।। ড. এ.কে.এম. মোতাহার হোসেন ।।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা এই বিশ্বে অগণিত মাখলুক সৃষ্টি করেছেন। মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষের খেদমতের জন্যই সমস্ত মাখলুকের সৃষ্টি। আর মানুষ হলো আল্লাহর জন্য। মানুষের দোজাহানের শান্তি, কামিয়াবী নির্ভর করে একমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখার উপর। এটাকেই বলা হয় তা’আল্লুক মা’আল্লাহ্। একটা আমের মুকুল যতক্ষণ পর্যন্ত গাছের সাথে সম্পর্ক রাখবে ততক্ষণ সেটা তাজা থাকবে, দিনে দিনে পরিপক্ক হবে, পাকবে, মানুষের কাছে মূল্যবান হবে, চড়া দামে বিক্রি হবে। যদি সেটা বোঁটা থেকে ঝরে পড়ে, গাছের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে যায়, তাহলে তার আর দাম থাকে না, সেটা তখন মানুষের পদদলিত হয়। তেমনি তা’আল্লুক মা’আল্লাহ মানুষকে দুনিয়াতেও সম্মানী করে, জীবনকে শান্তিময় করে, আখিরাতেও চিরস্থায়ী শান্তি, সম্মান ও সফলতা দান করে। তা’আল্লুক মা’আল্লাহ হাসিল হয়ে গেলে মানুষ আল্লাহর কাছে যা চায়, তাই পায়। কারণ, সে তখন আল্লাহ পাকের আপনজন হয়ে যায়, আর আল্লাহ পাক সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।
তা’আল্লুক মা’আল্লাহ হাসিলের সহজ উপায় কী? এই নিয়ামত হাসিলের সহজ ও একমাত্র উপায় হলো রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঠিক অনুসরণ। আল্লাহ পাক বলেন, আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহকে মাফ করে দিবেন, আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। ইত্তেবায়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে হাসিল হবে? সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) যে পদ্ধতিতে হাসিল করেছেন আমাদেরকে একই পদ্ধতিতে তা হাসিল করতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) প্রথমে ঈমানের মেহনত তথা দাওয়াতের মেহনত করে ঈমান শিখেছেন। ঈমানই তাঁদেরকে আল্লাহ পাকের সমস্ত হুকুম মানতে ও রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করতে বাধ্য করেছে। এ পথ ছাড়া আমরা যদি ভিন্ন পথ অবলম্বন করি, কখনো তা’আল্লুক মা’আল্লাহ হাসিল হবে না।
আল্লাহ তাআলার সাথে কোন মানুষের মুহাব্বতের সম্পর্ক হয়ে গেলে সে আসবাব (দুনিয়াবী জিনিসের সাহায্য) ছাড়া শুধু নামায দ্বারা সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারবে। বৃষ্টি নেই, নামায দ্বারা বৃষ্টি নামাতে পারবে। খানা নেই, নামায দ্বারা খানার ব্যবস্থা করতে পারবে। বাচ্চা অসুস্থ, নামায দ্বারা রোগ দূর করতে পারবে। যে আল্লাহর হয়ে যায়, আল্লাহ তাআলাও তার হয়ে যান, আর আল্লাহ পাক সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। তিনি কুন ফাইয়াকুন দ্বারা আসবাব ছাড়াও যা ইচ্ছা করতে পারেন।
হযরত আনাস (রাযি.)এর বাগানে পানি নেই, বৃষ্টির অভাবে গাছগুলো লাল হয়ে গেছে। তিনি বাগানে গিয়ে জায়নামায বিছালেন ও নামায পড়তে লাগলেন। প্রথম দু’রাকাত পড়লেন। আকাশে মেঘ আসল। আবার পড়লেন, বৃষ্টি শুরু হলো। পরে দেখা গেল শুধু তাঁর বাগানেই বৃষ্টি হলো। হযরত ইলিয়াস (রহ.)এর সময় দিল্লীর নিযামুদ্দিন মার্কাজের সামনে একটা কূপ ছিল, যার পানি বড়ই লোনা ও পানের অনুপযুক্ত ছিল। তিনি মিয়াজী আবদুর রহমান সাহেবকে খুব স্নেহ করতেন। হঠাৎ একদিন তাঁর উপর হযরত খুব রেগে গেলেন ও বললেন, এ কূপের পানি লোনা কেন? মিয়াজী বললেন, আমি কী করব? হযরত বললেন, তোমাকে এ কূপের পানি সংশোধন করতে হবে। মিয়াজী কূপের ধারে জায়নামায বিছালেন ও নামায পড়তে লাগলেন। দু’রাকাত পড়েন ও এক পেয়ালা পানি তুলে দেখেন পানি লবণমুক্ত হয়েছে কি না। এভাবে নামায পড়তে পড়তে তিনি লোনা পানিকে মিষ্ট করে ছাড়লেন।
