শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এক মহাআতংকের রূপ নিয়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাবে বিশ্বময় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা থমকে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানার উৎপাদন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বহুলাংশে বন্ধ হয়ে গেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে কুলকিনারা করতে পারছেন না। বিভিন্ন দেশের বিমান ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক দেশের মানুষ সম্পূর্ণ গৃহবন্দি অবস্থায় আছে। অভিভাবকরা সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন। বলতে গেলে এই করোনা মহামারিতে গোটা বিশ্বব্যবস্থা যেমন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম, তেমনি সমগ্র মানবজাতি চরম আতংকিত ও বিপর্যস্ত।
যে কোন রোগ-ব্যাধি বা মহামারির পেছনে কোন না কোনভাবে আর্থসামাজিক পরিবেশ, পরিস্থিতি ও মানব সৃষ্ট কারণ যেমন দায়ী থাকে, তেমনি মহামারির প্রাদুর্ভাবের আধ্যাত্মিক কারণও থাকে। যেমন- মানুষ যখন ব্যাপকহারে ভোগ-বিলাসিতা ডুবে অনাচার, ব্যভিচার, নেশা ও অখাদ্য-কুখাদ্য গ্রহণ করতে থাকে এবং স্বার্থান্ধ হয়ে ব্যাপকহারে জুলুম-অত্যাচার ও নিপীড়নে জড়িয়ে সমাজের নিম্ন-মধ্যবিত্ত, বিত্তহীন বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে, তখন অগোচরেই নতুন নতুন রোগের বিস্তার ঘটতে শুরু করে। এক সময় এসব নতুন রোগের মধ্যেই কোনটা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে জালেম ও ভোগবাদিদের ভীত কাঁপিয়ে দেয়। আধ্যাত্মিক যেসব কারণ থাকে, তার সাথেও মানবসৃষ্ট অনিয়ম ও অপরাধ জড়িত। সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; যার ফলে তাদের কৃতকর্মের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তাদের তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। (সূরা রূম- ৪১ আয়াত)।
অনুরূপ হাদীসেও হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং- ৪০১৯)।
বর্তমানে বিশ্বময় ভয়াবহরূপে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস জাতীয় মহামারী ও দূরারোগ্য ব্যাধি মূলতঃ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে শাস্তি ও সতর্কতামূলক হুঁশিয়ারী বলে মনে করছি। মানুষ যখন ব্যাপক হারে আল্লাহ তা’আলার অবাধ্যতা, নাফরমানি, জুলুম-অত্যাচার ও কর্তব্যজ্ঞান ভুলে ব্যাপকহারে ভোগ-বিলাসিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ তা’আলা মানুষদের সতর্ক করার জন্য পৃথিবীতে বিভিন্ন সতর্কতা ও শাস্তি নাযিল করেন।
বর্তমানে বিশ্বময় জুলুম-অত্যাচার ও পাপকর্ম মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কোন অন্যায় অপরাধ নেই, যেটা সমাজকে আক্রান্ত করেনি। মানুষ অন্ধের মতো ভোগ-বিলাসিতা, যেনা, ব্যাভিচার, নেশায় লিপ্ত হচ্ছে, সুদ-ঘুষকে অপরাধই মনে করছে না। খুন, গুম, অপহরণ, মারপিট, জেল-জুলুম, বিচারহীনতা, শোষণ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব অন্যায় কর্মকাণ্ডকে অপরাধই মনে করা হচ্ছে না। স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিথ্যাকে সত্যের মতো করে বলা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জান, মাল, ইজ্জত-আব্রুর কোন নিরাপত্তা নেই। অধিকারের জন্য ফরিয়াদ জানালে জঙ্গী, সন্ত্রাসী, চরমপন্থী বলে খুন-গুম করাকে মামুলি কাজে পরিণত হয়েছে।
