।। মুফতি মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ নোমান ।।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা, সুপ্রতিষ্ঠিত বিধি-বিধান এবং উৎকৃষ্ট শিষ্টাচার। যা মানুষকে ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তির সন্ধান দেয়। বাকশক্তিসম্পন্ন প্রতিটি ব্যক্তিকেই নিজের মনোভাব প্রকাশের জন্য বাকযন্ত্রের সাহায্যে দৈনন্দিন কথা বলতে হয়। কারও কথায় থাকে মিষ্টতা, আর কারও কথায় থাকে তিক্ততা। সুন্দর কথায় পর হয়ে যায় আপন। কটু কথায় আপন হয়ে যায় পর। মানুষ কীভাবে কথা বলবে, কোন কথা বলবে, কোন ক্ষেত্রে চুপ থাকবে ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয় অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে ইসলাম। কথা বলার মধ্যে রয়েছে আশ্চর্য এক সম্মোহনী শক্তি। উত্তম ব্যবহার একদিকে মানুষের ভদ্রতা ও রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে, অপরদিকে তা মানুষকে অধিষ্ঠিত করে সম্মানের সুউচ্চ আসনে। কথার দ্বারা মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। প্রকাশ পায় তার মন মানসিকতা ও চিন্তাধারা। কথার মাধ্যমে মানুষ পৌঁছে যেতে পারে জান্নাতে। আবার কথা জাহান্নামে যাওয়ার কারণও হতে পারে। আলোচ্য প্রবন্ধে কথা বলার কিছু ইসলামি নীতিমালা ও শিষ্টাচার সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
কথার শুরু ও শেষে সালাম দেয়া
কথা বলার অন্যতম আদব হলো, সালামের মাধ্যমে কথা শুরু করা। এটি সর্বোৎকৃষ্ট অর্থপূর্ণ অভিবাদন। এর মাধ্যমে পরস্পরের জন্য শান্তি, কল্যাণ ও নিরাপত্তা কামনা করা হয়। ফলে উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভালোবাসা ও হৃদ্যতা। সালামের আদেশ দিয়ে আসমানী গ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وإذا دخلتم فسلموا على أنفسكم، تحية من عند الله مباركة طيبة.
‘যখন তোমরা ঘরে ঢুকবে নিজেদের লোকদেরকে সালাম করবে, কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত বরকত পূর্ণ ও পবিত্র দুআ’। (সূরা নূর, আয়াত- ৬১)। কথা বলার পূর্বে সালাম দেয়া বিশ্ব মানবতার অনুপম রূপকার প্রিয়তম নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর শাশ্বত সুন্নাহ। হযরত জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-
السلام قبل الكلام
‘কথা বলার আগেই সালাম বিনিময় হবে।’(তিরমিযী শরীফ, হাদিস- ৬২৯৯)। প্রথমে সালাম দেয়া আল্লাহর প্রিয় হওয়ার অন্যতম উপায়। হযরত আবু উমামা থেকে (রাযি.) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-
إن أولى الناس بالله من بدأ بالسلام
‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকটে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে প্রথমে সালাম দেয়’। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস- ৫১৯৭)। কথা বলার শেষেও সালাম দেয়া সুন্নাহ। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোন মজলিসে উপস্থিত হলে সে যেন সালাম করে, তারপর তার ইচ্ছা হলে বসে পড়বে, তারপর সে যখন উঠে দাঁড়াবে তখনো যেন সালাম করে। কেননা, পরের সালামের চাইতে প্রথম সালাম বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ (তিরমিযী শরীফ, হাদিস- ২৭০৬)।
উত্তম কথা বলা
মানুষের প্রতিটি কথা রেকর্ড হয়। ফেরেশতার রেজিস্টারে সংরক্ষিত হয়। পরকালে মুখ নিঃসৃত প্রতিটি কথার জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
ما يلفظ من قول إلا لديه رقيب عتيد.
‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে যে (লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত’। (সূরা কাফ, আয়াত- ১৮)। তাই মানুষের সাথে উত্তমরূপে কথা বলার আদেশ দিয়ে মহামহিম আল্লাহ বলেন-
وقل لعبادي يقول اللتي هي أحسن، إن الشيطان ينزغ بينهم، إن الشيطان كان للإنسان عدوا مبينا.
