।। সংকলনে- আবু আবদিল্লাহ ।।
একজন তালিবুল ইলমের জীবনকে বিশুদ্ধ চিন্তা ও চেতনায় গড়ে তোলা কিংবা শেকড়কে শক্তভাবে ধরে রাখা এবং আত্মপরিচয় বিস্মৃত না হওয়ার জন্যে আকাবির ও আসলাফের জীবনী অধ্যয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসলাফের জীবনী পাঠ এবং সেই অনুযায়ী নিজ জীবনকে পরিচালনা করে একজন তালিবুল ইলম অনায়াসেই সফলতার শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছাতে পারবে। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ তালিবুল ইলম চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে স্থূল হওয়ার অন্যতম কারণ, আকাবির-আসলাফের সীরাত/জীবনী পাঠ থেকে বিমুখতা।
শামের বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা Ñহাফিযাহুল্লাহ- বলেন, তালিবুল ইলমের উচিত আসলাফ এবং আকাবিরগণের ইলমী ও আমলি জীবনী গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করা। যাতে তার জীবনে সালাফের চরিত্র, অভ্যাস ও বিশুদ্ধ চিন্তা-চেতনা ভালোভাবে গেঁথে যায়। আল্লামা ইবনুল জাওযী রহ. তাঁর বিভিন্ন রচনায় এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেছেন। এক জায়গায় লিখেন,
পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের হিম্মত অনেক উঁচু ছিল। তাঁদের বিশাল বিশাল সমৃদ্ধ ও বিস্ময়কর রচনা সেটারই সাক্ষ দেয়। যেগুলো তাঁদের জীবনের সারাংশ ছিল। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশ রচনা এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। কেননা বর্তমান সময়ের তালিবুল ইলমদের হিম্মত দুর্বল হয়ে গেছে। এখনকার তালিবুল ইলম শুধু সংক্ষিপ্ত গ্রন্থই পছন্দ করে। (আসলাফের বড় বড় রচনার প্রতি তাদের আগ্রহ খুব একটা দেখা যায় না) অথচ ইলমের মধ্যে পূর্ণতা অর্জনের রাস্তা এটাই যে, আকাবির উলামাদের রচনা বেশি বেশি পাঠ করা হবে।
তাঁদের রচনা পাঠের মাধ্যমে তাঁদের ইলমের ব্যাপারে সঠিক ধারণা লাভ করা যাবে। তাঁদের উঁচু হিম্মত ও সাহসের ব্যাপারে অবগত হওয়া যাবে। এর মাধ্যমে তালিবুল ইলমের চিন্তা-চেতনা ও সাহস বৃদ্ধি পাবে। এবং তাঁদের প্রত্যেক রচনায় কোনো না কোনো মনি-মুক্তার সন্ধান থাকে।
কিন্তু বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মানুষের অবস্থা থেকে আমি আল্লাহর পনা চাই। তাদের মাঝে না এমন কোনো হিম্মত আছে, প্রাথমিক তালিবুল ইলম যার অনুসরণ করবে। তাদের জীবনেও তাকওয়ার রং নেই, যা দ্বারা একজন যাহেদ ব্যক্তি উপকৃত হবে। এমন লোক থেকে আল্লাহর পানাহ। তালিবুল ইলমদের জন্য সালফে সালেহীনগণের জীবনী এবং তাদের রচনাই অধ্যয়ন করা উচিত।
শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা বলেন, “এটা একজন বিজ্ঞ আলেমের লেখার নির্বাচিত অংশ। যিনি পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের জীবনী অধ্যয়নের উপর উৎসাহ দিচ্ছেন। কেননা তাঁদের জীবনী পড়া, তাদের সাথেই জীবন অতিবাহিত করার মতো। পনি যেরকম বৃক্ষের গোড়ায় প্রবাহিত হয়ে, বৃক্ষকে সজীব ও ফলদায়ক করে তুলে, তেমনি সালাফের জীবনী অধ্যয়ন তালিবুল ইলমের রুহে ছড়িয়ে পড়ে।” (মাআলিমু ইরশাদিয়্যাহ- ৪২১-২২)
আসলাফের জীবনী বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু গ্রন্থ
শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা বলেন, আমি আমার প্রিয় তালিবানে ইলমে নববীকে বিশেষভাবে দুটি কিতাব অধ্যয়নের কল্যাণমূলক পরামর্শ দিবো।
