দাম্পত্যের একাল সেকাল

।। মুশতারী তাসনীম মুননী ।।

আমরা নানাভাইকে দেখিনি। নানুমনির মুখে তাঁর এতো এতো কথা শুনেছি যে, মনে হয় তাঁর মুখচ্ছবি, তাঁর চরিত্র যেন আমি এখনি দেখছি।

আমার নানা তৎকালীন সময়ে একজন শিক্ষিত আলেম ছিলেম। বহু বছর শিক্ষকতা করেছেন। তাকওয়াবান ছিলেন। নানুমনির সাথে তার বয়সের ব্যবধান ছিলো অনেক। অথচ দাম্পত্য ছিলো শান্তির ঠিকানা। এজন্য নানুমনিই এগিয়ে। চরম ধৈর্য আর অল্পতেই খুশি হওয়া ছিলো তাঁর বৈশিষ্ট্য।

একবার নানুমনিকে প্রশ্ন করেছিলাম, কখনও নানা ভাইয়ের ওপর রাগ হতো না?

মুচকি হেসে বললেন, রাগ হবে কেন! অভিমান হতো। বলতাম না। কখনও বুঝতো, কখনও বুঝতো না। কিন্তু আমি ওই অভিমান এর সময়ও তাঁর প্রতি দায়িত্ব কিংবা খেদমতে ত্রুটি রাখতাম না।

নানুমনি স্বামীভক্ত ছিলেন। স্বামীর খুশিকে তিনি বেহেশত মানতেন। স্বামীর নাখোশকে তিনি জাহান্নামের পথ ভাবতেন। নানুমনি মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত নানাভাইয়ের স্মৃতি আর ভালোবাসার গল্পে আমাদের বুঝাতেন দাম্পত্য জীবনে স্বামী কতটা শ্রদ্ধার কতটা ভালোবাসার।

নানুমনি আগ্রহের সাথে অপেক্ষমান ছিলেন কবে আখিরাতে নানুভাইয়ের সাথে আবার সাক্ষাত হবে। এ যাবত তাঁর মুখে নানুভাইয়ের প্রতি কোনও অভিযোগ শুনিনি। প্রশ্ন করলে বলতো, স্বামীরা একটু রাগ করবে, একটু বেখেয়ালি হবে, তাই বলে কি আমরাও একই কাজ করবো?

চুপ হয়ে যেতাম।

পরপুরুষ নানুমনিদের কাছে দোযখের মতো ভয়াবহ ছিলো। ছোট হতে আমাদেরও বলতো, দোযখের আগুন যতটা ভয়ের এতোটা ভয় রেখো পরপুরুষের প্রতি। যুবতী অবস্থায় ছয় সন্তানের জননী নানুমনিকে ছেড়ে নানাভাই আল্লাহর মেহমান হয়েছেন।

নানুমনি তাঁর ইজ্জত আব্রু আগলে রেখেছেন যত্নে, আল্লাহর ভয়ে। নানুমনিও প্রায় দেড় বছর হয় আল্লাহর মেহমান হয়েছেন। আল্লাহ নানুমনির প্রতীক্ষা শেষ করে নানাভাইসহ জান্নাতের মেহমান করুক।

আর এ যুগের দাম্পত্য! হাতের মেহেদীর রং মিলিয়ে যাওয়ার আগেই একজন আরেকজনের দোষ ত্রুটি আর না পাওয়ার তালিকা তৈরিতে নেমে পড়ে। আমাদের ধৈর্য খুব কম। সব বিষয়কে সহজভাবে ভাবার আগেই জটিলতায় মুড়িয়ে নেয়া অভ্যেস হয়ে গেছে। পরে এই জটিলতা আরও পেঁচিয়ে সেটা দাম্পত্যকে করে রুদ্ধ।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এখন স্যোশাল মিডিয়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় একসময়ের রাঁধুনি এখন জনপ্রিয় ব্লগার।

