নতুন উদ্বেগ কিশোর গ্যাং কালচার: শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ধর্মীয় প্রভাব ফিরিয়ে আনতে হবে

দেশে প্রচলিত অপরাধের সাথে কিশোর গ্যাং নামে নতুন ধারার এক অপরাধ যুক্ত হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে গড়ে উঠা কিশোর গ্যাং সমাজের জন্য এখন ভয়াবহ এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্য উঠতি বয়সের কিশোররা এমন কোনো অপরাধ নেই যা করছে না। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদকসেবন ও ক্রয়-বিক্রয় এবং ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। এছাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একদল আরেক দলের সাথে সংঘর্ষ ও খুনাখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বড় বড় শহর ছাড়িয়ে দেশের মফস্বল অঞ্চল পর্যন্ত কিশোর গ্যাং-এর দৌরাত্ম্য বিস্তার করেছে।

ভবিষ্যত প্রজন্মের কিশোরদের গ্যাং কালচারে জড়িয়ে দুর্দমনীয় হয়ে উঠা যেকোনো সমাজের জন্যই উদ্বেগের। উঠতি বয়সী কিশোরদের এভাবে বিপজ্জনক পথে ধাবিত হওয়া নিয়ে যেমন সচেতন মহল উদ্বিগ্ন, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে। কারণ, কিশোর গ্যাং যে ধরনের ফৌজদারী অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে তাদের গ্রেফতার করলেও বয়স বিবেচনায় যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। কিশোর সংশোধনাগারে পাঠিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকছে না। ফলে এক সময় ছাড়া পেয়ে তারা আরো দুঃসাহসী ও দুর্দমনীয় অপরাধে জড়াচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন-

দেশ ও জাতির ভবিষ্যত কান্ডারি বলা হয় কিশোরদের। এরাই আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবে। এদের যথাযথ বিকাশ, ধর্মীয় শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের বাড়ন্ত এ সময়ে এ কাজটির যে চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তা কিশোর-তরুণদের দল বেঁধে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া থেকেই বোঝা যাচ্ছে। স্বাভাবিক নিয়মে কিশোরদের বাড়ন্ত ও দুরন্ত সময়ে পরিবারের অভিভাবক শ্রেণির অধিক সতর্ক থাকতে হয়। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কার সাথে মিশছে, কখন ঘরে ফিরছে এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হয়। সেই সাথে সমাজের নেতৃস্থানীয়দেরও সচেতন থাকা অপরিহার্য।

আমাদের চিরায়ত পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা ইসলামী অনুশাসন ও মূল্যবোধকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। সুদীর্ঘকাল থেকেই ইসলামী রীতি-নীতি, শাসন-বারণ, আদব-কায়দা মানুষকে অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে, মাদরাসা শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সাধারণত মাদরাসায় যারা পড়াশোনা করে থাকে, তারা পারিবার ও সামাজে নীতি-নৈতিকতা ও ইসলামী মূল্যবোধের অনুশীলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পাশাপাশি গত দেড় যুগ আগেও জাতীয় শিক্ষাকারিকুলামে ধর্মীয় শিক্ষার বেশ প্রভাব ছিল। গত দুই যুগ আগেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলব্যাপী ফোরকানিয়া মক্তব্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল। এতে দেশের প্রতিটি শিশু জীবনের শুরু লগ্নেই প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষা অর্জন এবং নামায-রোযার পাশাপাশি অন্যান্য নৈতিকতারও কঠোর অনুশীলন করে সৎভাবে গড়ে ওঠতে বুনিয়াদি শিক্ষা পেত। কিন্তু পুঁজিবাদি কূটচালে কেজি স্কুল চালু করে মক্তব্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। এর সাথে ২০১০ সালে নতুন শিক্ষানীতি গ্রহণের পর জাতীয় শিক্ষা থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকোচন করতে করতে বর্তমানে অনেকটা গুরুত্বহীনতার স্তরে নামিয়ে বস্তু ও ভোগবাদের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। যার অনিবার্য বহুবিদ কুফল কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার, খুন, ধর্ষণ, নানা অপরাধমূলক কর্মকা- ও দুর্নীতির আশংকাজনক বিস্তারের মাধ্যমে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হতে শুরু করেছে।

সুতরাং পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনকে অক্ষুন্ন ও হুমকিমুক্ত রাখার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকপথে পরিচালিত করতে হলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাঠ্যসূচিতে ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। ফোরকানিয়া মক্তব শিক্ষাকে কীভাবে দেশব্যাপী আগের মতো চালু করা যায়, সেদিকটা গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।

প্রতিটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয় প্রখ্যাত আলেমদের দিয়ে সাপ্তাহিক ধর্মীয় আলোচনা সভার আয়োজন করা যায় কিনা, ভেবে দেখা যেতে পারে। হক্কানী উলামায়ে কেরামদের অংশগ্রহণে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন আরো ব্যাপকতর করতে হবে। পাড়া-মহল্লায় অভিভাবকশ্রেণিকে সভ্যতা, নীতি-নৈতিকতা ও শাসন-বারণের রীতি সুদৃঢ় রাখতে সক্রিয় হতে হবে। অপকর্মে লিপ্তদের পরিবারের অভিভাবকের সাথে সমাজপতিদের কথা বলতে হবে। শিক্ষার্থীদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। জুমার নামাযের সময় মসজিদের ইমামদেরও এ ব্যাপারে নিয়মিত বয়ান দেয়া উচিত। আর এ জন্য আলেম-উলামা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইসলামী জীবনধারণের প্রতি নেতিবাচক প্রচারণা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে।

অন্যদিকে, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং কিশোর গ্যাং রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আলেমদের সাথে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। তাদের শুধু অপরাধ বা অপরাধীদের ধরন নিয়ে গবেষণা করলে চলবে না। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবর্তন কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, এসব বিষয় নিয়েও গবেষণা করতে হবে।

আমরা মনে করি, এভাবে শিক্ষা ও সামাজিকব্যবস্থা গড়তে সরকার সদিচ্ছা পোষণ করলে কিশোর-তরুণদের সুপথে আনার পাশাপাশি অপরাধমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে দ্রুতই ইতিবাচক ফলাফল দেখা যাবে। মনে রাখতে হবে, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও নেতৃত্বই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন, তা কখনোই জাতির জন্য প্রত্যাশিত ফল বয়ে আনবে না।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।