তাবলীগ জামাতের ব্যাপারে সৌদি আরবের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এবং আমাদের অবস্থান

।। আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ।।

সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামীনের। সহ¯্র দুরুদ ও সালাম তাঁর প্রিয় রাসূলের প্রতি, সকল সাহাবাদের প্রতি এবং যাঁরা কিয়ামত পর্যন্ত সাহাবাদের অনুসরণ করবে তাঁদের প্রতি।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেন- “হে রাসূল, আপনার উপর যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে সেগুলো আপনি পৌঁছে দিন। যদি না করেন তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তাকে পৌঁছে দিলেন না। আল্লাহ আপনাকে দুষ্ট লোকদের থেকে রক্ষা করবেন”। (সূরা মায়েদা- ৬৭)।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “আমার পক্ষ হতে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও”। (বুখারী, হাদীস নং- ৩৪৬১)।

নবীজি আরও ইরশাদ করেছেন- “উপস্থিত ব্যক্তির উচিত অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট পৌঁছে দেয়া”। (বুখারী-হাদীস নং- ৫৫৫০)।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এই অনুকরণীয় নির্দেশ এবং তাঁর প্রিয় রাসূলের প্রজ্ঞাপূর্ণ নির্দেশনা অনুসরণ করে যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহর দরদী ওলামায়ে কেরাম এবং দাঈগণ ইসলামের সুমহান বার্তাকে পৃথিবীর আনাচে কানাচে পৌঁছে দেয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। কখনো ব্যক্তি পর্যায়ে, কখনো দলবদ্ধভাবে। ইসলামের দাওয়াতকে মানবজাতির কর্ণকুহরে পৌঁছে দেয়ার জন্য তারা স্বীকার করেছিলেন সর্বোচ্চ ত্যাগ। তাবলীগে দ্বীনের ক্ষেত্রে তারা আত্মত্যাগের বিরলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সেই দ্বীন, যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে অন্ধকার গলি-ঘুপচি থেকে উদ্ধার করে আলো ঝলমলে মিনারে অধিষ্ঠিত করার জন্য প্রেরণ করেছেন। দ্বীনের ঝান্ডাকে কাঁধে নিয়ে, তাওহীদের মশালকে হাতে নিয়ে তাঁরা চষে ফিরেছিলেন দুনিয়ার আনাচেকানাচে। মানুষকে সীরাতে মুসতাকীমের পথ দেখিয়েছিলেন। আহ্বান করেছিলেন আত্মশুদ্ধির প্রতি। হিদায়াত এবং শাশ্বত কামিয়াবির প্রতি।

এ সকল ওলামা-দাঈদের গর্বিত উত্তরসূরী হচ্ছেন ওলামায়ে দেওবন্দ। যাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে। কেবল ভারত উপমহাদেশেই নয়; বরং সমগ্র এশিয়া মহাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইলমে নববীর আলো ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে, ইসলামি সংস্কৃতির প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে এবং এতদ অঞ্চলের মানুষের অন্তরে ইসলামের সহীহ আক্বীদা-বিশ্বাসের বীজ বপন করার ক্ষেত্রে তাঁরা যে অসামান্য অবদান রেখেছেন, তা আগামীর ইতিহাস গর্বভরে স্মরণ করবে। ভারতীয় উপমহাদেশের মাটিতে সর্বপ্রকার ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা ও পথভ্রষ্ট গুষ্ঠীর মোকাবেলায় এবং এই বিস্তৃত অঞ্চল থেকে শিরক-বিদআতের মূলোৎপাটন করার ক্ষেত্রে ওলামায়ে দেওবন্দের অবদান নিঃসন্দেহে সর্বাধিক এবং ব্যাপক।

এই বিষয়টি অনেকটা কৌতুহলোদ্দীপক বটে, তবে মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয়। কারণ, ওলামায়ে দেওবন্দ সেই সুমহান ‘বৃক্ষে’র ফল, যার বীজ বপন করেছিলেন ইমাম আহমাদ সেরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.)। তাঁরা সেই বাগানের কুসুমকলি, যেটাকে শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) এবং তাঁর পরিবার ও শাগরেদগণ নিজেদের বুকের তপ্ত খুন আর চোখের অশ্রু দ্বারা সিক্ত করেছিলেন। তাঁদের ভাবশিষ্য হযরত কাসেম নানুতবী, হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী এবং শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দীর মতো মহান মনীষীগণ যে বাগিচার মালী ছিলেন।

