নিউজপ্রিন্ট ও অন্যান্য কাগজের দফায় দফায় নজিরবিহীন দাম বৃদ্ধির মুখে সংবাদপত্র ও প্রকাশনা শিল্প এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নিউজপ্রিন্টসহ সব ধরনের কাগজের দাম প্রায় দ্বিগুণের অধিক হয়ে গেছে। এমন সময় এর দাম আকাশ ছুঁয়েছে, যখন বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সঙ্কটে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যুদস্ত। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট দেশের শিল্পোৎপাদনে বড় ধরণের নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তৈরি পোশাক খাতসহ রফতানি বাণিজ্যে এই প্রভাব ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও ব্যাংকে ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানিকারকরা ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারায় আমদানিপণ্যের সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এতে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদন খরচ ও আমদানি ব্যয়বৃদ্ধির কারণে সব ধরনের কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিতে দেশের সংবাদপত্র, প্রকাশনা ও পাঠ্যপুস্তক শিল্প নজিরবিহীন সঙ্কটের মুখে পড়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরের শেষে টন-প্রতি নিউজপ্রিন্টের দাম ছিল ৫০ হাজার টাকা। চলতি নভেম্বরের শেষে এর দাম হয়েছে টন-প্রতি ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। একইভাবে সাদা কাগজের দামও দ্বিগুণ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে বছরের শেষে ও নতুন বছরের শুরুতে কাগজের চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। বিপুল পাঠ্যবই ছাপানো ছাড়াও শিক্ষাবর্ষের শেষে বার্ষিক পরীক্ষার আয়োজনে বিপুল কাগজ এবং শিক্ষাবর্ষের শুরুতে সব শিক্ষার্থীকে নতুন বই ও কাগজ কিনতে হয়। একই সময় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ডায়েরি ছাপানো ও ক্যালেন্ডার তৈরির কাজ হয়। জানা যায়, এ অবস্থায় নিউজপ্রিন্টসহ সব ধরনের কাগজের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে ছাপার কাজে ব্যবহৃত আমদানি নির্ভর প্লেটের দুষ্প্রাপ্যতা, কালির উচ্চমূল্য। একটি ম্যাগাজিন বা বই পাঠকের হাতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত প্রায় ৮-১০টি পেশাদার প্রতিষ্ঠান ঘুরে আসে। প্রতিটি খাতেই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এতে করে একটি বই, ম্যাগাজিন বা পত্রিকা বের করতে খরচ দ্বিগুণেরও বেশি পড়ছে।
আরও পড়তে পারেন-
- কওমি মাদ্রাসা: সামাজিক পুঁজি ও দারিদ্র্য বিমোচন
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
- সুখময় দাম্পত্য জীবনের নববী রূপরেখা
এই অস্বাভাবিকতা এখন চরম পর্যায়ে। এতে দেশের প্রকাশনা ও প্রেসবাজারে মারাত্মক স্থবিরতা নেমে এসেছে এবং বিপাকে পড়েছে সংবাদপত্র, প্রকাশক ও প্রেস মালিকরা। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে নানা কারণে দেশের সংবাদপত্র শিল্প নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গে দেশের সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীরা এক ধরনের সেল্ফ সেন্সরশিপে চলে গেছে। এতে সংবাদপত্রের স্বাভাবিক স্বাধীনতা বিঘ্নিত হচ্ছে। এবার কাগজসহ প্রকাশনা সরঞ্জামের নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে সংবাদপত্র শিল্পে বেশিরভাগ হাউজের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তেমনি অনেক পাক্ষিক, মাসিক ম্যাগাজিন অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়ে গেছে।
এর আগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সংবাদপত্র শিল্পকেও বড় আঘাত সইতে হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে করে সংবাদপত্রের প্রধান আয়ের উৎস বিজ্ঞাপনখাতেও সঙ্কট চলছে। সেই সাথে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। আর এ কারণে পত্রিকা বিক্রিও কমে গেছে। কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি শুধু সংবাদপত্র শিল্পেই কুপ্রভাব ফেলছে না, দেশের সামগ্রিক মুদ্রণশিল্প, পাঠ্যপুস্তক, সৃজনশীল প্রকাশনা এবং শিক্ষাব্যবস্থার উপরও বিরূপ প্রভাব ও অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সংবাদপত্র শিল্প নিছক একটি শিল্প নয়, এর সাথে দেশের হাজার হাজার সাংবাদিক-কর্মকর্তা, প্রেসকর্মী ও হকার পরিবারের রুটি-রুজি জড়িয়ে রয়েছে। অন্যদিকে সংবাদপত্র দেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আদর্শ, নৈতিকতা, জাতীয়তা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে যোগাযোগের টেকসই সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্র শিল্পের অস্তিত্ব ও বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে। নিউজপ্রিন্টের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সংবাদপত্র শিল্পে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা অশনি সংকেত।
এই পরিস্থিতিতে দেশের সংবাদপত্র মালিক ও প্রকাশনা শিল্পের সংশ্লিষ্টরা কাগজ আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে এবং জরুরি ভিত্তিতে বিনাশুল্কে কাগজের কাচামাল আমদানির সুযোগ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। সংবাদপত্র, পাঠ্যপুস্তক, সৃজনশীল প্রকাশনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপর উন্নত জাতি গঠন ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন-অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। জনগণের আয় ও কর্মংসংস্থান না বাড়লেও কাগজের মত গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সুদুরপ্রসারি নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সরকারের সুদৃষ্টি থাকা সময়ের দাবি। কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং এর কারসাজি বন্ধের পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারকে সংবাদপত্র ও জ্ঞান চর্চার যথাযথ বিকাশে এর সমস্যা ও সঙ্কট নিরসনে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে।
উদ্ভূত সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে মাসিক মুঈনুল ইসলামের সম্মানিত এজেন্ট, গ্রাহক, পাঠক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতি দাওয়াহ কার্যক্রম ও আদর্শ জাতি গড়ার প্রচেষ্টায় নিবেদিত পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পাশে থাকার জন্য সনির্বন্ধ অবেদন করছি। সাথে সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে এই পরিস্থিতি উত্তরণে সাহায্যের ফরিয়াদ জানাচ্ছি।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/