তাকওয়া: কামিয়াবীর চূড়ান্ত পাথেয়

।। আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী (দা.বা.) ।।

[গত ১ ডিসেম্বর জুমাবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র ‘জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী’র বার্ষিক মাহফিল ও দস্তারবন্দী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জামিয়ার মহাপরিচালক হযরত আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী (দা.বা.) ‘তাকওয়া: কামিয়াবীর চূড়ান্ত পাথেয়” শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানটির ঈষৎ সংক্ষিপ্ত সংকলন পাঠকসমীপে উপস্থাপন করা হল। – নির্বাহী সম্পাদক]

واتقو يوما ترجعون فيه الى الله ثم توفى كل نفس ما كسبت وهم لا يظلمون

অর্থাৎ- তোমরা সে দিনের ভয় করো, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। অতঃপর প্রত্যেক লোককে তার কৃত- কর্মের বিনিময় দেওয়া হবে এবং তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না।

হাদিসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা কুরআন আর ফরায়েযকে উত্তমভাবে শেখো। কেননা, আমি এই দুনিয়া থেকে চলে যাবো। রাসূলুল্লাহ ( সা.) যখন দুনিয়া থেকে চলে গেলেন, তখন উম্মতের জন্য ওহীর দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর ইন্তিকালের পর কোনো একদিন হযরত আবু বকর (রাযি.) এবং হযরত ওমর (রাযি.) হযরত উম্মে আইমান (রাযি.) (যিনি বয়স্কা একজন সাহাবিয়া ছিলেন)এর সাথে দেখা করতে গেলেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা.)এর ইন্তিকালের পূর্বে তাঁর সাথে দেখা করতেন। এই দুইজন সাহাবীকে দেখে, হযরত উম্মে আইমান (রাযি.) কাঁদতে লাগলেন। তখন হযরত আবু বকর (রাযি.) বললেন, রাসূল (সা.) দুনিয়াতে অনেক কষ্টের মধ্যে জীবন-যাপন করেছেন। এখন হুযূর (সা.)এর ওফাত হয়েছে, তিনি তো শান্তিতে আছেন। এখন কান্নার কী প্রয়োজন? তখন তিনি উত্তর দিলেন যে, যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) ছিলেন, তখন আল্লাহর রহমতের একটা সিলসিলা জারি ছিল, ওহী আসার ব্যবস্থা ছিল, এখন তো আর ওহী আসবে না। যদিও সবকিছু আমাদের সামনে আছে, কিন্তু যদি এখনো ওহী আসার ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে কোন একটা অঘটন ঘটলে সেটার সমাধান ছিল। এখন আমরা তা কোথায় পাবো! এ কথা শোনার পর তাঁরা সকলেই কাঁদতে শুরু করলেন।

অন্যএক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, এই তালিমী দ্বীনের জন্য আমি দুনিয়ার বুকে এসেছি। এই তালিম-তাআল্লুমের সিলসিলা তখন থেকেই আলেম-ওলামারা আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। তাঁরাই হলেন নবীগণের ওয়ারিশ, দ্বীনের ওয়ারিশ। এই সিলসিলার মধ্যে অনেক আকাবির দুনিয়াতে এসেছেন, দ্বীনের কাজ করতে করতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এভাবে ওলামায়ে কেরামের জামাআত পরম্পরা দাওয়াতি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এই পুরো সিলসিলার মধ্যে সমস্ত আকাবির ও আলেম-ওলামাদের মূল উদ্দেশ্য ও প্রচেষ্টা ছিল- মানুষকে গাফলতি থেকে ফিরিয়ে জান্নাতমুখী করা। মানুষের জীবন যেন শরীয়ত মোতাবেক চলে, আল্লাহ তাআলার হুকুম মতে চলে, এই তামান্না ছিল সকল আকাবিরগণের। ওলামায়ে কেরামের এই জামাআতের মধ্যে এমন কিছু আলেম ছিলেন, যারা এমন সুদূরপ্রসারি খেদমত করে গেছেন যে, তারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেও তাঁদের কাজের সুফল যুগ যুগ ধরে চলমান রয়েছে।

