পরিচালনায়- ফাতওয়া বিভাগ, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
দাড়ি প্রসঙ্গ
(৯৫২৫) মুহাম্মদ এমরান, হাটহাজারী মাদরাসা, চট্টগ্রাম।
জিজ্ঞাসা: দাড়ি রাখা সুন্নাত না ওয়াজিব? কেউ যদি দাড়ি রেখে পরবর্তীতে ফেলে দেয়, তার ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কী?
সমাধান: দাড়ি রাখা ওয়াজিব। আর তা মুন্ডানো বা এক মুষ্টির ভেতরে কাটা হারাম; সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি দাড়ি রেখে কেটে ফেলে, তাহলে সে ফাসিক বলে গণ্য হবে। তার উচিত নিজ কৃতকর্মের জন্য তাওবা করে পুনরায় দাড়ি রাখা। (সহীহ বুখারী- ২/৮৭৫, ফাতহুল কাদীর- ২/২৭০, হিদায়া- ১/২৫৫, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া- ২৪/৪৯২)।
কিয়াম প্রসঙ্গ
(৯৫২৬) মুহাম্মদ নূরুদ্দীন কাউছার লাবু, গোয়াইনঘাট, সিলেট।
জিজ্ঞাসা: কিয়াম করা জায়েয আছে কি? এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী।
সমাধান: হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরামের কাছে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চেয়ে প্রিয় কোনো ব্যক্তি ছিল না। তবুও তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে দেখে দাঁড়াতেন না। কারণ, তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর এ ব্যাপারে অসন্তুষ্টির কথা জানতেন। (সুনানে তিরমিযী)।
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, প্রচলিত কিয়াম তথা কোনো মজলিসে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর নাম শুনে দাঁড়িয়ে দরূদ পড়াকে ফযীলতপূর্ণ বা আবশ্যক মনে করা বিদআত ও ভ্রষ্টতা। আর রাসূলুল্লাহ (সা.)কে হাযির-নাজির মনে করে কিয়াম করা শিরক। (সূরা আলে ইমরান- ৪৪, সহীহ বুখারী- ২৬৯৭, উমদাতুল কারী- ৯/৫৮৫, ইবনে মাজাহ হাদিস নং- ২৩৬৩, দুররে মুখতার- ২/৭২০)।
খতমে তারাবীহ এবং জবাইকৃত পশুর হুকুম প্রসঙ্গে
(৯৫২৭) এমডি এস এইচ পারভেজ, কর্ণফুলী, চট্টগ্রাম।
জিজ্ঞাসা: (ক) মূর্তি পূজারী, আগুন পূজারী, মুরতাদ বা কাদিয়ানীর জবাইকৃত পশুর গোশত বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া যাবে কি? হারাম খাদ্য ও মাদক মিশ্রিত কোমল পানীয় পান করে- এমন ব্যক্তি কি আল্লাহর ওলী হতে পারে?
(খ) আমাদের এলাকার মসজিদগুলোতে রমযানের তারাবীর কুরআন খতম করা হয় ১লা রমযানের পর থেকে ২০শে রমযানের ভেতর। আর বাকি তারাবীতে সূরা তারাবীহ পড়া হয় চাঁদ দেখা পর্যন্ত। এটা প্রায় ৪০-৫০ বছর যাবত চলছে। এতে কোনো শরয়ী বাধা আছে কি না? অর্থাৎ- এটা জায়েয আছে কি না? জানতে চাই।
সমাধান: (ক) মূর্তি পূজারী, আগুন পূজারী, মুরতাদ ও কাদিয়ানীদের জবেহকৃত জন্তু হারাম। সুতরাং উক্ত জন্তুর গোশত বিসমিল্লাহ বলে খেলেও হারাম হবে।
(খ) হারাম ভক্ষণকারী কোনো ব্যক্তি মুত্তাকী হতে পারে না, পরিপূর্ণ তাকওয়া ছাড়া কখনোই আল্লাহর ওলী হওয়া যায় না। সুতরাং প্রশ্নোল্লিখিত ব্যক্তিও আল্লাহর ওলী হতে পারে না।
(গ) রমযান মাসে তারাবীতে একবার কুরআন খতম করা সুন্নাত। আর সেটা কতদিনে সম্পন্ন হবে- তা নির্ভর করে মুসল্লিদের সামর্থ্যের উপর। তবে পুরো রমযানেই তারাবীহ পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। সুতরাং মুসল্লীগণ যদি চায় ১৫ দিনে, ২১ দিনে, কিংবা ২৭ দিনে তারাবীতে কুরআনে কারীম শেষ করে বাকি দিনগুলোতে সূরা তারাবীহ পড়বে, তাহলে এতে শরীয়তের কোনো বাধা নেই। (ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া- ১৭/৩৮৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১০১৫, শরহে আকায়েদ লি নাসাফী- ১৪৫, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/১৭৭)।
ঈদের নামায মসজিদে পড়া প্রসঙ্গ
(৯৫২৮) মুহাম্মদ আব্দুশ শহীদ, রামশ্রী, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ।
জিজ্ঞাসা: আমাদের গ্রামে ঈদের নামায মসজিদে পড়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- ঈদের নামায মসজিদে পড়া জায়েয আছে কি না? উল্লেখ্য, উক্ত গ্রামের নির্দিষ্ট কোনো ঈদগাহ নেই।
সমাধান: ঈদের নামায ঈদগাহে পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা ঈদের নামায ঈদগাহে পড়তেন। তবে বৃষ্টির কারণে একবার মসজিদে পড়েছেন। সুতরাং শরয়ী ওজরবশত ঈদের নামায মসজিদে পড়া জায়েয আছে। আর আপনাদের গ্রামে নির্দিষ্ট কোনো ঈদগাহ না থাকা শরয়ী ওজরের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ঈদের নামায মসজিদে পড়া জায়েয হবে। কিন্তু ঈদের নামায যেহেতু ঈদগাহে পড়া সুন্নাত, তাই গ্রামবাসী সকলের দায়িত্ব হলো, পরামর্শ সাপেক্ষে একটি ঈদগাহ নির্ধারণের চেষ্টা করা। (দুররে মুখতার- ৩/৫৫, উমদাতুল কারী- ৫/১৭১, ২/৩৩৭, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/২১১, ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া- ৬/১৬৫)।
নামাযে কিরাত আস্তে ও জোরে পড়া প্রসঙ্গ
(৯৫২৯) মুহাম্মদ পেয়ারুল ইসলাম খোকন, ফটিকা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
জিজ্ঞাসা: পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের তিন ওয়াক্ত; অর্থাৎ- ফজর, মাগরিব ও ইশা’র কিরাত উচ্চঃস্বরে পড়া হয়। আর যোহর ও আসরের কিরাত নিম্নস্বরে পড়া হয়। এর কারণ কী? তাছাড়া মানুষের অন্তর থেকে হিংসা, অহংকার ইত্যাদি দোষগুলো দূর করার উপায় কী?
