূর্ণ করতে হয়। বড় আলেম হলেই হবে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনও আমলের অংশ। যেমন- সৎ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন গঠন এবং আত্মীয়তা, পারিবারিক ও সামাজি সম্পর্ক, ইনসাফ, সহনশীলতা, মানবিকতা, সাম্য, পরোপকারি মানসিকতার বিকাশে পাঠ ও অনুশীলন দেয়া হয় মাদ্রাসাগুলোতে। আর এসব আমলের উপর পরকাল নির্ভর করে ইসলামের ব্যাখ্যা অনুসারে।

জিডিপিতে এদের অংশ নেই

এটাও ভুল ধারণা। উৎপাদন মানেই কেবল কলকারখানা বা কৃষি উৎপাদন নয়। শ্রমও পণ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। এর উৎপাদন হয় সমাজের ভিতর থেকেই। মাদ্রাসাগুলোকে ঘিরে বড় ধরনের শ্রম উৎপাদন ও বিক্রি হয়। হতে পারে এই শ্রমের মূল্য কম। এর ফলে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক বড় ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা- সম্পাদিত হয়। জ্ঞান বা নলেজকেও সম্পদ ও ক্ষমতা হিসাবে গণ্য করা হয়। এই সম্পদেরও লেনেদেন হয়। মাদ্রাসাগুলোতে জ্ঞান চর্চা করা হয়। এখন আপনার পছন্দ না বলে এটাকে বাতিল করতে চাইছেন। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার অনেক শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা অনেক সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে বেশি। সমাজ ও দর্শন নিয়ে এরা বেশ গভীরে গিয়ে পড়াশোনা করে। বলা হয়, মাদ্রাসায় বিজ্ঞান পড়ানো হয় না। হওয়ার কথাও না। ওরা থিওলজি নিয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চায়। ওদের বিজ্ঞান পড়ানো দরকার নাই। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থিওলজির ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট ফ্যাকাল্টি থাকে। ওইখানে কেবল থিওলজিই পড়ানো হয়। তবে হ্যাঁ শ্রমবাজারে এদের আরো অ্যাক্টিভ করার জন্য কারিগরিসহ নানামুখি শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

পরিচালন ব্যয়

মাদ্রাসাগুলো সংগৃহীত অর্থের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীদের জন্যই খরচ করে। এরা মূলত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিপরীতে এনজিওগুলোও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু যে কোনো প্রোগ্রামের ৮০ শতাংশ অর্থ এনজিওরা পরিচালনা ব্যয় হিসাবে খরচ করে। ফলে দেখা যাচ্ছে, এনজিওগুলোর থেকে মাদ্রাসাগুলো বেশি বিনিয়োগ বা খরচ করে তাদের প্রোগ্রামের জন্য। যে কারণে মাদ্রাসার হুজুর খুবই কম বেতন পান। আর এনজিও কর্মকর্তা, কর্মচারীরা ৬ ডিজিটের বেতন পান অনায়াসেই।

মাদ্রাসা কীভাবে সামাজিক পুঁজিকে সামাজিক উদ্যোগে রূপান্তরিত করতে পারে

পুঁজি শব্দের ব্যবহার নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। পুঁজি মানেই নিখাদ ক্যাপিটালিজম বা চরম লাভ, লোকসান ও দেনা পাওয়ার হিসাব মনে হতে পারে। তবে জনসম্পদও পুঁজির অংশ। এ হিসাবে মাদ্রাসার বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্টরা সামাজিক পুঁজি হিসাবেই সমাজে বা রাষ্ট্রের ভেতরে অবস্থান করে।

এই পুঁজিকে যদি কার্যকর ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে যাবতীয় আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ককে পেছনে ফেলে কওমি মাদ্রাসাগুলো সামনে এগিয়ে যাবার সুযোগ  পাবে।  বিশেষ  করে  বিভিন্ন   প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাদ্রাসাগুলোর অংশগ্রহণ সমাজের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। যেমন করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার পর মাদ্রাসার অনেক শিক্ষার্থীরা মৃত ব্যক্তিদের দাফনে সহায়তা করেছে। বিশেষ করে মাদ্রাসার কর্মীরা করোনার ক্রান্তিকালে এক কঠিন দায়িত্ব পালন করছে। করোনায় মৃত বাবাকে ফেলে যখন ছেলে চলে যাচ্ছে। রাতভর স্বামীর মৃতদেহ বাড়ির সামনে স্ত্রী ও সন্তান ফেলে রাখছে তখন মাদ্রাসার কর্মীরা দাফন করতে এগিয়ে গিয়েছিল। এই মাদ্রাসার স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন জায়গা থেকে মৃতদেহ এনে দাফন সম্পন্ন করছেন। সন্দেহ নেই মাদ্রাসায় শিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। এছাড়া সিলেটের বন্যার সময় মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহণ আমরা দেখেছি। মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ত্রাণ নিয়ে সিলেট ও এর আশপাশের প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ পরিচালনায় মাদ্রাসার কর্মীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল।

এভাবে সামাজিক উদ্যোগের পরিধি কওমি মাদ্রাসাগুলো আরো বাড়াতে পারে। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামের আলোকে এরা সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারে। যেমন পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কওমি মাদ্রাসাগুলো অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ইসলাম প্রাণ  ও  প্রকৃতি রক্ষায় কী ধরনের নির্দেশনা দেয়, এসব বিষয়ে জুমআর দিনে খুতবায় বয়ান দিতে পারে। উপকূলে বেড়িবাঁধ রক্ষায় তারা অংশগ্রহণ করতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মেরামত করে দিতে পারে। মানবাধিকার, গুম, খুন, জুলুম নিয়ে কথা বলতে পারে।

ইসলাম এক সামগ্রিক জীবনের কথা বলে। ইসলাম কোনো বিচ্ছিন্ন জীবনের কথা বলে না। বরং সম্মিলিতভাবে সমাজ ও পরবর্তীতে রাষ্ট্র গঠনের নির্দেশ দেয় ইসলাম। মদিনা সনদের বাস্তবায়ন থেকে পরবর্তীতে ইসলামের খিলাফতের বিস্তারকালেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব বিষয়েই নাগরিকের ভূমিকা সম্পর্কে ইসলামের পরিষ্কার নির্দেশনা আছে। কেবল মাঠের রাজনীতিই না, পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনেও মাদ্রাসাগুলোর ভূমিকা রাখার বিশাল সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে মাদ্রাসাগুলো তাদের সামাজিক পুঁজিকে ব্যবহার করতে পারে। মাদ্রাসাগুলো মূলত স্থানীয়দের সাহায্য ও সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। এই সামাজিক বিনিয়োগকে ব্যবহার করে তারা দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তনেও মাদ্রাসাগুলো ভূমিকা পালন করতে পারে। সামাজিক পুঁজি ও শক্তির সক্ষমতা নিয়ে আমাদের অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই। কিন্তু সুসংগঠিত এই পুঁজিকে দেশ ও সমাজ গঠনে বিনিয়োগ করার বিষয়ে মাদ্রাসাগুলো আরো মনোযোগ দিতে পারে।

লেখক: গবেষক, সাংবাদিক।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।