জিজ্ঞাসা-সমাধান

যাকাত

(৯২৮৫) আব্দুল মালেক, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম।
জিজ্ঞাসা:
স্বর্ণ-রুপার অলংকার বানানোর সময় তাতে অন্যান্য ধাতু ব্যবহার করা হয়। জানার বিষয় হলো, যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে কি শুধু স্বর্ণ-রুপার পরিমাণের যাকাত দিতে হবে নাকি ধাতুসহ হিসাব করে যাকাত দিতে হবে?

সমাধান: অলংকারের ক্ষেত্রে যদি স্বর্ণ রুপার দিকটাই প্রধান্য থাকে তাহলে যুক্ত ধাতুর ভিন্ন হিসেব হবে না। স্বর্ণ রুপার অলংকার নেসাব পরিমাণ হলে বাজার মূল্য ধরে যাকাত দিতে হবে। আর ধাতুর দিকটাই প্রাধান্য পেলে সেই অলংকারের উপর স্বর্ণ রুপার হুকুম বর্তাবে না। সেই অংলকার ব্যবহারের জন্য হলে যাকাত দিতে হবে না। আর ব্যবসার জন্য হলে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে যাকাত দিতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে- ২/১৭, আলমুহীতুল বুরহানি- ২/২৪২, তাবয়ীনুল হাকায়েক- ১/২৭৯)।

সিয়াম

(৯২৮৬) রফিকুল ইসলাম, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।
জিজ্ঞাসা:
রোযা ইবাদাতটি অনেক ক্ষেত্রেই কাফফারা হিসেবে ব্যবহার হয়। যেমন, ফরয রোযার কাফ্ফারা হিসেবে রোযাকেই ধার্য করা হয়েছে। এমনিভাবে কসমের কাফফারা হিসেবেও রোযাকে ধার্য করা হয়েছে। আমি শুনেছি রোযাকে এমন আরও অনেক বিধানের কাফফারা ধার্য করা হয়েছে। আমার জানার বিষয় হলো, ঠিক কোন কোন বিধানের কাফ্ফারা রোযা ধার্য করা হয়েছে? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।

সমাধান: শরীয়তে একাধিক বিধানের ক্ষেত্রে রোযাকে কাফ্ফারা হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। নি¤েœ বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো-

এক. যিহারের কাফ্ফারা হিসেবে। যিহার মূলত স্ত্রী থেকে বিচ্ছেদ হওয়ার বা তালাক প্রদানের একটি প্রক্রিয়া। কেউ যদি নিজের স্ত্রীকে বলে, তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মতো। তাহলে যিহার সংঘটিত হয়ে যাবে। এতে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের উপর হারাম হয়ে যাবে। অবশ্য এই হুরমত তুলে নেওয়ার অবকাশ রয়েছে। স্বামী যদি কাফ্ফারা আদায় করে তাহলে পুনরায় তার জন্য স্ত্রী হালাল হয়ে যাবে। যিহারের কাফ্ফারার তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথমত, একটি দাস মুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুই মাস লাগাতার রোযা রাখতে হবে। তৃতীয়ত, ষাটজন মিসকীনকে একদিন দুবেলা খাওয়াতে হবে।

এখানে যিহারের কাফ্ফারার দ্বিতীয় ধাপে রোযাকে কাফ্ফারা হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنْ نِسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَتَمَاسَّا ذَلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ * فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَتَمَاسَّا فَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ذَلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘যারা তাদের স্ত্রীর সাথে যিহার করে, অতঃপর তাদের বক্তব্য থেকে ফিরে আসে, তাদের কাফফারা হলো, তারা একে অপরের সংস্পর্শে আসার আগে একটি দাস মুক্ত করবে। তোমাদেরকে এই উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, তোমাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সম্যক অবগত। আর যাদের এই সামর্থ্য নেই, তারা একে অপরের সংস্পর্শে আসার আগে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস রোযা রাখবে। আর যাদের এই সক্ষমতাও নেই, তারা ষাটজন মিসকিনকে (দুবেলা) খাওয়াবে। তোমরা যাতে আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি খাঁটি বিশ^াস স্থাপন করো, এই জন্যই এই বিধান। এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর কাফেরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সূরা মুজাদালা, ৩-৪)।

দুই. ফরয রোযা কোনো গ্রহণযোগ্য উযর ব্যতীত ইচ্ছাকৃত ভেঙে ফেলার কাফ্ফারা হিসেবে। কোনো ব্যক্তি যদি রমাযানে রোযা রেখে জেনেবুঝে স্ত্রী সহবাস করে বা খানাপিনা করে তবে তাকে সেই রোযা কাযা করতে হবে। সাথে সাথে কাফ্ফারাও দিতে হবে। ফরয রোযার কাফ্ফারা যিহারের কাফ্ফারার অনুরূপ। হয়ত দাস মুক্ত করতে হবে। সম্ভব না হলে দুই মাস ধারাবাহিক রোযা রাখতে হবে। তাও সম্ভব না হলে ষাটজন মিসকীনকে দুবেলা খাওয়াতে হবে। এক সাহাবী রমাযান মাসে রোযা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করে ফেলেন। পরে বিচলিত হলে রাসূল (স.)এর দরবারে হাজির হয়ে অপরাধ স্বীকার করে সমাধান চান। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার সমাধান কল্পে ইরশাদ করেন-

هل تجِدُ ما تُعتِقُ؟ قال: لا. قال: هل تستطيعُ أن تصومَ شَهرينِ مُتَتابعينِ؟ قال: لا. قال: فهل تجِدُ إطعامَ سِتِّينَ مِسكينًا؟ قال: لا. قال: فمكث النبيُّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم، فبينا نحن على ذلك أُتِيَ النبيُّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم بعَرَقٍ فيها تَمرٌ- والعَرَقُ: الْمِكتَلُ- قال: أين السَّائِلُ؟ فقال: أنا. قال: خذْ هذا فتصَدَّقْ به.