যেমন, এই উম্মুল মাদারিস দারুল উলূম হাটহাজারীর আকাবির যারা চলে গেছেন, তাঁরা দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও খেদমতে যে সমস্ত কাজ করে গেছেন, তা শত বছর ধরে উম্মাহর মাঝে আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। কবির ভাষায়- “আমি যদিও দুনিয়ার বুকে মৃত, কিন্তু আমার কর্ম আমাকে এমনভাবে স্মরণে রাখে, যেনো আমি জীবিত”।

আজকে আমাদের আকাবিরগণ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের আলোচনা সর্বদা আমাদের মাঝে বিরাজমান। যদিও দিলওয়ালারা এই পৃথিবীতে নেই, তবে দারুল উলূম হাটহাজারীর মতো এই নিশানাগুলো আমাদেরকে তাদের  অমরকীর্তি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তাই আমরা তাদের আলোচনা করি, তাদেরকে স্মরণ করি। কারণ, আমরা তাদের মাধ্যমে অত্র অঞ্চলে দ্বীন পেয়েছি, কুরআন পেয়েছি, তাদের দ্বারা আমরা ইলম পেয়েছি, তাদের কারণে আমরা জান্নাতমুখী হতে সচেষ্ট আছি। তাই আমরা সব সময় আকাবিরদের কথা আলোচনা করবো, স্মরণ করবো।

আজ প্রায় আড়াই হাজার ফারেগীন দস্তারে ফযীলত গ্রহণ করতে আসছেন। তাদের সবাইকে হয়তো ভালোভাবে চিনতেছি না। এত বড় মাদরাসা, এতো এতো ছাত্র। এতো এতো বিদায়ী ছাত্র তাদেরকে কীভাবে চেনা যায়! তবে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখবেন, তারা সকলেই হচ্ছেন ইসলামের দাঈ। এরা সবাই নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে ইসলামের কাজ করবে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওলামায়ে কেরামের সাথে আমার দেখা হয়। তখন তারা বলেন, “হুযূর! আমি ওই সময় ফারেগ হয়েছি। এখন আমি অমুক মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেছি। এটা শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও বিভিন্ন দেশে ইসলামের কাজ করে যাচ্ছেন দারুল উলূম হাটহাজারীর ফারেগীন। যেমন ভারতে হযরত মাওলানা আব্দুল হামিদ সাহেব ইসলামের কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি সবসময় হাটহাজারী, মেখলের কথা আলোচনা করতেন। আমারও ভারতের বিভিন্ন মাদরাসায় ইসলামের খেদমত করার তাওফিক হয়েছে। এটা হলো হাটহাজারী মাদরাসার বরকত।

আমার একটা কথা মনে পড়েছে,  আমি দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হওয়ার আগের বছর আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হয়ে গেছেন। সেই বছর ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন একটু সহজ হয়েছিল। মনে রাখবেন, দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হওয়া অনেক কষ্টের। তখন আমি চিন্তা করলাম, আমিও যদি তাদের সাথে যেতাম ভর্তি হয়ে যেতে পারতাম। কারণ, সে বছর ছাত্র বেশি নিয়েছিল। তো আমি ছিলাম দারুল উলূম খাদেমুল ইসলাম হাপুরে। দেওবন্দের সহকারি পরিচালক হযরত মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব (রহ.) কালেকশনের জন্য খাদেমুল ইসলামে আসলেন। আসার পর তিনি প্রথমে সকল আসাতেযায়ে কেরামকে একত্রিত করলেন।