সমাধান: ইমামের জন্য মাগরিব, ইশা ও ফজর-এর কিরাত উচ্চস্বরে এবং যোহর ও আসরের কিরাত নিম্নস্বরে পড়া ওয়াজিব। কারণসমূহ নিম্নরূপ- ১. হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোল্লিখিত নিয়মে সর্বদা নামায আদায় করেছেন। এর বিপরীত আমল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নেই; বরং আমলের এই পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ‘তাওয়াতুর’ এর সাথে বর্ণিত।
২. হযরত জিবরাঈল (আ.) যখন উম্মতকে নামায শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে দুই দিন ইমামতি করেছিলেন। তখন তিনি মাগরিব, ইশা ও ফজর-এর কিরাত উচ্চস্বরে এবং যোহর ও আসরের কিরাত নিম্নস্বরে পড়েছিলেন।
৩. ইসলামের শুরুলগ্নে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দিনের নামাযে কিরাত উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করতেন, তখন মুশরিকরা উক্ত কিরাত শোনার দরুণ মুসলিমদের গালি-গালাজ করতো ও কষ্ট দিতো। যদ্দরুন আল্লাহ তাআলা (সূরা বনী ইসরাঈল- ১১০ নং আয়াতে) দিনের নামাযে কিরাত নিম্নস্বরে এবং রাতের নামাযে কিরাত উচ্চস্বরে পড়ার বিধান জারি করলেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
৪. ফুকাহায়ে কেরাম চতুর্থতম কারণ উল্লেখ্য করেছেন যে, দিনের বেলা মানুষের হট্টগোল; শোরগোল ও চেঁচামেচির পরিবেশ থাকে এবং মানুষের অন্তরে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির ফিকির থাকে। যদ্দরুন গভীর মনোযোগ সহকারে আয়াতে কারিমার চিন্তা-ফিকির করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
(খ) আমাদের মানবদেহের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রতঙ্গ অসুস্থ হলে যেমনভাবে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। ঠিক তেমনিভাবে আত্মিক অসুস্থ হলেও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আত্মিক রোগ যেমন- অহংকার, হিংসা, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি। আত্মিক চিকিৎসার জন্য আমাদেরকে বিজ্ঞ, বুযুর্গ, হক্কানী ওলামায়ে কেরামের দীর্ঘ সংস্পর্শে থেকে সংশোধন করতে হবে এবং তিনি যেভাবে আমলের পরামর্শ দিবেন ঠিক সেভাবেই আমল করতে হবে। (সূরা তাওবা- ১১৯, আবু দাউদ- ৭২৪, বাদায়েউস সানায়ে- ১/৩৯৫, দারে কুতনী- ১/২৬৮, বাহরুর রায়েক- ১/৫৮৫-৬)।
নামায প্রসঙ্গ
(৯৫৩০) শাহ মুহাম্মদ জসিম উদ্দীন, চাপড়ী, তজুমদ্দীন, ভোলা।
জিজ্ঞাসা: আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব যোহরের চার রাকাত নামায পড়ার সময় নিয়ম অনুসারে পথম দুই রাকাত পড়ার পর বৈঠক শেষ করে উঠে তৃতীয় রাকাত শেষ করার পর পেছন থেকে জনৈক মুক্তাদি ভুলবশত তাকবীর দেন। তাকবীর শোনে ইমাম সাহেব মনে করেন এটা তার দ্বিতীয় রাকাত। দ্বিতীয় রাকাত মনে করে বৈঠক শেষ করে আর দুই রাকাত নামায যোগ করে শেষ বৈঠকে সিজদায়ে সাহু সহকারে নামায শেষ করেন। যাতে নামায হয়েছে মোট পাঁচ রাকাত। এমতাবস্থায় নামায হয়েছে কি? কেউ বলেছেন, সিজদা সাহু করার কারণে নামায হয়েছে। আবার কেউ বলেছেন, নামায হয়নি। কোনটি সঠিক?
সমাধান: প্রশ্নোল্লিখিত বর্ণনা অনুযায়ী চতুর্থ রাকাতে ইমাম সাহেব শেষ বৈঠক না করার কারণে তার নামায এবং সমস্ত মুসল্লীর নামায ভঙ্গ হয়ে গেছে; সুতরাং উক্ত নামায পুনরায় আদায় করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে- ১১/৪১৩, হিদায়া শরহে বিদায়াতুল মুবতাদী- ১/১৪২, দুররে মুখতার হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীন- ২/৬৬৫-৬৬৪, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/১৮৯)।
নামাযে ভুল কিরাত তিলাওয়াত প্রসঙ্গ
(৯৫৩১) মুহাম্মদ রাজি নোমানী, পরিচালক মারকাজে উলূমুল কুরআন, পূর্ব কাজীপাড়া, ঢাকা।
জিজ্ঞাসা: জনৈক ইমাম সাহেব ইশার নামাযের কিরাতে “ইল্লাল্ আশকাল্লাযী” এর স্থলে “ইল্লাল্ আতকাল্লাযী” তিলাওয়াত করেন। উপরিউক্ত পরিবর্তনের কারণে নামায ফাসেদ হয়েছে কি?
সামাধান: প্রশ্নোল্লিখিত ইমাম সাহেব ইশার নামাযে ইল্লাল্ আশকাল্লাযীর জায়গায় ইল্লাল্ আতকাল্লাযী পড়ার কারণে নামায ফাসেদ হয়ে যাবে; সুতরাং উক্ত নামায পুনরায় পড়া আবশ্যক। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/৭৯, কানযুদদায়েক- ১/২৭৪, মুহিতে বুরহানী- ২/৬২)।
টয়লেটযুক্ত গোসলখানায় দুআ পড়া প্রসঙ্গ
(৯৫৩২) উম্মে শাবীব মুহাম্মদ, কায়রো, মিসর।
জিজ্ঞাসা: মুফতী সাহেবের নিকট আমার জানার বিষয় হলো, বর্তমান টয়লেটযুক্ত গোসলখানায় অযু করার সময় শুরুতে বিসমিল্লাহ ও অন্যান্য দুআ পড়ার বিধান কি? বিস্তারিত দলীলের আলোকে জানালে উপকৃত হবো।
সমাধান: বাথরুম যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, ময়লা ও দুর্গন্ধ না থাকে, পেশাব পায়খানা করার পর পর্যাপ্ত পানি ঢালার কারণে কমোডে নাপাক দেখা না যায় এবং দুর্গন্ধ না থাকে, তাহলে ঐ অবস্থায় বাথরুমে অযু করার স্থানে অযু করার সময় শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা ও অযুর আগে- পরে হাদিসে বর্ণিত দুআ সমূহ পড়া যাবে। অন্যথায় পড়া যাবে না; বরং মনে মনে পড়বে। (ফাতাওয়ায়ে কাযীখান- ১/১০২, হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীন- ৫/২০০ ও ১/৩৬৩, ফাতাওয়ায়ে আলমগীর- ৫/৩১৫, দারুল উলূম দেওবন্দ; জওয়াব নাম্বার- ১৬৮২০২, তুহফাতুল আলমাঈ- ১/২০২)।
তাকবীরে তাশরীক প্রসঙ্গ
(৯৫৩৩) সাইফুল্লাহ, ফতেপুর, সাতক্ষীরা।
জিজ্ঞাসা: তাকবীরে তাশরীক কতো বার বলা ওয়াজিব? একবার হলে, একবারের স্থলে তিনবার পড়লে সাওয়াব বেশি হবে- এই নিয়তে তিনবার পড়া যাবে কি?