করোনাভাইরাসের যে অপ্রতিরোধ্য প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রতিয়মান যে এই মহামারীও আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত এক কঠোর হুঁশিয়ারি ও আযাব। একমাত্র আল্লাহর দয়া, রহমত ও ইচ্ছা ছাড়া কেউ এটা রোধ করতে পারবে না। কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানেরও সেই ক্ষমতা নেই। পবিত্র কুরআন-হাদীসের ভাষ্যমতে বর্তমানের করোনাভাইরাস মাহামারির প্রাদুর্ভাব মূলত হুঁশিয়ারী ও কঠোর সতর্কতা হিসেবে আল্লাহ তায়ালা প্রেরণ করেছেন। যাতে মুসলমানরা সতর্ক হয়ে জুলুম, অত্যাচার, নাফরমানি ও গোনাহের কাজ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহমুখী, ন্যায়-নীতিবান ও সৎ হয়ে যায়। অন্যদিকে অমুসলিমরাও যেন শোষণ, জুলুম থেকে তাওবা করে মহান সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যমুখী বা ঈমান গ্রহণ করেন।
আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা এসব পরীক্ষার মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে সবর করে, তাদেরকে জান্নাতের সুখবর দাও’। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৫)।
কেন মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, এবং এমন পরিস্থিতিতে করণীয় কি, এসব আয়াত ও হাদীসে তার স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। এমন পরিস্থিতিতে নফসকে হারাম ও নাজায়েয বিষয়াদি থেকে হেফাজত রাখতে হবে। আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে গভীর নিমগ্ন হতে হবে। অস্থির হয়ে এলোমেলো আচরণ করা যাবে না, বরং সুস্থিরতার সাথে করণীয় নির্ধারণ ও ধৈর্যধারণ করতে হবে।
যে কোন মুসিবত ও কঠিন পরিস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে নামাযে রত হয়ে পড়তেন। কারণ, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করো ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে’। (সূরা বাকারা, ১৫৩ আয়াত)।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলতে হবে, যেখানে এ ধরনের মাহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে, সেখানে যাতায়াত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নিরাপদ এলাকার কেউ আক্রান্ত এলাকায় যেমন প্রবেশ করবে না, তেমনি আক্রান্ত স্থানের কেউও অন্য এলাকায় যাবে না।
ইতিহাসে দেখা যায়, ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় প্লেগ রোগ দেখা দিয়েছিল। ইতিহাসে যা ‘আম্মাউস প্লেগ’ নামে পরিচিত। তখন খলিফা ছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)। এই প্লেগ রোগের খবর জানার আগেই প্রশাসনিক প্রয়োজনে তিনি সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। ‘সারগ’ নামক জায়গায় পৌঁছার পর সেনাপতি হযরত আবু উবাইদাহ (রাযি.) কারো মাধ্যমে খবর জেনে খলিফাকে বললেন, সিরিয়ায় তো প্লেগ দেখা দিয়েছে।
হযরত উমর (রাযি.) প্রবীণ সাহাবীদেরকে পরামর্শের জন্য ডাকলেন। এখন কী করবো? সিরিয়ায় যাবো নাকি যাবো না? সাহাবীদের মধ্য থেকে দুটো মত আসলো। একদল বললেন, “আপনি যে উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন, সে উদ্দেশ্যে যান”। আরেকদল বললেন, “আপনার না যাওয়া উচিত”।
তারপর আনসার এবং মুহাজিরদের ডাকলেন পরামর্শ দেবার জন্য। তারাও মতপার্থক্য করলেন। সবশেষে বয়স্ক কুরাইশদের ডাকলেন। তারা এবার মতানৈক্য করলেন না। সবাই মত দিলেন- “আপনার প্রত্যাবর্তন করা উচিত। আপনার সঙ্গীদের প্লেগের দিকে ঠেলে দিবেন না।”
হযরত উমর (রাযি.) তাঁদের মত গ্রহণ করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মদীনায় ফিরে যাবেন। খলিফাকে মদীনায় ফিরে যেতে দেখে সেনাপতি আবু উবাইদাহ (রাযি.) বললেন, “আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর থেকে পালানোর জন্য ফিরে যাচ্ছেন?”
