।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।
মহান আল্লাহ সূরা মারয়ামের ২২-২৬ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-
فَحَمَلَتْهُ فَانْتَبَذَتْ بِهِ مَكَانًا قَصِيًّا (২২) فَأَجَاءَهَا الْمَخَاضُ إِلَى جِذْعِ النَّخْلَةِ قَالَتْ يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَذَا وَكُنْتُ نَسْيًا مَنْسِيًّا (২৩) فَنَادَاهَا مِنْ تَحْتِهَا أَلَّا تَحْزَنِي قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا (২৪) وَهُزِّي إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا (২৫) فَكُلِي وَاشْرَبِي وَقَرِّي عَيْنًا فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنْسِيًّا (২৬)
অনুবাদ: অতঃপর এই ঘটল যে, মারয়াম সেই শিশুকে গর্ভে ধারণ করল (এবং যখন জন্মের সময় কাছে এসে গেল) তখন সে তাকে নিয়ে দূরে এক নিভৃত স্থানে চলে গেল (২২)। তারপর প্রসব-বেদনা তাকে একটি খেজুর গাছের কাছে নিয়ে গেল। সে বলতে লাগল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং সম্পূর্ণ বিস্মৃত-বিলুপ্ত হয়ে যেতাম (২৩)। তখন ফেরেশতা তার নিচের এক স্থান থেকে তাকে ডাক দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না, তোমার প্রতিপালক তোমার নিচে একটি উৎস সৃষ্টি করেছেন (২৪)। এবং খেজুর গাছের ডালকে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে পাকা তাজা খেজুর তোমার উপর ঝরে পড়বে (২৫)। তারপর খাও ও পান কর এবং চোখ জুড়াও, মানুষের মধ্যে কাউকে আসতে দেখলে (ইশারায়) বলে দিও, আজ আমি দয়াময় আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি রোযা মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কোন মানুষের সাথে কথা বলব না (২৬)। (সূরা মারয়াম)।
ব্যাখ্যাঃ যখন হযরত মারয়াম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ শোনেন এবং তাঁর আদেশ মেনে নেন। তখন হযরত জিবরাঈল (আ.) হযরত মারয়াম (আ.)এর পরিধেয় বস্ত্রের যে অংশ খোলা ছিল সেখানে ফুঁ দেন। অতঃপর ঐ ফুঁ গর্ভাশয়ে গিয়ে পৌঁছে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি গর্ভধারণ করেন। গর্ভবতীরা গর্ভধারণের কারণে যে সমস্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হন যেমন অসুস্থতা, ক্ষুধা, বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরানো ইত্যাদি, তাঁর ভেতরেও এসব লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। মানুষের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে যায় যে, হযরত মারয়াম (আ.)এর গর্ভধারণের জন্য ইউসুফ নাজ্জারই দায়ী। কারণ, ঐ আবাস স্থলে সে ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ বাস করতো না। তিনি ঐ মসজিদের খাদেমের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু, সংসার বিমুখ, সত্যবাদী ইবাদতগুজার। হযরত মারয়াম (আ.) লোকসমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একাকী বাস করতে থাকেন, যেখান থেকে কেউ তাঁকে দেখতে পেত না এবং তিনিও কারো কাছে যেতেন না।
আরও পড়তে পারেন-
- পাশ্চাত্য শিক্ষা বনাম কওমী শিক্ষা
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- ইসলামে সংশয়প্রবণতা এবং সংক্রামক রোগ
এক পর্যায়ে তাঁর প্রসব বেদনা শুরু হলে তিনি লোকসমাজের আড়ালে যে স্থানে অবস্থান করছিলেন সেখানের একটি খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নেন। মুফাসসিরগণের মধ্যে তাঁর অবস্থানস্থলের ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। আল্লামা সুদ্দী (রহ.) বলেন, তাঁর অবস্থান স্থল ছিল পূর্ব দিকে, যেখানে মসজিদে আকসা অবস্থিত। ওয়াহব ইবনে মুনাব্বিহ (রহ.) বলেন, তিনি দ্রুত চলতে থাকেন এবং যখন সিরিয়া ও মিসরের মাঝে পৌঁছেন তখন তাঁর প্রসব বেদনা শুরু হয়। তার অন্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, যে স্থানে তিনি হযরত মারয়াম (আ.) হযরত ঈসা (আ.)কে প্রসব করেন তা ছিল মসজিদে আকসা থেকে আট মাইল দূরে ‘বায়তুল লাহাম’ নামক এলাকায়। (ইবনে কাসীর)।
ঐ সময় হযরত মারয়াম (আ.) নিজের মৃত্যু কামনা করতে লাগলেন। তিনি জানতেন যে, কেউই তাঁকে সত্যবাদী মানবে না এবং তাঁর বর্ণিত ঘটনাকে সবাই মনগড়া ধরে নিবে। পূর্বে যারা তাঁকে একনিষ্ঠ ইবাদতকারিনী বলতো তারাই তাঁকে অপরাধী ও ব্যভিচারিনী বলে আখ্যা দিবে। লোকসমাজে তাঁর দুর্নাম রটাবে। তাই তিনি বলতে লাগলেন, হায়! এর পূর্বে যদি আমি মরে যেতাম এবং যদি আমাকে সৃষ্টি করাই না হত! আমি যদি লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম! না কেউ আমাকে স্মরণ করত, না কেউ খোঁজ-খবর নিত, আর না কেউ আমার সম্পর্কে আলোচনা করত।
সম্ভবত: হযরত মারয়াম (আ.) ধর্মের দিক চিন্তা করে মৃত্যু কামনা করেছিলেন। কেননা, দ্বীনের ফিতনার সময় এ কামনা জায়েয। (ইবনে কাসীর)।
অর্থাৎ- মানুষ দুর্নাম রটাবে এর মোকাবেলায় আমি ধৈর্যধারণ করতে পারব না। ফলে অধৈর্য হওয়ার গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ব। মৃত্যু হলে গোনাহ থেকে বেঁচে যেতাম, তাই এখানে মৃত্যু কামনা মূল উদ্দেশ্য নয়, গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাই উদ্দেশ্য। তবে বিপদের কারণে মৃত্যু কামনা করা নিষিদ্ধ।
عن أنس بن مالك قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم لايدعون أحدكم بالموت لضر نزل به ولكن ليقل اللهم أحيني ما كانت الحياة خيرا لي وتوفني إذا كانت الوفاة خيرا لي.
হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যেন বিপদে পড়ে মৃত্যু কামনা না করে। বরং সে যেন বলে, হে আল্লাহ যে পর্যন্ত জীবিত থাকা আমার জন্য কল্যাণকর, আমাকে ততক্ষণ জীবিত রাখুন এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য কল্যাণকর, তখন আমাকে মৃত্যু দিন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং- ৩১০৮)।
মারয়াম (আ.)কে সান্তনা
হযরত মারয়াম (আ.)কে তাঁর নিচ থেকে ফেরেশতা ডেকে বললেন, তুমি পেরেশান হয়ো না, তোমার পাদদেশে তোমার রব এ নহর সৃষ্টি করেছেন।
এখানে কে হযরত মারয়াম (আ.)কে ডেকেছিল তা নিয়ে দু’টি মত রয়েছে। এক. তাকে হযরত জিবরাঈল (আ.) ডেকেছিলেন। তখন ‘তার নিচ থেকে’ এর অর্থ হবে, গাছের নিচ থেকে। দুই. কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, মারয়াম (আ.)কে তাঁর সন্তানই ডেকেছিলেন। তখন এটিই হবে হযরত ঈসা (আ.)এর প্রথম কথা বলা।
হযরত মারয়াম (আ.)এর জন্য মহান আল্লাহ নিজ কুদরতে একটি ছোট নহর জারি করে দেন। অথবা সেখানে একটি মৃত নহর ছিল। মহান আল্লাহ সেটাকে পানি দ্বারা পূর্ণ করে দেন।
মহান আল্লাহ হযরত মারয়াম (আ.)কে সম্বোধন করে বলেন, তুমি খেজুর গাছের ডালকে শক্ত করে ধর এবং ঝাঁকুনি দাও। সেটা তোমার উপর তাজা-পাকা খেজুর ফেলবে। এভাবে মহান আল্লাহ তাঁর জন্য খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করে তার কষ্ট লাঘব করে দেন এবং বলেন, তুমি এ থেকে তৃপ্তি সহকারে আহার কর এবং পান কর, অতঃপর নিজ সন্তান দেখে চোখ জুড়িয়ে নাও, আনন্দিত হও। অতঃপর মহান আল্লাহ বলেন, তুমি কারও সাথে কথা বল না, শুধু ইশারা ইঙ্গিতে তাদের বুঝিয়ে দাও যে, তুমি সিয়াম পালন করছ। অথবা ভাবার্থ হচ্ছে, আমি কথা বলা থেকেই সিয়াম পালন করছি। অর্থাৎ আমাকে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেন, ইসলাম পূর্বকালে সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত মৌনতা অবলম্বন করা এবং কারও সাথে কথা না বলার সিয়াম পালন ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। (ইবনে কাসীর)।
ইসলাম একে রহিত করে মন্দ কথা-বার্তা, গালিগালাজ, মিথ্যা, পরনিন্দা ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকাকেই জরুরি করে দিয়েছে।
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে যায়িদ (রহ.) বলেন যে, যখন হযরত ঈসা (আ.) তাঁর মাকে অথবা জিবরাঈল (আ.) বলেন, আপনি বিচলিত হবেন না। তখন তাঁর জননী হযরত মারয়াম (আ.) বলেন, কীরূপে আমি বিচলিত না হই? আমার স্বামী নেই এবং আমি কারও অধিকারভুক্ত বাঁদী বা দাসীও নই। দুনিয়াবাসী বলবে যে, এই সন্তান কীরূপে জন্ম নিল? আমি তাদের সামনে কী জবাব দেব? তাদের সামনে আমি কী ওজর পেশ করব? হায়! আমি যদি ইতোপূর্বেই মারা যেতাম! আমি যদি লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম!
ঐ সময় হযরত ঈসা (আ.) বলেছিলেন, হে আমার মা! কারও সামনে কিছু বলার আপনার প্রয়োজন নেই, যা কিছু বলার আমিই বলব। আমিই আপনার জন্য যথেষ্ট। লোকসমাজের কেউ যদি আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে, তাহলে আপনি বলবেন, আমি মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিরবতা অবলম্বনের মান্নত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না। এগুলো সবই হযরত ঈসা (আ.)এর তাঁর মায়ের উদ্দেশ্যে উক্তি।
মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/