সমাধান: জিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ ফজরের নামায থেকে ১৩ তারিখ আছর পর্যন্ত প্রতি ফরয নামাযের পর একবার তাকবীরে তাশরীক পড়া ওয়াজিব। তবে কেউ যদি যিকিরের নিয়তে একাধিক বার পড়েন, তাতে কোন অসুবিধা নেই। (দুররে মুখতার- ৭১, ফাতাওয়ায়ে শামী- ২/৭২, হাশিয়ায়ে তাহতাবী- ১/৫৩৯, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু- ২/৩৮২, তাবয়ীনুল হাকায়েক- ১/৫৪৫, ফাতাওয়ায়ে কাসিমিয়া- ৯/৫০০)।
সালাম প্রসঙ্গ
(৯৫৩৪) আইয়ুব খান (ঝালকাঠী), হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।
জিজ্ঞাসা: আমরা জানি, পরস্পর সাক্ষাতে সালাম দেয়া সুন্নাত। প্রশ্ন হচ্ছে, সালামের সুন্নাত পন্থা কী? আমাদের দেশে দেখা যায়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষে প্রবেশকালে শিক্ষার্থীরা তাঁদেরকে সালাম দিয়ে থাকে। এটা সুন্নাত পন্থা কি না। সুন্নাত তরীকা না হলে, এভাবে সালাম দেয়া বর্জনীয় কি না?
সমাধান: সালাম দেয়া নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত। আর তা পালন করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)কে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং সালাম দেয়ার বিভিন্ন নিয়ম কানুন বলেছেন। যার কতিপয় নিয়ম এখানে উল্লেখ করা হলো- ১. দাঁড়ানো ব্যক্তি উপবিষ্ট ব্যক্তিকে সালাম প্রদান করা, ২. চলমান ব্যক্তি অবস্থানরত ব্যক্তিকে সালাম প্রদান করা, ৩. আগন্তুক ব্যক্তি ঘরে থাকা ব্যক্তিকে সালাম প্রদান করা, ৪. কোন মজলিসে নতুন করে শরিক হওয়া ব্যক্তি মজলিসে আগ থেকে শরিক থাকা ব্যক্তিদেরকে সালাম প্রদান করা, ৫. ছোটরা বড়দেরকে সালাম প্রদান করা।
আরও পড়তে পারেন-
- কওমি মাদ্রাসা: সামাজিক পুঁজি ও দারিদ্র্য বিমোচন
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
- সুখময় দাম্পত্য জীবনের নববী রূপরেখা
তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিভিন্ন হাদিস শরীফে বর্ণনা পাওয়া যায় যে, “প্রথম সালাম প্রদানকারী অহংকার থেকে মুক্ত”। তাই উপর্যুক্ত সুন্নাতী নিয়মানুযায়ী প্রথমে সালাম দেয়ার চেষ্টা করবে। তথাপিও অপরপক্ষও অহংকার থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রথমে সালাম দেয়ার চেষ্টা ও অভ্যাস করা ভালো। (মিশকাতুল মাসাবীহ [বাবুস সালাম]- ৩৯৮,৩৯৯ ও ৪০০, সুনানে আবু দাউদ- ২/৭০২)।
জমি বন্ধক প্রসঙ্গ
(৯৫৩৫) মুহাম্মদ আব্দুল আলীম, বাগবাড়ি, ফুলছড়ি, গাইবান্ধা।
জিজ্ঞাসা: আমাদের এলাকার জমি বন্ধক নামে ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। তা হলো, একজনের জমি অন্যজনের নিকট টাকার বিনিময়ে বন্ধক রাখে। যেমন- ১ বিঘা অর্থাৎ- ২০ কাঠা/৩৩ শতাংশ জমি ৮০,০০০/- (আশি হাজার) টাকার বিনিময়ে বন্ধক রাখে। টাকাদাতা ৮০,০০০/- (আশি হাজার) টাকা জমির মালিককে বুঝিয়ে দেয়ার পর সেই এক বিঘা বন্ধকী জমিকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেন এবং জমি থেকে উৎপাদিত সকল প্রকার শস্য ও ফসলাদি ভোগ করতে থাকেন। যতক্ষন পর্যন্ত জমির মালিক সেই ৮০,০০০/- (আশি হাজার) টাকা ফেরত না দিবেন।
তাদের লেনদেনের মাঝে একটি শর্ত থাকে। তা হলো, টাকাওয়ালার টাকা থেকে প্রতিবছর ১০০ অথবা ২০০ টাকা করে জমিওয়ালার জন্য শোধ বা পরিশোধ হিসেবে কর্তন করা হবে। যেমন- জমিওয়ালা ৫ (পাঁচ) বছর পর যখন টাকা ফেরত দিবে তখন টাকাওয়ালাকে ৫০০ অথব ১০০০ টাকা কম ফেরত দিবে। এই নিয়মে জমি বন্ধক রাখা জায়েয আছে কি না- জানতে চাই। যদি জায়েয না থাকে, তাহলে জায়েয বা হালালের কোনো পন্থা আছে কি না, তা জানিয়ে উপকৃত করবেন।
সমাধান: প্রশ্নোল্লিখিত প্রচলিত নিয়মের বন্ধকী লেনদেন হারাম। কারণ, বন্ধক গ্রহিতার জন্য বন্ধকী বস্তু থেকে উপকৃত হওয়া নাজায়েয।
আপনার প্রশ্ন থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট সেটা হচ্ছে, তাদের এই লেনদেনের মধ্যে একজনের টাকার প্রয়োজন সে জমি দিয়ে টাকা নিতে চায়, আর অন্যজন টাকার বিনিময়ে জমি নিয়ে তা থেকে উপকৃত হতে চায়। তাই এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে উভয়জন ইজারা (ভাড়া) চুক্তি করবে। উদাহরণস্বরূপ কোন ব্যক্তির ১০০,০০০/= (এক লক্ষ) টাকার প্রয়োজন, তাহলে সে বছর প্রতি ৫০০০/-(পাঁচ হাজার টাকা) করে কর্তন করার শর্তে ১০ বছরের জন্য তার জমি ইজারার চুক্তি করবে এবং টাকা ওয়ালাও যদি এটা করতে রাজি থাকে। তাহলে জমির মালিকের টাকার প্রয়োজন পূরণ করতে এবং টাকার মালিক জমি থেকে উপকৃত হতে এ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারবে।
তবে টাকার অনেক বেশি প্রয়োজনের সময় যদি ইজারা বা অন্যান্য কোনো হালাল পদ্ধতিতে কারো থেকে টাকা নেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে ‘বাইয়ূন ওফা’ করার সুযোগ রয়েছে। আর এর নিয়ম হলো, যথা- কোন ব্যক্তির ১০০,০০০/- (এক লক্ষ) টাকার প্রয়োজন, তখন সে তার জমিটা কাউকে এই শর্তে বিক্রি করবে যে, যখন আমি ১০,০০০০/- ( ১লক্ষ) টাকা দিয়ে এই জমি আপনার কাছ থেকে ক্রয় করতে ইচ্ছে পোষণ করব, তখন আপনি আমার জমি আমাকে দিয়ে দিবেন। এই নিয়মে জমির মালিকের টাকার প্রয়োজন পূরণ করতে এবং টাকার মালিক জমি থেকে উপকৃত হতে কোন অসুবিধা থাকবে না। তাহলে প্রশ্নোল্লিখিত শরীয়ত পরিপন্থি পদ্ধতির প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রয়োজন হবে না, সাথে সাথে যার টাকার প্রয়োজন তার প্রয়োজনও পূরণ হয়ে যাবে। (তাবয়ীনুল হাকাকে- ৬/২৩৭, আশবাহ ওয়ান নাযায়ের- ১/২৩৫-২৩৬, রদ্দুল মুহতার- ১০/৮৩, হেদায়া- ৪/৫২২, বাহরুর রায়েক- ৬/১১, আলফিকহুল হানাফী- ৪/৩৭০, আল মাওসুআ- ৯/৪৮-৪৯)।
তালাক প্রসঙ্গ
(৯৫৩৬) আব্দুল্লাহ, নরসিংদী।
জিজ্ঞাসা: আমার বিয়ের সময় আমার স্ত্রীকে কাবিননামায় তালাকের অধিকার দিয়েছিলাম। এখন আমাদের সাংসারিক জীবনে আমার ও আমার স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য ও ঝগড়া হওয়ার পর আমার স্ত্রী আমাকে বলে যে, আমি আপনার জন্য হারাম। তখন আমি বলেছি যে, তুমি এটা কী বলছো? তখন আমার স্ত্রী বলল, ‘আমাকে দেয়ার জন্যই বলেছি, আমি আপনার ভাত খাইতাম না, আমাকে দিয়ে দেয়ার জন্যই বলেছি’। এখন আমার জানার বিষয় হচ্ছে- এ কথা বলার দ্বারা আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ঠিক আছে কি না?
