হযরত ঈসা (আ.) এর জন্ম: কুদরতের বিস্ময়কর এক নিদর্শন!

।। মুফতী জসিমুদ্দীন ।।

মহান আল্লাহ সূরা মারয়ামের ১৬-২১ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-

 وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انْتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَانًا شَرْقِيًّا (১৬) فَاتَّخَذَتْ مِنْ دُونِهِمْ حِجَابًا فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا (১৭) قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَنِ مِنْكَ إِنْ كُنْتَ تَقِيًّا (১৮) قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلَامًا زَكِيًّا (১৯) قَالَتْ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ وَلَمْ أَكُ بَغِيًّا (২০) قَالَ كَذَلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِنَّا وَكَانَ أَمْرًا مَقْضِيًّا (২১)

অনুবাদ: এ কিতাবে মারয়ামের বৃত্তান্ত বিবৃত কর। সেই সময়ের বৃত্তান্ত, যখন সে তার পরিবারবর্গ থেকে পৃথক হয়ে পূর্ব দিকের এক স্থানে চলে গেল। (১৬) তারপর সে তাদের ও নিজের মাঝখানে একটি পর্দা ফেলে দিল। এ সময় আমি তার কাছে আমার রূহ (অর্থাৎ একজন ফিরিশতা) পাঠালাম, যে তার সামনে এক পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। (১৭) মারয়াম বলল, আমি তোমার থেকে দয়াময় আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি, যদি তুমি আল্লাহকে ভয় কর (তবে এখান থেকে সরে যাও)। (১৮) ফিরিশতা বলল, আমি তো তোমার প্রতিপালকের প্রেরিত (ফিরিশতা, আর আমি এসেছি) তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য। (১৯) মারয়াম বলল, আমার পুত্র হবে কেমন করে, যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি নই কোন ব্যভিচারিণী নারী (২০) ফিরিশতা বলল, এভাবেই হবে। তোমার রব বলেছেন, আমার পক্ষে এটা একটা মামুলি কাজ। আমি এটা করব এজন্য যে, তাকে বানাব মানুষের জন্য (আমার কুদরতের) এক নিদর্শন ও আমার নিকট হতে রহমত। এটা সম্পূর্ণরূপে স্থিরীকৃত হয়ে গেছে। (২১) (সূরা মারয়াম)।

ব্যাখ্যা: আলোচ্য আয়াত সমূহে হযরত ঈসা (আ.)এর জন্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এই ঘটনার ভূমিকা হিসেবে হযরত ইয়াহইয়া (আ.)এর জন্মের আলোচনা করা হয়েছে। কেননা, উভয় ঘটনা মহান আল্লাহ তাআলার কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শন। হযরত ইয়াহইয়া (আ.)এর জন্ম লাভ একজন বৃদ্ধ পুরুষ এবং বন্ধ্যা নারীর মাধ্যমে হয়েছে। পক্ষান্তরে হযরত ঈসা (আ.) কোনো পুরুষের (পিতা) মাধ্যম ছাড়াই হযরত মারয়ামের গর্ভে জন্ম লাভ করেন।  স্বাভাবিকভাবে এক নিদর্শন অপর নিদর্শনের জন্য সহায়ক হয়। যা  বুঝতে এবং মেনে নিতে মানুষের জন্য  সহজ হয়। (হিদায়াতুল কুরআন- ৫/২৬৩)।

আরও পড়তে পারেন-

হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, উভয় ঘটনা থেকে সামগ্রিকভাবে এই কথা বুঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলা বান্দাকে চাওয়ার মাধ্যমেও দান করেন। যেমন- হযরত যাকারিয়া (আ.)কে সন্তান চাওয়ার পর দান করা হয়েছিল। আবার কোনো বান্দাকে চাওয়া ছাড়াই দান করেন। যেমন- হযরত মারয়ামকে চাওয়া ছাড়াই সন্তান দান করেছেন। আল্লাহ তাআলার মুআমালা সকল বান্দার ব্যাপারে এক হয় না। ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। (তাফসীরে মাজেদী- ৫/২৬৩)।

হযরত মারয়াম (আ.) ছিলেন ইমরান ইবনে মাযান-এর কন্যা। তিনি ছিলেন দাউদ (আ.)এর বংশধর। এই পরিবারটি বনী ইসরাঈলের মধ্যে সম্মানিত পরিবার হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিল। হযরত মারয়ামের আম্মার নাম হান্না। তাঁর অপর এক বোন ছিল। যার সন্তান ছিলেন নবী হযরত ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া (আ.)। হযরত মারয়ামের আম্মার আশা ছিল, তার একজন পুত্র সন্তান হবে। যাকে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমতে উৎসর্গ করবেন। কিন্তু তিনি যখন কন্যা (মারয়াম) সন্তান জন্ম দিলেন, খুবই নিরাশ হলেন। কারণ, সে যুগে বাইতুল মুকাদ্দাসের খাদেম হওয়ার জন্য পুরুষ হওয়া শর্ত ছিল। নারীদের তা হওয়ার নিয়ম ছিলো না। কিন্তু হযরত মারয়াম (আ.)কে নিয়মের উপরে গিয়ে মসজিদের খেদমতের জন্য গ্রহণ করা হল। হযরত যাকারিয়া (আ.) তাঁর প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ৩৭নং আয়াতে এই ঘটনা চিত্রায়িত করে ইরশাদ করেন-

فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنْبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنًا وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِنْدَهَا رِزْقًا قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ

