।। কাজী হামদুল্লাহ ।।
একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করি। ২০২১ সালের ২রা মে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১২ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছিলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ জানিয়েছিলো, গ্রেফতারকৃতরা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এরা প্রত্যেকেই অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত। রয়েছে আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের সঙ্গেও যোগাযোগ। জুয়া ছাড়াও এরা আরও বিভিন্ন সাইবার অপরাধের সাথে জড়িত।
এর মাত্র আট দিনের মাথায় ১০ মে একই রকম ঘটনায় খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয় ৪ জনকে। এরও আটদিন পরে ১৮ মে ঢাকার বনশ্রী, সাভার এবং নোয়াখালীতে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আরও ৪ জনকে। এদের সবাই শিক্ষার্থী, সবাই সাইবার অপরাধের সাথে জড়িত।
একটি জাতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, এবছরের ৬ মার্চ থেকে ১৬ মে পর্যন্ত মাত্র ৭১ দিনে বগুড়ায় ছুরিকাঘাতের অর্ধশত ঘটনা ঘটেছে। পুলিশি তদন্তে দেখা গেছে, ছুরিকাঘাতের ঘটনায় সম্পৃক্তদের অধিকাংশেরই বয়স ২২ বছর থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, কিশোরও ছিল কয়েকজন। পাড়া-মহল্লায় আড্ডা, খেলাধুলাসহ ধর্মীয় উৎসবের দিনে কারও সঙ্গে সামান্য মতভেদ হলেই এলোপাতাড়ি চাকু বা ছুরি বসিয়ে দেয়ার এসব ঘটনা ঘটেছে।
দেশে-বিদেশে বহুল আলোচিত ঘটনা ‘আবরার হত্যাকা-’। আমরা সকলেই জানি, যারা আবরারকে হত্যা করেছে তাদের সবাই শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীরা কেবল ভিন্নমতের কারণে অপর আরেক শিক্ষার্থীকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাও তাদের পরমতসহিষ্ণুতাকে জাগ্রত করতে পারেনি। ফলে মতভিন্নতার কারণে তরুণ শিক্ষার্থীরাই হয়ে উঠেছে হায়েনা।
বর্তমান বিশ্বকে বলা হচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ। মানে পুরো পৃথিবী একটি গ্রামের মতো। আর এই বিশাল পৃথিবীকে গ্রামে পরিণত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্যকর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
আশা করা হয়েছিলো ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে পৃথিবীর মানুষ উৎকর্ষের পথে যাত্রা করবে। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে, মানুষ চলছে ঠিক তার উল্টো পথে। দেখা যাচ্ছে, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। দৈনিক যুগান্তরের এক নিবন্ধে বলা হচ্ছে, এই অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অল্পবয়সীরা।
শিক্ষার্থী ও তরুণ-যুবকদের সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটি হলো, তাদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ হৃাস পাচ্ছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে (?) সারাক্ষণ একঘরে হয়ে থাকায় তারা সামাজিক আচার-আচরণ ও দায়বোধ থেকে ছিটকে পড়ছে। এছাড়া সামাজিকতার অনুশীলন না থাকায় দিন দিন সহনশীলতা কমছে তাদের মধ্যে। বাড়ছে হিংসা-বিদ্বেষ ও ভিন্নমত দমনে আগ্রাসী মনোভাব।
উপরে অল্প যে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে এর মধ্যে কিছু সংঘটিত হয়েছে অনলাইনে আর কিছু অফলাইনে। কিছু ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে ভিন্নমত দমন করতে গিয়ে আর কিছু নিজের মধ্যে সামাজিক শিষ্টাচার না থাকার কারণে।