সমাধান: ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি অধ্যয়নে জানা যায় যে, প্রশ্নোল্লিখিত বর্ণনা যদি সঠিক হয়, তাহলে আপনার স্ত্রীর এ কথা বলা যে, আমি আপনার জন্য হারাম এর দ্বারা আপনার স্ত্রীর এক তালাকে বায়েন পতিত হয়ে গেছে। তাই আপনারা সংসার করতে চাইলে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার করতে পারবেন। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/৪৫৭, ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া- ৪/৪৮২, বাদায়েউস সানায়ে- ৩/১৮৬, মাবসুত- ৬/২২২, দুররে মুখতার- ৯/৩৮৭, হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীন- ৯/৩৯৬ ও ৩৯৭)।
ঈসালে সাওয়াব প্রসঙ্গ
(৯৫৩৭) মুহাম্মদ ওসমান গনি, নলডাঙ্গা, গাইবান্ধা।
জিজ্ঞাসা: মৃত ব্যক্তির রূহের মাগফিরাত উপলক্ষে একত্রিত হয়ে কুরআন খতম করা বা কিছু সংখ্যক লোক একত্রিত হয়ে কারো পরিচালনায় কয়েকবার দরূদ শরীফ ও কুরআনের নির্দিষ্ট কয়েকটি সূরা নির্দিষ্ট সংখ্যায় কবরস্থানে, মসজিদে বা অন্য কোনো স্থানে পাঠ করে মৃতের জন্য একত্রে হাত উঠিয়ে দুআ করা সম্পর্কে শরীয়তের বিধান কী?
সমাধান: কবরবাসী মৃত ব্যক্তিদের জন্য কুরআন খতম বা নির্দিষ্ট কিছু সূরা, আয়াত, দুরূদ ও দুআ-কালেমা পড়ে ঈসালে সাওয়াব করা যায়। আর এটা যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় যেকোনো পদ্ধতিতে করা যায়। তার জন্য কোনো স্থান-কাল নির্দিষ্ট নেই। তবে কয়েকজন একত্রিত হয়ে এবং বিনিময় গ্রহণ করে ঈসালে সাওয়াব করা জায়েয নেই। আর ঈসালে সাওয়াব করার জন্য কবরস্থান বা মসজিদে অথবা অন্য কোনো স্থানে হাত তুলে দুআ করা জরুরি নয়।
হ্যাঁ, কেউ হাত তুলে দুআ করতে চাইলে তার জন্য এভাবে দুআ করার অনুমতি আছে। তবে কবরস্থানে হাত তুলে দুআ করতে চাইলে, কবরের দিকে পিঠ করে ও কেবলার দিকে মুখ করে হাত তুলে দুআ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে দুআ করার কারণ হলো, যাতে করে তাদের থেকে প্রার্থনা করার মতো খারাপ ধারণা সৃষ্টি না হয়। (মিশকাত- ১/১৪৯, সুনানে আবু দাউদ- ২/১০৩, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/১৬৬, হাশিয়ায়ে তাহতাভী- ২২০-২২১, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল- ৪/৪০৪-৫)।
নামাযে কিরাত অশুদ্ধ পড়া প্রসঙ্গ
(৯৫৩৮) হাফেজ মুহাম্মদ মাকছুদুর রহমান মিল্লাত, তালগাছিয়া মাদরাসা, কাঠালিয়া, ঝালকাঠি।
জিজ্ঞাসা: জনৈক ইমাম সাহেবের সূরা-কিরাত এতো অশুদ্ধ যে, সূরা ফাতিহার মধ্যে পর্যন্ত অনেক ভুল রয়েছে, যা পরিষ্কার ‘লাহনে জলী’ হয়ে যায়। উক্ত ইমাম সাহেবের পেছনে নামায হবে কি?
সমাধান: ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি অধ্যয়নে জানা যায় যে, প্রশ্নোক্ত অবস্থায় উক্ত ইমাম সাহেবের কিরাত যদি ইলমে কিরাতের বিজ্ঞ কোনো আলেমের মতামত অনুযায়ী বাস্তবিকভাবেই ‘লাহনে জলী’, তথা এমন ভুল হয় যার দ্বারা অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে তার পেছনে নামায বিশুদ্ধ হবে না। (ফাতাওয়ায়ে কাযিখান- ১/৯৭, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/৮০, মুহিতে বুরহানী- ১/৩২৯, ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া- ৫/১০৭)।
সম্মিলিত মুনাজাত প্রসঙ্গ
(৯৫৩৯) হাফেজ হাবিবুর রহমান, দারুচ্ছালাম হাফেজিয়া মাদরাসা, সাজনপুর, শরীয়তপুর।
জিজ্ঞাসা: সচরাচর তাবলীগ জামাআতের লোকেরা যখন দাওয়াতের কাজে বের হন, তখন সকলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করেন এবং যে মসজিদে দাওয়াতের নিয়্যাতে অবস্থান করেন ঐ মসজিদে ঢোকার পূর্বেও সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরূপ সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা শরীয়তসম্মত হবে কি? না হলে শরীয়তের পরিভাষায় তাকে কী বলা হবে?
সমাধান: প্রশ্নোল্লিখিত বিষয়টা হচ্ছে এমন, যেখানে শরীয়তের পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা বা না করার আমল কোনটি বর্ণিত নেই, বিধায় সেসব ক্ষেত্রে জরুরি মনে না করে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার সুযোগ রয়েছে। আর যদি জরুরি মনে করে করা হয়; সেক্ষেত্রে বিদআত হবে। (সহীহ বুখারী- ১/৩৭১, সহীহ মুসলিম- ১/২৭৪ ও ২৭৪, দারুল উলূম হাটহাজারী- ২/৩৬০)।
মাসবুক ব্যক্তির নামায প্রসঙ্গ
(৯৫৪০) মুহাম্মদ ইমাদ উদ্দিন মাহবুব, গোয়াইনঘাট, সিলেট।
জিজ্ঞাসা: যে ব্যক্তি জামাতে নামায পড়ার সময় শুধুমাত্র শেষ রাকাত ইমামের সাথে পেয়েছে। ইমাম সাহেব শেষ বৈঠকে বসার পর ইমামের তাশাহহুদের সাথে সে কি তাশাহহুদ পড়বে? যদি পড়ে তাহলে দুরুদ শরিফ দুআয়ে মাসুরাসহ কি পড়তে পারবে? জানিয়ে বাধিত করবেন?