‘তোমার কাছে মুক্ত করার মতো কোনো কৃতদাস আছে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি ধারাবাহিক দুমাস রোযা রাখতে পারবে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি ষাটজন মিসকিনকে (দুবেলা) খাওয়াতে পারবে? সে বলল, না। আবু হুরাইরা. বলেন, এরপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেমে গেলেন, আমরাও এই অবস্থায় ছিলাম, এই সময় নবিজীর সামনে এক আরাক পেশ করা হলো, যাতে খেজুর ছিল। আরাক হলো ঝুড়ি। তিনি বললেন, প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল, আমি। তিনি বললেন, এগুলো নিয়ে সদকা করে দাও।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস -১৯৩৬)।

তিন. ভুলক্রমে হত্যার কাফফারা হিসেবে। কোনো মুসলিম যদি অপর কোনো মুসলিমকে ভুলক্রমে হত্যা করে ফেলে। আর ভুলক্রমে হওয়াটা যদি প্রমাণিত হয় তবে তাকে কাফ্ফারা দিতে হবে। তাকে একজন মুসলিম দাস স্বাধীন করতে হবে। সম্ভব না হলে ষাটটি রোযা রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَنْ يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَأً وَمَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا خَطَأً فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ وَدِيَةٌ مُسَلَّمَةٌ إِلَى أَهْلِهِ إِلَّا أَنْ يَصَّدَّقُوا فَإِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍ عَدُوٍّ لَكُمْ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ وَإِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ فَدِيَةٌ مُسَلَّمَةٌ إِلَى أَهْلِهِ وَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ تَوْبَةً مِنَ اللَّهِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا

‘কোনো মুমিন অপর মুমিনকে হত্যা করতে পারে না। তবে ভুলবশত (হলে ভিন্ন কথা)। যদি কোনো মুমিনকে সে ভুলবশত হত্যা করে ফেলে একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং নিহতের পরিবারকে রক্তপণ দিতে হবে। তারা মাফ করে দিলে ভিন্ন কথা। আর যদি নিহত ব্যক্তি তোমাদের শত্রুপক্ষের হয় এবং মুমিন হয়। তাহলে একজন মুমিন দাস মুক্ত করবে। আর যদি নিহত এমন কোনো কওমের হয় যার সাথে তোমাদের শান্তিচুক্তি রয়েছে, তাহলে তার পরিবারকে রক্তপণ দিতে হবে এবং একজন মুমিন দাস মুক্ত করতে হবে। আর যে দাস মুক্তির সামর্থ্য রাখে না সে আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফের জন্য দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখবে। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা নিসা, আয়াত- ৯২)।

চার. কসমের কাফ্ফারা হিসেবে। কোনো ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নামে কসম করলে সেই কসম পূর্ণ করতে হয়। কোনো কারণে পূর্ণ করতে না পারলে তবে কাফ্ফারা দিতে হবে। দশজন মিসকীনকে খাওয়াতে হবে অথবা পোশাক দিতে হবে। নচেৎ এক দাসকে স্বাধীন করতে হবে। অথবা তিন দিন রোযা রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الْأَيْمَانَ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ ذَلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ

‘তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। কিন্তু তোমরা ইচ্ছাকৃত কসম করে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভেঙে ফেললে তিনি তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। অতএব তার কাফফরা হলো, তোমরা নিজ পরিবারকে যে ধরনের খাবার দাও, তার মধ্যম মানের খাবার দিয়ে দশজন মিসকিনকে খাওয়াবে, বা তাদেরকে পরিধেয় দিবে বা দাস মুক্ত করবে। যে তা পারবে না, সে তিন দিন রোযা রাখবে। এটা হচ্ছে তোমাদের কসমের কাফফরা, যখন তোমরা কসম করো এবং তোমরা কসমকে রক্ষা করো’। (সূরা মায়েদা, আয়াত- ৮৯)।

পাঁচ. হজ্জে ইহরাম পরপন্থি কোনো কাজের কাফ্ফারা হিসেবে। হজ্জে ইহরাম পরপন্থি কোনো কাজ করলে কাফ্ফারা আদায় করতে হয়। হয়ত দম দিতে হয়। অথবা ছয়জন মিসকীন খাওযাতে হয়। অথবা তিন দিন রোযা রাখতে হয়। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ بِهِ أَذًى مِّن رَّأْسِهِ فَفِدْيَةٌ مِنْ صِيَامٍ أَوْ صَدَقَةٍ أَوْ نُسُكٍ
‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয়, কিংবা কারও মাথায় যদি কোনো সমস্যা থাকে (যার কারণে সময়ের আগেই মাথা মু-াতে হয়) তাহলে সে রোযা, সদকা বা কুরবানি দ্বারা ফিদয়া দিবে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত- ১৯৬)।

