কুরআন সৎলোকদের জন্য উপদেশ, হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ

।। আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ জসিমুদ্দীন ।।

মহান আল্লাহ সূরা ত্ব-হার ১-৮ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-

طٰهٰۚ ﴿۱﴾ مَاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکَ الۡقُرۡاٰنَ لِتَشۡقٰۤی ۙ﴿۲﴾ اِلَّا تَذۡکِرَۃً لِّمَنۡ یَّخۡشٰی ۙ﴿۳﴾ تَنۡزِیۡلًا مِّمَّنۡ خَلَقَ الۡاَرۡضَ وَ السَّمٰوٰتِ الۡعُلٰی ؕ﴿۴﴾ اَلرَّحۡمٰنُ عَلَی الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰی ﴿۵﴾ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَهُمَا وَ مَا تَحۡتَ الثَّرٰی ﴿۶﴾ وَ اِنۡ تَجۡهَرۡ بِالۡقَوۡلِ فَاِنَّهٗ یَعۡلَمُ السِّرَّ وَ اَخۡفٰی ﴿۷﴾ اَللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ لَهُ الۡاَسۡمَآءُ الۡحُسۡنٰی ﴿۸﴾

অনুবাদ: (১) ত্বা-হা। (২) আপনি কষ্ট-ক্লেশে পতিত হন- এ জন্য আমরা আপনার প্রতি কুরআন নাযিল করিনি; (৩) বরং যে ভয় করে তার জন্য উপদেশ হিসেবে, (৪) যিনি যমীন ও সমুচ্চ আসমানসমূহ সৃষ্টি করেছেন তাঁর কাছ থেকে এটা নাযিলকৃত, (৫) দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর উঠেছেন, (৬) যা আছে আসমানসমূহে ও যমীনে এবং এতোদুভয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ও ভূগর্ভে, তা তাঁরই। (৭) আর যদি আপনি উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন, তবে তিনি তো যা গোপন ও অতি গোপন, সবই জানেন। (৮) আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই, সুন্দর নামসমূহ তাঁরই।

তাফসীর: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) এ সূরা এবং আরো কয়েকটি সূরা সম্পর্কে বলেছেন, ‘বনী ইসরাইল, আল-কাহাফ, মরয়াম, ত্বা-হা এবং আম্বিয়া; এগুলো আমার সবচেয়ে প্রাচীন সম্পদ বা সর্বপ্রথম পুঁজি। (সহীহ বুখারী- ৪৭৩৯)।

এর অর্থ, প্রাচীন সূরা সমূহের মধ্যে এগুলো অন্যতম। তাছাড়া সূরা ত্বা-হা, আল-বাকারাহ ও আলে-ইমরান সম্পর্কে এসেছে যে, এগুলোতে মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত নাম রয়েছে, যার উসিলায় দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন”। (সুনানে ইবনে মাজাহ- ৩৮৫৬)।

‘ত্বা-হা’ এগুলো হচ্ছে “হুরূফুল মুকাত্তাআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ। পবিত্র কুরআনে সর্বমোট ঊনত্রিশটি সূরার শুরুতে এরূপ অক্ষর বা হরফ ব্যবহার করা হয়েছে। এর আসল উদ্দেশ্য বা অর্থ একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।

নাবী কারীম (সা.) থেকে এই বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলোর কোন নির্ভর যোগ্য তাফসীর পাওয়া যায় না। এজন্য এগুলো সম্পর্কে বলা হয়- اَللّٰهُ أَعْلَمُ بِمُرَادِهِ بِذَ لِكَ

“মহান আল্লাহই এগুলোর ব্যাপারে উত্তম জানেন”।

কেউ বলেছেন, এগুলোর অর্থ আছে, এগুলো সূরার নাম। কেউ বলেছেন, এগুলো আল্লাহ তাআলার নাম। আবার কেউ বলেছেন এগুলোর কোন অর্থ নেই। কারণ, আরবি ভাষায় এরূপ বিচ্ছিন্ন অক্ষরের কোন অর্থ হয় না। আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমিন (রহ.) একথাই প্রাধান্য দিয়েছেন।

ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, এগুলো এমন বিষয়, যার জ্ঞান আল্লাহ তাআলা তাঁর নিকট সীমাবদ্ধ রেখেছেন। সুতরাং এগুলোর তাফসীর আল্লাহ তাআলার দিকেই সোপর্দ করা উচিত। (কুরতুবী, ইবনে কাসীর)।

অতএব ‘হুরূফুল মুকাত্তাআত’ যা সূরার শুরুতে রয়েছে, এগুলোর ব্যাপারে নীরব থাকাই উত্তম। এ ব্যাপারে কোনরূপ বাড়াবাড়ি করা যাবে না, বরং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা এগুলো অনর্থক অবতীর্ণ করেননি। এগুলোর পেছনে হিকমত রয়েছে, যা আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, আমি কুরআন এই জন্য অবতীর্ণ করিনি যে, আপনি তাদের কুফরী করা ও ঈমান না আনার কারণে দুঃখে নিজেকে কষ্টে ফেলবেন এবং আফসোস ও দুঃশ্চিন্তা করবেন।

কুরআন নাযিল করে আমি আপনার দ্বারা এমন কোন কাজ করাতে চাই না, যা আপনার পক্ষে করা অসম্ভব। কুরআন নাযিলের সূচনালগ্নে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাহাজ্জুদের সালাতে কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। তিনি পরপর দীর্ঘক্ষণ সালাত আদায়ের জন্য একপার্য়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতেন, পরে অন্য পায়ে ভর দিয়ে সালাত আদায় করতেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পা ফুলে যায়। কাফের  মুশরিক কুরাইশরা বলতে থাকে যে, এ কুরআন মুহাম্মাদকে কষ্টে নিপতিত করার জন্যই নাযিল হয়েছে। (ইবনে কাসীর)।

আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে এই উভয়বিধ ক্লেশ থেকে উদ্ধারের জন্য বলা হয়েছে- আপনাকে কষ্ট ও পরিশ্রমে ফেলার জন্য আমি কুরআন নাযিল করিনি। যারা আখেরাত ও আল্লাহর আযাবকে ভয় করে, আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলে, তাদের জন্য এ কুরআন উপদেশ বাণী। তারাই এর মাধ্যমে হিদায়াত লাভ করতে পারে।

আরও পড়তে পারেন-

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-  فَذَکِّرۡ بِالۡقُرۡاٰنِ مَنۡ یَّخَافُ وَعِیۡدِ “কাজেই যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে উপদেশ দান করুন কুরআনের সাহায্যে”। (সূরা কাফ- ৪৫)।

অন্য আয়াতে এসেছে- إِنَّمَا تُنذِرُ مَنِ ٱتَّبَعَ ٱلذِّكْرَ وَخَشِىَ ٱلرَّحْمَـٰنَ بِٱلْغَيْبِ ۖ فَبَشِّرْهُ بِمَغْفِرَةٍۢ وَأَجْرٍۢ كَرِيمٍ “আপনি শুধু তাকেই সতর্ক করতে পারেন যে উপদেশ তথা কুরআনকে মেনে চলে এবং না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে”। (সূরা ইয়াসীন- ১১)।

পরের আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে, যারা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে তারা যেন উপদেশ গ্রহণ করতে পারে, এ জন্য কুরআন নাযিল করা হয়েছে।

কুরআন নাযিল করে তাকে কষ্টে নিপতিত করা হয়নি। বরং তার জন্য অনেক কল্যাণ চাওয়া হয়েছে। আল্লাহর কিতাব নাযিল হওয়া, তার রাসূলদেরকে প্রেরণ করা তাঁর বান্দাদের জন্য রহমত। এর মাধ্যমে তিনি যারা আল্লাহকে স্মরণ করতে চায় তাদেরকে স্মরণ করার সুযোগ দেন। কিছু লোক এ কিতাব শুনে উপকৃত হয়, আর কিছু লোক হয় হতভাগ্য।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- وَ یَتَجَنَّبُهَا الۡاَشۡقَی ﴿ۙ۱۱﴾  سَیَذَّکَّرُ مَنۡ یَّخۡشٰی ﴿ۙ۱۰﴾ “যে ভয় করে সে উপদেশ গ্রহণ করবে। আর তা উপেক্ষা করবে সে, যে নিতান্ত হতভাগ্য”। (সূরা আলা- ১০-১১)।

এই কুরআন তোমার প্রতিপালকের কালাম এটা তাঁরই পক্ষ হতে অবতারিত, যিনি সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা, মালিক, আহার্যদাতা এবং ব্যাপক ক্ষমতাবান। যিনি যমীনকে নীচু ও ঘন করেছেন এবং আকাশকে করেছেন উঁচু ও সুক্ষ্ম।

দয়াময় আল্লাহ ‘আরশে সমুন্নত’ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা স্বত্তায় আরশে সমুন্নত যেভাবে তাঁর সত্তার জন্য উপযোগী। কীভাবে কীরূপে জানা নেই। যেমন- ইমাম মালেক (রহ.) বলেছেন-

الاستواء معلوم، والكَيْف مجهول، والإِيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة

আল্লাহ তাআলা আরশের ওপরে রয়েছেন তা জ্ঞাত, কিন্তু কীভাবে আছেন তা অজ্ঞাত। এ ব্যাপারে ঈমান রাখা ওয়াজিব, কোন রূপ প্রশ্ন তোলা বিদআত। (সফওয়াতুত তাফাসীর- ১/৪১৮)।

তিনি আরশে সমাসীন; যেভাবে তাঁর মাহাত্ম্যের সাথে শোভনীয়। কীভাবে বা কী রূপে, তা কারো জানা নেই। এই আরশ বা মহাসন আল্লাহর সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। সর্বোচ্চ জান্নাত ফিরদাউসের উপরে বিদ্যমান। যার পায়া ও প্রান্ত আছে, ছায়া আছে।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেন, তিনিই আকাশ-জমিন ও এ দু’য়ের মাঝে যা কিছু রয়েছে সব কিছুর মালিক, এমন কি মাটির নিচে যা কিছু আছে তারও তিনি মালিক। অর্থাৎ সব কিছুর সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনি মানুষের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, স্বশব্দ ও নীরবের সকল কথা শুনতে পান, এমনকি তাদের অন্তরে যে বাসনা জাগে তাও জানেন।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- وَاَسِرُّوۡا قَوۡلَکُمۡ اَوِ اجۡهَرُوۡا بِهٖ ؕ اِنَّهٗ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۱۳﴾

“তোমরা তোমাদের কথা চুপে চুপে বল অথবা উচ্চঃস্বরে বল, তিনি তো অন্তর্যামী”। (সূরা মুলক- ১৩)।

মানুষের অন্তরের ধারণা ও কল্পনার খবরও তিনি রাখেন। মানুষ মনে যে গোপন কথা রাখে, কারো কাছে তা প্রকাশ করে না, তাকে বলা হয় ‘সির’। পক্ষান্তরে ‘আখফা’ বলে সে কথা বোঝানো হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত মনেও আসেনি, ভবিষ্যতে কোন সময় আসবে। আল্লাহ তাআলা এসব বিষয় সম্পর্কেও সম্যক ওয়াকিফহাল।

ইবাদত পাওয়ার যোগ্য একমাত্র তিনিই, যিনি উপরোক্ত গুণাবলীর অধিকারী। আর তাঁর সুন্দর নামাবলীও আছে, যা দ্বারা তাঁকে আহবান করা হয়। উপাস্য তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নয়, না তাঁর মত সুন্দর নাম কারো আছে। অতএব তাঁকে সঠিক ভাবে জানা, তাঁকেই ভয় করা উচিত, তাঁকেই ভালবাসা উচিত, তাঁকেই বিশ্বাস করা উচিত এবং তাঁরই আদেশ-নিষেধ পালন করা উচিত।

লেখক: মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতি এবং সহযোগী পরিচালক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।