‘আর আমার (মুমিন) বান্দাদের বলে দাও, তারা যেন এমন কথাই বলে যা উত্তম,নিশ্চয় শয়তান মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’। (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত- ৫৩)। প্রাণের ধর্ম ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে, মুমিন ভালো কথা বলবে, অন্যথায় চুপ থাকবে। মানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক প্রিয় নবী (সা.) আমাদের এ নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন-
من كان يؤمن بالله واليوم الاخر فليقل خيرا او ليصمت
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (সহীহ বুখারী, হাদিস- ৬৪৭৫)। উত্তম কথা বলা মহাপুণ্যের কাজ। মন্দ কথা বলা বড় গুনাহের কাজ। এই বাস্তবতা যে ব্যক্তি উপলব্ধি করবে, তার কথা বলা যেমন অর্থবহ হবে, তেমনি তার চুপ থাকাও হবে তাৎপর্যপূর্ণ। কথা বলা অনেক সময় বিপদজনক, আত্মঘাতী ও সর্বনাশী হয়। যার পরিণামে জাহান্নামে যেতে হয়। তাই মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু প্রিয়তম নবী (সা.) আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন- اتقوا النار ولو بشق تمرة
‘তোমরা জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকো, এক টুকরো খেজুরের বিনিময়ে হলেও। যদি সেটা কেউ না পায় তাহলে সে যেন উত্তম কথা বলে’। (সহিহ বুখারি- ৬০২৩)।
অতএব মানুষের দোষ চর্চা করা, কাউকে কটু কথা বলে জর্জরিত করা, মিথ্যা বলা, চুগলখুরি করা, অশ্লীল কথাবার্তা বলা এবং অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করা, মন্দ নামে ডাকা ইত্যাদি গুনাহ থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, প্রতিটি কথা একটি তীরের মতো। ধনুক থেকে বের হওয়া তীর যেমন ফিরিয়ে আনা যায় না, তেমনি মুখ থেকে বের হওয়া কথাও ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। সুতরাং ভেবেচিন্তে উত্তম কথা বলাই শুভ বুদ্ধির পরিচায়ক।
স্পষ্ট ও ধীরস্থিরভাবে কথা বলা
বিশুদ্ধ উচ্চারণে স্পষ্ট করে কথা বলা চাই। বাক্যের প্রতিটি শব্দ যেন শ্রোতা সহজেই বুঝতে সক্ষম হয়। স্পষ্টতা সুন্দর কথার অন্যতম গুণ। শ্রোতার মনে স্পষ্ট কথার প্রভাব পড়ে বেশি। আম্মাজান হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কথা এত সুস্পষ্ট ছিল যে, প্রত্যেক শ্রোতা তাঁর কথা বুঝতো’। (আবু দাউদ শরীফ, হাদিস- ৪৮৩৯)। পাশাপাশি ধীরস্থিরতার সাথে কথা বলাও সুন্নাহ। খুব দ্রুত গতিতে কথা বলা, যা মানুষের বুঝতে কষ্ট হয়, তা দোষণীয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) কথাবার্তায় ধীরস্থির ছিলেন।
হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) এমনভাবে কথা বলতেন, যদি কোনো গণনাকারীর গণনা করতে ইচ্ছা করে তবে সে গুনতে পারবে’। (মুসলিম শরীফ, হাদিস- ৭৩৯৯)। এজন্য বিরতি দিয়ে ধীরে-সুস্থে কথা বলার অভ্যাস করা চাই। প্রয়োজনে আলোচনার চুম্বকাংশ পুনরায় বলা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা তিনবার পর্যন্ত পুনরুক্ত করতেন।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো কথা বলতেন, তখন তা তিনবার বলতেন, যাতে তা বুঝে নেয়া যায়। আর যখন কোনো গোত্রের কাছে এসে সালাম করতেন, তাদের প্রতি তিনবার সালাম করতেন’। (সহীহ বুখারি, হাদিস- ৯৫)। এতে একদিকে শ্রোতাদের বুঝতে সহজ হয়, অন্যদিকে মূল বিষয়ের উপরও ফোকাস করা যায়। আবার একদম বেশি গ্যাপ দিয়ে কথা বলাও শ্রোতাদের জন্য বিরক্তিকর। তাই মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই বাঞ্ছনীয়।
সুউচ্চ কন্ঠ ও কর্কশ ভাষায় কথা না বলা
ইসলাম মানবসমাজকে সর্বদা ভদ্রতা ও সভ্যতার শিক্ষা দেয়। অতিরিক্ত উচ্চস্বরে কথা বলা অভদ্রতা ও শ্রুতিকটু। এছাড়াও তা মানুষের ব্যক্তিত্ব খর্ব করে অনায়াসে। হযরত লুকমান হাকীম তাঁর প্রিয় পুত্রকে লক্ষ্য করে কিছু বিজ্ঞোচিত মূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে সেগুলো উদ্ধৃত করেছেন সুনিপুণভাবে। তার একটি হলো, সংযত স্বরে কথা বলা। কর্কশ কণ্ঠ পরিহার করা। হযরত লুকমান হাকীম সন্তানকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন-
واقصد في مشيك واغضض من صوتك، ان انكر الاصوات لصوت الحمير.