(৯২৮৭) মাহমুদা আখতার, সদর, মোমেনশাহী।
জিজ্ঞাসা:
কিছুদিন পূর্বে আমার স্বামী মান্নত করেছে যে, যদি তার চাকরির ব্যবস্থা হয় তাহলে সে চারটি রোযা রাখবে।

মান্নত করার কিছু দিনের মধ্যেই তার চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যায়। এখন তিনি অলসতার দরুন মান্নতের রোযাগুলো রাখতে চাচ্ছেন না। আমি একাধিকবার অনুরোধ করেছি, তিনি গুরুত্বই দিচ্ছেন না। এখন আমি তার পক্ষ থেকে তার মান্নতের রোযাগুলো রাখতে পারব কি? দলীলসহ জানতে ইচ্ছুক।

সমাধান: নামায, রোযা স্বতন্ত্র ইবাদত। এ প্রকারের ইবাদতে বদলি দেয়ার নিয়ম নেই। হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন-
لَا يُصَلِّي أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ، وَلَا يَصُومُ أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ وَلَكِنْ يُطْعِمُ عَنْهُ

‘একজনের নামায অপরজন পড়তে পারবে না। একজনের রোযা অন্যজন রাখতে পারবে না। কিন্তু একজনের পক্ষ থেকে অন্যজন খাওয়াতে পারবে।’ (সুনানে নাসায়ী, হাদীস- ২৯৩০)।

হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন-
لَا تَصُومُوا عَنْ مَوْتَاكُمْ وَأَطْعِمُوا عَنْهُمْ.
‘তোমরা মৃতদের পক্ষ থেকে রোযা রেখো না; বরং তাদের পক্ষ থেকে খাওয়াও’। (সুনানে কুবরা, বাইহাকী, হাদীস -৮২৩২)।

এছাড়া জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে রোযা রাখা শরীয়ত সম্মত নয় এ ব্যাপারে সকল ইমামগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

ইমাম ইবনে হাযম (রহ.) বলেন-
واجمعوا أَنه لَا يَصُوم أحد عَن انسان حَيّ
‘জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কেউ রোযা রাখতে পারবে না এ ব্যাপারে সমস্ত আলেমগণ একমত পোষণ করেছেন’। (মারাতিবুল ইজমা- ৪০)।

তিনি অন্যত্র বলেন-
وَأَجْمعُوا على أَن الْوكَالَة فِي الصَّلَاة الْمَفْرُوضَة وَالصِّيَام لَا يجوز
‘সকলে একমত হয়েছেন যে, ফরয নামায ও রোযার ক্ষেত্রে কেউ কারো পক্ষ থেকে উকিল হয়ে আদায় করতে পারবে না’। (মারাতিবুল ইজমা- ৬২)।

ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহ.) বলেন-
لَا يُجْزِئُ صَوْمُ أَحَدٍ فِي حَيَاتِهِ عَنْ أَحَدٍ، وَهَذَا كُلُّهُ إِجْمَاعٌ لَا خِلَافَ فِيهِ.

‘একজনের জীবদ্দশায় অন্যজন তার পক্ষ থেকে রোযা রাখলে যথেষ্ট হবে না। এগুলো ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলা, এখানে কারও দ্বিমত নেই’। (আল ইসকিযকার -১০/১৬৭)।

ইমাম নববী (রহ.) বলেন-
قَالَ أَصْحَابُنَا وَغَيْرُهُمْ وَلَا يُصَامُ عَنْ أَحَدٍ فِي حَيَاتِهِ بِلَا خِلَافٍ سَوَاءٌ كَانَ عَاجِزًا أَوْ قَادِرًا
‘আমাদের মাযহাব এবং অন্যান্য মাযহাবের ইমামগণ বলেন, কারও জীবদ্দশায় তার পক্ষ থেকে রোযা রাখা যাবে না। চাই সে অক্ষম হোক বা সক্ষম হোক। এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই।’ (আল মাজমূ -৬/৩৭১)।
অতএব, আপনার স্বামীর মান্নত আপনার স্বামীকেই আদায় করতে হবে। আপনি রোযা রাখলে তার মান্নতের রোযার ওয়াজিব আদায় হবে না।

মান্নত নিজের পক্ষ হতে ওয়াদাকৃত একটি ইবাদাত। তাই মান্নত করার পর মান্নত আদায়ে অলসতা করা নিতান্ত নিন্দনীয় কাজ। হযরত আয়েশা (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কেউ যদি ভাল কাজের মান্নত করে সে যেন তা পূর্ণ করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ৬৬৯৬, ই’লাউস সুনান- ৯/১৩৭, রদ্দুল মুহতার- ২/৬৪০, হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাল মারাকী- ৬৯৪)।

হজ্জ
(৯২৮৮) আব্দুল কাদের, মুহাম্মদপুর, ঢাকা।
জিজ্ঞাসা:
হজ্জ ফরয হওয়ার পর সেই বছরেই হজ্জ করা কি আবশ্যক? নাকি বিলম্ব করার অবকাশ রয়েছে? কত দিন পর্যন্ত বিলম্ব করা যেতে পারে? বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক।

সমাধান: কারও উপর হজ্জ ফরয হলে যথা সম্ভব সেই বছরেই হজ্জ আদায় করা উচিত। পরবর্তী বছরও আদায় করার অবকাশ রয়েছে। তবে বিশেষ উযর না থাকলে বিলম্ব না করাই কাম্য।