আপনার সকাল হতে রাত পর্যন্ত কর্মজীবনও এখন ব্লগে উঠে আসে। আমরা ছোটখাটো সুখ, স্মৃতি, বেড়ানো কিংবা দুঃখগুলো শেয়ার করি স্যোশাল মিডিয়ায়। আপনার আমার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো আর ব্যক্তিগত থাকছে না। ছড়িয়ে দিচ্ছি পেইজে ব্লগে কিংবা স্ট্যাটাস এ। আর নানান লোকের উপদেশের দেয়ালে ভেঙে পড়ছে আপনার ইনবক্স কিংবা কমেন্ট লিংকে।

আরও পড়তে পারেন-

স্বামীর সাথে বনিবনা হচ্ছে না, লিখলেন দু’ কলম। আপনার শুভাকাক্সক্ষী, কেয়ারি বন্ধু জুটতে বেশিক্ষণ লাগবে না। সেখান হতেই আপনার হাই হ্যালো শুরু। শেষটা পরকীয়া কিংবা সংসারের ফাটল পর্যন্ত গড়ায়।

স্মার্টফোন আপনাকে স্মার্টলি এই অনলাইন ফাঁদে জড়িয়ে নিবে। আপনার সময়গুলো বড় রঙিন হয়ে উঠবে। পাতানো বন্ধু কিংবা বান্ধবী আপনার কত ভালো। সব কিছুতেই হেল্পফুল। আপনি আপনার না পাওয়া কেয়ার, যত্ন, আপনার চাহিদা পূরণের সব কিছুই এখানে পাবেন। কিন্তু এখান হতেই ভেঙে পড়ে মানষিক স্বাস্থ্য। যখন আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে, আপনি আস্তে আস্তে হারাবেন আপনার দায়িত্ববোধ, আপনার দাম্পত্যের ভবিষ্যত, আপনার সন্তানের ভবিষ্যত।

পরিবারে স্বামী কিংবা স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। একজন আরেকজনের অস্তিত্ব। এখানে ভালবাসা, ভালোলাগা, বন্ধুত্ব আর ভবিষ্যত প্রজন্মের শেকড় থাকে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক পবিত্র মধুময়। যখনই এই পবিত্রতা ছেড়ে আপনি বাইরের জগতে যাবেন, মরিচিকা আলেয়ার মতো সবই উজ্জ্বল আর মোহময় মনে হবে। মনে হবে একটি ধারাবাহিক জীবনের একঘেয়েমি হতে বেঁচে গেছেন। মনে হতে পারে আপনার সঙ্গীর তুলনায় নতুন রুপ মায়াবী, যত্নশীল কিংবা ভালোবাসার হীরক খনি।

না, আপনার ধারনা ভুল অবশ্যই। একজনের ছবি যেমন তার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করতে পারে না, তেমনি স্যোশাল মিডিয়ায় পাতানো বন্ধুও আপনার অবিকল রূপ প্রকাশ করবে না।

আমাদের দাম্পত্য এখন মিডিয়া নির্ভর। কেন?

আমরা এখন অল্পতেই হাতের নাগালে সহমর্মিতা বোঝার জন্য স্যোশাল বন্ধু খুঁজে নেই। কেন?

আমরা এখন সংসারের বাঁধন আলগা করে রাখতেই ভালোবাসি। কেন?

এসব শুধুমাত্র আমাদের তাকওয়ার কমতি এবং আমাদের খোদাভীরুতার গাফলতি বৈ কিছু নয়। আমরা স্যোশাল মিডিয়ায় এসে ভুলতে বসি কুরআন, ভুলতে বসেছি বই পড়া কিংবা হাতের কারুকাজ। আস্তে আস্তে গাফলতি আসছে সংসার সন্তানের প্রতি। অনেকটা সময় জুড়ে থাকি অনলাইন জগতে। এসব হতে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে হবে।