আপনারা দেখবেন দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতি তাদের ভালোবাসা কেমন। উলামায়ে কেরাম বললেন, আমরা এই মাসে যত বেতন পাবো, তার অর্ধেক দারুল উলূম দেওবন্দের জন্য দান করে দেবো। তারপর একটি হলের মধ্যে সমস্ত ছাত্রদেরকে নসিহত পেশ করলেন। তিনি আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, আপনারাও সকলে দারুল উলূমের ছাত্র, কেমন করে ছাত্র? ছাত্র দুই প্রকারের হয়। যথা- ১, বেলা ওয়াসেতা, ২, বিল ওয়াসেতা। অর্থাৎ- সরাসরি ছাত্র অথবা মাধ্যম হয়ে ছাত্র। আপনাদের উস্তাদ যারা আছেন তারাতো দারুল উলূমেরই ছাত্র।  এ কথা শোনে আমাদের সকলের মনে খুশি বয়ে গেল।

দারুল উলূম দেওবন্দের অনেক ঘটনা আছে, তন্মধ্যে একটা ঘটনার কথা বলি। একবার মাদরাসার ফান্ড খালি হয়ে গেছে, পাঁচ-ছয় দিন পর উস্তাদদের বেতন দিতে হবে। তখন হযরত ক্বারী তৈয়ব সাহেব (রহ.) মুহতামিম ছিলেন। তিনি অনেক ভেবেচিন্তে হযরত মাদানী (রহ.)এর কাছে গেলেন। তাঁকে সব খুলে বললেন। তখন তিনি সমস্ত উস্তাদগণকে একত্রিত করার নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ মতো সবাইকে একত্র করলে, মাদানী (রহ.) সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দারুল উলূম দেওবন্দের খেদমত অনেক বড় সম্মানের। এ মাসে যদি আপনাদেরকে এক টাকাও না দেওয়া হয় আপনারা কি খেদমত ছেড়ে দিবেন? আপনারা কি দরস না দিয়ে চলে যাবেন? তখন সকল আসাতেযায়ে কেরাম একত্র হয়ে বললেন, এক মাস কেনো, পুরো বছরও যদি আমাদেরকে বেতন না দেওয়া হয়, আমরা তারপরও এই বরকতময় খেদমত ছেড়ে যাব না। এরপরও আমাদের খেদমতের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে না। কিন্তু মাসটি শেষ না হতেই এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো। কলকাতার একজন মুসলমান অনেক বড় সম্পদশালী ছিলেন। তাঁর একটা রোগ ছিল, আরোগ্যের জন্য তিনি অনেক টাকা বিভিন্ন জায়গায় ব্যয় করেছেন। হঠাৎ করে ঐ মানুষটির রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে স্বপ্নে সাক্ষাত লাভ হয়। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো কোটি কোটি টাকা খরচ করতেছি, তারপরও আমার রোগ নিরাময় হচ্ছে না। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, তুমি আমার দারুল উলূম দেওবন্দে সাহায্য করো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি লাখ লাখ টাকা মাদরাসায় দান করে দিলেন। তারপর তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন।

এখানে এই বিষয়টি আমার বলার উদ্দেশ্য হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.) এখানে বলেছেন, এটি আমার মাদরাসা, দেওবন্দে যারা পড়তেছে আর যারা বাহিরে পড়তেছে সবাই দেওবন্দের ছাত্র। আজকের সভায় হাটহাজারী মাদরাসার ফারেগীনদের দেখে একটি ঘটনা মনে পড়ল।

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাযি.)কে রাসূল (সা.) দ্বীনের তালিম দেওয়ার জন্য প্রেরণ করছেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত মুয়াযকে বললেন, হে মুয়ায! তুমি সামনের বছর আসবে, কিন্তু আমাকে পাবে না। আমি হয়তো কবরবাসী হয়ে যাবো। এ কথা শোনামাত্রই হযরত মুয়ায (রাযি.)কান্না করতে লাগলেন। তাঁর কান্না দেখে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চোখেও পানি চলে এলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের উম্মতকে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। আর সাহাবায়ে কেরামও রাসূলুল্লাহ (সা.)কে নিজের পরিবার পরিজন থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসতেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি তার দিকে তাকাননি; বরং তিনি একটু বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে আর জীবনেও সাক্ষাত হবে না, আর তিনি যাচ্ছেন শরীয়তের হুকুম আহকাম শিখানোর জন্য।

