তুরস্কে ইসলামী পুনর্জাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শায়েখ মাহমূদ আফেন্দী (রহ.)এর ইন্তিকাল

।। মাওলানা শফিকুল ইসলাম আমিনী ।।

তুরস্কের কাসেম নানুতবী খ্যাত, আধুনিক তুরস্কে ইসলামের পুনর্জাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, মুসলিম বিশ্বের ৫০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের মধ্যে ৩৫ তম স্থানে অবস্থানকারী বিদগ্ধ আলিমে দ্বীন এবং প্রেসিডেন্ট  এরদোগানের আধ্যাত্বিক রাহবার শায়খ মাহমুদ আফেন্দি নকশবন্দী গত ২৩ জুন বৃহস্পতিবার  মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে  পরপারে পাড়ি জমান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

 ৯৩ বছর বয়সী এই মহান সাধক  একাধারে ছিলেন ধর্মপ্রচারক, শিক্ষক,আধ্যাত্মিক পীর, মুসলিম বিশ্বের সর্বজনবিদিত শ্রদ্ধেয় আলেমকুল শিরোমণিদের অন্যতম। সারা  জীবনব্যাপী ইসলাম ও দ্বীনের জন্য তার আত্মত্যাগ, সাধনা ও কুরবানী সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য বিশেষ করে ওলামায়ে কেরাম এবং তলাবাদের জীবনের পাথেয়  হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ। শায়েখ মাহমুদ আফেন্দি (রহ.) ১৯২৯ সালে তুরস্কের তারবুজুন শহরের মীজু গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক ধার্মিক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাহমুদ হাসাউসমানউগলু এবং আফেন্দি হাযরাতলেরি নামে পরিচিত ছিলেন। উনার বাবা ছিলেন স্থানীয় গ্রামের মসজিদের ইমাম এবং মা বেগম ফাতেমা খানম খুবই ধার্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছয় বছর বয়সেই বাবার কাছে পবিত্র কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন।

তারপর শায়খ তাসবিহী জাদাহ (রহ.)এর কাছে আরবি ও ফার্সি ভাষার জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তীতে যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে-দ্বীন শায়খ তুরসুন ফায়জী (রহ.)এর নিকট এলেম অর্জনে আত্মনিয়োগ করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে উনার কাছ থেকে ইলমের সনদ গ্রহণ করেন। প্রিয় শিষ্যের মেধা, প্রজ্ঞা, আত্মনিয়োগ ও খোদাভীরুতা দেখে নিজের মেয়েকে শায়খ মাহমুদের কাছে বিয়েতে আবদ্ধ করেন। উনার ধারণা মিথ্যে হয়নি। কাল পরিক্রমায় শায়খ মাহমুদ আফেন্দী হয়ে ওঠেন তুরস্কের তথা ইসলামী বিশ্বের অনন্য রত্ন। কর্মজীবনে ইস্তাম্বুলের ইসমাইল আগা  মসজিদের ইমাম ও শিক্ষক হিসেবে পথচলা শুরু করেন।

আরও পড়তে পারেন-

তখন থেকেই বিশিষ্ট বুযূর্গ শায়খ আলী হায়দার আফেন্দি (রহ.) সংস্পর্শে আসেন এবং আধ্যাত্মিক তারবিয়াতের  মাধ্যমে জীবনের আমূল পরিবর্তন সাধন হয় এবং হয়ে উঠেন নকশবন্দীয়া সিলসিলার মহান ব্যক্তিত্ব। সারা তুরস্ক ও ইউরোপে তার একেকটি খানকা উসমানী  খেলাফতের একেকটি মারকাজ মনে করা হয়। মসজিদ, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও দ্বীনের প্রচার প্রসারে তার অবদান অনবদ্য। কামাল আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্কের শাসনের সময় ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে অমানবিক ও অক্লান্ত প্রচেষ্টা করেছিলেন তিনি।

যখন মসজিদগুলোকে মিউজিয়াম বানিয়ে ফেলা হয়, সরকার মাদরাসার সম্পত্তি ক্রোক করে ফেলে; ধর্মীয় শিক্ষা, আযান দেয়া, আরবি শিক্ষা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে ধর্ম চর্চাকে কে নিষিদ্ধ করা হয়, তখন তুরস্কে ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে আলেম-ওলামাগণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে যান। যার অগ্রভাগে ছিলেন শায়খ মাহমুদ আফেন্দি (রহ.)। অবস্থা এমন ছিল যে, সৈন্যদের আসতে দেখলে তখন ছাত্র-শিক্ষকরা কৃষি কাজে নেমে পড়তেন। নিষেধাজ্ঞার সময় আঙ্গুলের ইশারায় নাহু- সরফ এবং হাতের ইশারায় মাসআলা-মাসায়েল শেখাতেন তালেবে ইলমদের। এখনো তুরস্কের বহু জায়গায় এ পদ্ধতি চালু রয়েছে।

কিছুদিন পর শহরের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং শহরে চলে যান দ্বীন প্রচারের জন্য। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছর তার পিছনে কেউ নামাজ পড়তে সাহস করেনি সরকারের নির্যাতনের ভয়ে। তিনি গোপনে দাড়ি রাখা এবং পর্দার প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেয়া এবং মসজিদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে লাগলেন। ফলশ্রুতিতে শত শত মাদরাসা, মসজিদ ও খানকা প্রতিষ্ঠিত হয় তুরস্ক ও ইউরোপ জুড়ে। ইসলামের ইশায়াত বা প্রসারের  জন্য তাকে কম কষ্ট করতে হয়নি। মিথ্যা মামলায় কারা নির্যাতিত হতে হয়েছিল। কয়েকবার হত্যা চেষ্টা করা হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা আপন কুদরতে তার ওলীকে হেফাজত করেছেন।

লেখালেখির ময়দানেও তিনি ছিলেন অগ্রগামী। লিখেছেন বহু মূল্যবান গ্রন্থ। তন্মধ্যে ১৮ খন্ডের  ‘রুহুল ফোরকান’ তুর্কি ভাষায় লিখিত বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ। যার চতুর্থ খন্ড, ৭২৪ পৃষ্ঠায় থানভী (রহ.)কে শায়খুল মাশায়েখ এবং শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.)কে ইমাম, মুহাদ্দিস ও আল্লামা বলে ভূষিত করেছেন। তিনি ছিলেন দেওবন্দী মানহাজের ও চিন্তা চেতনার অনুসারি। আল্লামা কাসেম নানুতবী (রহ.)কে তিনি বলতেন ১৪ শতকের মুজাদ্দিদ। ২০১৩ তুরস্কে অনুষ্ঠিত আলেম ওলামাদের এক সম্মেলনে তুর্কিস্তানে দ্বীনি শিক্ষার প্রচার প্রসারে অসামান্য অবদান স্বরূপ “ইমাম কাসেম নানুতবি (রহ.) এওয়ার্ড” প্রদান করা হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের সদরুল মুদার্রেছীন সাইয়েদ আরশাদ মাদানী (দা.বা.) তুর্কির কাসেম নানুতবী  উপাধি দেন। ক্ষণজন্মা এই ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও মহান সাধককে গত শুক্রবার ইস্তাম্বুলের ইয়াভুজ সুলতান সেলিম মসজিদে নামাযে জানাযা চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।

লেখক: শিক্ষক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী এবং সহকারী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।