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার বিষয়টা একটু আলাদাভাবেই বলতে হয়। কেননা, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে এটি একটি মহামারির আকার ধারণ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া হোক কিংবা আমাদের বাস্তব জীবন, সবখানেই আমরা এখন এক চরম অসহিষ্ণু জাতিতে পরিণত হয়েছি। বিশেষ করে শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী ও উঠতি বয়সীদের মধ্যে এই রোগ ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। স্কুল-কলেজ-মাদরাসা, খেলার মাঠ, বন্ধুমহল ও কর্মক্ষেত্র, এমনকি পরিবারেও; এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমরা সহনশীলতা প্রদর্শন করতে পারছি। ভিন্নমতের কারণে খুন-হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে যেন নিয়ম মেনে। ফেসবুকে ভিন্নমতের কারও পোস্ট আমরা মেনে নিতে পারছি না, রাজনীতিতেও নেই ভিন্নমতের লালন। উগ্রতা ও বিচ্ছিন্নতা যেন শোভা হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্রসমাজের, তরুণ-যুবকদের।
তারুণ্যের প্রাণশক্তি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন, ‘আমরা শক্তি আমরা বল/আমরা ছাত্রদল, মোদের চরণতলে মূর্ছে তুফান/ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল’।
কিন্তু বর্তমানে অনেকের কাছে এসব কথা কেবলই হাসির খোরাক। কেননা, তরুণ ও ছাত্রসমাজের সেই শক্তি এখন নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীরা খুইয়ে বসেছে নিজেদের আত্মপরিচয়। জাতীয় কবি যেই ছাত্রদেরকে শক্তি বলেছিলেন, তারা ছিলো হাজারও গুণে গুণান্বিত। তাদের ছিলো আলাদা ব্যক্তিত্ব, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং সমাজে ঐক্যবদ্ধভাবে চলার প্রয়াস। ইদানিং তা কি আছে?
উপরের ঘটনাসহ দেশে অহরহ ঘটতে থাকা হাজারও ঘটনাগুলো বলছে সেই তারুণ্য বা ছাত্রসমাজ এখন বিলকুল নেই। এখনকার শিক্ষার্থী ও তরুণ-যুবকদের নেই কোন ব্যক্তিত্ব, নেই কোন দায়িত্বশীলতা। তাদের মাঝে আছে কেবল বিবাদ ও বিভেদের হাজারও উপকরণ। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা, কমছে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি। বিনয় ও নমনীয়তা বলতে যে একটি সামাজিক আচরণ রয়েছে, তা হয়তো জানেই না অনেকে। দিন যতো চলে যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভয়াবহতা।
এখানে এসে স্বভাবতই একটি প্রশ্ন জাগ্রত হয় যে, কেন বাড়ছে এসব? কেন দিন দিন শিক্ষার্থীরা বিগড়ে যাচ্ছে? যারা আগামীর নেতৃত্ব দিয়ে সমাজকে বসবাসের উপযোগী করবে তারাই কেন কলুষিত জীবনযাপন করছে, কলুষিত করছে সমাজকে?
একটা সময় ছিলো, শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করতো, অবসরে বই পড়তো, ঘুরতে যেতো, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মিশতো। কিন্তু ইদানিং একটু অবসর পেলেই তারা বন্দি হয়ে পড়ে অনলাইনে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনকার শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা অনলাইনের ‘দূরে থেকেও কাছে থাকা’ বিষয়টির কারণে আদব-কায়দা ভুলতে বসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছোটখাটো সাধারণ মানুষরা যেমন আছে, তেমনই আছেন বড় বড় বিজ্ঞজনরাও। সেখানে যে কেউ যে কারও কথায়, পোস্টে বা কমেন্টে দ্বিমতপোষণ করতে পারে অনায়াসেই। যেহেতু তারুণ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘জাজমেন্টাল ক্যারেকটার’ বা যেকোন কিছুকে দ্রুত বিচার-বিশ্লেষণ করার স্বভাব প্রকৃতিগতভাবেই থাকে, তাই তারা বড়দের সাথেও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ভয়ংকর বিষয় হলো, এতে তাদের অনেককে গর্বও করতে দেখা যায়। শেষে ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায়, সে একজন বেয়াদব, অসামাজিক ও অসহিষ্ণু মানুষে পরিণত হয়।
