কাফির-মুশরিক-যালিমরা কিয়ামতের দিন সব কিছু স্পষ্ট শুনবে ও দেখবে

আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন

মহান আল্লাহ সূরা মারয়ামের ৩৮-৪০ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-
أَسْمِعْ بِهِمْ وَأَبْصِرْ يَوْمَ يَأْتُونَنَا لَكِنِ الظَّالِمُونَ الْيَوْمَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ (৩৮) وَأَنْذِرْهُمْ يَوْمَ الْحَسْرَةِ إِذْ قُضِيَ الْأَمْرُ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ وَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ (৩৯) إِنَّا نَحْنُ نَرِثُ الْأَرْضَ وَمَنْ عَلَيْهَا وَإِلَيْنَا يُرْجَعُونَ (৪০)

অনুবাদ: (৩৮) যে দিন তারা আমার কাছে আসবে সে দিন তারা কতইনা শুনবে এবং কতইনা দেখবে! কিন্তু যালেমগণ আজ স্পষ্ট গোমরাহীতে নিপতিত। (৩৯) (হে নবী!) তাদেরকে আক্ষেপের দিন সম্পর্কে সতর্ক করুন, যে দিন সকল বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়সালা হয়ে যাবে, অথচ মানুষ গাফলতিতে পড়ে আছে এবং তারা ঈমান আনছে না। (৪০) নিশ্চয়ই পৃথিবী এবং এর উপর যারা আছে, সকলের ওয়ারিশ হব আমিই এবং আমারই কাছে তাদের সকলকে ফিরিয়ে আনা হবে। (সূরা মারয়াম)।

কিয়ামতের দিন কাফিরদের অবস্থা কিরূপ হবে সেই সম্পর্কে মহান আল্লাহ খবর দিচ্ছেন যে, আজ দুনিয়ার কাফিররা তাদের চোখ বন্ধ করে রেখেছে এবং কানে ছিপি দিয়েছে। তারা চোখে দেখে না এবং কানে শুনেও শুনে না। কিন্তু কিয়ামতের দিন তাদের দৃষ্টিশক্তি তীক্ষè এবং শ্রবণ শক্তিও প্রখর হয়ে যাবে। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ তাদের মুখ থেকেই এ কথা বের করে এনেছেন।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
وَلَوْ تَرَى إِذِ الْمُجْرِمُونَ نَاكِسُو رُءُوسِهِمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ رَبَّنَا أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوقِنُونَ
অনুবাদ: এবং হায়! তুমি যদি সেই দৃশ্য দেখতে, যখন অপরাধীরা নিজ প্রতিপালকের সামনে মাথা নুইয়ে (দাঁড়িয়ে) থাকবে (এবং বলবে!) হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা (এবার প্রকৃত বিষয়) দেখলাম ও শুনলাম। সুতরাং আমাদের পুনরায় (দুনিয়ায়) পাঠিয়ে দিন। তাহলে আমরা সৎকাজ করব। আমরা যথার্থ বিশ^াসী হয়ে গিয়েছি। (সূরা সাজদা, আয়াত- ১২)।

সেই দিন দেখা ও শোনা কোনই কাজে আসবে না এবং দুঃখ ও আফসোস করেও কোন লাভ হবে না। যদি তারা দুনিয়ায় চোখ ও কান কাজে লাগিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে মেনে নেয়, তাহলে আজ আল্লাহর আযাব থেকে রেহাই পাওয়া যেত। সেই দিন চোখ ও কান খুলে যাবে, অথচ আজ তারা অন্ধ ও বধির সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিয়ামত দিবস আফসোস ও পরিতাপের দিন

আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলছেন- তুমি মানুষকে ঐ দুঃখ ও আফসোস করার দিন থেকে সাবধান করে দাও যখন সমস্ত কাজের ফরমান হয়ে যাবে, জান্নাতীদেরকে জান্নাত এবং জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেই দুঃখ ও আফসোস করার দিন হতে তারা আজ উদাসীন রয়েছে, এমনকি এটাকে তারা বিশ্বাসই করছে না। তুমি তাদেরকে সেই দিন সম্পর্কে সতর্ক করো।

জাহান্নামীরা সেদিন পরিতাপ করবে যে, তারা ঈমানদার ও সৎকর্মপরায়ণ হলে জান্নাত লাভ করত; কিন্তু এখন তাদের জাহান্নামের আযাব ভোগ করতে হবে। পক্ষান্তরে বিশেষ এক প্রকার পরিতাপ জান্নাতীদেরও হবে।

