দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা

।। জাওয়াদ তাহের ।।

সুখ আর দুঃখ উভয়ের সংমিশ্রণের নাম দুনিয়া। জীবন চলার পথে নানা রকম ঝড় আসে। সহ্য করতে হয় নানান যন্ত্রণা, মেনে নিতে হয় অনেক অপমান। ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবীতে কেউ চিরসুখী ছিলো না, আর থাকবেও না। এটাই দুনিয়ার বাস্তব সত্য বিধান। মুহূর্তেই মানুষকে তিনি হাসান, আবার তিনিই কাঁদান। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি মানুষকে হাসান এবং কাঁদান। তিনিই তো মৃত্যু দেন, জীবন দেন। ’ (সূরা নাজম, আয়াত- ৪৩)।

বিপদাপদ সবকিছু আল্লাহ প্রদত্ত পরীক্ষা। তিনি চাইলে মানুষকে বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন, আবার মুহূর্তেই তা দূর করে দিতে পারেন। সব কিছুই আল্লাহ তাআলার হুকুম এবং তাকদীর অনুযায়ী পরিচালিত হয়। অনেকেই বিপদে ধৈর্যধারণ করতে পারে না। শুধু হা-হুতাশ করে বেড়ায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, মানুষ তো সৃজিত হয়েছে ভীরু রূপে। যখন তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে হা-হুতাশ করে। আর যখন কল্যাণপ্রাপ্ত হয়, তখন কৃপণ হয়ে যায়। (সূরা মাআরিজ- ১৯-২১)।

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন নবী ও রাসূলগণ। আল্লাহর নিকট তারাই ছিলেন সর্বাধিক প্রিয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ এ সকল প্রিয় বান্দাদের নানাভাবে পরীক্ষা করেছেন। ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবী পরীক্ষাগার। তাই সকলের ক্ষেত্রেই এ অলঙ্ঘনীয় বিধান প্রযোজ্য। নবীদের সে সব ঘটনা থেকে আমরা আমাদের সান্তনার বাণী শোনাতে পারি। তা নিয়ে এ লেখা।

দুনিয়াতে মানুষের সবচেয়ে নিকট আপনজন হচ্ছেন মাতা-পিতা। কিন্তু যাপিত জীবনে মানুষ অনেক সময় আপন মা-বাবার পক্ষ থেকে কষ্টের শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে জীবনের উপর হতাশাগ্রস্থ না হয়ে হযরত ইবরাহীম আ. এর জীবন থেকে আপনি শিক্ষা নিতে পারেন। ইবরাহীম আ: নিজ পিতার আচরণেই দেশান্তর হতে বাধ্য হয়েছেন। পিতার মাধ্যমেই তিনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। ‘পিতা বলল, যে ইবরাহীম, তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, আমি অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করব। তুমি চিরতরে আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও’। (সূরা মারয়াম- ৪৮)।

মা-বাবার পর মানুষের নিকট আপনজন হচ্ছে ভাইবোন। এদিকে মানুষ যেভাবে ভাই বোনের মমতা নিয়ে বেড়ে উঠে, আবার অন্য দিকে রক্ত সম্পর্কীয় ভাইদের পক্ষ থেকে মানুষ শিকার বিভিন্ন হিংসা এবং বিদ্বেষের। আপনি যদি ভাইয়ের পক্ষ থেকে যুলুমের শিকার হোন, তাহলে স্মরণ করুন হযরত ইউসুফ আ. এর কথা। মায়া দেখিয়ে আপন ভাইগণ অন্ধকারাচ্ছন্ন গভীর কূপে নিক্ষেপ করেছিলো হযরত ইউসূফ আ.-কে। তারপরও আল্লাহ তাঁকে কতো সম্মানে অধিষ্ঠিত করেছেন।‘অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে চললো এবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে একমত হলো এবং আমি তাকে ইঙ্গিত করলাম যে, তুমি তাদেরকে তাদের এ কাজের কথা বলবে এমতাবস্থায় যে, তারা তোমাকে চিনবে না’।(সূরা ইউসুফ- ১৫, ১৬)

আপনার চারদিকে সঙ্কট আর বিপদাপদ। চারদিকে তাকালেই শুধু অন্ধকার, এভাবেই আপনার জীবন পরিক্রমা চলছে। এ জন্য আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করুন। হতাশ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি হযরত ইউনুস আ: এর কথা স্বরণ করুন। কঠিন বিপদের মুহূর্তেও তিনি হতাশ হননি। অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারেও তিনি আস্থা রেখেছিলেন মহান রবের প্রতি। সাগরের ভেতর মাছের পেটের অন্ধকারাচ্ছন্ন এক জীবন থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। ‘এবং মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন,অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাঁকে ধৃত করতে পারবো না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করলেনঃ তুমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই; তুমি নির্দোষ আমি গুনাহগার। অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনি ভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি’।(সূরা আম্বিয়া- ৮৭,৮৮)।

রোগব্যাধি মানুষের জীবনের অন্যতম এক পরীক্ষা। রোগাক্রান্ত হলে আপনি ভেঙে পড়বেন না, হতাশ হবেন না। স্মরণ করুন হযরত আইয়ুব আ: এর কথা। তিনি আপনার চেয়ে অনেক গুণ বেশি অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থতার পাশাপাশি তিনি একদম নিঃস্ব হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা পুনরায় সব দিয়েছেন। ‘এবং স্মরণ করুন আইয়ুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন, আমি দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ঠ দয়াবান। অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁর দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তাঁর পরিবারবর্গ ফিরিয়ে দিলাম, আর তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশত আর এটা ইবাদতকারীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ’। (সূরা আম্বিয়া- ৮৩, ৮৪)।