‘নিজ পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং নিজ কন্ঠস্বর সংযত রাখো। নিশ্চয়ই সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট স্বর গাধারই স্বর’ (সূরা লোকমান- ১৯)। তবে মেয়েদের জন্য পর পুরুষের সাথে কর্কশ স্বরে কথা বলাই ইসলামের নির্দেশ। প্রজ্ঞাময় আল্লাহর বাণী লক্ষ করুন-
يا نساء النبي لستن كاحد من النساء إن اتقيتن فلا تخضعن بالقول فيطمع الذي في قلبه مرض وقلن قولا معروفا.
‘হে নবী পত্নীগণ, তোমরা সাধারণ নারীদের মতো নও, যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো। সুতরাং তোমরা কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, পাছে অন্তরে ব্যাধি আছে এমন ব্যক্তি লালায়িত হয়ে পড়ে। আর তোমরা বলো ন্যায়সঙ্গত কথা’। (আহযাব- ৩২)।
আরও পড়তে পারেন-
- কওমি মাদ্রাসা: সামাজিক পুঁজি ও দারিদ্র্য বিমোচন
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
- সুখময় দাম্পত্য জীবনের নববী রূপরেখা
আবার একদম নিচু স্বরে কথা বলা, যা বুঝতে শ্রোতার কষ্ট হয়, ইসলামের নীতি বহির্ভূত। তাই মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই কাম্য। অনেকে কথার কিছু অংশ উচ্চস্বরে বলে আর কিছু অংশ খুব আস্তে বলে। ফলে অপর ব্যক্তি ভুল বুঝের শিকার হয়। কিংবা পরিপূর্ণ কথা বুঝতে পারে না। এটাও পরিত্যাজ্য।
বিশুদ্ধভাষায় কথা বলা
শুদ্ধ কথন ও প্রমিত উচ্চারণ শুনতে যেমন ভালো লাগে তেমনি তা শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখতেও সহায়ক হয়। ইসলামিক দাওয়ার জন্যও চমৎকার উপস্থাপনা অত্যন্ত অনুপেক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ। বিশুদ্ধ, মার্জিত ও শালীন কথামালা বয়ে আনে দাওয়াতের রকমারি সুফল। বলা যায়, দাওয়াতি কার্যক্রমকে বেগবান, প্রাণবন্ত ও আবেদনময় করে তুলে আকর্ষণীয় বিশুদ্ধ ভাষা ও সুন্দর উপস্থাপনা। তাই আল্লাহ তাআলা সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামকে স্বজাতির ভাষায় পূর্ণ দক্ষ ও বুৎপত্তিসম্পন্ন করে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
وما أرسلنا من رسول إلا بلسان قومه ليبين لهم.
‘আমি যখনই কোন রাসূল পাঠিয়ছি, তাঁকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের সামনে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারে’। (ইবরাহীম- ৪)।
মজার ব্যাপার হলো, বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দায়েমী ও শাশ্বত সুন্নাহ। তিনি জীবনে কখনো অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেননি। সমস্ত হাদিস শরীফের ভাষা সাহিত্যের সর্বোচ্চ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিয়েছেন- أنا أفصح العرب
‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী’। (তাবাকাতুশশাফিইয়াতিল কুবরা- ৬/৩২৪)। তাই এই সুন্নাহকে আমাদের পুনরুজ্জীবিত করতে হবে নব উদ্দীপনায়। সাওয়াবের আশায়। সুন্নাহর অনুসরণে। উম্মাহর কল্যাণে।
কথার মাঝখানে কথা না বলা
একই সঙ্গে দুজন কথা বলা অনুচিত। একজনের কথা বলার মাঝখানে অন্যজন কথা বলা ঠিক নয়। এমন করলে কেউ কারও কথা শুনবে না বা বুঝবে না। তাছাড়া এর দ্বারা কথার ছন্দপতন ঘটে, গতিশীলতা হ্রাস পায়। তাই নিয়ম হলো, একজনের কথা শেষ হলে আরেকজন কথা বলবে। অনুরূপভাবে এক বিষয়ে কথা বলার মাঝখানে অন্য বিষয় উত্থাপন করাও শিষ্টাচার পরিপন্থি। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদিন আল্লাহর রাসূল (সা.) একটি মজলিসে কথা বলছিলেন। ইতোমধ্যে তাঁর নিকট জনৈক বেদুঈন এসে জিজ্ঞেস করল, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? আল্লাহর রাসূল (সা.) (প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে) আলোচনায় রত থাকলেন। এতে কেউ কেউ বললেন, লোকটি যা বলেছে রাসূল (সা.) তা শুনেছেন; কিন্তু তার কথা পছন্দ করেননি। আর কেউ কেউ বললেন, বরং তিনি শুনতেই পাননি। আল্লাহর রাসূল (সা.) আলোচনা শেষ করে বললেন, কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে বলল, এই যে আমি, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যখন কোনো অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর কোনো কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করবে।’ (বুখারি, হাদিস- ৫৯)।
যাচাই করে কথা বলা
আমাদের সমাজে শোনা কথা তদন্ত ও অনুসন্ধান না করে প্রচার করে দেওয়ার প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এটি একটি নিন্দনীয়, গর্হিত ও নিকৃষ্ট অপরাধ। এর মাধ্যমে মানবসমাজে বিনাশ, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। নেমে আসে চরম বিপর্যয় ও মানবিক অবক্ষয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
يا ايها الذين آمنوا إن جاءكم فاسق بنبإ فتبينوا أن تصيبوا قوما بجهالة فتصبحوا على ما فعلتم ناد مين.
