গাজা অবরোধের ১৫ বছর

।। রাকিবুল হাসান ।।

ইসরাইল ২০০৭ সালের জুন মাসে গাজা অবরোধ দিয়েছিল। ২০২২ সালের জুন মাসে যার পনেরো বছর পূর্ণহয়। প্রায় অনুল্লেখ্য এক চিলতে ভূমিতে একুশ লাখ মানুষ কিভাবে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে আছে, তা এক বিস্ময় বৈ কি। কোনো চাকরি নেই, উৎপাদন নেই, আমদানি নেই, রপ্তানি নেই, শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই, আশ্রয় নেই, কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে দিনে-রাতে তিন বেলা আহারের পরিবর্তে নিয়মিত বোম্বিং। বিশ্বের সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র আর যুদ্ধবিমানের মুহুর্মুহু গর্জন। সেখানে কীভাবে দুই মিলিয়ন মানুষ বেঁচে আছে? কীভাবে? জাতিসংঘের পূর্বাভাষ মতে ২০২০ সাল নাগাদ গাজা উপত্যকা বসবাস অযোগ্য হয়ে যাওয়ার কথা। এখন ২০২২, গাযাবাসী এখনো টিকে আছে।

১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ইসরাইল এবং মিশর দুইদিক থেকে ফিলিস্তিনকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইলিরা মিশরের সিনাই উপত্যকা এবং ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনি ভূখ- আগে থেকেই ইসরাইলের দখলে ছিল। যা কিছু বাকি ছিল পশ্চিম তীর আর গাযা, এই যুদ্ধে সেগুলোও তাদের হস্তগত হয়।

তারপর ২০০৫ সাল পর্যন্ত তা ইসরাইলিদের দখলেই ছিল। সেবছর সহসা একপাক্ষিকভাবে ইসরাইল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। ২০০৫-৬ সালে ফিলিস্তিনে পৌর ও সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হামাস বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। প্রথমে হামাসের প্রতিদ্বন্দী দলগুলোকে দিয়ে তাদেরকে হটানোর চেষ্টা করা হয়। এই কাতারে সর্বাগ্রে ছিল ফাতাহ। ভ্রাতৃঘাতী এই সংঘাতে ফাতাহ পশ্চিম তীর থেকে হামাসকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হলেও গাজার নিয়ন্ত্রণ রয়ে যায় হামাসের হাতে।

পরের বছর জুনে গাযাবাসীকে শায়েস্তা করতে ইসরাইল গাজার উপর অবরোধ আরোপ করে। শুধুমাত্র তিনটি গেট দিয়ে তারা বহির্বিহশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। দুটি নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল, একটি মিশর। সেই থেকে বিশ্বের বহু মানবাধিকার সংগঠন গাযাবাসীর নিকট ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছে। ইসরাইলের অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করেছে।

২০১০ সালের মে’তে তুরস্কের নেতৃত্বে ছয়টি বেসামরিক নৌযান গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা নামক ত্রাণবহর নিয়ে অবরোধ ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিল। মানবিক এই অভিযানে পুরো বিশ্বের নজর ছিল। প্রতিদিন নিয়মিত সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে এর আপডেট প্রচারিত হচ্ছিল। গোটা বিশ্বের চোখে সামনে, এই নৌবহরে অভিযান চালিয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনী নয়জন তুর্কি নাগরিককে হত্যা করে। যা নিয়ে এখনো পর্যন্ত ইসরাইলের সাথে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি।

শুধু একটু অনুমান করুন, তুরস্কের মত শক্তিশালী দেশের মানবিক ত্রাণবহরে গোটা বিশ্বের চোখের সামনে যদি ইসরাইলের বর্বরতা এই মাত্রায় যেতে পারে, তাহলে পনেরো বছর ধরে গাযাবাসী কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে? একুশ লক্ষ জনসংখ্যার আট লক্ষের জন্ম অবরোধকালে। গাজার বাইরে তাদের কোনো পৃথিবী নেই!

অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর গ্যাব্রিয়েলা বুচারের ভাষ্যমতে গাযাতে ইসরাইল কোনো টমেটো ঢুকতে দেয় না যতক্ষণ না টমেটোর পাতা ছিঁড়ে ফেলা হয়। কারণ পাতা ছিঁড়ে ফেললে সেই টমেটো বেশিদিন তাজা থাকে না। ইসরাইল এটা নিশ্চিত করতে চায় যেন গাজায় দীর্ঘসময় খাবারদাবার না থাকে। সবসময় যেন তারা অনাহার-অর্ধাহারে থাকে।

বর্তমানে গাজার আশি শতাংশ শিশু মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত। প্রতি দশজনের সাতজনের জীবিকার একমাত্র উপায় আন্তর্জাতিক ত্রাণ। এভাবেই বেঁচে আছে একটা ভূখ-। ওয়ার অন টেররের পর থেকে আরব শাসকরা সন্ত্রাসবাদের ভয়ে ফিলিস্তিনিদের নিয়ে কোন কথা বলে না। আরব বসন্তের পর তো একদমই না। ফিলিস্তিনিরা আরব হয়েও আরব নয়। মুসলিম বিশ্বের কোথাও তারা নেই।

গাজায় নির্বাচন হয়েছিল মূলত প্রেসিডেন্ট বুশের কিছু পলিসির কারণে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে ইরাক আগ্রাসনের বৈধতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সে গণতন্ত্রায়ণ পলিসি গ্রহণ করেছিল। বিশ্বের সর্বত্র গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন করে গণতান্ত্রিক হত্যাকা-ের বৈধতা দিতে চেয়েছিল। সেই পলিসির অধীনে ফিলিস্তিনে নির্বাচন আয়োজন করা হয়েছিল।

ইসরাইলের সমস্ত বিশ্লেষকদের মতামত ছিল নির্বাচনে হামাস জয়লাভ করতে পারবে না এবং হামাসের পরাজয় নিশ্চিত করতে ২০০৪ সাল থেকেই তারা হামাসের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় সে বছর হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ইয়াসিনকে ফজরের নামাজের সময় রাস্তায় বোমা মেরে হত্যা করা হয়। তারপর হত্যা করা হামাসের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল আযিয আর-রানতিসিকে।

এতে তারা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে নেতৃত্বহীন হামাসের প্রতি মানুষের আস্থায় ধস নামবে। কিন্তু সমস্ত হিসেব নিকেশ উল্টে দিয়ে হামাস বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। আরও কিছু ঘটনার পাশাপাশি মূলত ফিলিস্তিনে হামাসের বিজয়ের পরপরই বুশ তার গণতন্ত্রায়ণ পলিসি বাতিল ঘোষণা করে।

বর্তমানে পশ্চিম তীর যদিও ফাতাহের দখলে, কিন্তু সেখানে প্রকৃত শাসন চলে ইসরাইলের। কারণ সেখানকার বিদ্যুৎ, পানি, কর্মচারিদের বেতনভাতা থেকে শুরু করে সবকিছুই প্রদান করে ইসরাইল। এমনকি পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনী এবং ফাতাহের প্যারামিলিটারির অস্ত্রশস্ত্রও প্রদান করে ইসরাইল।

সেখানে ইসরাইলের যথেচ্ছ প্রবেশাধিকার রয়েছে। সময়ে সময়ে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি গুড়িয়ে দেয়ার, রাতবিরাতে ঘরে তল্লাশির নামে হেনস্থার যেসব ভিডিও ভাইরাল হয়, সেগুলো সব পশ্চিম তীরের। পক্ষান্তরে গাজায় হচ্ছে কাঁটাতারে বেষ্টিত জনপদ। ইসরাইলিরা সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। তবে আকাশ থেকে বোম্বিং করে নিয়মিত।

ইসরাইলের ভিন্নমতবালম্বী ইহুদি ইতিহাসবিদ ইলান পাপ্পে তার সাড়া জাগানো বই টেন মিথস এবাউট ইসরাইলে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অসাধারণ আলোচনা করেছেন। ইসরাইলি লবি এবং পশ্চিমা মিডিয়া ও একাডেমিয়া ইসরাইলের পক্ষে যেসব মিথ্যাচার ছড়ায়, পয়েন্ট ধরে ধরে সেগুলোর মুখোশ উন্মোচন করেছেন। (বইটি অনূদিত হয়ে নবপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে)।

সেখানে তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন- গাজা ভূখ- ফিলিস্তিনের মোট ভূখ-ের মাত্র দুই শতাংশ! এই তথ্যটা ইলান পাপ্পের আগে-পরে কেউ উল্লেখ করেনি। অতি ক্ষুদ্র এক চিলতে জমি। কিন্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনের যেসব ভূমি দখল করেছে, সেখানকার লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত মানুষকে গাজায় ঠেসে ভরা হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে ইসরাইলি দখলদারিত্বের সময়ে আরও লাখ লাখ মানুষকে এখানে জড়ো করা হয়। তারপর ২০০৭ সালে চতুর্দিক থেকে বন্ধ করে দিয়ে এখন ইচ্ছে মতো যখন তখন বোম্বিং করা হয়।

এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন আছে। ইসরাইল কেন ২০০৫ সালে গাজা ত্যাগ করল? ইসরাইল এবং বিশ্বব্যাপী ইসরাইলি কুকর্মের দোসর পশ্চিমা মিডিয়া ও সরকারগুলো প্রচার করে থাকে যে মূলত ফিলিস্তিনের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ইসরাইল এই অঞ্চল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু হামাসের মত ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনগুলোর কারণেই ইসরাইলের এতবড় ত্যাগ বিফলে যাচ্ছে!

