কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ

।। তারেকুল ইসলাম ।।

কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কুরআন অবমাননার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন প্রতিবাদকারী নিহত হওয়ার সংবাদও এসেছে। কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হাজীগঞ্জে ও নোয়াখালীতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলো পরিদর্শন করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সাংবাদিকদের সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি এসব হামলা-ভাঙচুরের পেছনে ‘ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সম্পৃক্ততা আছে’ বলে দাবি করেছেন (১৭ অক্টোবর ২০২১, প্রথম আলো)।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এমন দাবির পেছনে যে-ধারণাটি কাজ করেছে তা হলো, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের ক্রমশ চীনমুখী হওয়া মেনে নিতে পারছে না আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রটি। সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতু এলাকা থেকে একের পর এক সন্দেহভাজন ভারতীয় নাগরিক (গুপ্তচর?) আটক এবং চীনকে তিস্তা প্রকল্পের কাজ দেয়ার কারণে ভারত বেশ নাখোশ বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাই সব মিলিয়ে আমাদের সরকারকে চীনমুখী নীতি থেকে ফেরানোর উদ্দেশ্যে কুমিল্লাসহ পরপর ঘটনাগুলোর অবতারণা করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

আর সাধারণত বাংলাদেশে এ ধরনের দৃশ্যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সংখ্যালঘু নির্যাতনের ফায়দা তোলে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। বিশেষত আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশসংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলোতে নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের তথাকথিত হিন্দু নির্যাতনের গল্প পুঁজি করে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট বাগানোর প্রয়াস চালায়। তারই ধারাবাহিকতায় কুমিল্লার ঘটনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের হিন্দুদের রক্ষায় ‘জরুরি হস্তক্ষেপ’ করতে মোদীকে আহ্বান জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। এই আহ্বান বাংলাদেশবিরোধী উসকানি এবং আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি প্রকাশ্য হুমকি হলেও শুভেন্দু বাংলাদেশের কুমিল্লা ও হাজীগঞ্জের মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাগুলোকে তার নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুরের বিধানসভার উপনির্বাচন ছিল খুব কাছে। শুভেন্দু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ঘটনার পর আরো তিন গুণ বেশি ভোটে এই আসনে জিতবে বিজেপি। ওপার বাংলায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজায় যা হয়েছে, তার উত্তর শান্তিপুরের মানুষ দেবে’ (১৮ অক্টো. ২০২১, মানবজমিন)।

এরই মধ্যে ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের অসংখ্য বাড়িঘর ও মসজিদে সংঘবদ্ধ হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালিয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। ‘ত্রিপুরা রাজ্য জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ’ অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার জেরেই ত্রিপুরায় মুসলমানদের ওপর হামলা করা হয়েছে (২২ অক্টো. ২০২১, হিন্দুস্তান টাইমস)। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাগুলোকে বিজেপি রাজনৈতিকভাবে ক্যাশ করবে। কারণ ১৫ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত ত্রিপুরার বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার নানা অপকর্ম ও অপশাসনের দরুন ব্যাপক সমালোচিত। এমনকি সম্প্রতি ত্রিপুরা রাজ্যের সুরমা আসনের বিজেপির বিধায়ক আশিস দাস দল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

আশিস অভিযোগ করে বলেছেন, ‘ত্রিপুরায় বিজেপি রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও অস্থিরতা তৈরি করেছে এবং ত্রিপুরার জনগণ বর্তমান রাজ্য সরকারের কর্মকাণ্ড ক্ষুব্ধ’ (৫ অক্টো. ২০২১, ভারতের এনডিটিভি)। সুতরাং, সামনের ত্রিপুরা নির্বাচনে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সাথে বিজেপি ভালো প্রতিনদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই পরবর্তী নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ক্ষমতালোভী বিজেপি তার চিরাচরিত মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক কার্ডের ওপর নির্ভর করতে পারে।

‘বাইলাইন টাইমস্’ নামে একটি বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ভারতীয় মিডিয়া খোলাখুলি লিখেছে: ‘Whereas attacks against Hindus by Muslims in Bangladesh have received around-the-clock coverage from mainstream Indian media outlets, along with statements of condemnation from the country’s political leaders, the past week’s non-stop violence against Muslims by Hindus in Tripura has been completely ignored – thus affirming suspicions that anti-Muslim violence enjoys the tacit approval of the Indian Government’ (28 Oct. 2021, CJ Werleman).