তাঁদের দ্বীনি খিদমত ছিল লক্ষণীয়ভাবে বৈচিত্র্যময়। তাঁদের মধ্যে কেউ ইলমের ময়দানে কাজ করেছিলেন। জ্ঞানী প্রজন্ম তৈরীর কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে শত শত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শত শত মসজিদ মাদরাসা। আবার কারও অবদান ছিল আত্মশুদ্ধি ও তাসাউফ-সুলূকের অঙ্গনে। আর কেউ বেছে নিয়েছিলেন দাওয়াত-ইসলাহের কঠিন পথ। এ পথে তাঁরা তাঁদের জীবনকে বিলীন করে দিয়েছিলেন। দ্বীনের দাওয়াতকে, তাওহীদের আহ্বানকে উম্মাহর দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাঁরা নিজেদের সহায়সম্পদ থেকে নিয়ে সম্ভাব্য সবকিছুই ব্যয় করেছিলেন।

শেষোল্লিখিত এই মহান দাঈদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ব্যক্তিটি ছিলেন আল্লামা শায়খ ইলিয়াস কান্দলবী (রহ.), যিনি দ্বীনের দাওয়াতের জন্য একটি বিপ্লবী ধারার গোড়াপত্তন করেছিলেন, যেটি পরবর্তীতে ‘তাবলীগ জামাত’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তাঁর প্রবর্তিতি এই ধারাটি বাস্তবিক অর্থেই ইসলামের দাওয়াতের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হয়।

আরও পড়তে পারেন-

আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
মুমিন জীবনে নামাযের গুরুত্ব
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি

উল্লেখ্য যে, এই ধারাটি যদিও শায়খ ইলিয়াস কান্দলভী (রহ.)এর চিন্তার ফসল; কিন্তু তিনি তড়িঘড়ি করে এর ঘোষণা দেননি। বরং এ বিষয়ে তিনি তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ আলেমদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। তাঁদের পরামর্শগুলো গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.), হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) এবং আল্লামা মুফতি কিফায়াতুল্লাহ (রহ.)সহ আরও বহু প্রথিতযশা মুহাক্কিক আলিম। পরবর্তীতে দাওয়াতের এই বিপ্লবী ধারার সাথে যুক্ত হন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা শায়খ যাকারিয়া কান্দলবী (রহ.), মুফতিয়ে আজম আল্লামা মুফতি ফয়জুল্লাহ (রহ.), পটিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা মুফতি আজীজুল হক (রহ.), আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.), মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.), জাস্টিস আল্লামা তকী ওসমানী, আল্লামা তাজুল ইসলাম ফখরে বাঙ্গাল (রহ.), ব্যারিস্টার ছানাউল্লাহ (রহ.), আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) এবং শায়খুল হাদীস আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)এর মতো বড় বড় ওলামায়ে কেরাম। এই বিপ্লবী দাওয়াতী ধারার আওয়াজ এবং আবেদন কেবল ভারত উপমহাদেশের সীমানায় আবদ্ধ থাকেনি; বরং অতি অল্প সময়ের মধ্যে হিন্দুস্তানের সীমানা পেরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, দূর দূরান্তে। আরব দুনিয়াতেও ব্যাপক সাড়া পড়ে। আরবগণ একে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আগ্রহভরে গ্রহণ করে। এই মেহনতে তারাও সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকে।

