জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে

।। মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

আল্লাহ তাআলা সূরা কাহাফের ১০৭-১১০ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا (১০৭) خَالِدِينَ فِيهَا لَا يَبْغُونَ عَنْهَا حِوَلًا (১০৮) قُلْ لَوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَنْ تَنْفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا (১০৯) قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا (১১০)

(অপর দিকে) যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে তাদের আপ্যায়নের জন্য অবশ্যই জান্নাতুল ফিরদাউসের উদ্যান রয়েছে। (১০৭) তাতে তারা সর্বদা থাকবে (এবং) তারা সেখান থেকে অন্য কোথাও যেতে চাইবে না। (১০৮) (হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, আমার প্রতিপালকের কথা লেখার জন্য যদি সাগর কালি হয়ে যায়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হওয়ার আগেই সাগর নিঃশেষ হয়ে যাবে, তাতে সাহায্যরূপে অনুরূপ আরও সাগর নিয়ে আসি না কেনো!। (১০৯) বলে দাও, আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই। (তবে) আমার প্রতি এই ওহী আসে যে, তোমাদের মাবুদ কেবল একই মাবুদ। সুতরাং যে কেউ নিজ মালিকের সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, সে যেনো সৎকর্ম করে এবং নিজ মালিকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে। (১১০)’

ঈমান ও আমল জান্নাতের চাবিকাঠি

পূর্বে আয়াতে জাহান্নামবাসীদের আলোচনা হয়েছে। জাহান্নামীদের আলোচনা শেষ করে আল্লাহ তাআলা উপর্যুক্ত আয়াতগুলোতে জান্নাতীদের আলোচনা করেছেন। জান্নাতীদের গুণাগুণ তুলে ধরেছেন। কারা জান্নাতে যেতে পারবে? কারাই বা জান্নাতের অধিকারী হবে? তাদের কী কী কাজ করতে হবে? কীভাবে জীবন-যাপন করতে হবে? এ বিষয়গুলোই আলোচিত হয়েছে আয়াতগুলোতে।

যারা বলে, আমাদের রব একমাত্র আল্লাহ এবং তারা তার উপর অটল থাকে। আল্লাহকে ইলাহ হিসেবে অন্তরে বিশ্বাস ও মুখে স্বীকার করে, তাঁর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে, কখনও শিরক করে না, এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো বাতিল মা‘বূদের উপাসনা করে না, অন্যকে বিধানদাতা মনে করে না। যাদের আকীদা ঠিক হয় এবং পুরোপুরিভাবে দৈনন্দিন সমস্ত কাজে শরীয়াতের হুকুমের অনুসারী হয়। যাদের সমস্ত কর্মকা-, ও কার্যকলাপে সৎ আমল প্রকাশ পায়। তাদের বাসস্থল হবে জান্নাত। তারা চির জীবন সেখানে নির্মল সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতে থাকবে। তারা কখনও জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হবে না। জান্নাতের সুখ শান্তি থেকেও বঞ্চিত হবে না।

ঈমান ও আমল নিয়ে যখন জান্নাতীরা হাযির হবে, তখন তাদের জান্নাতের দিকে আহ্বান করা হবে। পূর্ণ সম্মান ও সম্ভাসনসহ তাদেরকে জান্নাতে সুস্বাগতম বলা হবে। জান্নাত আল্লাহ তাআলাই দিবেন। তিনিই নিজ অনুগ্রহ তা দান করবেন। তবুও ব্যক্তির আমলকে স্মরণ করিয়ে বলা হবে যে, তুমি নেক আমল করেছো বলেই আজ তুমি জান্নাত প্রাপ্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَنُودُوا أَنْ تِلْكُمُ الْجَنَّةُ أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ.
এবং তাদেরকে আহ্বান করে বলা হবে, তোমরা যা করতে তারই জন্য তোমাদেরকে এ জান্নাতের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে। (সূরা আরাফ- ৪৩)।

