এক বছরের ব্যবধানে আবারও আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে আত্মসংযম আত্মশুদ্ধি ও ত্যাগ তিতিক্ষার আহ্বান নিয়ে দীর্ঘ অপার রহমতের মাস রমযানুল মুবারক। বছরের বার মাসের মধ্যে মাহে রমযান আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হবার এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। রহমত, মাগফিরাত এবং দোযখ থেকে পরিত্রাণ লাভের মাস মাহে রমযানুল মুবারক আজ আমাদের মাঝে সমাগত। এ মাসের সাথে বছরের অন্য কোন মাসের তুলনা চলে না। কারণ এ মাসেই নাযিল হয়েছে সর্বশেষ ও সর্বোৎকৃষ্ট আসমানী গ্রন্থ কুরআনুল কারীম।
এ মাসেই পাওয়া যায় এমন একটি রজনী, যার ইবাদত-বন্দেগী হাজার রাতের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। যে রজনী প্রাপ্তির জন্য পূর্ববর্তী নবীগণ পর্যন্ত আকাক্সক্ষা পোষণ করতেন। পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের বর্ণনানুযায়ী এ মাসের একটি ফরয ইবাদত অন্য মাসের সত্তরটি ফরয ইবাদতের সমতুল্য। আর একটি নফল ইবাদত একটি ফরয ইবাদত বলে আল্লাহ্র দরবারে বিবেচিত হবে। এই পবিত্র মাসের প্রথমাংশে আল্লাহ তাআলা মু’মিন রোযাদারগণের উপর রহমত বর্ষণ, মধ্যমাংশে তাঁদের গুনাহ মাফ এবং শেষাংশে দোযখ থেকে মুক্তি দান করেন। এ ছাড়াও আরো অসংখ্য ফযীলত ও অপার বরকত এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তে বিদ্যমান।
একজন মানুষের জীবনের সার্বিক সফলতা ও বিভিন্ন মানবিক গুণাবলী বিকাশের জন্য সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তিত্ব গঠনেও সংযমের গুরুত্ব অপরিসীম। যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যার মধ্যে সংযম অবলম্বনের শক্তি নেই, তার মধ্যে কোন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ববোধ সৃষ্টি হতে পারে না। ব্যক্তিত্বের যথার্থ বিকাশের জন্যে নিজের প্রবৃত্তি ও আবেগসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করা অপরিহার্য। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন মানুষের মধ্যে সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের গুণাবলী সৃষ্টি হয়। নিজের প্রবৃত্তির উপর বিবেক ও ইচ্ছাশক্তির প্রাধান্য স্থাপিত হয়। মানুষের যে কয়টি মূল চাহিদা রয়েছে, তন্মধ্যে পানাহার ও যৌন চাহিদা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সিয়াম সাধনা এসব চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষা দেয়। একটানা ত্রিশ দিনের সিয়াম সাধনা মানুষের মধ্যে প্রবল ইচ্ছাশক্তির সঞ্চার করে। তাকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে রোযার দিনে জৈবিক চাহিদা আর ইচ্ছাশক্তির লড়াইয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি তার ইচ্ছাশক্তিকে শাণিত ও শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়। প্রবৃত্তির লাগামহীন প্রবণতা সংযত হয়ে বিবেক ও ইচ্ছাশক্তির হাতে আত্মসমর্পণ করে। ফলে এক সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত জীবন গঠনে সক্ষম হয় একজন মানুষ। বস্তুতঃ সিয়াম সাধনা সংযত ও নিয়ন্ত্রিত জীবন গঠনের এক বলিষ্ঠ কর্মসূচী। এর যথার্থ অনুশীলন আমাদের জীবনে বয়ে আনে প্রভূত কল্যাণ, সৃষ্টি করে সংযম, আত্মশক্তি ও ইচ্ছাশক্তির বলিষ্ঠতা এবং বিবেকের প্রাধান্যতা আর শাণিত ব্যক্তিত্ব।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- মাহে রমযান: সিয়াম সাধনা, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