বস্তুতপক্ষে, বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমান- উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতি রাজনৈতিক স্বার্থের খেলায় পর্যবসিত হয়েছে। ডা. জাফরুল্লাহ তার উপরোল্লেখিত সাক্ষাতকারে এটাও বলেছেন, ‘ভারতের রাজনীতির সঙ্গে আমার দেশের রাজনীতি জড়িত হয়ে গেছে।’ উভয় দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বেনিফিশিয়ারি হয় মূলত ক্ষমতাসীন পক্ষই। দাঙ্গা লাগায় কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল আর সেটার ভুক্তভোগী হয় সাধারণ হিন্দু-মুসলিম উভয়ই। কুরআন অবমাননার প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাস্তায় গুলি খায় সাধারণ প্রতিবাদী ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা। আর এ সুযোগে হিন্দুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়গুলোতে অতর্কিত হামলা চালায় ক্ষমতাবান কায়েমি গোষ্ঠীরা। কুমিল্লায় আক্রান্ত মন্দিরগুলো পরিদর্শন করে স্থানীয়দের সাথে কথা বলার পর জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি গোবিন্দ প্রামাণিক এ হামলাগুলোর পেছনে স্থানীয় সরকারদলীয় এমপি’র অবহেলাকে দায়ী করেছেন (১৮ অক্টো. ২০২১, প্রথম আলো)।

এছাড়া হামলা ঠেকাতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা ও অসহযোগিতার জোরালো অভিযোগ তুলেছেন কুমিল্লার চাঁন্দমনি মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারাধন চক্রবর্তী ও সদস্য বিপ্লব ধর (১৫ অক্টো. ২০২১, বাংলা ডয়েচে ভেলে)। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিও সাক্ষাতকারে গোবিন্দ প্রামাণিক এ হামলাগুলোকে ‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক’ বলে সাব্যস্ত করেছেন এবং বলেছেন, কোনো দাড়ি-টুপিওয়ালা হুজুর বা মাদ্রাসার ছাত্ররা নয়, সাধারণ বেশভূষার লোকেরাই এসব হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীরা স্থানীয় নয়, বরং অচেনা ও বহিরাগত।

তথাকথিত ‘মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি’ নামের মুখস্ত বুলি আওড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোনো হামলা বা স্যাবোট্যাজের দায় এতদিন বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতের ওপর ঢালাওভাবে চাপানো হতো। কিন্তু তাদেরকে অনেক আগেই রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি প্রয়োগপূর্বক কোণঠাসা করে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, আর কারা বাকি থাকে যাদের দ্বারা এমন সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হামলা চালানো সম্ভব?

ঢাকা ট্রিবিউনের ১৪ অক্টোবরের এক রিপোর্টে জানা যায়, বান্দরবানের লামায় কুরআন অবমাননার প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন লামা উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক, পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম, উপজেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক মো. শাহীন ও ওলামা লীগের নেতারা। সেই প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে লামা উপজেলার কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরে দফায় দফায় হামলা চালানো হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে হামলাকারীদের সাথে সংঘর্ষ ঘটে। এতে পুলিশ সদস্যসহ অর্ধশত আহত হয়। সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ৪০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ৮টি বসতঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় বলে জানা গেছে। এখন বুঝতে কষ্ট হয় না, রাজনৈতিক দাঙ্গাবাজ আসলে কারা। তবে এটা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, ধর্মপ্রাণ ও নিরীহ প্রতিবাদকারী মুসলিমরা এসব সংঘবদ্ধ ভাঙচুর ও লুটপাটের সাথে জড়িত নয়।

সংবাদমাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে মন্দিরে যেসব হামলা ও লুটপাটের খবর এসেছে, সেসব হামলায় অংশগ্রহণকারী শত শত লোককে কারা এত দ্রুত সংগঠিত করেছে, তা তদন্তের দাবি রাখে। নেপথ্য কুশীলবদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এরমধ্যে রংপুরের পীরগঞ্জে গত ১৭ অক্টোবরের ঘটনার মূল হোতা হিসেবে সৈকত মণ্ডল নামে ছাত্রলীগের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। সুতরাং, সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে তথাকথিত সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগের আড়ালে আলেম-ওলামা, ইসলামপন্থী ও বিরোধী দলকে ঘায়েল করার যে-রাজনৈতিক ন্যারেটিভ এতদিন চর্চিত ছিল, সেটার জারিজুরি ইতোমধ্যে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।

যা হোক, কুরআন অবমাননার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে গভীর আঘাত লেগেছে; কিন্তু পাশাপাশি এটাও আমাদের বুঝা জরুরি যে, দেশব্যাপী দাঙ্গা-পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। কারণ পূজামণ্ডপে সকলের সামনে এভাবে মূর্তির পায়ের ওপর কুরআন রাখলে এর পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যে বা যারা কুরআন অবমাননার কাজটা করেছে, তারা জেনেবুঝে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই তা করেছে। কোনো সাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দু বা মুসলিমের পক্ষে এ ধরনের কাজ করার কথা নয়। এটি কোনো একটি সংঘবদ্ধ অপশক্তির পরিকল্পিত কাজ, যারা বিভিন্নভাবে এটার রাজনৈতিক ফায়দা তুলবে, সন্দেহ নেই। সুতরাং, এ ঘটনাকে নিছক সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা দিয়ে বুঝতে চাওয়া ঠিক হবে না। বরং এর নেপথ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুরের মামলায় চার্জশিটভুক্ত ৩ আসামিকে সম্প্রতি ইউপি চেয়ারম্যান পদে আ’লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল (১৩ অক্টো. ২০২১, ডেইলি স্টার)।

ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে আবার তাদের মনোনয়ন বাতিলও করা হয়েছে। এছাড়া কিছুদিন আগেও পঞ্চগড়ে গভীর রাতে তিনটি কালী মন্দিরের প্রায় ১০টি প্রতিমা ভাঙচুর করার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হন শক্তি চন্দ্র পাল ও সনাতন চন্দ্র পাল। শক্তি চন্দ্র পাল সেখানে একটি ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এবং আসন্ন তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে সদস্য প্রার্থী (১৯ নভে. ২০২১, বাংলা ট্রিবিউন)।

স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের অভিযোগ- শক্তি চন্দ্র পাল নির্বাচনে হিন্দু ভোটারদের সমর্থন পেতে মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছেন। সুতরাং, কখনো মুসলমানদের আবার কখনো হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে নৈরাজ্য তৈরির চেষ্টা নিছক সাম্প্রদায়িকতাপ্রসূত নয়, বরং কায়েমি স্বার্থ ও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক। আর আলোচিত রামু ও নাসিরনগরের ঘটনায় অভিযুক্তদের কারোরই আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের স্যাবোট্যাজ বা অন্তর্ঘাতমূলক হামলার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাচ্ছে না। এর সুযোগ নিতে পারে আধিপত্যবাদী শক্তিও।

মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এলে অবশ্যই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হবে। তবে শুধু ধর্মীয় অনুভূতিটার ব্যাপারেই সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করাটা ঠিক হবে না। কারণ বেশিরভাগ সময় আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলা করা হয়। এর নেপথ্যে ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলার, ফ্যাসিস্ট ও হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীসমূহের বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ বা এজেন্ডা থাকে। তাই প্রতিবাদ করার পাশাপাশি সেই স্বার্থ বা এজেন্ডাগুলো মোকাবেলা করার ক্ষেত্রেও আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের কৌশল নিতে হবে। তা না হলে যতই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হোক, কুরআন অবমাননা কিংবা রাসূল সা.-এর অবমাননার বিচার সুদূরপরাহত হয়ে থাকবে এবং এসব অবমাননার পুনরাবৃত্তিও রোধ করা সম্ভব হবে না।

