।। বিনতে এন, এম, জাহাঙ্গীর ।।
দিন যত পার হচ্ছে, আমরা এগিয়ে চলছি মহাকালের দিকে। দিন দিন ফিতনাসমূহও আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। নিজেদের বিশুদ্ধ-বিশ্বাসের অনুশীলন হতেও আমরা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছি। ভিনদেশি সংস্কৃতিগুলোই আমাদের পালনীয় ও আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। ফলশ্রুতি তো এই দাঁড়িয়েছে যে, এক পরিসংখ্যানে ‘দেশের প্রায় ৬৮% তরুণ ধর্মবিমুখ’ রিপোর্ট উঠে এসেছে। আর এর পরিমাণ বেড়েই চলছে।
বড়ই অবাক লাগে যে, একজন বিশেষজ্ঞ আলিম যদি একটি হাদীস বা সুন্নাহর কথা বলেন, সাধারণ শিক্ষিত যারা রয়েছেন, কুরআন-হাদীসের উপর যাদের বিশেষজ্ঞতা অর্জন হয়নি; তারাও এর রেফারেন্স খোঁজেন। সহিহ নাকি দুর্বল হাদীস, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দেন। হ্যাঁ, জানতে চাওয়া, শুদ্ধাশুদ্ধি বিশ্লেষণ করা মন্দ কিছু নয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত ‘দিবস পালন’ এর নামে আমরা যে কত বিদআত ও অপসংস্কৃতি পালন করছি, তার সূত্র বা রেফারেন্স খুব গবেষণার প্রয়োজনও বোধ করছি না। অথচ বিদআত চালু করা ও অপসংস্কৃতি অনুকরণের ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কঠোর নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। রব্বে কারীম কালামে পাকে ইরশাদ করেন-
إنَّ هذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَا تَّبِعُوهُ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِه ‘আর নিশ্চয় আমার এ পথ সহজ-সরল। সুতরাং তোমরা এ পথের অনুসরণ করো। এছাড়া অন্য পথসমূহের অনুসরণ করো না, তা তোমাদের সরলপথ হতে সরিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেবে’। (সূরা আনআম- ১৫৩)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হিদায়াতের পথের দিকে আহ্বান করে তাঁর জন্য এ পথের অনুসারীদের সমান সাওয়াব হবে। এতে তাদের (অনুসারীদের) সাওয়াব বিন্দুমাত্রও কমবে না। আর যে ব্যক্তি ভ্রান্ত পথের দিকে আহ্বান করে, তাঁর জন্য এ পথের অনুসারীদের সমান গোনাহ হবে। এতে তাদের (অনুসারীদের) গোনাহ বিন্দুমাত্রও কমবে না। (মুসলিম- ২৬৭৪, আবূ দাউদ- ৪৬১৯, আহমাদ- ৮৯১৫)।
প্রত্যেক ফিতনা, অশ্লীলতার সাথে কাফেরদের অনুসরণের বিষয়টি সম্পর্কিত। আর তাই নবীজি ফিতনার মূল উৎস ‘কাফেরদের অনুসরণ’কেই নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হল, নবীজির বাণীকে অবজ্ঞা করে আমরা প্রতিনিয়ত কাফেরদের অনুকরণের মহড়ায় লিপ্ত হই। এ দেশে কাফেরদের যত অপসংস্কৃতি চালু আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’। আধুনিকতার মোড়কে এ রাতে তরুণ প্রজন্মের কী পরিমাণে নৈতিকতা-মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়, তা ভদ্র কোনো মানুষের পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বর্ষবরণের নামে নগর-মহানগরে চলে হৈ-চৈ, গান-বাজনা, ওপেন কনসার্ট, মদপান ও লাইভ ডান্সের মতো পাপাচারের আয়োজন।
আর এই উচ্ছৃঙ্খলতাকে এক রকম সমর্থন করা হচ্ছে ‘তারুণ্যের উম্মাদনা’ হিসেবে উল্লেখ করে। যেন তারুণ্য মানেই অপ্রতিরোধ্য-বেপরোয়া হয়ে উঠা। জাতীয় দৈনিকগুলোতেও উঠে আসছে বিভিন্ন প্রতিবেদন। যাতে উল্লেখ করা হচ্ছে, হাজার হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়ে থাকে এই থার্টি ফার্স্ট নাইট এর উচ্ছৃঙ্খলতাকে সামাল দেয়ার জন্য। তবুও দুর্ঘটনা-লজ্জাজনক কাহিনী ঘটেই চলছে। সমাজ হতে উচ্ছৃঙ্খলতা-বেহায়াপনার মূল উৎস মূলোৎপাটন না করে ক্ষণিকের পাহারা-মোতায়েনে সুদূর প্রসারী ফায়দা হচ্ছে কিনা, বিষয়টি ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
যেই খ্রিস্টবর্ষ নিয়ে এত আয়োজন, আগে জেনে নেয়া যাক, এর সূচনা-বৃত্তান্ত।
ইংরেজিবর্ষ সূচনা
খ্রিস্টানদের তৈরি এই বর্ষপঞ্জি, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় চেপে বসেছে প্রায় পুরো পৃথিবীর সব তারিখ গণনার উর্ধ্বে! এর ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ৪২৩৬ অব্দে শুরু হয় ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি। সুমেরীয় বর্ষপঞ্জি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ক্যালেন্ডার। পরবর্তীতে ছিল মিশরীয়, অ্যাসিরীয়, এল্যামাইটসহ আরো অনেক ক্যালেন্ডার। (‘Religion in the Etruscan period’ in roman).