কোনো কারণে বিলম্ব হয়ে গেলে গুনাহ হবে না। একাধিক ইমামের বক্তব্য অনুযায়ী হজ্জ ফরয হয়েছে ষষ্ঠ হিজরীতে। (আল-উম্ম -২/১২৯)। আর রাসূল (সা.) হজ্জ করেছেন ১০ম হিজরীতে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, হজ্জ পালন করতে কিছুটা বিলম্ব হওয়াও দোষের কিছু নয়। তবে বিনা কারণে বিলম্ব না করাই কাম্য।

বিশেষ করে এত বিলম্ব তো মোটেই ঠিক নয় যে, হজ্জ করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। শারীরিক অক্ষমতার দরুন হজ্জ থেকে মাহরূম হতে হয়।

এছাড়া বিলম্বটা যদি অবহেলা বা অলসতার স্তরে পৌঁছে যায় তখন সর্বাবস্থায় নিন্দনীয়। যারা অলসতাবশত এবং নিছক পার্থিব আয় উন্নতিতে অন্ধ হয়ে হজ্জে যেতে বিলম্ব করছেন তাদের রাসূল এর হুশিয়ারী স্মরণ করা উচিত। এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন-
مَنْ لَمْ يَمْنَعْهُ عَنِ الْحَجِّ حَاجَةٌ ظَاهِرَةٌ ، أَوْ سُلْطَانٌ جَائِرٌ، أَوْ مَرَضٌ حَابِسٌ فَمَاتَ وَلَمْ يَحُجَّ ، فَلْيَمُتْ إِنْ شَاءَ يَهُودِيًّا، وَإِنْ شَاءَ نَصْرَانِيًّا

‘যে ব্যক্তি সুস্পষ্ট অভাব বা অত্যাচারী শাসকের বাধা কিংবা সাংঘাতিক রোগ ছাড়া হজ্জ না করে মারা গেলো, সে চাই ইহুদি হয়ে মারা যাক বা নাসারা হয়ে মারা যাক (এতে কিছু যায় আসে না)’। (সুনানে দারিমী, হাদীস -১৮২৬)।

(৯২৮৯) আবিদ উল্লাহ, পূর্ব বশিকপুর, ফুলগাজী, ফেনী।
জিজ্ঞাসা:
হজ্জ ফরয হওয়ার পরও যদি কেউ হজ্জ না করে, তার সম্পর্কে ইসলামে কী বিধান রয়েছে? বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক।

সমাধান: হজ্জ ইসলামের শিআর পর্যায়ের একটি ফরয বিধান। হজ্জ ফরয হলে অবশ্যই হজ্জ করতে হবে। হজ্জ ফরয হওয়ার পরও হজ্জ না করলে ফরয তরকের কারণে কবীরা গুনাহ হবে। হজ্জ ফরয হওয়ার পরও নিছক অলসতা বশত হজ্জ না করা; পার্থিব আয় উন্নতিতে মত্ত হয়ে হজ্জে গমন না করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। এ প্রেক্ষিতে একাধিক হাদীসে নিন্দা ও হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। এক হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّ عَبْدًا صَحَّحْتُ لَهُ جِسْمَهُ، وَوَسَّعْتُ عَلَيْهِ فِي الْمَعِيشَةِ يَمْضِي عَلَيْهِ خَمْسَةُ أَعْوَامٍ لَا يَفِدْ إليَّ لَمَحْرومগ্ধ

যখন আমি বান্দার শরীর সুস্থ রাখি এবং তাকে আমি স্বচ্ছলতা দান করি, এমতাবস্থায় তার উপর যদি পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে যায় এবং সে আমার (বাইতুল্লাহর) কাছে না আসে, তাহলে সে বঞ্চিত। (সহীহ ইবনে হিব্বান- ৩৭০৩)।

রাসূল (সা.) বলেন- مَنْ أرَادَ الحجَّ فلْيَتَعَجَّلْ
‘যে হজ্জের নিয়ত করেছে সে যেন বিলম্ব না করে।’ (মুসতাদরাকে হাকিম-১৬৪৫, হাদীসটি সহীহ )।

আবু উমামা ও আলী (রাযি.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন-
مَنْ لَمْ يَمْنَعْهُ عَنِ الْحَجِّ حَاجَةٌ ظَاهِرَةٌ ، أَوْ سُلْطَانٌ جَائِرٌ، أَوْ مَرَضٌ حَابِسٌ فَمَاتَ وَلَمْ يَحُجَّ ، فَلْيَمُتْ إِنْ شَاءَ يَهُودِيًّا، وَإِنْ شَاءَ نَصْرَانِيًّا
‘যে ব্যক্তি সুস্পষ্ট অভাব বা অত্যাচারী শাসকের বাধা কিংবা সাংঘাতিক রোগ ছাড়া হজ্জ না করে মারা গেলো, সে চাই ইহুদি হয়ে মারা যাক বা নাসারা হয়ে মারা যাক (এতে কিছু যায় আসে না)।’ (সুনানে দারিমী, হাদীস -১৮২৬)।