রাসূলুল্লাহ (সা.) কেন সম্পূর্ণভাবে তাঁর দিকে তাকাননি? কারণ, হযরত মুয়ায (রাযি.) যদি রাসূলের (সা.) চোখের পানি দেখেন, তাহলে তার অন্তর ফেটে যেতো। তখন শুধু বললেন, ‘তুমি যখন তাকওয়া অর্জন করবে, তুমি যেখানে থাকো না কেন তুমি আমার নিকটবর্তী, তুমি আমাকে পাবে’।  আমার তো যেতেই হবে, আমি তো চিরদিনের জন্য আসিনি। তোমার আমার সম্পর্ক এটাই।

সুতরাং আমিও আপনাদের উদ্দেশ্যে বলবো, এখান থেকে পাগড়ি নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ যেন এই পাগড়িটাকে অসম্মান না করেন। সব সময় যেন মাথায় ব্যবহার করেন। এভাবে নিজেদের জীবনের প্রতিটি স্তরকে সুন্নাতের আলোকে সাজিয়ে তুলতে সচেষ্ট থাকবেন। দ্বীনের প্রচার-প্রসারে আজীবন মশগুল থাকবেন। এই সংকল্পই হোক আজকের মজলিস থেকে।

একদিন হযরত মাদানী (রহ.) এক জায়গায় গেলেন, মনে রাখতে হবে মাদানী (রহ.)এর মাথায় সব সময় পাগড়ি থাকতো। তিনি দেখলেন মিহরাবে পাগড়ি রাখা আছে। তখন তিনি তাঁর মাথা থেকে ওই পাগড়িটা ওখানে রেখে নামায পড়িয়েছেন। এমন করার কারণ হলো, তিনি এখানে শিক্ষা দিয়েছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য নয়; বরং চব্বিশ ঘণ্টার জন্য আমলে থাকতে হবে।

আর দ্বিতীয় কথা হলো, ফরয নামাযের মধ্যে বাঁধা হলো আর সুন্নাতের মধ্যে বাঁধা হলো না। তখন কি বাঁধা সুন্নাত নয়? তাই আমার একটা নসিহত হলো, আপনারা সব সময় পাগড়ির ইহতিরাম করবেন। বিশেষ করে তাকওয়া অর্জন করবেন, যেমন হাদিসে এসেছে- “যার মধ্যে তাকওয়া আছে, সমস্ত দ্বীনি কাজের জন্যও তার মাঝে তাকওয়া থাকবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা তিন বিষয়ের কথা বলেছেন-  ১. নসিহত, ২. ঘটনা, ৩. মাসায়িল। মাসায়েল আবার দুই প্রকার- ১. আকিদার মাসায়েল, ২. আমলের মাসায়েল।

আকিদার মাসায়েলগুলো ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে কোনরূপ রদবদলের অবকাশ নেই। আকিদার মাসায়েলসমূহ স্পষ্ট, তাতে কোন অস্পষ্টতা নেই। যদি অস্পষ্ট থাকে সেটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কাজ দ্বারা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