‘হে ঈমানদারগণ! কোন ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি না করে বসো। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে।’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত- ৬)।
এই মর্মে হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন-
كفى بالمرء كذبا ان يحدث بكل ما سمع.
‘মানুষ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যাই শুনে তাই বলে বেড়ায়।’ (সহীহ মুসলিম, হাদিস- ৫) পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া শোনা কথা বলে বেড়ানো মানুষকে বিভ্রান্ত করারই নামান্তর। কাজেই এক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক হওয়া কাম্য।
তৃতীয়জনকে এড়িয়ে কথা না বলা
কোথাও তিনজন একত্রে থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে অন্য দু’জন কানাকানি কথা বলা অনুচিত। দু’জন এমন ইঙ্গিতে কথা বলাও উচিত নয়, যা তৃতীয়জনের বোধগম্য নয়। হযরত ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন-
إذا كنتم ثلاثة فلا يتناجى رجلان دون الآخر حتى تختلطوا بالناس أجل أن يحزنه.
‘তোমরা তিনজন থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দু’জন কানে কানে কথা বলবে না। এতে সে মনে কষ্ট পাবে। তোমরা পরস্পর মিলে গেলে তবে তা করাতে দোষ নেই।’ (বুখারি- ৬২৯০)। অবশ্য চারজন বা এর অধিক হলে দু›জনে কানাকানি করা নিষিদ্ধ নয়।
অযথা কথা পরিহার করা
চারিদিকে অযথা ও অনর্থক বিষয়াদির ছড়াছড়ি। এসব বাজে কাজে সময় নষ্ট না করে যিকির আযকার, কুরআন তিলাওয়াত, মানবসেবার মতো পূণ্যের কাজ করার কতো সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে! কিন্তু আমরা কী করি? সুযোগ পেলেই অনর্থ আলাপচারিতায় মেতে উঠি! অথচ অযথা কথা মানুষকে আল্লাহ তাআলার যিকির থেকে বিরত রাখে। বেহুদা গল্প গুজবে মেতে ওঠা ও অনর্থক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া মুমিনের শান নয়। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন-
من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه.
‘ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা’। (সহীহ বুখারী, হাদিস- ৪৫৬৬)। অনর্থ বিষয় পরিহার সফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য। সফল মুমিনদের অন্যতম গুণ হচ্ছে, অযথা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
قد أفلح المؤمنون. الذين هم في صلاتهم خاشعون. والذين هم عن اللغو معرضون.
‘নিশ্চয় সফলতা অর্জন করেছে মুমিনগণ। যারা তাদের নামাযে আন্তরিকভাবে বিনীত। যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে।’ (সূরা মুমিনুন, আয়াত- ১-৩)।
এটি আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দাদেরও বিশেষ গুণ। দয়াময় আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেন-
والذين لا يشهدون الزور، وإذا مروا باللغو مروا كراما.
‘এবং (রহমানের বান্দা তারা) যারা অন্যায় কাজে শামিল হয় না এবং যখন কোন বেহুদা কার্যকলাপের নিকট দিয়ে যায় তখন আত্মসম্মান বাঁচিয়ে যায়’। (ফুরকান- ৭২)।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী শিষ্টাচার ও বিধি-বিধান মেনে চলার তাওফীক দান করুন!
লেখক: উস্তাযুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/