স্যোশাল মিডিয়ায় আপনি সময় দিন দাওয়াতি কাজে কিংবা ভালো কিছুর জন্য। মোটকথা উদ্দেশ্য হবে দ্বীনের। এই মিডিয়া আমরা শুধু নাস্তিক কিংবা একচেটিয়া গ্রুপের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না। আমাদের কলম, আমাদের চিন্তা হোক দ্বীন নিয়ে। দুনিয়ার অপকর্ম আর অসচেতনতার বিরুদ্ধে।

আমরা দাম্পত্যজীবনে সোশ্যাল স্পর্শ নাইবা আনি। একে ওপরকে জানতে চেষ্টা করি। উদাসীনতা, অবহেলা, কিংবা ভাষার অপব্যবহার দূর করি। স্বামীর ভালোলাগাগুলো নিজের করে নেই। স্বামীর অপছন্দের পথ হতে নিজেকে গুটিয়ে নেই এবং একটু ভালোবাসা বাড়িয়ে দেই। সাথে সবর এর জন্য প্রস্তুত থাকি। জীবন একসময় এসে সুখে জড়াবেই।

তেমনি স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ববোধ বজায় রাখি। চিকিৎসা, খাদ্য, পোশাক কিংবা তার শখগুলোর ভ্যালু দেই। কাজের ফাকে তার জন্য সময় রাখুন, একাকীত্ব দূর করতে মুঠোফোনে খোঁজ রাখুন। সময় হলে মাঝেমধ্যে ঘুরে আসুন।

পরিবারে নানান জটিলতা থাকে। তাকে আপনার আপনজন করে নিন। যেনো সমস্যার প্রতিকার খুঁজতে বাইরে নয়, আপনাকে ভরসা করে। এভাবেই একে অপরের জন্য সহজ হয়ে যাই। দাম্পত্য হোক কলুষমুক্ত।

স্যোশাল মিডিয়া এখন যেমন আছে, ভবিষ্যতে জীবন হয়তোবা আরও ভার্চুয়াল হয়ে যাবে। এখন হতেই প্রিপারেশন থাকুক সুন্দর আগামীর। আমাদের দাম্পত্য হবে স্যোশাল ভাইরাসমুক্ত।

একটি দাম্পত্যের সাথে জুড়ে থাকে বহু উপাদান। পরিবার, সন্তান, সমাজ ছাড়াও অবস্থান। এই দাম্পত্যে যদি ফাটল আসে তবে পরিবার অনেকাংশে অসম্মানিত হয়।

সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়, ওরা সহিংস মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। সমাজের ভিত্তি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায়। যখন দুজনের জন্য এতো কিছু বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, তখন দু’জনকেই এই বিপর্যয় রোধে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য একজন আরেকজনকে সেক্রিফাইস করুন, ছাড় দিন।

অনেক সময় চুপ থেকেও সমাধান হয়, আবার অনেক সময় সুস্থ মস্তিষ্কে বুঝিয়ে দিন তার কমতিগুলো। দাম্পত্যে সুখের জন্য নিজেকে স্বচ্ছ রাখুন। আরেকজন স্বচ্ছ হয়ে ফিরবেই। দাম্পত্যের পবিত্রতা আপনার সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলবে। আর দাম্পত্যের অশান্তি আপনার সন্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।

আপনি আমি কিংবা সবাই একযোগে ভালো পথে ফিরতে নাইবা পারি। কিন্তু ভালো হবার পথ কখনোই বন্ধ থাকে না।

ভুলপথে পা বাড়িয়ে ভুল করা যায়, আবার ভুল শুধরে প্রিয়জনের কাছে নিজেকে প্রেজেন্ট করার অবকাশও থাকে। সুতরাং যে পারিবারিক মিডিয়া হোক বা সোশ্যাল মিডিয়া হোক, নিজেকে টিকিয়ে রাখতে অবশ্যই আগে নিজেকে শুধরে নিন। একাল সেকালের দাম্পত্য হোক তাকওয়া ও সুখ সমৃদ্ধির স্তম্ভ।

লেখক: সাহেবজাদী, হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ বাহার (রহ.)।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।