তাই আমি বলছিলাম, নসিহতের যে আয়াতগুলো আছে, সমস্ত আয়াতের শেষ আয়াত নাযিল করেছেন আল্লাহ তাআলা। সেটি হলো, এ আয়াত যেটি আমি পাঠ করেছি। অর্থ- ‘তোমরা ঐদিনকে ভয় করো, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহ তাআলার কাছে হাযির হতে হবে’। মুফাসসিরগণ লিখেছেন, এই একটি আয়াত পড়তে গেলে নিজের পশমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। এই একটা আয়াতের মধ্যে সমস্ত মানুষের সমস্ত যিন্দেগির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, অর্থাৎ- প্রত্যেক মানুষকে বদলা দেওয়া হবে, তাদের উপর কোনরূপ যুলুম করা হবে না, ভালো কাজের ভাল ফলাফল আর খারাপ কাজের খারাপ ফলাফল যথাযথভাবেই তারা পাবে। তাই এ সম্পর্কে একটি রেওয়ায়াত পেশ করেছি, প্রত্যেক মানুষকে বদলা দেওয়া হবে যে, ভালো কাজ করলে ভালো আর মন্দ কাজ করলে মন্দ প্রতিফল দেওয়া হবে। আমরা জান্নাত জাহান্নাম দেখিনি। কিন্তু আদম (আ.) জান্নাত দেখেছেন। তিনি যখন জান্নাত থেকে বের হয়েছেন, তখন অনেক কান্নাকাটি করেছেন। তিনি এতো কান্নাকাটি কেন করেছেন? কারণ, তিনি জান্নাতের যিন্দেগি দেখেছেন, সেখানে আরাম পেয়েছেন, শান্তি পেয়েছেন। আর দুনিয়ার মধ্যে অশান্তি আর অশান্তি।

একটি রেওয়ায়েতে আছে, হুযূর (সা.)এর সামনে একটি জানাযা আসলো। তখন রাসূল (সা.) ইরশাদ করলেন, এই জানাযাটি মুস্তরি অথবা মুস্তরাহ মিনহু হবে, তখন সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন মুস্তরি মুস্তর মিনহু কী? তখন রাসূল (সা.) ইরশাদ করলেন, এই মানুষটা হলো মুমিন, তার জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। দুনিয়াবী যিন্দেগি হলো কষ্টের যিন্দেগি, দুনিয়ার কষ্ট থেকে এখন বিরত হয়ে সে জান্নাতে যাচ্ছে, আল্লাহর রহমতের দিকে যাচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন-

আর মুস্তারাহ মিনহু হলো, এই মানুষটা ছিল গুনাহগার, সে জন্য তার থেকে আল্লাহ তায়ালার বান্দাগণ পৃথক হয়ে গেছে। এমনকি গাছ, পশু-পাখিও তার থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। হুবারা নামক একটা পাখি আছে। তার অভ্যাস ছিল, সে একেবারে সকালে তার নিজের বাসা থেকে বের হয়ে দিনের অর্ধেক পর্যন্ত সে যেতেই থাকবে, অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর সে তার খাদ্য তালাশ করে। সে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে আবার নিজের বাসায় চলে আসে। এই পাখিটাও ঐ যালেমের এলাকায় খাবার পায় না। কারণ হলো, ঐ যালেমের কারণে সেখান থেকে আল্লাহ তাআলার রহমত পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল।

আরেকটি কথা হলো, রহমত যখন উঠে যাবে, কোন বৃষ্টি হবে না। আর যখন বৃষ্টি হবে না, গাছ-গাছালি থাকবে না। যখন গাছ গাছালি থাকবে না, তখন পশুপাখিও ওই এলাকায় থাকবে না। আর যখন পশুপাখি চলে যাবে, তখন মানুষ অশান্তি আর অশান্তির মধ্যে বসবাস করবে। তাই বলছিলাম, অনেক যালেম তো আমাদের মধ্যেও আছে, তারপরও রহমত উঠে যাচ্ছে না। তার কারণ হলো, এই সমস্ত দ্বীনি মাদরাসা। যেখানে সব সময় কুরআন তিলাওয়াত হয়, নামায পড়ানো হয়, তাসবিহ-তাহলীল হয়। আর সেখানে আলেম তৈরি হয়, তারা আল্লাহর ইবাদত করেন। সেই জন্য আমরা যালেমদের উপস্থিতি সত্ত্বেও আল্লাহর রহমত ও বরকত থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছি না।

প্রিয় বন্ধুরা, যদি এরকম সিলসিলা চলতে থাকে, তাহলে ওই যালেম আল্লাহর কাছে অবশ্যই শাস্তি পাবে। কারণ, দুনিয়া হলো দারুল আমল, আখেরাত হলো দারুল জাযা। এখন আমাদের দেখার বিষয় হলো, আমরা কেমন করে জীবন কাটাচ্ছি। আমরা কি যালেম হয়ে জীবন কাটাচ্ছি, নাকি ভালো হয়ে জীবন কাটাচ্ছি?