হযরত আবু উবাইদাহ (রাযি.)এর কথা শুনে উমর (রাযি.) কষ্ট পেলেন। আবু উবাইদাহ (রাযি.) ছিলেন তাঁর এতো পছন্দের যে, আবু উবাইদাহ (রাযি.) এমন কথা বলতে পারেন উমর (রাযি.) সেটা ভাবেননি।
হযরত উমর (রাযি.) বললেন, “ও আবু উবাইদাহ! যদি তুমি ব্যতীত অন্য কেউ কথাটি বলতো! আর হ্যাঁ, জেনে রাখো, আমরা আল্লাহর এক তাকদীর থেকে আরেক তাকদীরের দিকে ফিরে যাচ্ছি।”
আল্লাহর এক তাকদীর থেকে আরেক তাকদীরের দিকে ফিরে যাওয়ার মানে কী? উমর (রাযি.) সেটা আবু উবাইদাহ (রাযি.)কে বুঝিয়ে বলেন, “তুমি বলতো, তোমার কিছু উটকে তুমি এমন কোনো উপত্যকায় নিয়ে গেলে যেখানে দুটো মাঠ আছে। মাঠ দুটোর মধ্যে একটি মাঠ সবুজ শ্যামল, আরেক মাঠ শুষ্ক ও ধূসর। এবার বলো, ব্যাপারটি কি এমন নয় যে, তুমি সবুজ মাঠে উট চরাও তাহলে তা আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ী চরিয়েছো। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তাও তো আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ী চরিয়েছো।” হযরত উমর (রাযি.) বুঝালেন যে, হাতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভালোটা গ্রহণ করা মানে এই না যে আল্লাহর তাকদীর থেকে পালিয়ে যাওয়া।
কিছুক্ষণ পর হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাযি.) আসলেন। তিনি এতক্ষণ অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি পরিস্থিতি জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর হাদীসটি শুনালেন- “কোথাও প্লেগ বা মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা ছেড়ে অন্যত্র গমন করো না। অন্যদিকে কোনো এলাকায় মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গাতে প্রবেশ করো না”। (বুখারী শরীফ- ৫৭২৯, তিরমিযী শরিফ, হাদীস- ১০৬৫)।
হযরত রাসূল (সা.)এর হাদীসটি সমস্যার সমাধান করে দিলো। উমর (রাযি.) হাদীসটি শুনে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।
এক হাদীসে আছে- হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- “প্লেগ বা মহামারীতে মৃত্যু হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের জন্য শাহাদাত”। (সহীহ বুখারী- ২৮৩০)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) প্লেগ বা মহামারি সম্পর্কে বলেন, “এটা হচ্ছে একটা আযাব। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের উপর ইচ্ছা তাদের উপর তা প্রেরণ করেন। তবে, আল্লাহ মুমিনদের জন্য তা রহমতস্বরূপ করে দিয়েছেন। কোনো ব্যক্তি যদি প্লেগে আক্রান্ত জায়গায় সওয়াবের আশায় (পালিয়ে না বেড়িয়ে) ধৈর্য ধারণ করে অবস্থান করে এবং তার অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, আল্লাহ তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে, তাহলে সে একজন শহীদের সওয়াব পাবে।” (সহীহ বুখারী- ৩৪৭৪)।
রাসূলুল্লাহ (সা.)এর হাদীসে আমরা দেখতে পাই, প্লেগকে তিনি বলেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব, আবার বলেছেন এটা মুমিনদের জন্য শর্তসাপেক্ষে রহমত।