হযরত উমার (রাযি.) বলেন-
مَن أطاق الحجَّ فلم يحجَّ، فسواء عليه مات يهوديًّا أو نصرانيًّا
‘যে ব্যক্তি হজ্জের সামর্থ্য রেখেও হজ্জ করেনি, তার জন্য ইহুদী বা নাসারা হয়ে মারা যাওয়া এক বরাবর।’ (তাফসীরে ইবনে কাছীর- ১/৫০৮, ইবনে কাছীর রহ. হাদীসটি সহীহ আখ্যা দিয়েছেন)।

উপর্যুক্ত হাদীসসমূহ থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, হজ্জ ফরয হওয়ার পরও হজ্জ না করাটা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ ও নিন্দনীয় কাজ।

স্মর্তব্য, কোনো ব্যক্তির উপর হজ্জ ফরয হওয়ার পরও হজ্জ পালন করতে অক্ষম হয়ে গেলে বদলী হজ্জ করাতে পারবে। এ অবস্থায় মারা যাওয়ার উপক্রম হলে অবশ্যই বদলী হজ্জ পালনের অসিয়ত করে যেতে হবে।

আরও পড়তে পারেন-

(৯২৯০) জাহিদুল ইসলাম, জামালখান, চট্টগ্রাম।
জিজ্ঞাসা:
আমি হজ্জে যেতে ইচ্ছুক কিন্তু আমার সামর্থ্য নেই। ইসলামে এমন কোনো আমল আছে কি যা করলে হজ্জের সাওয়াব মিলবে। অনুগ্রহপূর্বক জানিয়ে বাধিত করবেন।

সামাধন: জী, ইসলাম এমন অনেক আমলই রয়েছে যা আদায় করলে পূর্ণ হজ্জের সাওয়াব মিলবে। বিভিন্ন হাদীসে তা বর্ণিত হযেছে। নি¤েœ কয়েকটি আমল উল্লেখ করা হলো-

এক. ফজরের নামায জামাতে আদায় করে ইশরাক পর্যন্ত বসে থেকে ইশরাক আদায় করলে হজ্জ ও উমরার সাওয়াব মিলবে। হযরত আনাস (রাযি.) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
مَنْ صَلَّى الغَدَاةَ فِي جَمَاعَةٍ، ثُمَّ قَعَدَ يَذْكُرُ اللَّهَ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ، ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ، كَانَتْ لَهُ كَأَجْرِ حَجَّةٍ وَعُمْرَةٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : ্রتَامَّةٍ، تَامَّةٍ، تَامَّةٍ

‘যে ব্যক্তি জামাতের সাথে ফজরের নামায আদায় করবে। অতপর সূর্যোদয় পর্যন্ত যিকিরে লেগে থাকবে, অতঃপর দু রাকাত নামায আদায় করবে, তার জন্য একটি হজ্জ ও উমরার সমপরিমাণ প্রতিদান রয়েছে’। রাবী বলেন, তিনি বলেলন, ‘পরিপূর্ণ পরিপূর্ণ পরিপূর্ণ।’ (জামে তিরমিযী, হাদীস- ৫৮৬)।

অন্য আর একটি বর্ণনায় যুহা তথা চাশতের নামায পড়ার কথা উল্লেখ হয়েছে। যেমন বর্ণিত হযেছে-
من صلَّى صلاةَ الصبح في جماعةٍ، ثم ثبتَ حتى يسبِّحَ لله سُبحةَ الضحى، كان له كأجرِ حاجًّ ومعتمرٍ، تاماً له حجه وعمرته
‘যে ফজরের নামায জামাতে আদায় করল, অতপর চাশতের নামায পর্যন্ত সেখানে বসে থাকলো, তাকে একজন হজ্জ ও উমরাপালনকারীর সওয়াব প্রদান করা হবে, যার হজ্জ ও উমরা দুটোই পরিপূর্ণ আদায় হয়েছে। (আল মুজামুল কাবীর, হাদীস- ৭৬৪৯, হাদীসটি সামগ্রীকভাবে হাসান)।

দুই. মসজিদে দ্বীনি ইলম শেখা বা শিখানোর উদ্দেশ্যে গমন করা। হযরত আবু উমামা (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
من غَدا إِلَى الْمَسْجِد لَا يُرِيد إِلَّا أَن يتَعَلَّم خيرا أَو يُعلمهُ كَانَ لَهُ كَأَجر حَاج تَاما حجَّته
‘যে ব্যক্তি কল্যাণের কাজ শেখা বা শেখানোর জন্য মসজিদে গেল, তাকে একজন হাজীর সওয়াব দেয়া হবে, যার হজ্জ পরিপূর্ণ আদায় হয়েছে’। (তাবারানী, হাদীস- ৭৪৭৩, মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস- ৩১১)।

তিন. অযু করে মসজিদে নামাযের উদ্দেশ্যে গমন করা। হযরত আবু উমামা (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-

مَنْ خَرَجَ مِنْ بَيْتِهِ مُتَطَهِّرًا إِلَى صَلَاةٍ مَكْتُوبَةٍ فَأَجْرُهُ كَأَجْرِ الْحَاجِّ الْمُحْرِمِ،
‘যে ব্যক্তি ফরয নামাযের জন্য পবিত্র হয়ে ঘর থেকে বের হলো, তাকে একজন মুহরিম হজ্জ পালনকারীর সওয়াব দেয়া হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস- ৫৫৮)।

চার. পিতা মাতার সেবা করা। হযরত আনাস (রাযি.) বলেন-
أَتَى رَجُلٌ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: إِنِّي أَشْتَهِي الْجِهَادَ، وَإِنِّي لَا أَقْدِرُ عَلَيْهِ، فَقَالَ: ্রهَلْ بَقِيَ أَحَدٌ مِنْ وَالِدَيْكَ؟গ্ধ قَالَ: أُمِّي قَالَ: ্রفَأَبْلِ اللَّهَ عُذْرًا فِي بِرَّهَا، فَإِنَّكَ إِذَا فَعَلْتَ ذَلِكَ فَأَنْتَ حَاجٌّ وَمُعْتَمِرٌ وَمُجَاهِدٌ.