প্রিয় বন্ধুগণ, কবি বলতেছেন- ‘আমরা দুনিয়াতে এসেছি, দুনিয়ার লোভ লালসা নিয়ে আমরা এমনভাবে মগ্ন হয়ে গিয়েছি, আমরা পরকালের কোন চিন্তাই করছি না’। দুনিয়ার মধ্যে তো মানুষের জরুরত থাকবে, কিন্তু এটি আমাদের উদ্দেশ্য হতে পারবে না। আর যেসব ব্যক্তি দুনিয়াকে মূল্য দেয়নি, যাদের পরকালের মুহাব্বত থাকবে, তাদের কাছে দুনিয়ার কোন কিছুর মুহাব্বত থাকবে না।

মোটকথা, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হুকুম আহকাম মতে যারা দিন কাটাবে তারা হলেন আহলে দ্বীন। যখন আমাদের অন্তরের অবস্থা এরকম না হবে, তখন আমাদেরকে আসল দ্বীনওয়ালাদের কাছে যেতে হবে।

কবি বলেন, ‘আমি তো এরকম ছিলাম না, কিন্তু আল্লাহ তাআলার সাথে আমার সম্পর্ক হয়েছে, যার কারণে আমার অন্তরে একটি রওশন জ্বলেছে’।

জীবনের বাঁকে বাঁকে মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় নানা রকমের গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। এসব গুনাহের মূল কারণ হিসেবে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘দুনিয়ার মোহই সকল গুনাহের মূল’। সুতরাং দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে পরকালমুখী হতে পারলে সহজেই আল্লাহর নাফরমানি থেকে মুক্ত থাকা যায়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানি করে না, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা তাকে ভালোবাসেন।

আমরা আজ দুনিয়ার মোহ-মায়া তথা সম্পদ আয়ত্বের প্রতি এতোটা মশগুল হয়ে পড়েছি যে, আমরা মনে করছি দুনিয়ার যিন্দেগীটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, অর্থাৎ- ‘তোমাদেরকে যে সব বস্তু দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্তু ও তার শোভামাত্র। আর আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে, তা সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী, তবুও কি তোমরা বুঝবে না?’ কাজেই আমরা যেনো দুনিয়ার পেছনে পড়ে, আখেরাতকে যেন নষ্ট না করি।

দুনিয়াতে যতো নাজ ও নিয়ামত রয়েছে, তা আখেরাতের নিয়ামতের কাছে একটা পুরনো কাপড়ের নেকড়ার সমপর্যায়েরও নয়। দুনিয়ার সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী, আখেরাতের সকল কিছুই চিরস্থায়ী। অথচ এই দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা নিজেদের স্থায়ী জীবনকে নষ্ট করতেছি।

আমরা যা কিছু নিজেদের বলে দাবি করছি, অর্থাৎ- বাড়ি, ঘর, আসবাপত্র ও বেশভূষা, কিছুই আমাদের সাথে যাবে না। সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। আমাদের সাথে যাবে ইবাদত ও উত্তম আমালসমূহ। আমাদের দান-সদকাসমূহ যাবে। আপনারা দারুল উলূম হাটহাজারি মাদ্রাসার মতো দ্বীনি মাদরাসাসমূহে যে সাহায্য-সহযোগিতা ও দান-সদকা করছেন, এগুলোর সাওয়াব পরকালে যাবে।

প্রিয় বন্ধুগণ, আমি একটা ঘটনা বলে আমার আলোচনা শেষ করছি। মানুষ বলে আমার মাল আমার মাল। অথচ তার মাল হলো, যেটা খেয়ে নিয়েছে আর পরিধান করে নিয়েছে। আর যেটা আল্লাহর রাস্তায় দিয়েছে এটা হলো তার জমানো। এটিই চিরস্থায়ী জীবনে তার কাজে আসবে। এই যে মাদরাসা চলছে, এগুলোর মধ্যে, যারা সাহায্য করবে এগুলো সদকায়ে জারিয়া।