এক. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ। এই কিতাব ইমাম আবুল কাসেম আব্দুল কারীম বিন হাওয়াযেন আল-কুশাইরি রহ. (মৃত ৪৬৫ হিজরি) কর্তৃক রচিত। যার লেখকের ব্যাপারে আল্লামা সামআনী রহ. স্বীয় গ্রন্থ আল-আনসাবে লেখেন, তিনি বিশ্বখ্যাত সেইসব মনীষীদের অন্যতম, যারা ইলম এবং তাকওয়ার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
আল্লামা যাহাবী রহ. নিজেই আল্লামা সামআনী রহ. থেকে বর্ণনা করেন, ইলম আমল এবং শাস্ত্রীয় দক্ষতায় ইমাম কুশাইরী সমকালীন বিশ্বে এক অদ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি শরীয়াহ এবং তাসাউফ উভয় শাস্ত্রে বুৎপত্তি আর্জন করেছিলেন।
আল্লামা ইবনে আসাকির রহ. তাঁর সম্পর্কে বলেন, আল্লামা কুশাইরি রহ. যেসকল ইলমে পারদর্শী ছিলেন, তা মনুষ্য শক্তির বাইরে, বিস্ময়কর।
আল্লামা সুবকি রহ. তাবাকাত গ্রন্থে আল্লামা সামআনী থেকে বর্ণনা করেন, ইমাক কুশাইরি রহ. একবার হজ করতে গিয়েছিলেন। সে বছর বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় চারশো বিচারপতি এবং বিভিন্ন শাস্ত্রের দক্ষ দক্ষ আলেম উপস্থিত হয়েছিলেন। মসজিদে হারামে হাজিদের উদ্দেশ্যে ওয়াজ-নসীহত করার প্রয়োজন ছিল। সকলে মিলে ইমাম কুশাইরি রহ. এর নাম প্রস্তাব করলেন এবং তিনিই মসজিদে হারামে ওয়াজ-নসীহত করেছিলেন।
ইমাম কুশাইরির এই কিতাব এতটুকুতেই বুঝা যায়, যে বিগত দশ শতাব্দী পর্যন্ত এই কিতাবটি গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য ছিল। কিতাবটি এতই প্রসিদ্ধ যে, ইমাম কুশাইরির পরিচয় দেয়া লাগে এই কিতাবরে মাধ্যমে যে, তিনিই রিসালায়ে কুশাইরিয়ার লেখক।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- মাহে রমযান: সিয়াম সাধনা, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
এমন একটি উঁচু পর্যায়ের এবং সর্ব মহলে গ্রহণযোগ্য কিতাব তালিবুল ইলমদের অধ্যয়নে অবশ্যই থাকা উচিত।
দুই. সিয়ারু আলামিন নুবালা- এটা দ্বিতীয় নাম্বারের কিতাব, যা আমি অধ্যয়নের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। এই কিতাবের লেখক বিশ^বিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং ঐতিহাসিক ইমাম যাহাবী রহ.। এই কিতাব তালিবুল ইলমদের জন্য পথের আলোর ভূমিকা রাখে। এই কিতাবে ইলম, আমল, আত্মশুদ্ধি এবং সালাফে সালেহীনদের জীবন যাপন পদ্ধতি বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়। (মাআলিমু ইরশাদিয়্যাহ : ৪২২-৪২৩)
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়্যাহ পাকিস্তান এর সম্মানিত সদর (প্রধান), শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ মাদারিসে দ্বীনিয়্যার পরিচালক এবং শিক্ষকবৃন্দের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে বলেন,
“বর্তমান সময়ে আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার মূল উৎস হচ্ছে, আকাবিরে দেওবন্দের শিক্ষা ও তাঁদের উত্তম আদর্শ। যার মাধ্যমে তালিবুল ইলমদের অন্তরে আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব তৈরি হয়। সুতরাং মাদ্রাসায় এ বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত যে, আকাবিরে দেওবন্দের জীবনী অথবা তাঁদের বাণীসমূহ সবাই একত্র হয়ে কমপক্ষে দশ মিনিটের জন্য হলেও নির্দিষ্ট কোনো সময়ে (উদহারণ স্বরূপ, ফজর অথবা আসরের পর) তালীম করা উচিত। নি¤েœ এ বিষয়ক কিছু গ্রন্থের নাম দেওয়া হল, আপ-বীতী : শায়খুল হাদীস হযরত যাকারিয়া রহ., সাওয়ানেহে কাসেমী (হযরত কাসেম নানুতবীর জীবনী) : মাওলানা সাইয়েদ মানাযির আহসান গিলানী রহ., তাযকিরাতুর রাশীদ (ইমাম রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর জীবনী) : মাওলানা আশেকে ইলাহি মিরঠী রহ., হায়াতে শায়খুল হিন্দ : মাওলানা সাইয়েদ আসগর হুসাইন রহ., আশরাফুস সাওয়ানেহ (হযরত থানবী রহ. এর জীবনী) : খাজা আযীযুল হাসান মাজযুব রহ., তাযকিরাতুল খলীল (হযরত খলীল আহমদ সাহারানপুরীর জীবনী) : মাওলানা আশেকে ইলাহি মিরঠী রহ., নাকশে হায়াত : শায়খুল ইসলাম হযরত হোসাইন আহমদ মাদানী রহ., নাকশে দাওয়াম (ইমামুল আসর আল্লামা আনোওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. এর জীবনী), মাআরেফে মাদানী (শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রহ. এর ইলমি এবং আত্মশুদ্ধিমূলক জীবনী) : মাওলানা আব্দুশ শাকুর তিরমিযী রহ., তাজাল্লিয়াতে উসমানী (শায়খুল ইসলাম মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী রহ. এর ইলমি আলোচনা) : মাওলানা নুরুল হাসান শিরকুটি রহ., আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দের খুতুবাত যেমন খুতুবাতে হাকীমুল ইসলাম কারী তৈয়ব সাহেব রহ.।
এসব কিতাব দীর্ঘ ও বড় হওয়ার কারণে যদি পরিপূর্ণ পড়ে শোনানো সম্ভব না হয়, তাহলে কমপক্ষে এসবে আত্মশুদ্ধিমূলক যেসব আলোচনা আছে শিক্ষক তা বয়ান করবেন। তালিবুল ইলমদেরকে এসব গ্রন্থ অধ্যয়নের জন্য উৎসাহ দিবেন। এ উদ্দেশ্যে মাদারিস সমূহের গ্রন্থাগারে এসব কিতাবের অতিরিক্ত কপি সংগ্রহে থাকা উচিত।”
প্রাথমিক পর্যায়ের তালিবুল ইলমদের অধ্যয়নের জন্য মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর পা-জা সুরাগে যিন্দেগী, যার বাংলা অনুবাদ তালিবানে ইলমের জীবন পথের পাথেয় (মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ হাফিজাহুল্লাহ) এবং মাওলানা ইবনুল হাসান আব্বাসী রহ. এর মাতায়ে ওয়াক্ত আওর কারওয়ানে যিন্দেগী, যার বাংলা অনুবাদ সময়ের মূল্য ও জীবন সাধনা (মাওলানা লিয়াকত আলী) অনেক উপকারী হবে। এছাড়া মাধ্যমিক এবং উঁচু স্থরের তালিবুল ইলম এবং শিক্ষকদের জন্য আরবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা হাফিজাহুল্লাহর মাআলিমু ইরশাদ্যিায়াহ শিয়রে রাখার মতো একটি কিতাব। তালিবুল ইলম যদি এই কিতাবের ব্যক্তিগত অধ্যয়ন এবং সমষ্টিগত তালিম করে, তাহলে অনেক উপকার হবে ইনশাআল্লাহ।
মোটকথা, একজন তালিবুল ইলমের জীবনকে আদর্শিকভাবে গড়ে তোলার জন্যে আকাবিরদের জীবনী অধ্যয়ন করা এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যকীয় একটি বিষয়। আমাদের আসলাফগণ ইলম অর্জন করতে গিয়ে সময়কে কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন, প্রতিটি মুহূর্তকে তারা কীভাবে কাজে লাগিয়েছেন, মাশায়েখদের দরসে বসার জন্য তারা কী পরিমাণে কুরবানী করেছেন, মুরব্বীর সাহচর্যে তারা কীভাবে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন এবং তাদের আখলাক-চরিত্র, লেনদেন, সাধারণ মানুষের সাথে উঠাবসা এ সবকিছুই তালিবুল ইলমের সামনে ভেসে উঠবে তাদের জীবনী অধ্যয়নের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ভরপুর তাওফীক দান করুন। ইলমী খেদমতের জন্য কবুল করে নিন। আমীন।।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/