কারণ, কেবল একটাই নয়, আরও আছে। আমাদের দেশের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন অনেকটাই ভঙ্গুর অবস্থায় চলে এসেছে। গত জুন মাসের এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি পরিবারে তালাকের ঘটনা ঘটেছে। তালাকের আগে যেসব কারণে তারা কলহ-বিবাদে জড়াতো তার মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতাসহ বিভিন্ন কারণ। অন্যদিকে স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজায, সংসারের প্রতি উদাসীনতা ও সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় থেকে এসব প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। পারিবারিক বন্ধনের মূল বিষয় ধৈর্য। যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয়। পরিবারে যখন অভিভাবকরাই সহনশীল হতে পারেন না, তখন সেই অসহিষ্ণুতার প্রভাব সন্তানদের উপরও গিয়ে পড়ে সরাসরি।
পরিবার থেকে বেরিয়ে সমাজের দিকে তাকালে এর পরিবেশ আরও ভয়ানক। দিন দিন বাড়ছে অপরাধ ও অপসংস্কৃতি, পুঁজিবাদিদের থাবায় মানুষ হচ্ছে স্বার্থপর ও লোভী প্রকৃতির। দৈনিক প্রথম আলোর এক সাব হেডিংয়ে বলা হয়েছে ‘আগের বছরের (২০২০-এর) তুলনায় চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। খুন ও মাদকের ঘটনাও কম নয়’। এইরকম এক অশান্ত আর উচ্ছৃঙ্খল সমাজে যখন একটা মানুষ বড় হতে থাকে, তখন সে যে আর সভ্য ও সামাজিক হয়ে বেড়ে ওঠে না, তা বলাই বাহুল্য।
গবেষকরা বলছেন, নীতি-নৈতিকতাহীন এই তরুণসমাজের মুক্তির জন্য অন্য সব প্রচেষ্টার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কঠোরতা আনতে হবে। শিক্ষার্থী ও তরুণদেরকে এখন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো থেকে ফেরানো অতো সহজ নয়। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান করতে হলে তাদেরকে এর সঠিক ব্যবহার শিক্ষা দিতেই হবে। ব্যক্তি ও সমাজজীবনে সামাজিক আচরণের পাঠ চালু করতে হবে। হালযামানার উঠতি বয়সী এসব শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক সবক পেলেও স্বভাব ও চরিত্র গঠনের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। সোশ্যাল রিলেশন সম্পর্কে তারা অনেকটাই অজ্ঞ। এসব তাদেরকে জানতে ও জানাতেই হবে।
তাদের সামাজিক চরিত্রকে আলোকিত করতে চাইলে সর্বপ্রথম দরকার পারিবারিক নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা। দরকার সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতির বিনাশ। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক চরিত্র গঠনের আদর্শ সবক।
আর এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে সবচেয়ে বেশি যেই জিনিসটার প্রয়োজন সেটি হলো ধর্মচর্চা। পৃথিবীর বুকে আদর্শ মানবজাতি গঠনের জন্য ইসলাম ও কুরআনের ছায়াতলে আসার কোনই বিকল্প নেই।
বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল (রহ.) তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন, ‘ওহ যামানা মে মুআযযায থী হামেলে কুরআন হো কর/ আওর তুম খার হুয়ী তারেকে কুরআন হো কর’। অর্থাৎ ইসলামের প্রথম যুগের মানুষ সম্মানিত ছিলেন কুরআনের বাহক হয়ে, আর তোমরা অপদস্ত হচ্ছো কুরআন ছেড়ে দিয়ে।
মুসলিম উম্মাহ আজ যেখানেই অধঃপতনের শিকার হচ্ছে, গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় এর মূলে রয়েছে ইসলাম, কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আমাদের দূরে সরে যাওয়া, কুরআন-সুন্নাহকে আমাদের জীবন থেকে মুছে ফেলা। সময় যত গড়াচ্ছে কুরআন-সুন্নাহ থেকে আমাদের দূরত্ব ততোই বাড়ছে। কুরআনের পাতায় পাতায় যে নীতি ও আদর্শের মহান সবক রয়েছে, জীবনব্যস্ততায় পড়ে তা খুলে দেখার সময়টুকুও আমাদের হচ্ছে না। তাই ছাইচাঁপা তারুণ্যের মুক্তি মিলছে না কোথাও।
কিন্তু আদর্শ জীবন, সুন্দর সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে আমাদেরকে ফিরতেই হবে কুরআন-সুন্নাতের জান্নাতি বাতায়নে। কুরআনের আলোয় আদর্শ শিক্ষার্থী ও তরুণ-যুবসমাজের হাত ধরেই আসবে জাতির সফলতা।
লেখক: সম্পাদক, প্রবচন সাহিত্য সাময়িকী।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/