সমাধান: যে ব্যক্তি জামাতে নামায পড়ার সময় শুধুমাত্র শেষ রাকাত ইমামের সাথে পেয়েছে, সে ব্যক্তি ইমাম সাহেব শেষ বৈঠকে বসার পর ইমামের সাথে তাশাহহুদ পড়া ওয়াজিব।
তবে তাশাহহুদকে এমন ধীরে ধীরে পড়বে, যেন ইমাম সালাম ফিরিয়ে নিতে পারে এবং দরুদ শরিফ ও দুআয়ে মাছুরা পড়বে না। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/১৪৯, বাহরুর রায়েক- ১/৫৭৫, ফাতাওয়ায়ে কাযিখান- ৬৬, রদ্দুল মুখতার- ২/৪২০০)।
ফ্রিল্যান্সিং প্রসঙ্গ
(৯৫৪১) নাম ও ঠিকানা বিহীন।
জিজ্ঞাসা: আমি ফ্রিল্যান্সিং মার্কেট প্লেসে ওয়েবসাইট তৈরি করে বা বিভিন্ন ডিজাইন করে টাকা বা ডলার উপার্জন করতে চাই। কিন্তু বিভিন্ন ডিজাইন (যেমন- টিশার্ট ডিজাইন, ব্যানার বা পোস্টার ডিজাইন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, লোগো ডিজাইন ইত্যাদি) করার সময় প্রাণীর ছবি দিতে হয়। আবার ওয়েবসাইট তৈরি করার সময় প্রাণীর ছবি, ভিডিও, অডিও দিতে হয়। এখন এগুলোর মাধ্যমে অনলাইনে ব্যবসা, চাকরি বা ফ্রিল্যান্সিং করে অর্থ উপার্জন করা জায়েয হবে কি না? দলীলসহ জানালে ভালো হতো।
সমাধান: বিভিন্ন এপ্লিকেশনের (যেমন- ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, ইনডিজাইন, পাওয়ার পয়েন্ট ইত্যাদি) সাহায্যে কোন ছবি, টেক্সট, বিভিন্ন নকশা ইত্যাদির বা হৃদয়পটে অঙ্কিত কল্পনাকে বাস্তবিক চিত্রে ফুটিয়ে তোলাকে গ্রাফিক্স ডিজাইন বলা হয়। মানুষের জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে এর ব্যবহার রয়েছে। যেমন- পণ্যের সাইনবোর্ড, ব্যানার, বিলবোর্ড, ভিজিটিং কার্ড, বিয়ের কার্ড, বিজনেস কার্ড ইত্যাদির নকশা তৈরি করতেও গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রয়োজন হয়। এভাবে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গ্রাফিক্স ডিজাইনের আশ্রয় নিতে হয়। এগুলো সবই বর্তমান সময়ে মানুষের অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়। তাই ইসলামী শরীয়তের কতিপয় মূলনীতি মেনে চলে গ্রাফিক্স ডিজাইন করতে এবং এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে অর্থ উপার্জন করতে কোন বাধা নেই। যে সকল শর্তসাপেক্ষে গ্রাফিক্স ডিজাইন করা বৈধ। (১) মানুষ, পশু, পাখি, জীব-জন্তু ইত্যাদির ছবি ডিজাইন করা যাবে না। কেননা, একাধিক হাদিসে এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে
অবশ্যই শরীয়তসম্মত জায়েয কাজে মানুষের ছবির প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা, তথা জায়েয। যেমন- পাসপোর্ট, আইডি কার্ড, জরুরি প্রমাণ বা ডকুমেন্ট ইত্যাদির প্রয়োজনে ছবি উঠানো।
(২) নারীর ছবি, অশ্লীল দৃশ্য ইত্যাদি ডিজাইন করা যাবে না। ইসলামে নারীর জন্য পর্দা করা ফরয, চাই তা বাস্তব জীবনে হোক অথবা ছবি ভিডিও ইত্যাদির ডিজিটাল ক্ষেত্রে হোক।
(৩) কোন কপিরাইটকৃত ছবি সংগ্রহ করে এডিটের মাধ্যমে তা পরিবর্তন করা যাবে না। কারণ, তা অন্যের অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
(৪) ছবি এডিটের মাধ্যমে শরীয়া বিরোধী কোনো কাজ করা যাবে না। এছাড়া গাছ-পালা, বাগান, ফল-ফুল, মসজিদ, ঘর-বাড়ি, জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি প্রাকৃতিক দৃশ্য ডিজাইন করতে কোনো বাধা নেই।
(৫) গ্রাফিক্স ডিজাইন করতে গিয়ে কোনো ধরনের অডিও ও ভিডিও’র ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, এটি হারাম ও নিষিদ্ধ। (সূরা বাকারা- ২৭৫, সহীহ বুখারী হাদিস নং- ৫৯৫০, উমদাতুল কারী- ১০/৩০৯, মিরকাতুল মাফাতীহ- ১৩/২৪৪, হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীন- ১/৬৪৮, ইবনে কাসীর- ৬/৩৩০)।
অবৈধ সন্তানের স্বীকৃতি প্রসঙ্গ
(৯৫৪২) মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, ঠিকানা বিহীন।
জিজ্ঞাসা: ছেলেমেয়ের মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের ফলে মেয়ের গর্ভে বাচ্চা এসে গেলো। এখন ওদের মধ্যে বিবাহ হলে, বাচ্চার হুকুম কী হবে? বাচ্চাটা কি জারজ না বৈধ বাচ্চা বলে গণ্য হবে?
সমাধান: ছেলে মেয়ের অবৈধ সম্পর্কের ফলে মেয়ের গর্ভে বাচ্চা এসে গেলে, যদি তাঁদের মধ্যে শরীয়ত সম্মতভাবে বিবাহ এবং পরবর্তী ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে। তাহলে ঐ বাচ্চা তাঁদের বৈধ সন্তান বলে গণ্য হবে এবং ছেলের (স্বামী) পক্ষ থেকে বাচ্চার বংশীয় স্বীকৃতি তথা নসব সাবেত হবে এবং বাচ্চা মিরাসের উত্তরাধিকারী হবে।
আর যদি বিবাহের পর ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার আগেই বাচ্চার জন্ম হয়, তাহলে সে বাচ্চা তাদের বৈধ সন্তান বলে গণ্য হবে না এবং ছেলের (স্বামীর) পক্ষ থেকে তাঁর নসবও সাবেত হবে না, মিরাসও পাবে না।
তবে এক্ষেত্রে ছেলে (স্বামী) যদি যিনার কথা উল্লেখ না করে সেই বাচ্চার বাবা হওয়ার দাবি করে, তখন তাঁর থেকে বাচ্চার নসব প্রমাণিত হবে এবং বাচ্চা মিরাসের উত্তরাধিকারী হবে।
উল্লেখ্য, বিবাহ বহির্ভুত গাইরে মাহরাম ছেলে-মেয়ে পরস্পর দেখা-সাক্ষাত ও কথাবার্তা বলা, সম্পূর্ণরূপে হারাম এবং শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া অনেক বড় কবিরাহ গুনাহ।
তাই এ ধরনের গুনাহ ও পাপের কাজ থেকে বিরত থাকা একান্ত আবশ্যক। সাথে সাথে এরকম পাপাচারে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তিদের অবশ্যই খাঁটি দিলে আল্লাহর দরবারে তাওবা ও ইস্তেগফার করে নেওয়া জরুরি। (সূরা বনী ইসরাঈল- ৩২, রদ্দুল মুহতার- ৩/৪৯, মুহিতে বুরহানী- ৩/২৫২, ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া- ৪/৩১৫, ফাতাওয়ায়ে কাযিখান- ৭/২২৪)।
বিড়ি-সিগারেট পান করা প্রসঙ্গ
(৯৫৪৩) মুহাম্মদ আব্দুর রহিম, মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট।
জিজ্ঞাসা: বিড়ি-সিগারেটের ধুমপান করা জায়েয আছে কি? মানুষকে কষ্ট দেয়া ছাড়া এবং নেশার ভাব না হলে পান করা যাবে কি?