সিয়াম সাধনার মর্যাদা ও বিশেষত্বের পেছনে প্রচ্ছন্ন কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ রোযা আসলে একটি অদৃশ্য ও গোপন ইবাদত। তাই এই ইবাদতটি গোপনভাবে কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই নিবেদিত হয়ে থাকে। রোযার কোন দৃশ্যমান অবয়ব ও অস্তিত্ব নেই। যেমন- অন্যান্য ইবাদত নামায, যাকাত, হজ্ব ইত্যাদির বাহ্যিক ও দৃশ্যমান অবয়ব রয়েছে। তাছাড়া রোযা নিয়্যাতের সাথে সম্পৃক্ত। রোযাদার আল্লাহ্র রেযামন্দী ও খুশনুদী অর্জনের লক্ষ্যে রোযায় নিয়্যাত করে পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ কর্মকা- হতে বিরত থাকে। রোযাদারের এই মানসিক দৃঢ় চিত্ততা কেউ বাইরে থেকে দেখতে পায় না, অবলোকন করতে পারে না।
কেউ যদি প্রকৃত পক্ষে রোযাদার না হয়েও বলে বসে যে, আমি রোযাদার, তা বাইরে থেকে কেউ সঠিক ও বেঠিক বলে মন্তব্য করতে পারে না বা তাকে মিথ্যাবাদী রূপে সাব্যস্ত করতে পারে না। মানসিক এই নিয়্যাত ও উদ্দেশ্যকে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন, বুঝেন ও উপলব্ধি করতে পারেন। তাই তিনি রোযাকে একান্তভাবে নিজের বলে ঘোষণা করেছেন এবং এর প্রতিফল কত বড় হবে, তা নির্ধারণের বিষয়টি নিজের কাছে গোপন রেখেছেন। সিয়াম সাধনার প্রকৃত অবস্থা ও পরিম-ল অনুসারে আল্লাহ তাআলা এর বিনিময় প্রদান করবেন।
রমযানের শিক্ষা ধৈর্য ও সংযম। রমযানের একটি নাম হচ্ছে শাহরুল মুওয়াসাত তথা সহমর্মিতার মাস। একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, সমবেদনা ও সহমর্মিতা রমযানের মহান শিক্ষা। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে মুসলমানদের ওপর নানা দিক থেকে আক্রমণ আসছে, নানা ষড়যন্ত্রের শিকার। অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক হামলা, অপপ্রচার সব মিলিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষা নিতে হবে সংযমের উৎকর্ষ থেকে। যেকোনো উসকানি ও ষড়যন্ত্রে হুটহাট মাথা গরম করে ভুল সিদ্ধান্ত না নিয়ে সংযম ও তাকওয়া রক্ষা করে চলাই রমযানের শিক্ষা।
আমাদের দেশে সহমর্মিতার একটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও ক্রেতা-ভোক্তাসাধারণের হাতের নাগালে রাখা। খাদ্যে ভেজাল না মেশানো এবং ওজনে কমবেশি না করা। মনে রাখতে হবে, ইসলাম শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়, এর মূল বাণীই হচ্ছে মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি অকৃত্রিম গভীর আনুগত্য এবং মানবতার উৎকর্ষ। এ কারণে একজন প্রকৃত রোযাদার প্রচ- তৃষ্ণা সত্ত্বেও গোপনে পানি পান করে না। অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকলে এটি কখনো সম্ভব হতো না। রোযা রাখার মাধ্যমে মানুষের মনে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয়। তাঁর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে থাকার অনুভূতি তীব্র হয়। মানবতার তরে ত্যাগ ও সহমর্মিতার অনুশীলন হয়। এভাবেই অর্জিত হয় তাক্বওয়া, যা মু’মিন জীবনের মহামূল্যবান গুণ।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/