৭৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ হতে রোমানদের প্রবর্তিত প্রথম ক্যালেন্ডার শুরু হয়। গ্রিকদের অনুসরণে রোমান ক্যালেন্ডারও ছিল ৩০৪ দিনে। পরবর্তীতে রাজা নুমা আরো দুমাস বৃদ্ধি করে মোট ১২ মাস করেন। বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হওয়ায় পরবর্তীতে সম্রাট জুলিয়াস সিজার রোমান ক্যালেন্ডার পরিবর্তন ও সংস্করণ করেন। তাই একে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার বলা হতো।
আরও পড়তে পারেন-
আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
মুমিন জীবনে নামাযের গুরুত্ব
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
রোমে ‘জানুস’ নামে এক দেবতা ছিল। জানুস মূর্তির ছিল সামনে-পিছনে দুটি মুখ। একটি মুখ বিদায়ী অতীতে, অন্যটি অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। যাকে রোমানরা সূচনার দেবতাও মনে করতো। এই বিশ্বাস হতেই জুলিয়াস জানুয়ারি মাসকে বছরের প্রথমে নিয়ে আসে (এবং ফেব্রুয়ারিকেও)। এমনকি বলা হয়ে থাকে, রোমানরা নাকি ৩১শে ডিসেম্বর রাত ১২টার পূর্বে ‘জানুস’ মূর্তির একটি মুখের সামনে এবং রাত ১২টার পর ‘নতুন বর্ষে’ অন্য মুখের সামনে এসে উপাসনা করত।
১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি, জ্যোতির্বিদদের সাথে পরামর্শ করে, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। হযরত ঈসা আ: (খ্রিষ্টানদের মতে,‘যিশুখ্রিষ্ট’) এর জন্মের বছর হতে গণনা করেন। এই খ্রিষ্ট পাদ্রীর সংশোধিত ক্যালেন্ডারের রূপই মূলত বর্তমানের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা ইংরেজিবর্ষ।
থার্টি ফার্স্ট নাইট সূচনা
মেসোপটেমিয় সভ্যতায় সর্বপ্রথম বর্ষপালনরীতি লক্ষ করা যায়। তাদের নিজস্ব বর্ষের নববর্ষ উদযাপন করত তারা। আর তথাকথিত ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ আনুষ্ঠাকিতার সাথে পালন শুরু হয় ১৯০৪/১৯০৭ এর দিকে।
সৌদি আরব, ইরান, ইথিওপিয়া, আফগানিস্তানসহ বেশ কিছু দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয় না। তাই তারা পালন করে না এই থার্টি ফার্স্ট নাইটের অপসংস্কৃতি।
মুসলিম দেশে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’!
সব কিছু নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা করার ক্ষেত্রে আমাদের বেশ আগ্রহী দেখা যায়। অথচ একজন মুসলমান তাঁর জীবনের প্রতিটি কাজের শুরুতে জেনে নেয়, সে যা করছে, তা সঠিক কিনা। কোন কিছুর জন্ম ও মৃত্যু তথা ‘শুরু-শেষ’ এর জন্য পালনীয় কোন কিছু ইসলাম সাব্যস্ত করে না। বিশেষত বর্ষপালন খ্রিষ্টান-ইহুদিদের প্রচলিত কালচার। আমাদের পেয়ারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বিরোধিতার আদেশ করেছেন। পেয়ারা নবীজির জন্ম ও মৃত্যুদিন পালনের যেখানে অনুমতি নেই, সেখানে একটি বর্ষ-সূচনায় কিভাবে তা ‘বরণ আনুষ্ঠানিকতা’ সঠিক হবে?!