অনুবাদ: সুতরাং তার প্রতিপালক তাকে (মারয়ামকে) উত্তমভাবে কবুল করলেন এবং তাকে উৎকৃষ্ট পন্থায় প্রতিপালন করলেন। আর যাকারিয়া তার তত্ত্বাবধায়ক হল। যখনই যাকারিয়া তার কাছে তার ইবাদতখানায় যেত, তার কাছে কোন রিয্ক পেত। সে জিজ্ঞেস করল, মারয়াম! তোমার কাছে এসব জিনিস কোথা থেকে আসে? সে বলল, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহ যাকে চান অপরিমিত রিয্ক দান করেন। (সূরা আলে ইমরান- ৩৭)।

তিনি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী, দুনিয়ার প্রতি ঔদাসীন্য এবং সংযমশীলতায় মগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁর ইবাদত, আধ্যাত্মিক সাধনা ও তাকওয়ার কথা সর্বসাধারণের মুখে আলোচিত হতে থাকে। তাঁর লালন-পালনের দায়িত্বভার তাঁর খালু যাকারিয়া (আ.) গ্রহণ করেছিলেন। এ সময় তিনি ছিলেন বনী ইসরাঈলের নবী।

হযরত মারয়াম (আ.)এর অলৌকিক ঘটনা

বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর ঘরে গ্রীষ্মকালে শীতের ফল-মূল এবং শীতকালে গ্রীষ্মকালের ফল-মূল পেতেন। অতঃপর আল্লাহ পাক সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তার গর্ভে তার একজন অন্যতম প্রসিদ্ধ বান্দা ও রাসূল জন্ম লাভ করাবেন। তাই একদিন মাসিক বন্ধ হওয়ার পর বায়তুল মুকাদ্দাসে তার হুজরার গোসল খানায় গোসল করার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেন। আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরীল (আ.)কে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে তাঁর কাছে প্রেরণ করলেন। মারয়াম (আ.) জিবরীল (আ.)কে মানুষ মনে করে ভয় পেয়ে গেলেন। হয়তো কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করেছে- এই ভেবে তিনি বললেন, তুমি যদি আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর তাহলে আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহ তাআলার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হযরত জিবরীল (আ.) বললেন, আপনি যা মনে করেছেন তা নয়, আমি আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন দূত। আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে আপনাকে একটি পূতপবিত্র পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দান করার জন্য।

মহান আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ৪৫নং আয়াতে ইরশাদ করেন-

إِنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِنْهُ اسْمُهُ الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ وَجِيهًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمِنَ الْمُقَرَّبِينَ (৪৫)

অনুবাদ: হে মারয়াম! আল্লাহ তোমাকে নিজের এক কালিমার (জন্মগ্রহণের) সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হবে মাসীহ ঈসা ইবনে মারয়াম, যে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানে মর্যাদাবান হবে এবং (আল্লাহর) নিকটতম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা আলে ইমরান- ৪৫)।

হযরত জিবরীল (আ.)এর এ কথা শোনে মারয়াম (আ.) আরও বেশি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, সুবহানাল্লাহ! কিন্তু আমার সন্তান হওয়া কী করে সম্ভব? আমাকে কখনও কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই। সুতরাং এমন বাস্তবতায় আমার সন্তান হবে- এ কেমন কথা!

বিশ্বসীর প্রতি রাব্বুল আলামীনের কুদরত

পৃথিবীর মানুষকে মহান আল্লাহ চার পদ্ধতিতে সৃষ্টি করে তাঁর কুদরতকে প্রকাশ করেন। এক. পিতা-মাতা ছাড়া, যেমন- হযরত আদম (আ.)। দুই. শুধু পুরুষ হতে, যেমন- হযরত হাওয়া (আ.)কে হযরত আদম (আ.) থেকে। তিন. হযরত ঈসা (আ.)কে মা থেকে পিতা ছাড়া। চার. পিতা-মাতার মাধ্যমে বাকি আদম সন্তান।

হযরত জিবরীল (আ.) মারয়াম (আ.)এর বিস্ময় দূর করার জন্য বললেন, এটা সত্য বটে; অর্থাৎ (আপনাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি বৈধ উপায়ে বা অবৈধ উপায়ে), তবে স্বামী ছাড়া বা অন্য কোনো উপকরণ ও উপাদান ছাড়াও আল্লাহ তাআলা সন্তান দানে সক্ষম। তা আল্লাহর জন্য সহজ। তিনি যা চান তাই হয়। তিনি এই সন্তান এবং এই ঘটনা মানুষের জন্য একটি নিদর্শন বানাতে চান। এটা আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন হবে যে, তিনি সর্বপ্রকারের সৃষ্টির উপরই সক্ষম।

সূরা আম্বিয়ার ৯১নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَالَّتِي أَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيهَا مِنْ رُوحِنَا وَجَعَلْنَاهَا وَابْنَهَا آيَةً لِلْعَالَمِينَ

অনুবাদ: এবং দেখ সেই নারীকে, যে নিজ সতীত্ব রক্ষা করেছিল। তারপর আমি তার ভেতর আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পুত্রকে সমগ্র জগতবাসীর জন্য এক নিদর্শন বানিয়েছিলাম। (সূরা আম্বিয়া- ৯১)।

এভাবে তিনি নিজের ব্যাপক ও পূর্ণ ক্ষমতা ও বিশালত্বের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। জিবরীল (আ.) বলেন, এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার। এটাই আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্ত, যা তিনি পূর্ব হতেই ঠিক করে রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা যখন কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তা এড়িয়ে যাবার কোনো সুযোগ থাকে না।

– মুফতি জসিমুদ্দীন, উস্তাযুল ফিক্বহ ওয়াল হাদীস, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।