হযরত আবদুল্লাহ বিন মোবারক (রহ.) অনেক বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি হযরত ইমাম বুখারী (রহ.)এর উস্তায ছিলেন। তাঁর সময় অনাবৃষ্টি দেখা দিল। অনেক দিন বৃষ্টি নেই। পর পর তিন দিন বৃষ্টির নামায পড়লেন হাজার হাজার মানুষ নিয়ে। কিন্তু বৃষ্টি আসছে না। তিনি খুব চিন্তান্বিত অবস্থায় মিম্বরে বসে আছেন। এমন সময় একজন কালো মাযূর লোক এসে গাছের আড়ালে দু’রাকাত নামায পড়ল ও বলল, হে আল্লাহ! তোমার সাথে তো আমার এমন কথা ছিল না, বৃষ্টি দাও, এখনি, এখনি, এখনি। সাথে সাথে ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল ও অল্প সময়ে হাঁটু পানি হয়ে গেল। হযরত আবদুল্লাহ (রহ.) বিষয়টা লক্ষ করলেন। কালো লোকটা দোয়া করেই পাশের একটা বাড়িতে ঢুকে গেলেন। হযরত আবদুল্লাহ (রহ.) ঐ বাড়ীতে গেলেন। বাড়িওয়ালা গোলাম বিক্রি করে। হযরত তাকে বললেন, আমি একটা গোলাম কিনব। বাড়িওয়ালা সমস্ত গোলাম হাজির করল। তিনি ঐ কালো মাজুর গোলামটা দেখলেন ও কিনে নিলেন। পথে যেতে যেতে গোলাম বললেন, হুযূর, আমি মাযূর মানুষ, আপনার কী খেদমত আমি করব? হযরত বললেন, আমার খেদমত আপনাকে করতে হবে না, আপনার খেদমত করার জন্যই আপনাকে খরিদ করেছি। গোলাম বুঝে গেল তার সাথে আল্লাহ পাকের সম্পর্কের ব্যাপারটা জাহির হয়ে গেছে। সে তখন দাঁড়িয়ে গেল ও দোয়া করল, হে আল্লাহ, তোমার সাথে তো আমার এমন কথা ছিল না, তুমি আমাকে উঠিয়ে নাও, এখনি, এখনি, এখনি। সাথে সাথে সে মৃত্যুবরণ করল।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- মাহে রমযান: সিয়াম সাধনা, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
এটাই হলো তাআল্লুক মাআল্লাহ। আল্লাহ পাকের সাথে যখন কারো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়ে যায়, তখন সে আল্লাহ্র কাছে যা চায় তাই পায়। যা থেকে পানাহ চায় আল্লাহ পাক তা থেকে পানাহ দেন। সর্বাবস্থায় আল্লাহ পাক তার সাথে হয়ে যান। এই সম্পর্ক কোন ব্যক্তি বা যামানার সাথে সম্পর্কিত নয়। যে কোন যুগের যে কোন মানুষ আল্লাহ্র প্রিয়পাত্র হতে পারেন। আমরা মনে করি, সাহাবায়ে কেরামের সময় তাঁরা নামায পড়ে সমস্যার সমাধান করেছেন; কিন্তু আমরা অনেক পরের উম্মত। আমাদের দ্বারা তা সম্ভব নয়। অনেক সময় আমরা কয়েক রাকাত নামাযও পড়ি সমস্যা সমাধানের জন্য। কিন্তু দু’চার রাকাত নামায পড়েই ক্ষান্ত হয়ে যাই। শয়তান এই বলে আমাদেরকে ধোঁকা দেয় যে, তোর দ্বারা হবে না, তুই গুনাহ্গার বান্দা, তোর সমস্যার সমাধানের জন্য মাখলুকের সাহায্য লাগবে। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আমরা নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া ছেড়ে দেই। এটা আমাদের বিরাট ভুল। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের ঘরে খানা নেই। এজন্যে তিনি তিনবারে ছয় রাকাত নামায পড়েছেন। তারপর খানার ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যদি ছয় রাকাত নামায পড়তে হয়, তাহলে আমাদের কয় রাকাত পড়তে হবে? কোন কোন আল্লাহ্র বান্দা পাঁচশত রাকাত নামায পড়েছেন হাজত পূরণের জন্য। হাদীস শরীফে আছে, “নামাযী শাহেনশাহের দরজায় করাঘাত করতে থাকে; যে ক্রমাগত করাঘাত করতে থাকে, তার জন্য দরজা খোলাটাই স্বাভাবিক।” সুতরাং আমরা নামায পড়ায় লেগে থাকলে আল্লাহ পাক অবশ্যই সমস্যার সমাধান করে দিবেন। তাঁর জন্য এটা কুন-ফাইয়াকুনের ব্যাপার।
আসল ব্যাপার হলো, “আল্লাহ পাক সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান; মাখলুকের সাহায্য ছাড়াই তিনি যে কোন কাজ করতে পারেন; কিন্তু মাখলুক কিছু করতে হলে আল্লাহ পাকের ইচ্ছার মুখাপেক্ষী” -এই পরম সত্য কথাটার উপর আমাদের বিশ^াস নেই। যদি বিশ^াস থাকত, তাহলে যত হাজার রাকাত নামায দরকার, আমরা তা পড়তাম।