মাহামারি শাস্তি স্বরূপ তাদের জন্য, যেসব গাফেল মুসলমান অন্যায়, অপরাধ ও পাপকর্ম ছেড়ে তাওবা-ইসতিগফার করে নিজেকে সৎকর্মে ব্রত করে পরিশুদ্ধ হয় না এবং এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। অন্যদিকে কাফেররা জুলুম-অত্যাচার জারি রেখে ঈমান আনয়ন না করে বেঈমান অবস্থায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা। এতে তাদের দুনিয়াবি ভোগবিলাসিতা দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দ্রুত পরকালীন ভয়াবহ শাস্তিরও মুখোমুখি হয়ে পড়ে শাস্তিতে নিপতিত হয়।
অন্যদিকে মহামারি রহমত স্বরূপ তাদের জন্য, যারা এই মহামারিতে আতংকিত হয়ে সকল প্রকার অন্যায়, অপরাধ ও পাপকর্ম ছেড়ে তাওবা-ইসতিগফার করে নিজেকে সৎকর্মে ব্রত করে পরিশুদ্ধ হয়। তখন আল্লাহর রহমতে মহামারি থেকে সে মুক্তি পেলেও পরিশুদ্ধ হয়ে গেল এবং মৃত্যুবরণ করলেও পরিশুদ্ধ হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিল এবং শহীদের মর্যাদা লাভ করলো। অন্যদিকে কাফের বা অবিশ্বাসীদের জন্যও কল্যাণকর তখন হবে- যদি তারা এতে আতংকিত হয়ে মহান সৃষ্টকর্তা আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করেন। এতে মহামারি থেকে রক্ষা পেলে সে ঈমানদার হিসেবে বাকী জীবন যাপন করার সৌভাগ্য অর্জন করলো। আর মৃত্যুবরণ করলেও সে ঈমানদার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার সুযোগ পেল।
সুতরাং বর্তমান করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর নির্দেশনা মতে আমাদের সকলের কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহমুখী হয়ে যাওয়া। যার যার কৃতকর্ম পর্যালোচনা করা। সকল প্রকার অন্যায়, জুলুম, পাপাচার ও বেইনসাফী থেকে বিরত হয়ে ভবিষ্যতে আর কখনো না করার সংকল্প করে খালেস মনে তাওবা করা। ভবিষ্যত জীবনে আল্লাহ ও আল্লাহর পরিপূর্ণ আনুগত্য, ইবাদত-বন্দেগী, রাসূল (সা.)এর সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণ, সৎকর্ম ও সাধ্যমতো মাখলুকের সেবা করে যাওয়ার নিয়্যাতে দৃঢ়সংকল্প করা। যে যে জায়গায় অবস্থান করছেন, সে এলাকা কোনভাবেই ত্যাগ না করা। গৃহে অবস্থান করা এবং বাইরে ঘুরাফিরা না করা। কারণ, এতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার যেমন প্রবল আশংকা বিদ্যমান, তেমনি এতে আল্লাহর নির্ধারিত তাক্বদীরের উপর বিশ্বাস বা দৃঢ়তাও ঠুনকো হয়ে যায়। তাছাড়া স্থান বদলে দুনিয়াবি ফিতনায় জড়ানো বা শৃঙ্খলাতেও সংকট তৈরি হয়। কারণ, এতে নিরাপদ এলাকায় কোন আক্রান্ত ব্যক্তি গমন করার পর ওই এলাকায় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সে ব্যক্তিকে দায়ী করার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অস্থির ও আতংকগ্রস্ত না হয়ে নিজেকে আল্লাহর নির্ধারিত তাক্বদীরের উপর সোপর্দ করতে হবে। সুস্থিরতার সাথে চিকিৎসকদের পরিপূর্ণ নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বাজার-ঘাট ও দোকানপাটে ঘুরাঘুরি থেকে একেবারেই বিরত থাকতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে চলতে হবে। হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার পরিহার করে ঘরে তৈরি খাবার গ্রহণ করতে হবে। একান্ত জরুরত ছাড়া গণপরিবহণের বাস, ট্রেন ও লঞ্চে যাতায়াত পরিহার করতে হবে। সবসময় পাক-পবিত্র ও অজুর হালতে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুন্নাহ অনুযায়ী হাঁচি-কাশি ও হাই তোলার সময় মুখ ঢেকে