‘এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, আমি জিহাদ করতে চাই, কিন্তু আমার তার সামর্থ্য নেই। তখন নবীজি বললেন, তোমার পিতা মাতার কেউ জীবিত আছেন? সে বলল, আমার মা। তিনি বললেন, তোমার মায়ের খেদমতের দোহাই দিয়ে তুমি আল্লাহর কাছে উযর পেশ করো, যদি তুমি তাই করো, তাহলে তুমি হজ্জপালনকারী, উমরাপালনকারী ও মুজাহিদ। (তাবারানী; আওসাত, হাদীস- ২৯১৫, ইমাম ইরাকী (রহ.) ও ইমাম হাইসামী রহ. হাদীসটি হাসান আখ্যা দিয়েছেন)।

পাঁচ. ভবিষ্যতে সামর্থ্য হলে হজ্জ করার পাক্কা নিয়ত করা। এবং আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করা। ইনশাআল্লাহ, এতে আল্লাহ তাআলা আপনার আমলনামায় হজ্জের সওয়াব প্রদান করবেন। রাসূল (স.) বলেন, চার প্রকার মানুষের জন্য এই পৃথিবী। তার মধ্যে প্রথম দুই প্রকার হলো-

عَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَعِلْمًا فَهُوَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ، وَيَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ، وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا، فَهَذَا بِأَفْضَلِ المَنَازِلِ، وَعَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالًا فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ، يَقُولُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلَانٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ.

‘ঐ বান্দা যাকে আল্লাহ ইলম সম্পদ দুটোই দিয়েছেন, সে এক্ষেত্রে তার রবকে ভয় করে, এর মাধ্যমে আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখে এবং এতে সে আল্লাহর হক আছে বলে জানে, এই ধরনের ব্যক্তি সর্বোচ্চ স্তরের। ঐ বান্দা যাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন কিন্তু সম্পদ দেননি। তবে সে সৎ নিয়তের অধিকারী, সে বলে, আমার যদি সম্পদ থাকতো, আমি অমুক অমুক কাজ করতাম। এই প্রকারের ব্যক্তির মর্যাদা তার নিয়ত মুতাবিক হবে। এই দুই প্রকারের ব্যক্তির সওয়াব সমান হবে।’ (জামে তিরমিযী, হাদীস- ২৩২৫, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান ও সহীহ বলেছেন)।

বি:দ্র: এসব আমলের মাধ্যমে হজ্জের সওয়াব মিললেও এগুলো ফরয হজ্জের বিকল্প হবে না।

নিকাহ-তালাক
(৯২৯১) সালমা আখতার, বেলাব, নরসিংদী।
জিজ্ঞাসা:
আমার একটি ভাল পরিবারে বিবাহ হয়েছে। সংসারের কাজ আমি নিয়মিত করে যাচ্ছি। হঠাৎ আমার স্বামী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি এখন নিজের কাজগুলোও নিজে নিজে করতে পারেন না। সব কাজে তাকে সাহায্য করতে হয়। অন্য দিকে বেশ কিছু দিন ধরে আমার শশুর অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তাকেও দেখভাল করতে হয়। সব কাজ করে দিতে হয়। এখন আমার পক্ষে দুই জনের সেবা করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন আমার জানার বিষয় হলো, কার সেবা করা আমার উপর অধিক আবশ্যক?

সমাধান: আপনার স্বামীই আপনার সেবা পাওয়ার অধিক হকদার। সেবার ক্ষেত্রে তাকেই প্রধান্য দিতে হবে। স্বামীকে ফেলে রেখে অন্য কারও সেবা করা ঠিক নয়। তবে শশুরের প্রতিও অবহেলা না করা উচিত। অন্য কোনো সেবক পাওয়া না গেলে আপনার উপর যথা সম্ভব সেবা করে যাওয়ার দায়িত্ব বর্তাবে। আল্লাহ তাআলা আপনাকে এর উত্তম বিনিময় দান করবেন। ইনশাআল্লাহ। (সুনানে আবু দাউদ ১/২৯৮, রদ্দুল মুহতার ৩/২০৮, ফাতাওয়া বায্যাযয়া ৪/১৫৬)।

(৯২৯২) রোজি ইসলাম, দরগাহ, সিলেট।
জিজ্ঞাসা:
আমার বিবাহ হয়েছে তিন বছর হলো। বিবাহের পরে কিছু দিন আমার স্বামী আমার খোরপোষ দেন এবং নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। কিছু দিন যেতে না যেতেই খোঁজখবর নেয়া এবং খোরপোষ দেয়া বন্ধ করে দেন। আমি আজ প্রায় তিন বছর যাবত আমার পিতার বাড়িতে আছি। আমারা স্বামী আমাকে তালাকও দিচ্ছেন না আবার খোরপোষও দিচ্ছেন না। এমতাবস্থায় এমন স্বামী থেকে বিচ্ছেদ গ্রহণ করার অধিকার আমার আছে কি? থাকলে কীভাবে বিচ্চেদ গ্রহণ করতে পারি। জানিয়ে বাধিত করবেন।