সমাধান: বিড়ি-সিগারেট তথা ধূমপান করা মাকরূহে তাহরিমী। মানুষকে কষ্ট দেয়া ছাড়া এবং নেশার ভাব না আসলেও বিড়ি-সিগারেট তথা ধূমপান করা জায়েয নেই।
কারণ, এতে আর্থিক অপচয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত ব্যাপক ক্ষতিও রয়েছে; যা সকলেরই জানা। আর জেনেশুনে নিজের জান মালের ক্ষতি করা নাজায়েয ও গুনাহের কাজ। অধিকন্তু ধূমপায়ীর মুখের দুর্গন্ধের কারণে অন্যের কষ্ট হয়, যা পৃথক একটি গুনাহ। তাই বিড়ি-সিগারেট তথা ধূমপান থেকে বিরত থাকা একান্ত আবশ্যক। (সূরা নিসা- ২৯, সূরা বাকারা- ১৯৫, সূরা আরাফ- ৩১, সূরা ইসরা- ২৭, সুনানে ইবনে মাযাহ- ২৩৪১, দুররে মুখতার- ৬/৪৬০, রদ্দুল মুহতার- ৬/৪৯, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ৫/৩৯৪)।
পর্দা প্রসঙ্গ
(৯৫৪৪) মুহাম্মদ দিদার, চকরিয়া, কক্সবাজার।
জিজ্ঞাসা: আমার জানার বিষয় হলো, মহিলাদের কোন কোন অঙ্গ পর্দার অন্তর্ভুক্ত এবং বর্তমানে মহিলাদের মাধ্যমে কুরআন, হামদ-নাত কিংবা যে সকল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে, সে সকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না?
মহিলাদের জন্য যে সকল পরিক্ষা নিজ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দিতে হয়। সেই সব পরিক্ষার শরয়ী হুকুম কী?
অতএব, মহোদয়ের নিকট বিনীত আবেদন এই যে, উপরিউক্ত প্রশ্নগুলোর শরয়ী সমাধান দলীল সহকারে জানিয়ে বাধিত করবেন।
সমাধান: প্রথমত মাথা থেকে পা পর্যন্ত পূর্ণ শরীরকে এমনভাবে আবৃত করা, যাতে মহিলার শরীরের গঠন ও সৌন্দর্য কোনোটিই প্রকাশ না পায়, এটাকেই পর্দা বলে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর যুগে বড় বড় চাদর, ওড়না জাতীয় কাপড় পর্দার কাজে ব্যবহার করতো। পরবর্তীতে তা বোরকার আকারে প্রকাশ পায়।
দ্বিতীয়ত কুরআন হাদিসের আলোকে পর্দার বিভিন্ন স্তর পরিলক্ষিত হয়- (ক) মহিলা ঘরে পূর্ণ পর্দার সাথে থাকা, যাতে কেউ তার আকার-আকৃতিও দেখতে না পায়। আসল ও উপকৃত পর্দা এটাই, যা সকলের জন্য উত্তম পন্থা। (খ) অনিবার্য প্রযোজনে পরপুরুষের সামনে শরয়ী বোরকা নিয়ে হাত ও মুখমন্ডল সম্পূর্ণ আবৃত করে বের হওয়া, অতি প্রয়োজনে ঘর থেকে এভাবে বের হওয়া যেতে পারে। তবে শরয়ী সফরের দুরত্বে যাতায়াত করলে সাথে অবশ্যই স্বামী বা কোনো মাহরাম পুরুষ থাকতে হবে। (গ) যেসব ক্ষেত্রে ফেতনা ও কুদৃষ্টির কবলে পড়ার আশঙ্কা নেই, শুধু সেখানে পুরো বোরকাসহ হাত ও মুখমন্ডল খোলা রেখে প্রকাশ হওয়া, এটা পর্দার শেষ স্তর হলেও মুখমণ্ডল সাধারণত ফেতনার মূল কারণ হওয়ায় বিজ্ঞ ফুকাহায়ে কেরাম হাত ও মুখমন্ডল খোলা রেখে পরপুরুষের সামনে প্রকাশ হতে নিষেধ করেছেন।
উপরোল্লিখিত নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নোক্ত অবস্থায় দ্বীনের প্রয়োজনীয় ইলম ও জরুরি মাসাআলা-মাসায়েল শিখার জন্য যদিও প্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েরা পূর্ণ শরয়ী পর্দা করে সম্পূর্ণ ফিতনা। মুক্তভাবে নিজ এলাকায়, কাছের কোনো মাদরাসায় গিয়ে ইলম শিখার অনুমতি রয়েছে এবং বিশেষ প্রয়োজনে উক্ত প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পরীক্ষা দেয়ার অবকাশ আছে।
তবে শরয়ী সফরের দূরত্বে হলে সাথে অবশ্যই স্বামী বা কোনো মাহরাম পুরুষ থাকতে হবে। আর কম দূরত্বে হলেও কোনো মাহরাম পুরুষ থাকা উত্তম এবং মাহরাম ছাড়া রাত্রি যাপন করা যাবে না।
শরীয়ত যেখানে নারীদের অলংকারের আওয়াজকে গোপন রাখার জন্য জোরে পদচারণা করতে নিষেধ করেছে, সেখানে নারীদের জন্য কোমল ও আকর্ষণীয় কণ্ঠে সংগীত উপস্থাপনার উপর শরয়ী নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। যদিও নারীদের কণ্ঠ আওরাহ (এমন অঙ্গ যা গাইরে মাহরাম থেকে অবশ্যই গোপন রাখতে হবে)এর অর্ন্তভুক্ত নয়। তবুও কোনো মহিলার জন্য সুরেলা ও কোমল কণ্ঠে পর পুরুষদের সামনে কুরআন তিলাওয়াত, গজল বা ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করা কোনোভাবেই জায়েয হবে না। এটি নিঃসন্দেহে ফিতনার কারণ। আল্লাহ তাআলা নারীদেরকে প্রয়োজনে পুরুষদের সাথে কথা বলার সময় কোমল কণ্ঠ পরিহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন-
إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا
যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না। কু-বাসনা করবে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। আর তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। (সূরা আহযাব, ৩২ আয়াত)।
সুতরাং, মহিলাদের জন্য উন্মুক্তভাবে সুর করে কুরআন তিলাওয়াত, হামদ, নাত, গজল বা ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করা জায়েয নেই এবং এ ধরনের কোন অনুষ্ঠানে মুসলিম নর-নারীদের জন্য অংশগ্রহণ করাও জায়েয নেই। (তাফসীরে মাযহারী- ৩/৩৪৫, রুহুল মাআনী- ৯/৩৪০, আহকামুল কুরআন- ৩/৪১৬, মিশকাতুল মাসাবীহ- ৮/১০০০, ফাতহুল কাদীর- ১/৪৯৬, বাহরুর রায়েক- ১/২৮৫, মুহিতে বুরহানী- ৫/১৪৪, ইমদাদুল ফাতাওয়া- ৪/১৯৭, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া- ১৪/১১৬)।
ওয়ারিস প্রসঙ্গ
(৯৫৪৫) জনৈক ব্যক্তি, ঠিকানা বিহীন।
জিজ্ঞাসা: আমরা পাঁচ ভাই তিন বোন। আমার মা এখনো জীবিত, আমার পিতা মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ। আমার পিতা গ্রামের বাড়িতে ১০.৫০ শতাংশ জমির কিছু অংশে দুই লক্ষ টাকা দিয়ে তাঁর মেজ ছেলেকে বাড়ি করে দেন। আর বাবা নিজ টাকা দিয়ে মাকেও একবার ৩৩.০০ শতাংশ জমি ক্রয় করে দেন। এই জমি পিতার মৃত্যুর পর মা মেজ ছেলেকে রেজিস্ট্রি করে দেন। আর পিতা জীবিত অবস্থায় ছোট ভাইকেও আড়াই কাঠা জমি ক্রয় করে দেন দুই লক্ষ টাকা দিয়ে।
এখন আমার জানার বিষয় হলো, কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী এতে অন্যান্য সন্তানদের হক নষ্ট হয়েছে কি না? রোজ হাশরের দিন পিতা সন্তানদের হক নষ্টের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কি না? মা ও বড় ছেলের জন্য বর্তমানে কি কোন কিছু করণীয় আছে?