রাখতে হবে। খাবার গ্রহণের আগে-পরে ভালভাবে হাত ধৌত করতে হবে। মুখে ও নাক-কানে হাত দিলে দ্রুত ধুয়ে নিতে হবে। যার যার নিত্য ব্যবহার্য কাপড়-চোপড় আলাদা রাখতে হবে। মসজিদে অজুর হালতে প্রবেশ করতে হবে। মসজিদে যাওয়ার সময় নিজেদের ব্যবহৃত জায়নামায নিয়ে যেতে পারলে উত্তম হয়। ফরয নামায শেষে নিজের ঘর বা বাসাবাড়িতেও সুন্নাত-নফল আদায় করা যাবে। রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে বা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মতো আশংকাজনক পরিস্থিতি তৈরি হলে নিজের ঘরে বসেও নামায আদায় করার অনুমতি ইসলামে রয়েছে। মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন বা কমিটির দায়িত্বশীলগণ প্রতি নামাযের আযানের আগে মসজিদের মেঝে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করবেন। আর এই সময়ে মসজিদের কাতারে কার্পেট না রাখাই উত্তম মনে করি। মুসল্লীদের যে কেউ ব্যক্তিগত জায়নামায ব্যবহার করতে পারেন।
ইসলামে পাকপবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাঁচবার নামায পড়তে পাক-পবিত্র ও অজু করতে হয়। মুসলমানদেরকে সবসময় পাক-পবিত্র কাপড় পরিধান ও পরিচ্ছন্ন হয়ে চলার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নিয়ম করে হাত-পায়ের বাড়তি নখ কাটা, অবাঞ্ছিত কেশ পরিষ্কার, মিসওয়াক, অজুর সময় তিনবার করে ভালভাবে মুখ-হাত-পা ধোয়া, গোসল, খাবারের আগে-পরে হাত ধোয়া, দস্তরখান ব্যবহার, ইস্তিঞ্জায় ঢিলাকুলুখ ও পানি ব্যবহার, নাপাক থেকে বাঁচতে পায়ে জুতা ব্যবহার, আতর বা সুগন্ধি ইত্যাদি নবীর সুন্নাহ। ইসলামের পাকপবিত্র থাকার নীতিমালা অনুসরণ করে চললে, শুধু করোনাভাইরাস নয় বরং সংক্রামক সকল রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা সহজ হয়।
সর্বোপরি দৈনন্দির নির্ধারিত ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি বেশি বেশি নফল নামায, কুরআন তিলাওয়াত ও যিকিরে থাকতে হবে। আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করে তার সাহায্য ও রহমত কামনা করতে হবে। আর বেশি বেশি নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়তে হবে। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) রোগ-ব্যাধির মহামারি থেকে হেফাজতে থাকতে বেশি বেশি এই দোয়া পড়তে বলেছেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ، وَالْجُنُونِ، وَالْجُذَامِ، وَمِنْ سَيِّئِ الأَسْقَامِ. (رَوَاهُ أَبو داود بإِسنادٍ صحيح))
উচ্চারণ- “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুযামি,ওয়া সাইয়ি ইল আসক্কাম’।
অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত, উন্মাদনা, কুষ্ঠ এবং সমস্ত দুরারোগ্য ব্যাধি হতে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং- ১৫৫৪)।
পরম করুণাময় আল্লাহ বাংলাদেশের সকল মানুষ এবং বিশ্ববাসীকে করোনাভাইরাসের মহাদুর্যোগ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
—————————————
লেখক: প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ, শিক্ষাপরিচালক ও শায়খুল হাদীস- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, আমির- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।