কুদরতের মহানিদর্শন: শিশু ঈসা (আ.)এর মায়ের কোলে কথোপকথন

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

মহান আল্লাহ সূরা মারয়ামের ২৭-৩৩ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-

فَأَتَتْ بِهِ قَوْمَهَا تَحْمِلُهُ قَالُوا يَا مَرْيَمُ لَقَدْ جِئْتِ شَيْئًا فَرِيًّا (২৭) يَا أُخْتَ هَارُونَ مَا كَانَ أَبُوكِ امْرَأَ سَوْءٍ وَمَا كَانَتْ أُمُّكِ بَغِيًّا (২৮) فَأَشَارَتْ إِلَيْهِ قَالُوا كَيْفَ نُكَلِّمُ مَنْ كَانَ فِي الْمَهْدِ صَبِيًّا (২৯) قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا (৩০) وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا (৩১) وَبَرًّا بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّارًا شَقِيًّا (৩২) وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدْتُ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا (৩৩)

অনুবাদ: তারপর সে শিশুটি নিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে আসল। তারা বলে উঠল, মারয়াম! তুমি তো বড় খতরনাক কাজ করেছ! (২৭) ওহে হারূনের বোন! তোমার পিতাও কোন খারাপ লোক ছিল না এবং তোমার মাও ছিল না অসতী নারী। (২৮) তখন মারয়াম শিশুটির দিকে ইশারা করলেন। তারা বলল, আমরা এই দোলনার শিশুর সাথে কীভাবে কথা বলব? (২৯) অমনি শিশুটি বলে উঠল, আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী বানিয়েছেন। (৩০) এবং আমি যেখানেই থাকি না কেন আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যত দিন জীবিত থাকি আমাকে নামায ও যাকাত আদায়ের হুকুম দিয়েছেন। (৩১) এবং আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত বানিয়েছেন। আমাকে উদ্ধত ও রূঢ় বানাননি। (৩২) এবং (আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে) আমার প্রতি সালাম যে দিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যে দিন আমার মৃত্যু হবে এবং যে দিন আমাকে পুনরায় জীবিত করে ওঠানো হবে। (৩৩) (সূরা মারয়াম)।

ব্যাখ্যা: হযরত মারয়াম (আ.) আল্লাহ তাআলার হুকুম মেনে নিজের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে জনসমক্ষে হাজির হন। তাকে ঐ অবস্থায় দেখা মাত্রই প্রত্যেকে কটাক্ষ করতে শুরু করে দিল এবং বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকে। তাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে, হে মারয়াম, তুমি তো বড়ই মন্দ কাজ করেছ। নাউফ আল বিকালী (রহ.) বলেন যে, লোকেরা হযরত মারয়াম (আ.)এর খুঁজে বের হয়েছিল।

কেননা, তিনি ছিলেন আল্লাহর আর্শিবাদপুষ্ট এক পরিবারের সদস্য। কিন্তু আল্লাহ তাআলার কী মাহাত্ম্য যে, তারা কোথাও তাঁকে খুঁজে পায়নি। পথে এক রাখালের সাথে তাদের সাক্ষাত হল। তারা রাখালকে জিজ্ঞেস করল! এরূপ এরূপ ধরনের কোন মহিলাকে এই জঙ্গলের কোন জায়গায় দেখছ কি? উত্তরে রাখাল বলে, না তো। তবে রাতে আমি এক বিষ্ময়কর দৃশ্য দেখেছি। তারা জিজ্ঞেস করল কী সেই দৃশ্য? সে উত্তরে বলল, আমার এই সব গরু এই উপত্যকার দিকে সাজদারত হয়েছিল। (তাফসীরে তাবারী- ১৮/১৮৭)।

লোকগুলো ঐ নিশানা ধরে চলতে শুরু করে। এমতাবস্থায় তারা হযরত মারয়াম (আ.)কে দেখতে পায় যে, তিনি সন্তানকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসছেন। লোকগুলোকে দেখে তিনি সেখানেই সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে পড়েন। তারা সবাই তাঁকে ঘিরে ধরে এবং বলতে থাকে- হে মারয়াম তুমি তো এক অদ্ভূত কান্ড করে বসেছ।