কিন্তু কিছু দিন পূর্বে আমরা হঠাৎ করেই এই মর্মে একটি অনাকাক্সিক্ষত এবং দুঃখজনক সংবাদ শুনতে পাই যে, সৌদি আরবের ধর্মমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাবলীগ জামাতকে পথভ্রষ্ট দল আখ্যা দিয়ে সে দেশের সকল খতীবের নিকট এই মর্মে নির্দেশনা জারি করা হয় যে, জুমার খুৎবায় যেন তাবলীগ জামাতের ভ্রষ্টতার বিষয়টি বিস্তারিত উল্লেখ করে মুসলিম উম্মাহকে এর কার্যকলাপের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। বিষয়টি আমাদের কাছে অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ছিল। বিশ্বাস করা কষ্টকর ছিলো। বাস্তবেও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশকে সেদেশের খতীবগণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তাঁরা তাবলীগ জামাতের ব্যাপারে কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বিভিন্ন অভিযোগে তারা এই জামাতকে অভিযুক্ত করেন। তাদের অনেকগুলো অভিযোগের মধ্যে দু’টি অভিযোগ ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং গুরুতর। প্রথমটি হচ্ছে, এই জামাতের কর্মকান্ডের মধ্যে অনেক বিদআতের মিশ্রণ রয়েছে। এরা কবরপূজার মতো গর্হিত কাজে লিপ্ত থাকে। এমনকি এর ভিত্তিমূলে পৌত্তলিক ধ্যানধারণার প্রভাব থাকাও বিচিত্র নয়। আর দ্বিতীয় অভিযোগটি হচ্ছে, এরা সন্ত্রাসের সহযোগী। তাদের ভাষায়, সন্ত্রাসের মহাতোরণগুলোর একটি।

এই দু’টি অভিযোগের ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। তাবলীগ জামাতের মতো দ্বীনের এমন মুখলিস একটি ধারার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা কেবল সত্যের অপলাপই নয়; বরং একই সাথে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সফল একটি ইসলামী দাওয়াতী ধারার উপর চরম আঘাত। এসব অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। যে মহান দাওয়াতী ইসলাহী ফিকরের ধারক এই জামাতটি, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের মাটিতে বিদআতের মূলোৎপাটনে সবচেয়ে কঠিন এবং সফল সংগ্রামে নিয়োজিত যে দলটি, তাদেরকেই শিরক বিদআতের প্রচলনকারী আখ্যা দেয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। উপরন্তু এই দলের সাথে রাজনীতির লেশমাত্র সম্পর্ক নেই। পৃথিবীর কোন দেশের রাজনৈতিক কর্মাকান্ডে এই দলের সামষ্টিক অংশগ্রহণ আছে, কিংবা কোন দেশের বিপ্লব সংগ্রামে এদের হাত আছে, কিংবা সরকার উৎখাতের মতো কোন অভ্যুত্থানে তারা কখনো জড়িত ছিল, কিংবা তারা সমাজের শৃঙ্খলা ও শান্তি বিনষ্ট করার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল, এমন কোন রেকর্ডই নেই। এ রকম সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক দাওয়াতী একটি জামাতকে সন্ত্রাসের সহযোগী আখ্যা দেয়া সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।

সৌদি সরকারের এমন আকস্মিক পদক্ষেপের পেছনে কী কার্যকারণ থাকতে পারে সেটা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। তবে নিঃসন্দেহে তাদের এ রকম একটি অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানকে ব্যথিত এবং হতাশ করেছে। আমাদের দাবি এই নয় যে, তাবলীগ জামাত ভুলের ঊর্ধ্বে। বরং এই জামাতের সাথে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষের ভুল থাকতে পারে এবং ভুল থাকাটা স্বাভাবিকও। তবে এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হচ্ছে তাদেরকে নসীহত করা। ইসলাহ করা। তাদের দিকে সত্য-অসত্য মিলিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করে তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কোন সমাধান নয়। এই পদ্ধতিতে কোনো ভাবেই কাঙ্খিত ফলাফল আশা করা যায় না।

আমরা সৌদি আরব সরকারের এহেন পদক্ষেপে খুবই মর্মাহত হয়েছি। বর্তমান সময়ে মুসলিম উম্মাহ অত্যন্ত নাযুক সময় পার করছে। প্রচন্ড ঝড়ের মধ্য দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে চলেছে। যুগের বহুমুখী চ্যালেঞ্জের ভারে নুইয়ে পড়েছে। এ রকম একটি সঙ্গীন মুহূর্তে এমন কোন পদক্ষেপ কাম্য নয় যা উম্মাহর ভগ্নপ্রাসাদের দেয়ালে কুঠারাঘাত করবে। এতে কেবল মুসলিম উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়; বরং পবিত্র হারামাইন শরীফাইনের খাদেম হিসেবে সৌদি আরবের সুনাম এবং মর্যাদার স্থানটিও মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আমরা তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্তকে পুনরায় বিবেচনা করে এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সৌদি সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। [১২ জুমাদাল ঊলা, ১৪৪৩ হিজরী]

লেখক: মুহতামিম, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।