কওমী মাদরাসা ঈমানদার জনতার প্রাণকেন্দ্র

।। খন্দকার মনসুর আহমদ ।।

কওমী মাদরাসা এদেশে কুরআন-হাদীসের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে জাতিকে আলোকিত করার মহান দায়িত্ব পালন করে আসছে। অন্ধকারে আলোর প্রদীপ হয়ে জাতির মাঝে ঈমান ও দেশপ্রেমের চেতনা সঞ্চার করে যাচ্ছে। কওমী মাদরাসা হলো সেই চিরসবুজ সতেজ প্রাণবান বৃক্ষের ধারক, যার মূল জমিনে প্রোথিত আর শাখা-প্রশাখা ঊর্ধ্বলোকে বিস্তৃত। মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-‘তুমি কি লক্ষ্য করো না আল্লাহ কীভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? সৎ বাক্যের তুলনা উৎকৃষ্ট বৃক্ষ, যার মূল সুদৃঢ় এবং যার শাখা-প্রশাখা ঊর্ধ্বে বিস্তৃত।’ (সূরা ইবরাহীম- ২৪)।

সৎবাক্য মানে কালিমায়ে তাওহীদ। কওমী মাদরাসা দিন-রাত এই কালিমায়ে তাওহীদেরই প্রতিধ্বনি করে থাকে।

কওমী মাদরাসা এদেশের ঈমানদার জনতার বিন্দু বিন্দু মমতায় গড়ে ওঠা ইলমে ওহীর এক একটি আলোকিত পুষ্পোদ্যান। তাদের ভালোবাসার প্রাণকেন্দ্র। এর পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করে থাকেন এদেশের সর্বস্তরের সুধী-সাধারণ ঈমানদার জনতা। শুদ্ধ সুন্দর জীবনের জন্য এবং দেশের প্রতিটি মানব বসতিতে ঈমান, দেশপ্রেম ও মানবিকতার আলো জ্বেলে দেয়ার জন্যই এর জন্ম। এখানে এলে তাই ঈমান, দেশপ্রেম ও মানবিকতার আলো পাওয়া যায়। এখানে ঈমানদার মানুষের হৃদয় প্রশান্তি খুঁজে পায়।

তাই বলা যায়- কোনো কালবৈশাখীর তা-বের মুখে কওমী মাদরাসা নামক বৃক্ষে বা পুষ্পোদ্যানে একটি দোলা হয়তো লাগতে পারে, তবে তা উপড়ে ফেলা বা তছনছ করে দেয়ার সাধ্য কোনো ঝড়ের নেই। কওমী মাদরাসা এদেশে বানের পানিতে ভেসে আসা কোনো বস্তু নয়, যাকে একটু তরঙ্গাঘাতেই স্রোতের মুখে ঠেলে দিয়ে অজানার দিকে ভাসিয়ে দেয়া যায়। নয় কোনো জীবনীশক্তিহীন নড়বড়ে বৃক্ষ, যাকে সামান্য ধাক্কা মেরেই উপড়ে ফেলা যায়। দেশি বা বিদেশি কোন শক্তি বা পরাশক্তির চোখরাঙানিতে নিভে যাবার মতো কোনো ক্ষীণম্লান প্রদীপও নয় কওমী মাদরাসা। উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে উলামায়ে দেওবন্দ তথা কওমী মাদরাসার গৌরবদীপ্ত অবদান এর পরিচয়কে আরও সুস্পষ্ট করেছে। তাই কারোর কাছে ভালো লাগুক বা না লাগুকÑ কওমী মাদরাসা ছিলো, আছে এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ।

যদি কারো মনে এমন প্রশ্ন জাগে যে, কোন খুঁটির জোরে টিকে থাকছে কওমী মাদরাসা? মহান আল্লাহ তায়ালার বাণীতে দেখুন তার দ্ব্যর্থহীন জবাব। তিনি ইরশাদ করেনÑ ‘আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর হেফাযতকারী।’(সূরা আল-হিজর আয়াত-৯)। এই কুরআনই কওমী মাদরাসার মূল শক্তি ও চেতনা।