সদকা নিয়ে একটা বর্ণনা আছে, হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, “সদকা আল্লাহ তাআলার রাগকে পানি করে দেয়। আল্লাহর রাগ যখন শেষ হয়ে যাবে, রেযামন্দি যখন আসবে, তিনি যখন রাযি হবেন, তার জন্য আর কোন সমস্যা থাকবে না”।

বিশেষ করে আরেকটি কথা হলো, সদকা খারাপ মৃত্যু থেকে বাঁচাবে। মানুষের মৃত্যু হলো অনেক কঠিন সমস্যা, এই মৃত্যুর পরে জান্নাতে যাবে অথবা জাহান্নামে যাবে। যখন সে খারাপভাবে মৃত্যুবরণ করবে, তখন তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে থাকবে। এই জন্য সদকার ব্যাপারে আমরা মনে করি, আমার সম্পদ তো চলে গেল, কিন্তু সেটা কখনো নয়। আপনি যতো সদকা করবেন, আপনার সম্পদ ততো বৃদ্ধি পাবে।

আরেকটি ঘটনা বলছি, এক ব্যক্তি একজন অভাবি মানুষকে কিছু খাদ্য দিয়েছিল। একসময় ঐ অভাবি লোকটি বাদশার মন্ত্রী হয়ে যায়। মন্ত্রী হওয়ার পর যে ব্যক্তি খাদ্য দিয়েছিল, তার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেলো। অনেকদিন পর সে যখন শুনতে পেল আমি যাকে খাদ্য দিয়েছিলাম সে এখন মন্ত্রী হয়ে গেছে। তার মনে হলো, মন্ত্রীর কাছে একটি দরখাস্ত লিখি। সে লিখেছিল এমন কোন মানুষ আছে নাকি, যে মৃত্যু বিক্রি করবে, আমি যে কষ্টের মধ্যে আছি সেখান থেকে বেঁচে যাবো। সে জন্য যে ব্যক্তি আমাকে কিছু দান করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে উত্তম প্রতিদান দিবে। মন্ত্রী উক্ত চিঠি পড়ে দুটি ভরে তার জন্য অনেক কিছু দিলেন এবং কুরআনের একটি আয়াত লিখে পাঠিয়ে দিলেন-

مَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَهُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ کَمَثَلِ حَبَّۃٍ اَنۡۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ فِیۡ کُلِّ سُنۡۢبُلَۃٍ مِّائَۃُ حَبَّۃٍ ؕ وَ اللّٰهُ یُضٰعِفُ لِمَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ

যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।

দান-সদকা আল্লাহর গোস্বাকে ঠান্ডা করে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়, অপমৃত্যু থেকে হেফাজত করে, বিপদাপদ দূর করে এবং সকল কাজে বরকত আনয়ন করে। তাই বেশি বেশি দান সদকা করবেন। অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করবেন। দ্বীনি মাদ্রাসাসমূহে সাধ্যমতো সাহায্য করবেন। আপনাদের এসব সাহায্য-সহযোগিতায় বহুমুখী কল্যাণ ও বরকত অর্জিত হবে। আমরা যদি এইসব মাদরাসার মধ্যে দান করি তাহলে আমাদের অনেক সম্মান বৃদ্ধি হবে। দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার দ্বীনি কার্যক্রম পরিচালনা ও উন্নয়নে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করছেন, তাদের সকলের শোকরিয়া আদায় করছি এবং তাদের সকলের দুনিয়াবী বিপদাপদ দূর ও আখেরাতে উত্তম বিনিময়ে লাভের জন্য দোয়া করছি। আমিন।

শ্রুতি লিখনে- মুহাম্মদ শহিদ উল্লাহ

শিক্ষার্থী- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।