আরও পড়তে পারেন-

পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি

যেমন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- কোন একদল মানুষ যখন কোন বৈঠকে বসবে তারপর আল্লাহর যিকির এবং রাসূলের উপর দরুদ পাঠ করা ব্যতীত যদি সে মজলিস শেষ হয়, তবে কিয়ামতের দিন সেটা তাদের জন্য আফসোসের কারণ হিসেবে দেখা দিবে। (জামে তিরমিযী- ৩৩৮০)।

অন্য এক হাদীসে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামত দিবসে মৃত্যুকে একটি ধূসর রঙের মেষের আকারে আনা হবে। তখন একজন সম্বোধনকারী ডাক দিয়ে বলবেন, হে জান্নাতবাসী! তখন তাঁরা ঘাড়-মাথা উঁচু করে দেখতে থাকবে। তখন সম্বোধনকারী বলবে, তোমরা কি তাকে চিন? তারা বলবে, হ্যাঁ, এ তো মৃত্যু। কেননা, তারা সকলেই তাকে দেখেছে তারপর (সেটিকে) যবেহ করা হবে। আর ঘোষক বলবেন, হে জান্নাতবাসী! স্থায়ীভাবে (এখানে) থাক। তোমাদের আর কোন মৃত্যু নেই। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করলেন-

وَأَنْذِرْهُمْ يَوْمَ الْحَسْرَةِ إِذْ قُضِيَ الْأَمْرُ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ وَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ (৩৯)
এবং তার হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন, দুনিয়াদারগণ দুনিয়ার গাফলতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। (সহীহ বুখারী- ৪৭৩০)।

পুরো পৃথিবীর মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, পুরো পৃথিবীর চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী আমি। অর্থাৎ, সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর একমাত্র আল্লাহই থাকবেন এবং সবকিছু থাকবে তাঁর মালিকানাধীন। সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও ব্যবস্থাপক আমি ছাড়া আর কেউই নয়। আমি ছাড়া সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র আমিই অবশিষ্ট থাকব। আমি ছাড়া কোন কিছুর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার দাবিদার কেউই হতে পারে না। আমার সত্তা যুলুম থেকে পবিত্র। আমি ন্যায় বিচারক। কারও প্রতি বিন্দুমাত্র অন্যায় করা হবে না। প্রত্যেকে তার কাজের প্রতিদান পাবে, তা যদি একটি মশার ওজনের সমানও হয় কিংবা অনু পরিমাণও হয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-

وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
অনুবাদ: এবং তোমরা সেই দিনকে ভয় করো, যখন তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিপূর্ণরূপে দেয়া হবে, যা সে অর্জন করেছে, আর তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না। (সূরা বাকারা, আয়াত- ২৮১)।

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَلِكُلٍّ دَرَجَاتٌ مِمَّا عَمِلُوا وَلِيُوَفِّيَهُمْ أَعْمَالَهُمْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ (১৯)

অনুবাদ: আপন কৃতকর্মের কারণে প্রত্যেক (দল)এর রয়েছে বিভিন্ন স্তর এবং তা এই জন্য যে, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের পুরোপুরি প্রতিফল দেবেন এবং তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না। (সূরা আহকাফ, আয়াত- ১৯)।

পৃথিবীর বুকে যা কিছু আছে সব ধ্বংস হয়ে যাবে, অনুরূপ আসমানে যারা আছে তারাও ধ্বংস হবে কেবলমাত্র আল্লাহর সত্তা এবং তিনি যাকে ইচ্ছা করবেন তিনি বাকি থাকবেন।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ لَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (৮৮)

অনুবাদ: সবকিছুই ধ্বংসশীল, কেবল আল্লাহর সত্তাই ব্যতিক্রম। শাসন কেবল তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। (সূরা কাসাস, আয়াত- ৮৮)।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ (২৬) وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ (২৭)

অনুবাদ: ভূ-পৃষ্ঠে যা কিছু আছে, সবই ধ্বংস হবে। বাকি থাকবে কেবল তোমার প্রতিপালকের গৌরবময়, মহানুভব সত্তা। (সূরা আর-রহমান, আয়াত- ২৬-২৭)।

দুনিয়ার সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর কিয়ামতের দিন আবার সবাই তাঁর নিকটই ফিরে আসতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَالْمَوْتَى يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ ثُمَّ إِلَيْهِ يُرْجَعُونَ (৩৬)
অনুবাদ: আর মৃতদের বিষয়টা এই যে, আল্লাহই তাদেরকে কবর থেকে উঠাবেন, অতঃপর তাঁরই কাছে তারা প্রত্যানীত হবে। (সূরা আনআম, আয়াত- ৩৬)।

লেখক: মুহাদ্দিস, মুফতি ও নায়েবে মুহতামিম- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।