দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার পদ্ধতি: দাওয়াতের ভাষা হবে কোমল ও হিকমতপূর্ণ

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

মহান আল্লাহ সূরা ত্ব-হার ৪১-৪৮ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-

وَاصۡطَنَعۡتُکَ لِنَفۡسِیۡ ﴿ۚ۴۱﴾ اِذۡهَبۡ اَنۡتَ وَاَخُوۡکَ بِاٰیٰتِیۡ وَ لَا تَنِیَا فِیۡ ذِکۡرِیۡ ﴿ۚ۴۲﴾ اِذۡهَبَاۤ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ اِنَّهٗ طَغٰی ﴿ۚ۴۳﴾ فَقُوۡلَا لَهٗ قَوۡلًا لَّیِّنًا لَّعَلَّهٗ یَتَذَکَّرُاَوۡیَخۡشٰی ﴿۴۴﴾ قَالَا رَبَّنَاۤ اِنَّنَا نَخَافُ اَنۡ یَّفۡرُطَ عَلَیۡنَاۤ اَوۡ اَنۡ یَّطۡغٰی ﴿۴۵﴾ قَالَ لَا تَخَافَاۤ اِنَّنِیۡ مَعَکُمَاۤ اَسۡمَعُ وَ اَرٰی ﴿۴۶﴾ فَاۡتِیٰهُ فَقُوۡلَاۤ اِنَّا رَسُوۡلَا رَبِّکَ فَاَرۡسِلۡ مَعَنَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ۬ۙ وَلَا تُعَذِّبۡهُمۡ ؕ قَدۡ جِئۡنٰکَ بِاٰیَۃٍ مِّنۡ رَّبِّکَ ؕ وَالسَّلٰمُ عَلٰی مَنِ اتَّبَعَ الۡهُدٰی ﴿۴۷﴾ اِنَّا قَدۡ اُوۡحِیَ اِلَیۡنَاۤ اَنَّ الۡعَذَابَ عَلٰی مَنۡ کَذَّبَ وَ تَوَلّٰی ﴿۴۸﴾

অনুবাদ: (৪১) এবং আমি আপনাকে আমার নিজের জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছি। (৪২) আপনি ও আপনার ভাই আমার নিদর্শনসহ যাত্রা করুন এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করবেন না, (৪৩) আপনারা উভয়ে ফিরাউনের কাছে যান, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে। (৪৪) আপনারা তার সাথে নরম কথা বলবেন, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে। (৪৫) তারা বলল, হে আমাদের রব! আমরা আশঙ্কা করি সে আমাদের উপর বাড়াবাড়ি করবে অথবা অন্যায় আচরণে সীমালঙ্ঘন করবে। (৪৬) তিনি বললেন, “আপনারা ভয় করবেন না, আমি তো আপনাদের সঙ্গে আছি, আমি শুনি ও দেখি। (৪৭) সুতরাং আপনারা তার কাছে যান এবং বলুন, আমরা তোমার রবের রাসূল, কাজেই আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিও না, আমরা তো তোমার কাছে এনেছি তোমার রব এর কাছ থেকে নিদর্শন। আর যারা সৎপথ অনুসরণ করে তাদের প্রতি শান্তি। (৪৮) নিশ্চয় আমাদের প্রতি ওহী পাঠানো হয়েছে যে, শাস্তি তো তার জন্য যে মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।