আরও পড়তে পারেন-

এবং ঠিক এই কারণেই ইসরাইলের প্রতিটা নৃশংস হামলায় পশ্চিমা সরকারগুলো শর্তহীন সমর্থন দিয়ে আসছে। আসলে বাস্তবতা কী? ইলান পাপ্পে পুরো এক চ্যাপ্টার নিয়ে এই বিষয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন। যার সারকথা হচ্ছে- শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসরাইল গাজা ভূখ- ছেড়েছে, এটা একটা নির্জলা মিথ্যাচার।

মূলত, ১৯৬৭ সালের পর থেকে ইসরাইল গাজায় ও পশ্চিম তীরে ইহুদিদেরকে নিয়ে বসতি গড়ায়। আলাদা নিরাপত্তা দেয়াল তুলে দিয়ে, হাই সিকিউরটি প্রদান করে প্রচ- কট্টর ইহুদিদেরকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়। গাজায় প্রায় ৫ হাজার ইহুদি স্থানান্তরিত হয়।

১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির পর থেকেই গাজার অবস্থান কী হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। চুক্তি অনুসারে গাজা ও পশ্চিম তীর একই দেশের অংশ হিশেবে পরিগণিত হবে। দুই ভূখ-ের জনগণ বিনা বাধায় চলাচল করতে পারবে। এখানে উল্লেখ্য, গাজা ও পশ্চিম তীরে মাঝখানে রয়েছে ইসরাইল। অনেকটা সাবেক বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মতো। তো চুক্তিতে যদিও দুই ভূখ-কে এক দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে ইসরাইল ফিলিস্তিনকে একটি ছিটমহল হিসেবে আচরণ করছিল। গাযাবাসীর অবস্থার উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হয়। গাযাকে দুইভাগ করে একভাগে রাখা হয় ফিলিস্তিনিদের, অপরপাশে রাখা হয় ইহুদিদের। ২০০০ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা। ইন্তিফাদার ফলে একই সাথে পশ্চিম তীর এবং গাজায় প্রচ- আন্দোলন ও সংঘাত শুরু হয়।

এমতাবস্থায় ইসরাইলের সামনে দুটি অপশন ছিল। এক, যেভাবে আছে সেভাবেই চলতে থাকবে। ফলে পশ্চিম তীর কিংবা গাযা- কোনোটাতেই ইসরাইলের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে না। অথবা গাজা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে শুধু পশ্চিম তীরে মনোনিবেশ করা হবে। ইসরাইল দ্বিতীয়টি বেছে নেয়।

এছাড়া আরও একটি কারণ ছিল। ইন্তিফাদায় অংশগ্রহণের সাজা হিসেবে ইসরাইলি সেনাবাহিনী পশ্চিম তীরে একই সাথে আকাশ ও স্থল আক্রমণ পরিচালনা করছিল। সেখানকার ফিলিস্তিনিদের উপর নির্মম প্রতিশোধ নিচ্ছিল। কিন্তু ঘনবসতি হওয়ায় গাজায় বিমান আক্রমণ পরিচালনা করা যাচ্ছিল না। কারণ এখানে ইহুদিরাও রয়েছে।

পাশাপাশি ইহুদি সেটলারদের বাড়িঘরগুলো ফিলিস্তিনি যুবকদের সহজ নিশানায় পরিণত হয়। সবদিক বিবেচনায় ইসরাইলের সামনে গাজা থেকে সেনাবাহিনি প্রত্যাহার ভিন্ন গতি ছিল না। কিন্তু বেকে বসে সেখানকার অতি কট্টর ইহুদিরা। তারা গাজা ত্যাগ করতে রাজি ছিল না। ফলে সেনাবাহিনি পাঠিয়ে একপ্রকার তাড়িয়েই নিতে হয়েছে তাদের।

এবং তার পরপরই শুরু হয় অবরোধ, জুনে যার পনেরো বছর পূর্ণ হল।

লেখক: তাকমিল; মাদরাসা বাইতুল উলুম, ঢালকানগর এবং শিক্ষার্থী- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।