এছাড়া, সংখ্যালঘু ইস্যুটা দেশে ও বিদেশে খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। অধিকন্তু, এদেশে আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের চাপে রাখতে রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘুদের ‘দাবার ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই সংখ্যালঘু ইস্যুতেও তাদের কিছু করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। যেমন- আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য খুতবায় ও ওয়াজে নিয়মিত তুলে ধরা, সংখ্যালঘুদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানে তৎপরতা দেখানো, তাদের বাড়িঘর ও উপাসনালয় হামলার শিকার হলে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের সরেজমিনে পরিদর্শনপূর্বক মিডিয়ার উপস্থিতিতে সমবেদনামূলক ও সচেতনমূলক বক্তব্য দেয়া এবং এ ধরনের হামলা ঠেকাতে সামাজিকভাবে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেয়া।

অপরদিকে, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের অনেকেই যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় এমনভাবে অভিযোগ করে থাকেন, যেন এদেশের মুসলমানরা তাদের পর করে রেখেছে এবং নির্যাতন করছে। অথচ ব্যাপারটা এমন না। সুশাসনের অভাবের অনিবার্য ফলস্বরূপ সংখ্যালঘুরাও যে নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকে, সেই বিবেচনা তাদের মধ্যে লক্ষণীয় নয়। হিন্দু নেতৃবৃন্দের উচিত মুসলমানদের সহমর্মী ভাবা এবং ইসলামপন্থীদের সাথে কৌশলগত লিয়াজোঁ রক্ষা করা। কিন্তু না, তারা যথারীতি ক্ষমতাসীন মহল ও ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলারদের ‘দাবার ঘুঁটি’ হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকেন।

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা সমগ্র ভারতবর্ষে প্রধানত হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি ও বিরোধ জারি রেখে প্রায় ২০০ বছর তাদের উপনিবেশিক শোষণ ও শাসন ধরে রাখতে পেরেছিল। সেই একই ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতিতে পুরো বাংলাদেশকে আরো আগেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের মেরুকরণের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এখন হিন্দু ও মুসলমানকে একে অপরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়ার বীভৎসতা দৃশ্যমান।

জার্মানির বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক জোহান ওফগ্যাংগ ভনের কালজয়ী উচ্চারণ: ‘Divide and rule, the politician cries; unite and lead, is watchword of the wise.’ অর্থাৎ, রাজনীতিবিদরা চায় জনগণকে বিভক্ত করতে এবং শাসন করতে; কিন্তু বুদ্ধিমানরা চেষ্টা করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং নেতৃত্ব দিতে। সুতরাং, জাতি হিসেবে আমাদের এ মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সবচেয়ে জরুরি। আমরা বিপজ্জনক ক্রান্তিকাল পার করছি। আমাদের জাতীয় ঐক্যের মূলে ক্রমাগত কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। আমাদের তৃণমূল সমাজে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থান যথেষ্ট গৌরবের। আমাদের ধর্মীয় অনুভূতির সুযোগ নিয়ে এই গৌরব ধুলায় মিশিয়ে দিতে চায় স্বৈর-ফ্যাসিবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও আধিপত্যবাদের মিলিত যূথবদ্ধ শক্তি। সুতরাং, আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য অক্ষুণ্ন রাখতে দেশের দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ, নেতৃস্থানীয় আলেম-ওলামা ও সচেতন তরুণ সমাজের উচিত- এ ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি রোধকরণে অতিদ্রুত সম্মিলিতভাবে তৎপর হওয়া।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
Email: tareqislampt@gmail.com

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।