তাই আল্লাহ পাকের ক্ষমতা ও ওয়াদার উপর আমাদের বিশ^াস পয়দা করতে হবে। তখন সবই সহজ হয়ে যাবে। যে কোন কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য দু’রাকাত নামাযই যথেষ্ট হয়ে যাবে। আখেরাতে মহা সমস্যাও আল্লাহ পাক তাঁর এরূপ প্রিয় বান্দাদের জন্য সমাধান করে দিবেন।
এ জন্য দরকার সঠিক দিক নির্দেশনা মোতাবেক মেহনত করা। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করতে হবে, যে পথে চলে সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) আল্লাহর সাথে সম্পর্ক কায়েম করেছেন। সর্বনিকৃষ্ট মানুষগুলি সর্বোৎকৃষ্ট হয়েছেন। তা হলো দাওয়াতের মেহনত। নবুওত প্রাপ্তির পর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগার বছর পর্যন্ত শুধু দাওয়াতের আমলই করেছেন। তারপর মিরাজ শরীফের মাধ্যমে নামায ফরয হলো। নামায দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম সব সমস্যার সমাধান করেছেন।
আমাদেরও একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নতুন কোন পথ অবলম্বন করলে আল্লাহকে পাওয়া যাবে না। আমরা যদি আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে সাহাবাদের মতো দাওয়াতের মেহনত করি, তাহলে আমাদের ঈমান মজবুত হবে। আমরা সত্যিকারের ঈমানওয়ালা ও একীনওয়ালা হয়ে যাব ও আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাঁর বন্ধু হিসেবে কবুল করে নিবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের বন্ধু। তিনি আরও বলেন- ঈমানদারদেরকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য। ঈমানের মেহনত করে ঈমান মজবুত করা ছাড়া কেউ আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক কায়েম করতে পারবে না। তাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো, জীবনের প্রথম সুযোগে চার মাসের জন্য তাবলীগে বের হয়ে যাওয়া ও খুব মুজাহাদা করা। আল্লাহর জন্য কষ্ট মুজাহাদা করলে আল্লাহ পাক হিদায়াতের পথসমূহ খুলে দিবেন এবং তাআল্লুক মাআল্লাহ হাসিল হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন- “এবং যারা আল্লাহ্র জন্য কষ্ট মুজাহাদা করবে, তিনি তাদের জন্য হিদায়াতের পথসমূহ খুলে দিবেন”। (সূরা আনকাবুত)।
আল্লাহ্র সাথে সম্পর্কের পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য আল্লাহওয়ালাদের সুহবত এখতিয়ার করাও জরুরী। যাঁরা গুনাহ থেকে পুরাপুরি বেঁচে থাকেন এবং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতসমূহ পুরোপুরি আমল করেন, তাঁরাই আল্লাহ্ওয়ালা। আল্লাহ পাকের নাফরমানি করে কখনো কেউই আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা হতে পারবে না। মানুষ যখন আল্লাহ পাকের পছন্দনীয় আমল করবে, তখন আল্লাহ পাকও মানুষের পছন্দনীয় অবস্থা সৃষ্টি করবেন।
তাই আমরা যদি দুনিয়া ও আখিরাতে সুখী হতে চাই, তাহলে বুদ্ধিমানের কাজ হলো, আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ করা, তাঁকে মেনে চলা। এই মানার যোগ্যতা অর্জনের জন্যই আমাদেরকে তাবলীগে দীর্ঘ সময় (চার মাস) লাগিয়ে প্রথমে ঈমান শিখতে হবে। ঈমানই আল্লাহর সমস্ত হুকুম মানতে বাধ্য করবে। ফলশ্রুতিতে আমরা আল্লাহ পাকের বন্ধু হয়ে যাব। তখন যা চাইব তাই পাব। দুনিয়াটা তখন বেহেশতের মতো হয়ে যাবে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তাঁর আপন হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, হেল্থ ইনফরমেশন টেকনোলজী বিভাগ, কিং আব্দুল আজীজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা, সৌদীআরব।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/