প্রিয় পাঠক! এ প্রসঙ্গে ইতিহাসের একটি চমৎকার ঘটনা শুনুন। একবার বৃটিশ সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ একটি পরিষদ গঠন করে সিদ্ধান্ত নিলোÑ হিন্দুস্তানে কুরআন শরীফের যত কপি আছে তা ক্রয় করে সাগরে ডুবিয়ে দিতে হবে। মুসলিম জাতি দরিদ্র। তাই টাকার বিনিময়ে সবার ঘর থেকেই কুরআন শরিফ ক্রয় করে নিয়ে আসা যাবে। কুরআন ডুবিয়ে দেয়ার জন্য গঠিত কমিটির সকল সদস্য এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দিল্লিতে সমবেত হলো। সরকারও এ বিষয়ে তাদেরকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছিলো। সেসময়ে দিল্লির সবচেয়ে বড় আলেম হিসেবে গণ্য হতেন শাহ আবদুল আজিজ দেহলভি (রহ.)। ইংরেজ কমিটি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য তাঁর মাদরাসায় পৌঁছলো। তারা গিয়ে হযরত মাওলানা শাহ আবদুল আজিজকে হুমকি দিয়ে বললোÑ এবার আমরা কুরআন শরিফ সব ক্রয় করে দরিয়ায় ফেলে দিবো। ফলে কিছুকালের মধ্যেই পুরো হিন্দুস্তান কুরআন শূন্য হয়ে যাবে। আমরা দেখবো আপনি কীভাবে কুরআন রক্ষা করেন।

মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ রহ. এই কর্মসূচি শোনে মুচকি হাসলেন এবং তাঁর সামনে বসা একজন তালিবুল ইলমকে আদেশ দিলেন- অমুক সূরাটি পড়, ছাত্রটি দাঁড়িয়ে তখনি ঐ সূরাটি মুখস্ত শোনিয়ে দিলো। তারপর ইংরেজরা পরীক্ষামূলক আরো কয়েকজন ছেলেকে এ মর্মে ইশারা দিলো যে, তোমরাও তোমাদের উস্তাদ যেসকল সূরা পড়তে বলেন তা পড়ে শোনিয়ে দাওতো! তারপর তাই হলো। তখন মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ বললেন, দেখুন! পবিত্র কুরআন এদের বক্ষে সংরক্ষিত রয়েছে। তাই পবিত্র কুরআনের সব কপি জ¦ালিয়ে দিলেও কুরআন অবশ্যই সংরক্ষিত থাকবে। তারপর ইংরেজ কমিটি মুখ কালো করে চলে গেলো এবং তাদের এই কর্মসূচি ব্যর্থ হয়ে গেলো। (হেকায়াতে শাহ আব্দুল আজিজ)।

মাদরাসার সবচেয়ে বড় গৌরবের বিষয় এটাইÑ মহান আল্লাহ মাদরাসাকে তাঁর পবিত্র কুরআনের হিফাযত ও খিদমতের জন্য কবুল করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

[ দুই ]

গত শতকের বিশ্ববিখ্যাত মনীষী আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)এর কণ্ঠে শুনুন এ মাদরাসার পরিচয়Ñ ‘আমি মাদরাসাকে পৃথিবীর সকল কেন্দ্র থেকে অধিক সংহত, শক্তিশালী, জীবনের যোগ্যতার অধিকারী এবং জাগ্রত কেন্দ্র বলে মনে করি। এর এক প্রান্ত নবুওয়াতে মুহাম্মদীর সঙ্গে মিলিত, আরেক প্রান্ত এই জীবনের সঙ্গে যুক্ত। মাদরাসা নবুওয়াতে মুহাম্মদীর আবে হায়াতের ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তা সিঞ্চন করে। মাদরাসা যদি তার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়, তাহলে জীবনের সব ক্ষেত-খামার শুকিয়ে যাবে এবং মানবতার মৃত্যু হতে থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীতে কোন্ প্রতিষ্ঠান মাদরাসার চেয়ে প্রাণবন্ত, জাগ্রত ও ব্যস্ত হতে পারে? জীবনের জিজ্ঞাসা অগণিত, জীবনের পরিবর্তন অগণিত, জীবনের প্রয়োজন অসংখ্য, জীবনের ভুল-ভ্রান্তি অজস্র, জীবনের স্খলন অগণ্য, জীবনের প্রতারণা অসংখ্য, জীবনের ডাকাত অসংখ্য, জীবনের আকাক্সক্ষা অগণিত, জীবনের প্রত্যাশা অগণিতÑ মাদরাসা যখন এই জীবনের পথ প্রদর্শন ও লক্ষ্যে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তখন তার আর অব্যাহতি কোথায়?’ [দেখুন- পা জা ছুরাগে যিন্দেগী]