সমাধান: পিতা-মাতার জীবদ্দশায় তাদের সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ে কারো কোনো হক বা অধিকার থাকে না। শরীয়তের নীতিমালা অনুযায়ী মানুষ জীবদ্দশায় যাকে যে পরিমাণ ইচ্ছা দান করার অধিকার রাখে, তবে সন্তান সন্ততির মধ্যে জীবদ্দশায় সম্পদ বণ্টন করতে চাইলে সবাইকে সমান হারে বণ্টন করাই শরীয়তের নির্দেশ। বিহিত কোন কারণ ছাড়াই সন্তানদের মধ্যে তারতম্য করা গুনাহ।
সুতরাং প্রশ্নোক্ত মাসআলায় শুধু দুই ছেলেকে হেবা করার দ্বারা যদি বাকিদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা উদ্দেশ্য না হয়, তাহলে তাদেরকে দেয়াটা শরীয়ত পরিপন্থি হয়নি এবং আপনার পিতা এর দ্বারা গুনাহগারও হননি। সাথে সাথে যদি পিতা জীবদ্দশায় উক্ত সম্পত্তি তাদের ভোগ দখলে দিয়ে থাকে, তাহলে হেবা পরিপূর্ণ হওয়ার কারণে তারাই একমাত্র উক্ত সম্পদের মালিক হবে। বাকি অন্য কোনো ওয়ারিশদের জন্য উক্ত সম্পত্তির দাবি করা জায়েয হবে না। আর যদি শুধুমাত্র মৌখিকভাবে হেবা করে থাকে এবং তাদের ভোগ-দখলে না দিয়ে থাকে, তাহলে উক্ত সম্পত্তি পৈতৃক মিরাছ হিসেবে মিরাছের বিধি-বিধান মোতাবেক জীবিত ওয়ারিশদের মাঝে বণ্টন করতে হবে। আর যদি কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে তাদেরকে সম্পদ থেকে মাহরূম করে থাকে, এমতাবস্থায় আল্লাহ যদি মাফ না করেন তাহলে হাশরের ময়দানে জবাব দিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার- ৫/৬৯৬, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ৪/৪৩৭, ফাতাওয়ায়ে কাযিখান- ৪/২৯০, বাহরুর রায়েক- ৭/২৮৮, আহসানুল ফাতাওয়া- ২/২৫৬)।
মিরাছ প্রসঙ্গ
(৯৫৪৬) মুসাম্মৎ হালিমা খাতুন, চকফরদি, সদর, বগুড়া।
জিজ্ঞাসা: আমার তিন ছেলে এবং ছয় মেয়ে আছে। আমার স্বামী গত ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের পহেলা মার্চ ইন্তিকাল করেন। ইন্তিকালের প্রায় এক বৎসর পূর্ব থেকে তিনি লিভার সিরোসিসসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। ইন্তিকালের মাত্র তিন মাস পূর্বে তাঁর কয়েক কোটি টাকার প্রায় সমূদয় সম্পত্তি তাঁর তিন ছেলের জন্য হিবা করে যান। হিবাকৃত সম্পত্তির বিবরণ- ২৫ শতাংশ জায়গা এবং তার উপর নির্মিত চারটি দোকান ও চারটি টিনসেড বাড়ী এবং আট শতাংশ জায়গার উপর নির্মাণাধীন বহুতল ভবন। নির্মিত চারটি দোকান এবং দুটি টিনসেড বাড়ীর ভাড়া নির্মাণ করার পর থেকে আমার স্বামীর ইন্তিকাল পর্যন্ত আমি উঠাতাম। বাকি দুটি বাড়ীর মধ্যে একটি বাড়ী আমার বড় মেয়ের জন্য নির্মাণ করা হয়। যেখানে সে নির্মাণ করার পর থেকে আমার স্বামীর ইন্তিকালের কয়েক বছর পর পর্যন্ত অবস্থান করেছিল। বহুতল ভবনটি আমার স্বামীর ইন্তিকালের সময় নির্মাণাধীন ছিলো। কাজের তদারকি আমি ও আমার বড় ছেলে মিলে করতাম। যেহেতু আমি এবং আমার ছয় মেয়ে জানতাম যে, উক্ত জায়গা ও টিনসেড বাড়ী ও দোকান এবং নির্মাণাধীন বাড়ী আমার স্বামীর নামে আছে, তাই আমরা মনে করেছিলাম যে, আমার স্বামীর ইন্তিকালের পর উক্ত জায়গা ও বাড়ী আমি ও আমার ছেলে-মেয়ের মধ্যে বণ্টন হবে। বিধায় উক্ত নির্মাণাধীন বাড়ীর নির্মাণকল্পে আমার ব্যক্তিগত ১২ লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু স্বামীর ইন্তিকালের পর আমরা জানতে পারলাম যে, উক্ত সমূদয় সম্পত্তি তিনি তাঁর তিন ছেলের নামে হিবা দলিল করে গিয়েছেন।
অতএব, মুফতীয়ানে কিরামের নিকট জানতে চাই যে- (ক) উপরোল্লিখিত বর্ণনা মতে উক্ত সম্পত্তি হিবা দলিল দ্বারা দান করার মাধ্যমে কি আমার ছেলেদের কবজায় চলে গেছে, না যায়নি? যদি না গিয়ে থাকে, তাহলে উক্ত হিবা বৈধ না অবৈধ? যদি অবৈধ হয়ে থাকে, তাহলে কি উক্ত সম্পত্তির মালিক শুধু আমার ছেলেরা? নাকি আমি ও আমার ছেলে-মেয়ে সবাই?