তারা বলল! হে হারুনের বোন! (এখানে হারুন বলতে হযরত মুসা (আ.)এর ভাই হারুন উদ্দেশ্যে নয়। বরং হারুন বলতে বনী ইসরাঈলের কোন একজন সৎ ব্যক্তি, মারয়াম (আ.) তার সহোদর বোন ছিলেন বা হযরত মারয়াম (আ.) নবী হারুন (আ.) এর বংশেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।) তুমি তো ভাল ঘরের মেয়ে। কী করে তুমি এরূপ অসৎ কাজ করলে? তোমার মাতা-পিতা উভয়েই ভাল ছিলেন। তোমার পরিবারের সমস্ত লোকই পবিত্র। এতদসত্ত্বেও তুমি কী করে এ কাজ করলে? কাওমের এই ভর্ৎসনামূলক কথা শুনে মারয়াম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর সন্তানের দিকে ইশারা করে বললেন, তার কাছে জিজ্ঞেস করুন। তারা তাঁর মর্যাদা স্বীকার করল না এবং তাঁকে অন্যায়ভাবে অনেক কিছু বলল।

আরও পড়তে পারেন-

তারা বলল: তুমি কি আমাদেরকে পাগল পেয়েছ যে, আমরা তোমার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করব? সে আমাদেরকে কী বলবে? হযরত ঈসা (আ.) মায়ের কোল থেকেই বলে ঊঠলেন, “হে লোক সকল! আমি আল্লাহর একজন দাস”। হযরত ঈসা (আ.)এর প্রথম উক্তি ছিল এটাই। তিনি মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করলেন এবং নিজের দাসত্বের কথা ঘোষণা করলেন। তিনি আল্লাহ তাআলার সত্তাকে সন্তান জন্মদান হতে পবিত্র বলে ঘোষণা দিলেন। এমনকি তা সাব্যস্ত করে দিলেন। কেননা, সন্তান দাস হয় না।

অত:পর তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। এতে তিনি তাঁর মায়ের দোষমুক্তির বর্ণনা করেছেন এবং দলীলও বর্ণনা করেছেন। নবীর কথা প্রকাশ করে প্রকারান্তরে তিনি এ কথা বলেছেন যে, আমার জননীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ সম্পূর্ণ ভ্রান্তি। কেননা, আমার নবী হওয়া এবং রেসালাত লাভ করা এ বিষয়েরই প্রমাণ যে, আমার জন্মে কোন গোনাহের দখল থাকতে পারে না। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন- ৮৩৪)।

নাউফ আল বিকালী (রহ.) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন ঐ লোকগুলো হযরত মারয়াম (আ.)কে তিরস্কার করছিল ঐ সময় হযরত ঈসা (আ.) তাঁর দুধ পান করছিলেন। তাদের ঐ তিরস্কার শুনে তিনি স্তন থেকে মুখ টেনে নেন এবং বাম পাশে ফিরে তাদের দিকে মুখ করে এই উত্তর দেন।

হযরত ঈসা (আ.) আরও বলেন, আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। আমি মানুষকে কল্যাণের কথা শিক্ষা দিব এবং তারা আমার দ্বারা উপকৃত হবে। আল্লাহ তাআলা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, যতদিন আমি জীবিত থাকব ততদিন যেন সালাত আদায় করি এবং যাকাত প্রদান করি। এবং মাতার প্রতি অনুগত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে শুধু মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার কথা উল্লেখ হওয়াতেও স্পষ্ট যে, ঈসা (আ.) এর পিতা ছিল না। বরং তাঁর জন্ম পিতা ছাড়া এক অলৌকিক মুজিযার ব্যাপার।

এরপর হযরত ঈসা (আ.) বলেন, আমার প্রতি ছিল শান্তি যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি ও শান্তি থাকবে যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি পুনরুত্থিত হব। কারণ জন্মের সময় আমাকে শয়তান স্পর্শ করতে পারেনি, আমি নিরাপদ ছিলাম। অনুরূপভাবে মৃত্যুর সময়ও পুনরুত্থানের সময়ও আমাকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। এর দ্বারাও হযরত ঈসা (আ.) দাসত্ব এবং সমস্ত মাখলূকের মত তিনিও যে আল্লাহর এক মাখলূক এটা প্রমাণিত হচ্ছে।

সমস্ত মানুষ যেমন অস্তিত্বহীন হতে অস্তিত্বে এসেছে, অনুরূপভাবে তিনিও অস্তিত্বহীন হতে অস্তিত্বে এসেছেন। অতঃপর তিনিও মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবেন এবং কিয়ামতের দিন জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবেন। তবে এ তিনটি অবস্থা অত্যন্ত কঠিন হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জন্য এটা সহজ হয়ে যাবে। তাঁর মধ্যে কোন উদ্বেগ ও ভয়-ভীতি থাকবে না, বরং তিনি পূর্ণভাবে শান্তি লাভ করবেন। তাঁর উপর দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।