হ্যাঁ, সায়্যিদ নদভী (রহ.)এর কণ্ঠে ধ্বনিত এ মূল্যবান বাণীর পাশাপাশি আমরাও উচ্চারণ করতে চাইÑ মাদরাসার অব্যাহতি নেয়ার সুযোগ নেই বলেই একে অব্যাহতি দেয়ার যে কোনো অপপ্রয়াসও সফলতার মুখ দেখেনি কোনদিন। যেহেতু কওমী মাদরাসা পবিত্র কুরআনের ধারক-বাহক, আর এই মহাগ্রন্থের হিফাযতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, সে কারণেই কোনো শক্তির পক্ষেই একে থামিয়ে দেয়া সম্ভব নয়।

আরও পড়তে পারেন-

আর সে কারণেই আন্তর্জাতিক ইসলাম বিদ্বেষী চক্রগুলো এবার ভিন্ন পরিকল্পনার পথে পা বাড়িয়েছে। ওরা ভাবছে- তাহলো কওমী মাদরাসা থেকে মহাশক্তির এ উৎসটাকেই ধীরে ধীরে সরিয়ে দেয়া অথবা কুরআনকে কাটছাট করে দেয়া যায় কি-না! (নাউযুবিল্লাহ)। আন্তর্জাতিক সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য কওমী শিক্ষা সংস্কারের নামে পবিত্র কুরআনের অংশবিশেষকে চর্চার বাইরে রেখে এমন এক পাঠ্যসূচি তৈরি করে দেয়ার পরিকল্পনার কথাও মাঝে মাঝে শোনা যায়Ñ যার মাধ্যমে কওমী মাদরাসাকে তার ঐতিহ্যের পথ থেকে বিচ্যুত করা যাবে এবং তৈরি করা যাবে আলেম নামধারী নির্জীব একদল বশংবদ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে অন্যায়Ñঅত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বশংবদদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে না। মদ ও মাদকদ্রব্য, সুদ-ঘুষসহ নানাবিধ পাপাচারের বিরুদ্ধে যাদের কণ্ঠ সোচ্চার হবে না। নর-নারীর অবাধ মেলামেশা আর পাশ্চাত্যের ভোগবাদী নির্লজ্জ জীবনচর্চার পথে যারা কোনো অন্তরায় রচনা করবে না। ইসলামের অনস্বীকার্য ফরয বিধান জিহাদের যারা বিকৃত ব্যাখ্যা দিবে এবং সা¤্রাজ্যবাদী শকুনদের যেকোনো আগ্রাসী তৎপরতার মুখে থাকবে নির্বিকার। ভীরু শেয়ালের মতো নিজ নিজ গুহায় বসে যারা সা¤্রাজ্যবাদীদের দেয়া স্বল্পমূল্যের চকলেট চুষে চুষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে জীবন-যাপন করবে। কখনও বা হয়তো ইতিহাসের পথভ্রষ্ট সাধক বল‘আম বা‘উরার মতো হাত তুলে দোয়া করবে- ‘হে আল্লাহ, তুমি চকলেটদাতাদের দীর্ঘজীবী করো।’

হ্যাঁ, কওমী মাদরাসা থেকে এখন এমন এক শ্রেণীর লেবাসসর্বস্ব আলেম তৈরির পরিকল্পনার কথাই শোনা যাচ্ছে। কারণ, কওমী মাদরাসাকে তার ঐতিহ্যের পথ থেকে বিচ্যুত করা সম্ভব হলে দেশে দেশে আধিপত্যকামী অপশক্তির আধিপত্য বিস্তারের পথে এবং অবৈধ দাদাগিরির পথে বিশ্বের বুকে আর কোনো উল্লেখযোগ্য অন্তরায় থাকবে না। গভীরভাবে দেশপ্রেম ও ইসলামী জাতীয়তাবোধসম্পন্ন ও দ্বীনি মূল্যবোধ রক্ষায় বদ্ধপরিকর এই কওমী মাদরাসাই যুগে যুগে বিশ্বব্যাপী সা¤্রাজ্যবাদের কালোহাত বিস্তারের পথে প্রধান অন্তরায়। সা¤্রাজ্যবাদী ও ব্র্রাহ্মণ্যবাদীশক্তি গভীরভাবে সে সত্য উপলব্ধি করেই বর্তমান বিশ্বে দেওবন্দী ধারার মাদরাসাসমূহ এবং দেওবন্দী চেতনার উলামাসম্প্রদায়কে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ স্থির করেছে এবং দেশে দেশে তাদের দোসরদেরকে কওমী মাদরাসা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নিযুক্ত রেখেছে। কিন্তু মহান আল্লাহর অনুগ্রহে দেওবন্দিদের অন্তর্গত চেতনায় ছড়িয়ে আছে পবিত্র কুরআনের এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা- ‘তারা ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূর নেভাতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে’। (সূরা সাফ্, আয়াত-৭)।