তাফসীর: আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে নবুওয়াত দেওয়ার কথা উল্লেখ করছেন এবং ফিরাউনকে দাওয়াত দেওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, হে মূসা! আমি আপনাকে একজন সম্মানিত রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছি। অর্থাৎ আপনাকে আমার ওহী ও রিসালাত বহনের জন্য তৈরি করে নিয়েছি এবং আমার দলীল-প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আপনাকে আমি পছন্দ করে নিয়েছি। আর আপনাকে আমার ও আমার বান্দাদের মধ্যে ওহী ও রিসালাতের বাহক হিসেবে নির্ধারণ করছি। এভাবেই মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের পছন্দ করেন তাদেরকে নিজের করে তৈরী করেন। যাতে করে পরবর্তী দায়িত্বের জন্য যোগ্য বিবেচিত হন।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ফেরাউনের কাছে আমার ওহী ও রিসালাতের দাওয়াত নিয়ে যেতে কোন প্রকার বিলম্ব করবেন না। আমার স্মরণে কোন ধরনের শৈথিল্য করবেন না। আপনারা দু’জন আমার স্মরণ কখনও পরিত্যাগ করবেন না। ফিরাউনের কাছে যাওয়ার সময়ও যিকির করবেন, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবেন। যাতে করে যিকির আপনাদের জন্য তাকে মোকাবিলার সময় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আল্লাহর স্মরণ আপনাদের মনে শক্তি যোগাবে এবং কাফিরদের মনে ভীতি সঞ্চার করবে। ফলে তারা পরাভূত হবে।

আপনারা দু’জন ফিরাউনের কাছে ঈমানের দাওয়াত নিয়ে যান। সে সীমালঙ্ঘন করেছে। মাথা উঁচু করে রয়েছে। আমার অবাধ্যতা করেছে। নিজের মালিক ও সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গেছে।

সেই সাথে আরো বললেন, ফিরাউনের সাথে ভদ্রতা ও নম্রতা বজায় রেখে কথা বলবেন। কারণ, যে ব্যক্তি যেমন পদমর্যাদার অধিকারী তাকে তেমন সম্মান দিয়ে কথা বললে কথা বলা ফলপ্রসূ হতে পারে। প্রথমেই যদি সম্মানে আঘাত হানা হয়, তাহলে পরবর্তীতে কথা শুনবে না। স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে দাওয়াতের পদ্ধতি ভিন্ন হবে। দাওয়াতের ভাষা হতে হবে নরম, যাতে অন্তরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং দাওয়াত সফল হয়। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ

অর্থাৎ- “আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন। আপনার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশ দ্বারা”। (সূরা আন-নাহল- ১২৫ আয়াত)।

এ আয়াতে দাওয়াত প্রদানকারীদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে। সেটা হচ্ছে, ফিরআউন হচ্ছে সব চেয়ে বড় দাম্ভিক ও অহংকারী, আর মূসা (আ.) হচ্ছেন আল্লাহর পছন্দনীয় লোকদের অন্যতম। তারপরও ফিরআউনকে নরম ভাষায় সম্বোধন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)।

আরও পড়তে পারেন-

এতে বুঝা যাচ্ছে যে, প্রতিপক্ষ যতই অবাধ্য এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার বাহক হোক না কেন, তার সাথেও সংস্কার ও পথ প্রদর্শনের কর্তব্য পালনকারীদের হিতাকাক্সক্ষীর ভঙ্গিতে নম্রভাবে কথাবার্তা বলতে হবে। এরই ফলশ্রুতিতে সে কিছু চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হতে পারে এবং তার অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হতে পারে।

মানুষ সাধারণত দু’ভাবে সঠিক পথে আসে। সে নিজে বিচার-বিশ্লেষণ করে বুঝে, শুনে ও উপদেশ বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করে, অথবা অশুভ পরিণামের ভয়ে সোজা হয়ে যায়। তাই আয়াতে ফিরাউনের জন্য দু’টি সম্ভাবনাই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য আয়াতে মূসা আলাইহিস সালাম কীভাবে সে নরম পদ্ধতি অবলম্বন করে ছিলেন, সেটার বর্ণনা এসেছে। তিনি বলেছিলেন-

فَقُلۡ هَلۡ لَّکَ اِلٰۤی اَنۡ تَزَکّٰی ﴿ۙ۱۸﴾

وَ اَهۡدِیَکَ اِلٰی رَبِّکَ فَتَخۡشٰی ﴿ۚ۱۹﴾

অর্থাৎ- আপনার কি আগ্রহ আছে যে, আপনি পবিত্র হবেন, আর আমি আপনাকে আপনার রবের দিকে পথ প্রদর্শন করি, যাতে আপনি তাঁকে ভয় করেন? (সূরা আন-নাযিআত- ১৮-১৯)।