সমাধান: প্রশ্নোক্ত অবস্থায় আপনার জন্য স্বামী থেকে বিচ্চেদ গ্রহণ করার অধিকার রয়েছে। আপনি চাইলে বিচ্ছেদ গ্রহণ করে অন্যত্রে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। বিচ্ছেদ গ্রহণ করার পদ্ধতি নি¤œরূপ: যদি কাবিন নামায় খোরপোশ না দেওয়ার শর্ত বা কোনো শর্ত ব্যতীরেকে আপনাকে তালাক প্রদান করার স্বামী কর্তৃক অনুমতি থাকে তাহলে আপনি সেই অধিকার বলে নিজের উপর তালাক পতিত করে সেই স্বামী থেকে বিচ্ছেদ গ্রহণ করতে পারেন। আর যদি তালাকে কোনো অনুমতি দেয়া না থাকে তাহলে আদালতে গিয়ে মুসলিম কোনো বিচারকের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। (কিফায়াতুল মুফতী ৮/৫৩৭)।

ওয়াকফ-মসজিদ
(৯২৯৩) বিলাল আহমদ রাসেল, সিলেট।
জিজ্ঞাসা:
আমাদের মসজিদে প্রতি শুক্রবারে মানুষ অনেক টাকা দান করেন। সেই টাকা থেকে মসজিদের যাবতীয় খরচ বহন করা হয়। ইমাম খতীব ও মুয়াজ্জিনের বেতনও সেখান থেকে দেয়া হয়। একজন বললেন এ টাকা থেকে তাদের বেতন দেয়া যাবে না। আমার জানার বিষয় হলো, মসজিদে দানকৃত টাকা থেকে খতীব, ইমাম ও মুয়াজ্জিন সাহেবদের হাদিয়া প্রদান করার বিধান কী?

সমাধান: মানুষ সাধারণত মসজিদের কল্যাণ ফান্ডে দান করে। আর কল্যাণ ফান্ডের আওতায় মসজিদের অন্যান্য ব্যয়ের পাশাপাশি ইমাম খতীব ও মুয়াজ্জিন সাহেবের বেতনও অন্তর্ভুক্ত। তাই সাধারণ ফান্ডে দানকৃত টাকা থেকে তাদের বেতন দেওয়া যাবে। অবশ্য কোনো ব্যক্তি যদি মসজিদের বিশেষ কোনো কাজে; তথা নির্মাণ কল্পে বা অযুখানা মেরামত ইত্যাদি কাজের জন্য দান করে থাকেন তাহলে তার টাকা সেই খাতেই ব্যয় করতে হবে। অপরিহার্য না হলে সেখান থেকে বেতন দেয়া যাবে না। (হিন্দিয়া- ২/৩৬৮, শামী- ৪/৩৬০, বাহরুর রায়েক- ৫/৪১৪)

(৯২৯৪) মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ
জিজ্ঞাসা:
একজন ব্যক্তি মসজিদের নামে কিছু জায়গা ওয়াক্ফ করে দিয়েছেন। এখনো মসজিদ নির্মাণ করা হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো ঐ জায়গাটা কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কি না?

সমাধান: মসজিদের নামে ওয়াকফকৃত জমিতে কবরস্থান বানানো বৈধ হবে না। যে খাতে ওয়াক্ফ করা হয়েছে সেই খাতেই তা ব্যবহার করতে হবে। শরয়ী প্রয়োজন ব্যতীত ভিন্ন খাতে ব্যবহার করার অনুমতি নেই। (সহীহ বুখারী- ২৭৩৭, ফাতওয়া শামী- ৬/২৮৩, বাহরুর রায়েক- ৫/২৬৬)।

(৯২৯৫) আনসারুল করিম, চাঁদপুর।
জিজ্ঞাসা:
জনৈক ব্যক্তি নিজের টাকায় একটা মসজিদ নির্মাণ করে এবং সেই মসজিদে একজন ইমাম নিয়োগ দেয়। ঐ ব্যক্তির উপর যাকাত ফরয। সে তার যাকাতের টাকা থেকে ইমামের বেতন দিতে চাচ্ছে। জানার বিষয় হলো, ঐ ব্যক্তিকে যদি ইমাম সাহেব তার যাকাতের টাকা থেকে বেতন দেয় তাহলে তার যাকাত আদায় হবে কি?

সমাধান: না, ঐ ব্যক্তির যাকাত আদায় হবে না। কেননা, ইমাম সাহেবের বেতন একটি বিনিময় চুক্তি হিসেবে প্রদান করা হয়। যাকাত আদায়ের মূল শর্ত হচ্ছে বিনিময় ব্যতিরেকে নিঃশর্তে কোনো গরিব লোককে মালিক বানিয়ে দেয়া। সুতরাং ইমাম সাহেবকে বেতন হিসেবে যাকাতের টাকা দিলে যাকাতই আদায় হবে না। তবে ইমাম সাহেব এমনিতে দরিদ্র হলে বেতন বাদে অতিরিক্ত টাকা যাকাত থেকে দান করা যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে- ২/৩৯, ফাতহুল কাদীর- ২/২৫৯,আল বাহরুর রায়েক- ২/২১৬, রদ্দুল মুহতার- ২/২৫৬-২৫৮)।
ব্যবসা-লেনদেন