জান্নাত একটি চিরন্ত সুখের বাসস্থান

কেমন হবে জান্নাত? কেমন হবে তার সুখ শান্তি ও ব্যবস্থাপনা? এ সবের প্রকৃত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। যেহেতু তা হবে আমাদের কল্পনাতীত। তবে কুরআন ও হাদীসে খন্ডিত অনেক বিবরণ উল্লেখ হয়েছে। জান্নাতের বর্ণনা দিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন আহ্বানকারী আহ্বান করে বলবে, তোমাদের জন্য এটাই উপযোগী যে, তোমরা সুস্থ থাকবে, কখনও রোগাক্রান্ত হবে না। তোমাদের জন্য উপযোগী হলো জীবিত থাকা, সুতরাং তোমরা কখনও মারা যাবে না। তোমাদের শান হলো যুবক থাকা, সুতরাং তোমরা কখনো বৃদ্ধ হবে না। তোমাদের প্রাপ্য হলো নেয়ামতের মধ্যে থাকা, সুতরাং তোমরা কখনো অভাব-অভিযোগে থাকবে না। আর এটাই হলো আল্লাহর বাণীর অর্থ যেখানে তিনি বলেছেন, এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হবে, তোমরা যা করতে তারই জন্য তোমাদেরকে এ জান্নাতের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম- ২৮৩৭)।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন-
فإذاسألتماللهفاسألوهالفردوسفإنهأوسطالجنةوأعلىالجنةأراهفوقهعرشالرحمنومنهتفجرأنهارالجنة.
তোমরা আল্লাহর কাছে চাইলে জান্নাতুল ফেরদাউস চাইবে। কেননা, এটাই হলো সবচেয়ে উত্তম ও সর্বোচ্চ জান্নাত। আমার মনে হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাও বলেছেন, এর উপর রয়েছে আরশে রহমান। আর সেখান থেকে জান্নাতের নহর সমূহ প্রবাহিত হচ্ছে। (সহীহ বুখারী- ২৭৯০)।

এই জান্নাতুল ফেরদাউস হবে তাদের জন্য বাসস্থান। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। সেখান থেকে কোনো দিন বের হবে না, বের হওয়ার কামনাও করবে না। কেননা, এর চেয়ে সুখময় স্থান আর নেই। সেখানে কোনো কিছুর অভাব নেই। একের পর এক রহমত আসতেই থাকবে। দৈনন্দিন এর প্রতি আগ্রহ আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। মনে কোনো বিরক্তি আসবে না। জান্নাতে সর্বপ্রকারের উচ্চমানের জীবনোপকরণের সুব্যবস্থা রয়েছে। মন যা চাইবে তাই দেয়া হবে।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ.
সেখানে তোমাদের জন্য সমস্ত কিছু রয়েছে যা তোমাদের মন চায়, যা তোমরা আকাঙ্খা করো। (সূরা হা-মীম সাজদাহ- ৩১)।

জান্নাতে মুমিনের প্রতিটি বাসনা পূর্ণ করা হবে- তোমরা চাও বা না চাও। এমন অনেক নেয়ামতও মুমিন সেখানে পাবে, যার আকাঙ্খাও অন্তরে সৃষ্টি হয়নি। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি জান্নাতী ব্যক্তি নিজ গৃহে সন্তান জন্মের বাসনা করে, তবে গর্ভধারণ, প্রসব, শিশুর দুধ ছাড়ানো এবং যৌবনে পদার্পণ সব এক মুহূর্তের মধ্যে হয়ে যাবে। (সুনানে তিরমিযী- ২৫৬৩)।

জান্নাতবাসীদের জন্য জান্নাত চিরস্থায়ী নেয়ামত। যে জান্নাতে প্রবেশ করেছে, তাকে সেখান থেকে কখনও বের করা হবে না। জান্নাতের নেয়ামতসমূহ পেয়ে কখনও তাদের মন একঘোয়েমি অনুভব করবে না, যাতে তারা জান্নাত ছেড়ে অন্যত্র যেতে চাইবে। এমনকি জান্নাত থেকে বাইরে যাওয়ার কল্পনাও কোনো সময় মনে জাগবে না।