এ কথাটি অত্যন্ত নরম ভাষা। কেননা, প্রথমে পরামর্শের মতো তাকে বলা হয়েছে যে, আপনার কি আগ্রহ আছে? কোন জোর নয়, আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত বলা হচ্ছে যে, আপনি পবিত্র হবেন, এটা বলা হয়নি যে, আমি আপনাকে পবিত্র করব। তৃতীয়ত: তার রবের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, যিনি তাকে লালন পালন করেছেন।

অতঃপর হযরত মূসা ও হারুন আলাইহিমুস সালাম আল্লাহ তাআলার সামনে ভয় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বললেন, ফিরাউন আমাদের বক্তব্য শ্রবণ করার আগেই ক্ষমতার অহমিকায় উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে এবং অনাকাক্সিক্ষত কিছু করে সে সীমালঙ্ঘন করতে পারে। অথবা সে আপনার শানে অসমীচীন কথাবার্তা বলে আরো বেশি অবাধ্যতা প্রদর্শন করতে পারে অথবা আমাদের উপর তার হাত প্রসারিত করবে।

তাদেরকে সান্ত্বনা ও অভয় দিয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- আপনারা ফিরাউনকে যা কিছু বলবেন ও তার প্রত্যুত্তরে সে আপনাদেরকে যা কিছু বলবে, আমি তা শুনব ও তার প্র্র্রতিক্রিয়া লক্ষ করব। আর সেই অনুযায়ী আমি আপনাদেরকে সাহায্য করব এবং তার সকল চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিব। সুতরাং আপনারা তার নিকট যান কোন ধরনের দ্বিধা ও ভয় ছাড়া। আমার সাহায্য ও সহযোগিতা আপনাদের সাথে থাকবে।

ফিরাউনের কাছে গিয়ে তাকে বলুন- অবশ্যই আমরা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল। সুতরাং আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলকে যেতে দাও। আর তাদেরকে কষ্ট দিও না। আমরা তো তোমার কাছে এসেছি তোমার প্রতি পালকের তরফ হতে নিদর্শন ও শান্তির বিধান নিয়ে, তাদের প্রতি যারা সৎ পথের অনুসরণ করে।

আমাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার ওপর মিথ্যারোপ করবে ও আমাদের দাওয়াত থেকে বিমুখ হবে, তার ওপর শাস্তি নেমে আসবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فَاَنۡذَرۡتُکُمۡ نَارًا تَلَظّٰی ﴿ۚ۱۴﴾ لَا یَصۡلٰىهَاۤ اِلَّا الۡاَشۡقَی ﴿ۙ۱۵﴾ الَّذِیۡ کَذَّبَ وَ تَوَلّٰی ﴿ؕ۱۶﴾

অর্থাৎ- অতঃপর আমি তোমাদেরকে লেলিহান আগুন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি। তাতে প্রবেশ করবে সে-ই, যে নিতান্ত হতভাগ্য, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। (সূরা লাইল- ১৪-১৬)।

জাহান্নামে নিতান্ত হতভাগা ব্যক্তিই দাখিল হবে। যে আল্লাহর আয়াতসমূহের প্রতি মিথ্যারোপ করে এবং তাঁর আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেেেছন-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ أَبَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى.

অর্থাৎ- প্রত্যেক উম্মতই জান্নাতে যাবে, তবে যে অস্বীকার করবে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কে অস্বীকার করবে? তিনি বললেন, যে আমার অনুসরণ করবে সে জান্নাতে যাবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে বস্তুত সেই আমাকে অস্বীকার করলো। (সহীহ বুখারী, ৭২৮০)।

লেখক: বিশিষ্ট মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির এবং মুঈনে মুহতামিম- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব- নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।