ফারসী কবির ভাষায়-
চেরাগে রা কেহ ইযাদ বর ফরুযাদ
কাছে কাশতফ যানাদ রিশাশ বছুযাদ
অর্থ- ‘যে প্রদীপ ওহে জ্বালালেন খোদ আল্লাহ পরোয়ার
নিভাতে চাইবে ফুৎকারে যে- তা, মুখ পুড়ে যাবে তার।’

[ তিন ]

মনে রাখতে হবে, এদেশ শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ। শত আউলিয়ার চোখের পানিতে এখানকার মাটি আর্দ্র। এখানকার মাটি ও মানুষের মাঝে ঈমানের বীজ উপ্ত। এদেশের সবুজ মাঠগুলি এক একটি পবিত্র জায়নামায। এদেশে অন্ন-বস্ত্র ও আলো-বাতাস গ্রহণের অধিকারের মতোই বিশুদ্ধ ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চাও মুসলমানদের জন্মগত মৌলিক অধিকার। এ কারণেই ইলমে ওহীর আলোকবর্তিকা কওমী মাদরাসাসমূহ রক্ষাও মুসলমানদের মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত। এদেশে বাস করতে হলে সাম্রাজ্যবাদের পদলেহনকারীদেরকেও এ সত্যটি অনুধাবন করতে হবে। এ বোধ এদেশের বিবেকবান মুসলিম জনতার আছে বলেই তাঁরা কওমী মাদরাসাকে ভালোবাসেন। যে জনশক্তিকে এদেশের ক্ষমতাপ্রিয় ব্যক্তিরা রাজনৈতিক স্বার্থে সম্মান করতে জানেন, আল্লাহর অনুগ্রহে সে শক্তিও কম নয় কওমী মাদরাসার সঙ্গে। বাহ্যত শুধু আলিম-উলামাকে এর পরিচর্যায় দেখা গেলেও অন্তরালে রয়েছে বিরাট জনশক্তি। তাঁরা আছেনÑ কবি নজরুলের ভাষায়Ñ ‘শক্তির পেছনে রুধীর ধারার মতো গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতা-রসের মতো অলক্ষে।’ তাঁরা কওমী মাদরাসাকে তাঁদের ঈমান ও আমলের আশ্রয়কেন্দ্র বলে মনে করেন। তাদের এ ভালোবাসা যেহেতু ঈমানের সূত্রে, তাই এটা রোধ করার সাধ্য কারোর নেই।

প্রসঙ্গত বলা যায়, কওমী মাদরাসায় পাঠ গ্রহণকারীদের অধিকাংশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সন্তানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও কওমী মাদরাসায় পাঠ গ্রহণ করে থাকে। বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত পদস্থ কর্মকর্তা, উচ্চ পর্যায়ের ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার আইনজীবী ও বিচারপতি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাগণও তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করছেন কওমী মাদরাসায়। ধর্মহীন আধুনিক শিক্ষার অন্তসারশূন্যতা অনুভব করে পরিণামদর্শী বিবেক আপন সন্তানের আখিরাত ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কওমী মাদরাসার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। আরও একটি জ্বলন্ত সত্য হলো, সাধারণ শিক্ষার নৈতিক দৈন্য অনুভব করে প্রায় সর্বস্তরের আধুনিক শিক্ষিত মানুষ তাবলীগ জামাতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছেন। অধুনা বিচ্ছিন্ন এতায়াতি সম্প্রদায়ের কথা বাদ দিলে তাবলীগ জামাত কওমী মাদরাসারই একটি ভ্রাম্যমাণ সর্বব্যাপী রূপ। অভিন্ন উৎস থেকেই কওমী মাদরাসা ও ‘তাবলীগ’ নামের দু’টি স্রোতধারার উৎপত্তি। তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. উলামায়ে দেওবন্দেরই হাতে গড়া সন্তান। তাবলীগী ধারার দ্বীনী দাওয়াতের সঙ্গে দলমত নির্বিশেষে এদেশের সাধারণ জনগণসহ শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত মানুষের রয়েছে আত্মার সম্পর্ক ও গভীর যোগ। তাবলীগ-সম্পৃক্ত এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কওমী মাদরাসাকে দেখেন তাঁদের আত্মার আত্মীয় বলয়রূপে। নিজেদেরকে কওমী মাদরাসার আলিম-উলামা ও তালিবে ইলমদের সহযাত্রী ভেবে ধন্যবোধ করেন। তাদের খেদমত করাকে মনে করেন সৌভাগ্য।