প্রতিটি মানুষের জন্য তার সন্তান আল্লাহ প্রদত্ত এক বড় নেয়ামত। কিন্তু সন্তান অনেক সময় অবাধ্য হয়ে যায়, ভুল পথে পরিচালিত হয়। মা-বাবার জন্য বড় এক পেরেশানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সন্তান যদি অবাধ্য হয় একং শত চেষ্টা করেও তাকে দ্বীনের পথে আনতে পারছেন না, তাহলে স্মরণ করুন হযরত নূহ আ. এর কথা। যিনি সাড়ে নয়শত বছর দাওয়াত দিয়ে মাত্র ৮০ জন মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে পেরেছেন।

নিজের সন্তানকে শত চেষ্টা করেও সঠিক পথে আনতে পারেননি। ‘আর নৌকাখানি তাদের বহন করে চললো পর্বত প্রমাণ তরঙ্গমালার মাঝে, আর নূহ (আ.) তাঁর পুত্রকে ডাক দিলেন আর সে সরে রয়েছিলো, তিনি বললেন, প্রিয় বৎস! আমাদের সাথে আরোহন করো এবং কাফেরদের সাথে থেকো না। সে বললো, আমি অচিরেই কোনো পাহাড়ে আশ্রয় নেবো, যা আমাকে পানি হতে রক্ষা করবে। নূহ (আ.) বললেন আজকের দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কোনো রক্ষাকারী নেই। একমাত্র তিনি যাকে দয়া করবেন। এমন সময় উভয়ের মাঝে তরঙ্গ আড়াল হয়ে দাঁড়াল, ফলে সে নিমজ্জিত হলো’। (সূরা হুদ- ৪২,৪৩)।

মানুষের সুখ-দুঃখ এবং জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী হচ্ছে তার স্ত্রী। আপনার স্ত্রী যদি অবাধ্য হয়,শত চেষ্টা করেও তাকে সঠিক পথে আনতে পারছেন না। সে বাঁকা পথকে ভালোবাসে,অন্যায়কে সমর্থন করে। তাহলে স্মরণ করুন হযরত লূত আ. ও নূহ আ. এর স্ত্রীদয়ের কথা। ‘আল্লাহ তাআলা কাফেরদের জন্য নূহ-পতœী ও লূত-পতœীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। তারা ছিলো আমার দুই ধর্মপরায়ণ বান্দার গৃহে। অতঃপর তারা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। ফলে নূহ ও লূত তাদেরকে আল্লাহ তাআলার কবল থেকে রক্ষা করতে পারলো না এবং তাদেরকে বলা হলো, জাহান্নামীদের সাথে জাহান্নামে চলে যাও’। (সূরা আত-তাহরীম- ১০)।

আপনার স্বামী যদি আল্লাহর অবাধ্য বান্দা হয়, আপনাকে সঠিক পথে চলতে বাধা দেয়, তাহলে স্মরণ করুন ফেরআউন পতœীর কথা।‘আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জন্যে ফেরাউন-পতœীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন’। (সূরা আত-তাহরীম- ১১)।

আপনি যদি কারো মিথ্যা অপবাদ এবং মামলা মুকাদ্দামায় ফেঁসে যান, তাহলে স্মরণ করুন হযরত ইউসুফ আ. ও হযরত আয়েশা রাযি. এর ঘটনা। মিথ্যা অপবাদে দীর্ঘ সাত বছর জেলের কুঠুরিতে কাটিয়েছেন হযরত ইউসুফ আ:। ‘ইউসুফ বললঃ হে পালনকর্তা তারা আমাকে যে কাজের দিকে আহ্বান করে, তার চাইতে আমি কারাগারই পছন্দ করি। যদি আপনি তাদের চক্রান্ত আমার উপর থেকে প্রতিহত না করেন, তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বো এবং অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। অতঃপর তার পালনকর্তা তার দুআ কবুল করে নিলেন। অতঃপর তাদের চক্রান্ত প্রতিহত করলেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’। (সূরা ইউসুফ- ৩৩, ৩৪)।

আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. এর উপর যে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছিলো তার ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। মুনাফিকদের মিথ্যা অপবাদে তাঁর জীবনে নেমে এসেছিলো অন্ধকার এক অধ্যায়। কিন্তু মহান আল্লাহ স্বয়ং কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করে আম্মাজান আয়েশার পবিত্রতা বয়ান করেছেন এবং যারা মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে,তাদের জন্য কঠোর শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। ‘যদি ইহকালে ও পরকালে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো, তবে তোমরা যা চর্চা করছিলে, তার জন্যে তোমাদেরকে গুরুতর আযাব স্পর্শ করতো।

যখন তোমরা একে মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং মুখে এমন বিষয় উচ্চারণ করছিলে, যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিলো না। তোমরা একে তুচ্ছ মনে করছিলে, অথচ এটা আল্লাহর কাছে গুরুতর ব্যাপার ছিলো।

তোমরা যখন এ কথা শুনলে তখন কেনো বললে না যে, এ বিষয়ে কথা বলা আমাদের উচিত নয়। আল্লাহ তো পবিত্র, মহান। এটা তো এক গুরুতর অপবাদ’।সূরা আন-নুর- ১৪, ১৫)। তাই হতাশা নয়, প্রয়োজন আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস।