কাফিরদের ধন-দৌলত ও সন্তান-সন্ততি কিয়ামতের দিন কোন উপকারে আসবে না

।। আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ জসিমুদ্দীন ।।

মহান আল্লাহ সূরা মারইয়ামের ৭৭-৮৪ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-

اَفَرَءَیْتَ الَّذِیْ کَفَرَ بِاٰیٰتِنَا وَقَالَ لَاُوْتَیَنَّ مَالًا وَّ وَلَدًا ﴿ؕ۷۷﴾  اَطَّلَعَ الْغَیْبَ اَمِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمٰنِ عَهْدًا ﴿ۙ۷۸﴾  کَلَّا ؕ سَنَكْتُبُ مَا یَقُوْلُ وَنَمُدُّ لَهٗ  مِنَ الْعَذَابِ مَدًّا ﴿ۙ۷۹﴾  وَّ نَرِثُهٗ مَا یَقُوْلُ وَیَاْتِیْنَا فَرْدًا ﴿۸۰﴾  وَاتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِ اللهِ اٰلِهَۃً  لِّیَكُوْنُوْا لَهُمْ عِزًّا ﴿ۙ۸۱﴾  کَلَّا ؕ سَیَكْفُرُوْنَ بِعِبَادَتِهِمْ وَ یَكُوْنُوْنَ عَلَیْمْْ  ضِدًّا ﴿٪۸۲﴾  اَلَمْ  تَرَ اَنَّـاۤ  اَرْسَلْنَا الشَّیٰطِیْنَ عَلَی الْکٰفِرِیْنَ تَؤُزُّهُمْ  اَزًّا ﴿ۙ۸۳﴾  فَلَا تَعْجَلْ عَلَیْمْْ  ؕ اِنَّمَا نَعُدُّ لَهُمْ عَدًّا ﴿ۚ۸۴﴾

অনুবাদ: (৭৭) আপনি কি তাকে লক্ষ করেছেন যে, আমার নিদর্শনাবলীতে বিশ্বাস করে না এবং বলে- আমাকে অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি অবশ্যই দেয়া হবে। (৭৮) সে কি অদৃশ্য বিষয় জেনে ফেলেছে, অথবা দয়াময় আল্লাহর নিকট থেকে কোন প্রতিশ্রুতি প্রাপ্ত হয়েছে? (৭৯) না, এটা ঠিক নয়। সে যা বলে আমি তা লিখে রাখব এবং তার শাস্তি দীর্ঘায়িত করতে থাকব। (৮০) সে যা বলে, মৃত্যুর পর আমি তা নিয়ে নেব এবং সে আমার কাছে আসবে একাকী। (৮১) তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য ইলাহ গ্রহণ করেছে, যাতে তারা তাদের জন্য সাহায্যকারী হয়। (৮২) কখনই নয়, তারা তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে এবং তাদের বিপক্ষে চলে যাবে। (৮৩) আপনি কি লক্ষ করেননি যে, আমি কাফেরদের উপর শয়তানদেরকে ছেড়ে দিয়েছি। তারা তাদেরকে বিশেষভাবে (মন্দকর্মে) উৎসাহিত করে। (৮৪) সুতরাং তাদের ব্যাপারে আপনি তাড়াহুড়া করবেন না। আমি তো তাদের গণনা পূর্ণ করছি মাত্র।

তফসীর: কাফির মুশরিকদের দাবি ছিল, মহান আল্লাহ তাদেরকে পরকালে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দান করবেন। আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ তাদের এ দাবি খন্ডন করেন।

শানে নুযুল: হযরত খাব্বা ইবনে আরত (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জাহেলি যুগে আমি একজন কর্মকার (কামার) ছিলাম।

আসবিন আয়েলের নিকট আমার কিছু ঋণ পাওনা ছিল। আমি তার নিকট আসলাম তা নেয়ার জন্য। সে বলল, তুমি মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্কীকার না করা পর্যন্ত আমি এ পাওনা শোধ করব না। তখন আমি বললাম- আমি অস্বীকার করব না আল্লাহ তাআলা তোমাকে মৃত্যু দিয়ে পুনরায় জীবিত না করা পর্যন্ত। তখন সে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও মৃত্যুর পর জীবিত না হওয়া পর্যন্ত। তখন আমাকে সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেয়া হবে, আর তা দিয়ে তোমার পাওনা শোধ করব। তখন এ আয়াতদ্বয় নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ২০৯১)।

আল্লাহ তাআলা তাদের এ বিকৃত মন মানসিকতা উল্লেখ করে সেটার উত্তর দিয়ে বলেছেন, সে কীরূপে জানতে পারল যে, পুনরায় জীবিত হওয়ার সময়ও তার হাতে ধন-দৌলত ও সন্তান-সন্ততি থাকবে? সে কি উঁকি মেরে অদৃশ্য বিষয়সমূহ জেনে নিয়েছে? বলা বাহুল্য, তাদের এ কথা সত্য নয়। বরং তারা কিয়ামতের দিন আমার নিকট একা একা আসবে। সেখানে তাদের কোন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি থাকবে না।

আর তাদের অপরাধের ফিরিস্তিতে তাদের এ দাম্ভিক উক্তিও শামিল করা হবে, সেটাকে লিখে নেয়া হবে। তার পর সেটার শাস্তির বিধান করা হবে এবং এই দাম্ভিক উক্তির জন্য শাস্তিও ভোগ করতে হবে।

কাফিররা আখারাতেও সন্তান-সন্ততি, ধন সম্পদের অধিকারী হওয়ার যে দাম্ভিকতা দেখাচ্ছে, তা পরকালে পাওয়া তো দুরের কথা দুনিয়াতেও তারা যা প্রাপ্ত হয়েছে, তাও ত্যাগ করতে হবে। কারণ, সেগুলো তো তখন আল্লাহর মালিকানাধীন হবে। তাদের কাছ থেকে দুনিয়াতে প্রাপ্ত যাবতীয় সম্পদই কেড়ে নেয়া হবে। সমস্ত সম্পদ তাদের হস্তচ্যুত হয়ে অবশেষে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে। অতপর হাশরের মাঠে শুধু একাই রিক্ত হস্তে উপস্থিত হবে।

কিয়ামতের দিন কেউ কারো কোন উপকার করতে পারবে না

কাফির-মুশরিকরা আল্লাহ তাআলাকে ব্যতীত যাদের উপাসনা করে, তারা মনে করে যে, ঐ মাবুদরা তাদের সাহায্য করবে।

তাদের এ ভ্রান্ত ধারণার জবাবে মহান আল্লাহ বলেন, তাদের মাবুদরা তাদের সাহায্য করার পরিবর্তে তাদেরই ইবাদত অস্বীকার করবে এবং তারা তাদের শত্রু হয়ে যাবে। তাদের মাবুদরা তাদের কোন লাভ-ক্ষতি করতে পারবে না।

যেমন মহান আল্লাহ বলেন-

وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ

অর্থাৎ- আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদত করছে যা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। (সূরা ইউনুছ, ১৮)।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

وَ مَنۡ اَضَلُّ مِمَّنۡ یَّدۡعُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مَنۡ لَّا یَسۡتَجِیۡبُ لَهٗۤ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ وَ هُمۡ عَنۡ دُعَآئِهِمۡ غٰفِلُوۡنَ – وَ اِذَا حُشِرَ النَّاسُ کَانُوۡا لَهُمۡ اَعۡدَآءً وَّ کَانُوۡا بِعِبَادَتِهِمۡ کٰفِرِیۡنَ

অর্থাৎ- সে ব্যক্তির চেয়ে বেশি গোমরাহ আর কে হতে পারে, যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামতের দিন পর্যন্তও সাড়া দেবে না। বরং তারা তাদের আহ্বান সম্পর্কে গাফেল। (হাশরের ময়দানে) যখন সব মানুষকে একত্রিত করা হবে, তখন তারা যাদেরকে ডাকতো তারা তাদের দুশমন হয়ে যাবে এবং তাদের ইবাদতকে অস্বীকার করবে। (সূরা আহকাফ- ৫-৬)।

আরও পড়তে পারেন-

কিয়ামতের দিন কাফিরদের সহায় হওয়ার আশায় কাফেররা যাদের ইবাদত করতো, তারা এই আশার বিপরীতে তাদের শত্রু হয়ে যাবে। তারা বলবে, আল্লাহ এদেরকে শাস্তি দিন। কেননা, এরা আপনার পরিবর্তে আমাদেরকেও উপাস্য করে নিয়েছিল। আমরা কখনো এদেরকে বলিনি আমাদের বা শয়তান কাফেরদের সহচর: শয়তানরা কাফেরদের মন্দ কাজে প্রেরণা যোগাতে থাকে, মন্দ কাজের সৌন্দর্য অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করে দেয় এবং সেগুলোর অনিষ্টের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে দেয় না। তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে থাকে,  প্রলোভন ও কুমন্ত্রণা দেয় এবং পাপের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাদেরকে সীমালঙ্ঘন করতে দেয় এবং শয়তান হয় তাদের সহচর।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-

وَ مَنۡ یَّعۡشُ عَنۡ ذِکۡرِ الرَّحۡمٰنِ نُقَیِّضۡ لَهٗ شَیۡطٰنًا فَهُوَ لَهٗ قَرِیۡنٌ

অর্থাৎ- আর যে রহমানের যিকর থেকে বিমুখ হয়, আমারা তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান। অতঃপর সে হয় তার সহচর। (সূরা যুখরুফ- ৩৬ আয়াত)।

এরপর মহান আল্লাহ রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেছেন- আপনি কাফেরদের বাড়াবাড়ির কারণে  তাদের আযাবের দুআ করবেন না। কারণ, এদের দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এসেছে। আল্লাহর দেয়া অবকাশের মাত্র আর ক’দিন বাকি আছে। এ দিনগুলো পূর্ণ হতে দিন। আর যখন সেই অবকাশের নির্ধারিত কাল শেষ হয়ে যাবে, তখন তারা আল্লাহর আযাবে পতিত হবে। মহান আল্লাহ যালিমদের কৃতকর্ম হতে উদাসীন নয়।

ইরশাদ হয়েছে, অর্থাৎ- যালিমরা যা করছে সে ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে কখনো উদাসীন মনে করো না। (ইবরাহীম- ৪২)।

সুতরাং আপনি তাদের শাস্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করবেন না। শাস্তি সত্বরই হবে। কেননা, আমি তাদেরকে দুনিয়াতে বস-বাসের জন্য যে দিন ও সময় দিয়েছি, তা দ্রুতই পূর্ণ হয়ে যাবে। এরপর তাদের জন্য শাস্তিই শাস্তি।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-

 نُمَتِّعُهُمۡ قَلِیۡلًا ثُمَّ نَضۡطَرُّهُمۡ اِلٰی عَذَابٍ غَلِیۡظٍ

অর্থাৎ- আমি স্বল্পকালের জন্য ওদেরকে উপভোগ করতে দেব। অতপর ওদেরকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করবো। (সূরা লোকমান- ২৪)।

লেখক: মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতি এবং সহযোগী পরিচালক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।