(৯২৯৬) তাওসিফ, কক্সবাজার।
জিজ্ঞাসা:
আমি অনলাইনে রি-সেলার হিসেবে কাজ করছি দুই বছর যাবত। পণ্য ছাড়ে কিনে তা আবার দোকানে অথবা লোকাল ক্রেতার কাছে বিক্রি করাই মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেছে অনলাইন কোম্পানিটি পণ্য দিতে অপারগ হলে বা সময়মতো দিতে ব্যর্থ হলে পণ্যের বাজার মূল্যের চেক দিচ্ছে। যাতে ক্রেতা পণ্যটি বাহির থেকে কিনতে পারে। তবে চেক হস্তান্তর করে আরো দুই-তিন মাস পর। অর্থাৎ- সমপরিমাণ টাকা দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু টাকা ক্যাশ হবে দুই তিন মাস পর। এখন আমি নিজেও বেশ কয়েকবার এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। আবার নিজেও ইচ্ছাকৃতভাবে চেক নিয়েছি টাকা বেশি লাভের আশায়।

বিষয়টা আমি উদাহরণস্বরূপ বলি মনে করেন, একটি পণ্যের বাজার দর ৫ টাকা। অনলাইন কোম্পানি ছাড়ে দিচ্ছে ৩ টাকায়। সময় নিচ্ছে অন্তত দুই মাস। দুই মাস পর যখন আমি পণ্য কব্জ করি। আমি বিক্রয় করি ৪/৪.৫ টাকায়। কিন্তু অনলাইন কোম্পানি যখন পণ্য দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তারা পণ্য না দিয়ে পণ্যের বাজার মূল্যের ৫ টাকার একটি চেক প্রদান করে। আর এই চেকের তারিখ থাকে আরো অন্তত দুই তিন মাস পর। মানে আমি পণ্য বাজারে বিক্রি করলে টাকা সাথে সাথে পেতাম, আর এখানে চেক নিলে টাকার পরিমাণ একটু বেশি হলেও অনেক দিন সময় দিতে হচ্ছে ওদের।

জনাবের খেদমতে আমি জানতে চাচ্ছি, এই চেকের টাকা কি আমার জন্য হালাল হচ্ছে? সম্প্রতি এ নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। যদি হারাম হয় সে ক্ষেত্রে আমার করণীয় কী? আর আমার মূলধনে যদি হারাম দাখিল হয় সে ক্ষেত্রে আমার কী করণীয়? আর ব্যাংকিং লেনদেন করতে গিয়ে অনেক সময় ব্যাংক ইন্টারেস্ট বলে টাকা দেয়। আবার ব্যাংকিং লেনদেন না করেও সঠিকভাবে ব্যবসা সম্ভব না। এখন আমার করণীয় কী?

সমাধান: অগ্রিম টাকা দিয়ে পরে পণ্য নেয়ার চুক্তির ক্ষেত্রে যদি পণ্য সরবরাহকারী পণ্য দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মূল টাকা ক্রেতাকে ফেরত দিতে হবে। বাড়তি টাকা দেয়া বা নেয়া কোনোটাই বৈধ নয়। আপনার বর্ণনা মতে আপনি যে কয়বার কোম্পানি থেকে পণ্যের বাজার মূল্যের চেক, ‘যা আপনার দেয়া টাকার অতিরিক্ত পরিমাণের’ নিয়েছেন তা বৈধ হয়নি। চেকে আপনার দেয়া পরিমাণের অতিরিক্ত টাকা আপনার জন্য হারাম। এই টাকার মালিক আপনি নন; বরং কোম্পানি। এখন আপনার উপর ওয়াজিব, যে কয়বার আপনি এমনটি করেছেন সে কয়েকবারের টাকা হিসাব করে মূল টাকা বাদে অতিরিক্ত টাকা কোম্পানিকে দিয়ে দেয়া এবং এ অতিরিক্ত টাকা ব্যবসায় লাগিয়ে যত মুনাফা অর্জন করেছেন তার সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত যাকাত গ্রহণের উপযুক্তদেরকে দিয়ে দেয়া। এভাবে আপনার মূলধন হারাম মুক্ত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আপনি যেহেতু মাত্র কয়েকবার এমনটি করেছেন এজন্য এর হিসাব বের করা কঠিন হবে না।

ব্যাংকিং লেনদেন করতে যদি বাধ্য হন, তবে যেসব ব্যাংকে কারেন্ট একাউন্ট এর সুবিধা রয়েছে সেগুলোর সাথে কারেন্ট একাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করবেন।

কিছু কিছু ব্যাংকে কারেন্ট একাউন্টের মধ্যেও ইন্টারেস্ট এর টাকা জমা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে করণীয় হলো- ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মূল টাকার পরিমাণ এবং ইন্টারেস্ট এর টাকার পরিমাণ এর হিসাব নিয়ে ইন্টারেস্ট এর টাকা সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত যাকাত গ্রহণের উপযুক্তদেরকে দিয়ে দেয়া। (সূরা বাকারা- ২৭৫। সুুনান আবু দাউদ- ৩৪৬৯, হিদায়া- ৩/৫২, বাদায়িয়ুস সানায়ে- ২/৫৯৪, আর্দ্দুরুল মুখতার- ৭/৪৮৩)।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।