(খ) উক্ত সম্পত্তি আমার স্বামী তাঁর তিন ছেলেকে এজমালিভাবে হারাহারি করে হিবা করে গেছেন (প্রমাণ হিসাবে দলিলের নকল প্রশ্নের সাথে দেয়া হলো)। এখন আমার প্রশ্ন হলো বণ্টনযোগ্য জায়গা ও বাড়ীর হিবা বৈধ হওয়ার জন্য তো ‘ইফরায’ তথা সাইড উল্লেখ করে পৃথককরণ শর্ত। আমার স্বামী তো পৃথককরণ না করে এজমালিভাবে তাঁর ছেলেদেরকে হিবা করেছেন। বিধায় উক্ত হিবার দ্বারা কি উক্ত সম্পত্তির মালিক আমার ছেলেরা হয়ে গেছে? নাকি হিবা পরিপূর্ণ না হওয়ার কারণে, আমরা সকলেই উক্ত সম্পত্তির মালিক আছি? কুরআন হাদিসের আলোকে উক্ত সমস্যার সমাধান দিয়ে কৃতজ্ঞ করবেন।
সমাধান: কোনো ব্যক্তি নিজ জীবদ্দশায় সন্তানদের মাঝে ধন-সম্পদ বণ্টন করলে তা হেবা বা দান হিসেবে গণ্য হয়। হেবা তথা দানপত্র মৌখিকভাবে হোক বা লিখিতভাবে হোক- তা পরিপূর্ণ ও কার্যকরী হওয়ার জন্য শরীয়তের দৃষ্টিতে হেবাকারীর জীবদ্দশায় সে সম্পদ পৃথক করে সম্পূর্ণভাবে হেবাগ্রহীতাদের ভোগদখলে দিয়ে দেওয়া ও তা গ্রহীতাদের বুঝে নেওয়া আবশ্যক এবং বণ্টনযোগ্য সম্পত্তি এক সাথে কয়েক জনকে হেবা করার ক্ষেত্রে প্রত্যেকের অংশ আলাদা ভাবে তাদের মালিকানায় দেয়া আবশ্যক। যাতে পরবর্তিতে নিজেদের অংশ নির্ধারণ করার মধ্যে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি না হয়। উপর্যুক্ত শর্তাবলী পাওয়া না গেলে হেবাপত্র বাতিল বলে গণ্য হয় এবং সমুদয় সম্পদ তাদের পৈতৃক সম্পদ হিসাবে বণ্টন করতে হয়, বিধায় প্রশ্নের বিবরণ মতে মাইয়্যেত যেহেতু প্রত্যেকের অংশ আলাদাভাবে হেবা না করে যৌথভাবে করেছেন এবং নিজ জীবদ্দশায় উক্ত সম্পদ সন্তানদের ভোগদখলে না দিয়ে, নিজ দখলে রেখেছেন। তাই শুধুমাত্র হেবা বা দানপত্রে উক্ত সম্পদ তার তিন ছেলের নামে এজমালিভাবে বণ্টন করে দেয়ার দ্বারা ওই হেবানামা ও বণ্টননামা সহিহ ও কার্যকর হবে না।
অতএব, উক্ত বণ্টননামা ও হেবা পূর্ণ না হওয়ায় মাইয়্যেতের সমূদয় সম্পত্তি পৈতৃক সম্পত্তি হিসাবে তার জীবিত সকল ওয়ারিসদের মাঝে মিরাছের বিধি বিধান মোতাবেক বণ্টন করতে হবে। (রদ্দুল মুহতার- ৫/৬৯২, ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া- ১৪/৪৩১, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ৪/৩৭৪, বাহরুর রায়েক- ৭/৪৮৬, হিদায়া- ৩/২৮৩, দুররে মুখতার- ৮/৫৬৯, ফাতাওয়ায়ে উসমানী- ৩/৪৪৫)।
তালাক প্রসঙ্গ
(৯৫৪৭) রিদওয়ান ইসলাম, ময়মনসিংহ।
জিজ্ঞাসা: আমার মা আমার মামাকে জায়গা কিনার জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলো। পরে আমার দুই মামা মিলে ৬ শতাংশ জমি কিনেছে। বড় মামা ছোট মামাকে বলতেছে, আমরা তো সামনে আবার জমি কিনবো; এখন তোমার ৩ শতাংশ বোনকে দিয়ে দাও।
পরে ছোট মামা কষ্ট পাওয়া সত্ত্বেও বোনকে নিজের ৩ শতাংশ দিয়ে দেয়। এরপর আবার দুই মামা মিলে ৬ শতাংশ জমি কিনেছে। পরে বড় মামা ছোট মামাকে বলতেছে; এই ৬ শতাংশের অর্ধেক বিক্রি করে আমরা বাকি অর্ধেকের উপর ফ্ল্যাট বানাই। এ কথা শোনে ছোট মামা বড় মামাকে বলছে; আমার অংশ আমাকে দিয়ে দাও। আমি ফ্ল্যাট বানাব যখন আমার সামর্থ্য হবে। এ নিয়ে তাদের মাঝে অনেক মনোমালিন্য ও ঝগড়াঝাটি হয়েছে। এমনকি বড় মামা ছোট মামাকে গালি-গালাজও করেছে। একপর্যায়ে বড় মামা ছোট মামাকে বলতেছে; তুই আমার ঘর থেকে বের হয়ে যা। পরে ছোট মামা বড় মামাকে বলছে- বের হইতেছি; বের হয়ে তো যাবোই। আর জীবনেও তোমার ঘরে আসবো না। এমনকি আমার পরিবারও আসবে না। যদি আমার বউ আসে; তাহলে তালাক। এ কথা বলে ছোট মামা ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। দেড় মাস পর ছোট মামা আস্তে আস্তে আবার বড় মামার বাড়িতে যাওয়া শুরু করে এবং ৯/১০ মাস পরে ছোট মামার বউও বড় মামার বাড়িতে যায়। এখন মুফতি সাহেবের কাছে আমার জানার বিষয় হলো, এ অবস্থায় আমার ছোট মামার বউ তালাক হবে কি না- জানিয়ে বাধিত করবেন।
সমাধান: শর্তযুক্ত করে স্ত্রীকে তালাক দিলে; শর্ত পাওয়া যাওয়ার সাথে সাথে স্ত্রীর উপর তালাক পতিত হয়ে যায়। সুতরাং ছোট মামা যেহেতু বড় মামাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, “আর জীবনেও তোমার ঘরে আসব না। এমনকি আমার পরিবারও আসবে না। যদি আমার বউ আসে; তাহলে তালাক”। এর ৯/১০ মাস পরে ছোট মামার স্ত্রীর বড় মামার ঘরে যাওয়ার দ্বারা তার উপর এক তালাকে রজয়ী পতিত হয়েছে। এখন পুনরায় ঘর-সংসার করতে চাইলে ইদ্দতের মধ্যে রজআত করে নেবে। আর রজআত মৌখিকভাবেও করা যায়। (তথা স্বামী স্ত্রীকে বলবে; ‘আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসাবে রেখে দিলাম।) বা স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণের মাধ্যমেও করা যায়। আর যদি ইদ্দত শেষ হয়ে যায়; তাহলে নতুনভাবে মোহর ধার্য করে বিবাহ করে নিবে। (সূরা বাকারা- ২৩১, হিদায়া- ২/৩৮৫, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া- ১/৪৮৮, রদ্দুল মুহতার- ৪/৪৩৯)।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/