কওমী মাদরাসার একজন নগণ্য সেবক হিসেবে আমি এই ভালোবাসা অনুভব করি। এ প্রসঙ্গে আমার একটি ছোট্ট স্মৃতির কথা বলেই এ লেখার সমাপ্তি রেখা টানতে চাই। একবার আমি আমার মাদরাসায় জ্বর ও মাথাব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার অসুস্থতার সংবাদ শোনে আমাদের মসজিদে অবস্থানরত ভি.আই.পি তাবলীগ জামাত থেকে আমাকে দেখতে আসেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় হার্টবিশেষজ্ঞ ডাক্তার এস. আর. খান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন একজন সংসদ সদস্য। এস. আর. খানের মতো একজন বড় মাপের ডাক্তারের উপস্থিতিতে আমি বেশ সান্ত¡না অনুভব করলাম। আমি মানসিকভাবে বেশ সুস্থবোধ করলাম। ছাত্ররা নাস্তা পরিবেশন করলে তিনি তা গ্রহণ করছিলেন আর আমার চতুর্দিকে সাজানো গ্রন্থাগারের আলমারি ভর্তি কিতাবগুলো দেখছিলেন আর রসিকতা করে বলছিলেন, ‘এতো কিতাব পড়লে মাথা ধরবে না তো কী করবে?’ তাঁর এ রসিকতায় ছাত্ররা ঢের আনন্দ পেলো। অত্যন্ত মমত্ববোধের সঙ্গে তিনি আমাকে দেখলেন, কথা বললেন, আর আমার জন্য ব্যবস্থাপত্র লিখে দিয়ে কিছু পরামর্শ দিয়ে গেলেন। আমি তাঁর লিখে দেয়া ওষুধ সেবনের পর মহান আল্লাহর অনুগ্রহে দ্রুত সেরে উঠি। তাঁর এ আন্তরিকতায় আমি কওমী মাদরাসার প্রতি এদেশের বিবেকবান উচ্চশিক্ষিত মানুষের আন্তরিক ভালোবাসার কথাও অনুভব করতে পারি। দীর্ঘদিন পর ডাক্তার এস আর খান আবার যখন এলেন, তখন তিনি আমার খাটে উপবেশন করতে খুবই সংকোচ প্রকাশ করলেন এবং বললেন যে, তিনি একজন আলিমের খাটে উপবেশনের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। মূলত ঈমানদার জ্ঞানীদের চিন্তা-চেতনা এমনই হয়ে থাকে।

কুরআন সুন্নাহর শিক্ষাদান সূত্রে কওমী মাদরাসার প্রতি এ দেশের বিবেকবান মুসলিম জনতার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এমন অসংখ্য উদাহরণ তৈরি হয় প্রতিদিন। প্রতিটি কওমী মাদরাসা এদেশের ঈমানদার জনতার এক একটি আত্মার আত্মীয়-বলয়। আমরা মহান আল্লাহর কাছে কওমী মাদরাসার শুভার্থী জনতার উত্তম প্রতিদান কামনা করি এবং কওমী মাদরাসা ও আলিম সমাজের মানহানির চেষ্টায় লিপ্ত অবুঝ বন্ধুদের হিদায়াত কামনা করি।

– খন্দকার মনসুর আহমদ, মুহাদ্দিস- জামিয়া আরাাবিয়া বাইতুস সালাম, উত্তরা, ঢাকা।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।