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُو مِنْهُمْ -‘যে ব্যাক্তি যেই জাতির অনুসরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (আবূ দাঊদ- ৪০৩৩, শুআবুল ঈমান- ১১৯৯)।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাযি. বলেন, যে ব্যক্তি অনারবীয় দেশে বসবাস করে, সে যদি তাদের নাওরোয (নববর্ষ) ও উৎসব উদযাপন করে এবং তাদের সাথে সাদৃশ্য রাখে ও এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তবে সে কিয়ামতের দিন তাদের সাথেই পুনুরুত্থিত হবে। (বায়হাকী- ৯৩৮৭)।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করবে, এমনকি যদি তারা গুইঁ সাপের গর্তে প্রবেশ করে, তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে’। সাহাবীরা বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইহুদি ও নাসারাদের? নবীজি বললেন, ‘তারা ব্যতীত আর কে!’ (বুখারী- ৩২৬৯,৬৮৮৯; মুসলিম- ৬৯৫২; ইবনে মাজাহ- ৩৯৯৪, ইবনে হিব্বান- ৬৭০৩)।
মুমিনের সৌন্দর্য
সর্বশেষ একটি কথা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা একজন মুমিনের বিশেষ ৭টি গুণ বর্ণনা করেছেন। ২য় গুণটি হলোÑ ‘তাঁরা অহেতুক কাজ হতে বিরত থাকে’ (সূরা মু’মিনুন- ৩)। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য এই যে, সে অহেতুক কাজ ও অনর্থক কথা হতে বেঁচে থাকবে”। (তিরমিযী)।
আর এগুলো অবশ্যই অহেতুক কাজ। এতে রয়েছে সময় ও অর্থের অপচয়। ঈমান, চারিত্রিক নৈতিকতা ও সুস্থ সামাজিকতা-মূল্যবোধের অবক্ষয়।
আমাদের করণীয়
আমাদের জীবন হতে পূর্ণ একটি বছর অতীত হতে চলছে। মানে, আমি কবরের পথে এক বছর এগিয়ে গেলাম। জানিনা সামনে পূর্ণ একটি বছর পাবো কিনা কিংবা অতীতের অবহেলিত সময় ও ভুলগুলো শুধরে নেয়ার সময় পাব কিনা! তবু কীসের এত উল্লাস, কীসেরইবা এত উন্মাদনা! যেই নবীজির আখলাক ছিল লাজুকময়তা-সংযমশীলতা ও উত্তমচরিত্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ, আজ তাঁরই উম্মত দাবি করে আমরা এ কোন ঘোরে দিন পার করছি! ইসরাইল ইংরেজিবর্ষ গণনা করে, তবু ‘অ-ইহুদী’ উৎস হতে এই বর্ষ উৎপত্তি হওয়ায়,তারা ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ পালন করে না! আর আমরা স্বধর্মকে কতটুকু মূল্যায়ন করি! ইসলাম তো আমাদের প্রত্যেকটি কাজেরই সুন্দর ও ভদ্রোচিত নিয়ম শিখিয়েছে।
নতুন বছর এলে আমাদের উচিত, ফেলে আসা বছরের হিসেব গ্রহণ করা। গত বছর আমি কী খারাপ কাজ করেছি, কী ভাল কাজ করেছি। ইচ্ছে করলে তো আমি আরো ভাল হতে পারতাম। শুধু নতুন বছরকে কেন্দ্র করেই নয়, বরং প্রতিনিয়তই আমাদের উচিত ‘আত্মসমালোচনার’ দ্বার উন্মুক্ত রেখে নিজেকে শুধরে নেয়া।
সকলেরই ভুল আছে। তাই আমাদের উচিত হবে, আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চাওয়া রাতের মুনাজাতে, আতশবাজি ফুটিয়ে আঁধার রাত আলোকিত করার মাঝে নয়! আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতে ডাকছেন, তাঁর অফুরন্ত খাযানা হতে আমাদের প্রয়োজনসমূহ চেয়ে নেয়ার জন্য। আর রবের আহ্বানের বিপরীতে আতশবাজি, মাইকবাজি, ডিজে পার্টির এসব গোনাহে আমরা সাড়া দিচ্ছি! কখনো কি এভাবে ভেবেছি? যখন আমি এগুলো ভাবব, তখন কিভাবে সম্ভব গোনাহে লিপ্ত হওয়া?!
আর গোনাহ-পাপাচারের মাধ্যমে সূচিত বছর, ব্যক্তি-জীবনে কতটুকু সফলতা বয়ে আনতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। দেশের দায়িত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ, কর্তা ও নাগরিক শ্রেণি সকলের উচিত হবে, প্রত্যেকের স্থান হতে এই পাপাচারি অপসংস্কৃতি বন্ধে সংযমের সাথে সচেষ্ট হওয়া। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক: ওয়াপদা কলোনী, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে।
মেইল- jahangirbwdb63@gmail.com
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/