আল্লাহর জ্ঞান-হিকমতের কথা লিখে শেষ করা যাবে না

মহান আল্লাহর পরিব্যাপ্ত জ্ঞান, তাঁর হিকমত এবং ঐ সমস্ত দলীল-প্রমাণ যা তাঁর একত্ববাদকে প্রমাণ করে, যা মানুষের পক্ষে পূর্ণমাত্রায় জ্ঞাত হওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর সমস্ত গাছপালাকে যদি কলম বানানো হয় এবং সমস্ত সমুদ্র; বরং তার সমপরিমাণ আরো সমুদ্রের পানিকে যদি কালি তৈরি করা হয়, তাহলে কলমসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে এবং সমস্ত কালি নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর বাণী ও হিকমত ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে কখনোই শেষ হবে না।

সূরা লোকমানে এ কথা মহান আল্লাহ এভাবে ইরশাদ করেন-
وَلَوْ أَنَّمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ شَجَرَةٍ أَقْلَامٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِنْ بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللَّهِ.

আর যমীনের সব গাছ যদি কলম হয় এবং সাগর, তার পরে আরও সাত সাগর কালি হিসেবে যুক্ত হয়, তবুও আল্লাহর বাণী নিঃশেষ হবে না। (সূরা লুকমান- ২৭)।

মহান আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞান, তাঁর সৃষ্টি ও কারিগরির বিস্ময়কর নিপুণতা এবং তাঁর মর্যাদার কথা লিপিবদ্ধ করে এবং তার প্রশংসা করে শেষ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মানুষ ও আল্লাহর প্রেরিত নবী

আল্লাহ তাআলা নবী আলাইহিস সালামকে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন যে, বলে দাও, আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ, তোমরা যেমন রক্ত-মাংসের তৈরি আমিও তাই। তবে তোমাদের থেকে আমার আলাদা বৈশিষ্ট্য ও ফযীলত হলো আমাকে রাসূল করে পাঠানো হয়েছে, আমার কাছে ওহী আসে আর তোমাদের কাছে ওহী আসে না।

আল্লাহ তাআলার বাণী-
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَاسْتَقِيمُوا إِلَيْهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ وَوَيْلٌ لِلْمُشْرِكِينَ.
বলো, আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ, আমার প্রতি ওহী হয় যে, তোমাদের মা’বূদ একমাত্র মা’বূদ। অতএব তাঁরই পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করো এবং তারই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। দুর্ভোগ অংশীবাদীদের জন্য। (সূরা হা-মীম সাজদাহ- ৬)।

আল্লাহর অনুগ্রহ পেতে চাইলে শিরকমুক্ত আমল করতে হবে

আমরা আল্লাহকে পেতে চাই। আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ লাভ করতে চাই। ইহজগত ও পরজগত উভয় জগতে তার অনুগ্রহে ধন্য হতে হলে অবশ্যই নেক আমল করতে হবে এবং আমল হতে হবে যে কোনো ধরনের শিরকমুক্ত। যার অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে যে বিশ্বাস করে যে, এক সময় আল্লাহর সামনে দাড়াতে হবে। তার উচিত আল্লাহর ইবাদতে কাউকে শরীক না করা এবং প্রতিটি কাজ সুন্নাহ মোতাবেক করা। যেহেতু বিদআত ও শিরক; এ দুটি হলো, আমল পণ্ড নিষ্ফল হওয়ার মূল কারণ। সুতরাং একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে ইখলাসের সাথে। ইবাদত হতে হবে নেক আমলের মাধ্যমে। আর নেক আমল হবে একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথে আমল করলেই। মহান আল্লাহ প্রতিটি মুসলিমকে শিরক ও বিদআত হতে দূরে রাখুন। আমীন॥

– মুফতি জসিমুদ্দীন, মুহাদ্দিস ও মুফতি, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।