নবীজির পবিত্র অভ্যাস এবং বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা

।। ড. আবদুল কাদির খান ।।

আমরা সকলেই জানি, পবিত্র কুরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থার নাম। তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবন। অমুসলিম বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, যেন পবিত্র কুরআন থেকে তারা ভুল বের করতে পারে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়; বরং কুরআনের ৮০ শতাংশ ঘটনাকে তারা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ পেয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ যেগুলো বাকি আছে, তা অচিরেই বিশুদ্ধ প্রমাণিত হবে। ইনশাআল্লাহ। আমার এক প্রিয় বন্ধু আমাকে কিছু তথ্য দিয়েছে। আমি তা আপনাদের কাছে শেয়ার করছি। এগুলোর উপর আমাল করতে পারলে ৭৫ শতাংশ সাওয়াব সে পেলে বাকি ২৫ শতাংশ সাওয়াবের আশা আমি মাধ্যম হিসেবে পাবো, ইনশাআল্লাহ।

প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো জীবনে কোনো দিন অসুস্থ হননি। এর রহস্য আপনি নিচের কারণগুলো থেকে জানতে পারবেন-

সকালে ঘুম থেকে দ্রুত ওঠা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকালে খুব দ্রুত ঘুম থেকে উঠতেন; বরং হাদীসে এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না যে, নবীজির তাহাজ্জুদ কোনো দিন কাযা হয়েছে। সূর্যোদয়ের আগ মুহূর্ত থেকে নিয়ে সূর্যোদয়ের এক ঘণ্টা পর পর্যন্ত সময়টি অক্সিজেনে ভরপুর থাকে। আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণা অনুযায়ী দৈনন্দিন ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও উত্তম সময় হচ্ছে এই সময়টি। যেখানে আপনি বেশি থেকে বেশি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারবেন। যা আপনার সুস্থ জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

চোখের ম্যাসেজ: সকালে ঘুম থেকে উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোখ ম্যাসেজ করতেন। আমাদের পুরো শরীর এগারোটি সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত। ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর সিস্টেম আপন অবস্থায় ফিরে আসতে প্রায় ১০ থেকে ১২ মিনিট সময় নেয়। যদি আপনি চোখ ম্যাসেজ করেন, তাহলে এই সিস্টেম ১০- থেকে ১৫ সেকেন্ড সময়ের ব্যবধানে আপন অবস্থায় ফিরে আসবে।

ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকতেন। এ সময় তিনি নিয়ম অনুযায়ী তিন বার সূরা ইখলাস পড়তেন। যা পড়তে প্রায় এক মিনিট সময় ব্যয় হয়। বর্তমান সময়ের মেডিকেল বিজ্ঞান এটাই বলে যে, আমাদের মস্তিষ্কে একটি নার্ভ আছে, যার এক অংশ থেকে অপর অংশ পর্যন্ত রক্ত সঞ্চারের জন্য সেতুর কাজ করে। এই সেতুর মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে রক্তের সঞ্চারণ আপন অবস্থায় ফিরে আসে এবং এর দ্বারা আমাদের পুরো শরীর নিয়ন্ত্রিত হয়।

যদি কেউ সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হতেই চলাফেরা শুরু করে দেয়- অথচ মস্তিষ্কে রক্তের সঞ্চারণ এখনো শুরু হয়নি- তাহলে মস্তিষ্ক হ্যামার হওয়া কিংবা মস্তিষ্কে জটিল কোনো সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। যার মধ্যে পক্ষাঘাত আক্রান্ত হওয়াও অন্তর্ভুক্ত। যদি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে এক মিনিট বিছানায় বসে থাকে, তাহলে এসব সমস্যা থেকে বাঁচার সম্ভাবনা থাকবে। অমুসলিম বিজ্ঞানীরা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর উক্ত হাদীসে গবেষণা করে সকলেই সর্বসম্মতিক্রমে মত ব্যক্ত করেছেন যে, আমাদের জন্য উচিত মুহাম্মদ (সা.)এর সুন্নাত অনুযায়ী সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ বসে থাকা। এর দ্বারা মস্তিষ্ক পরিপূর্ণরূপে সচল হয়ে আমাদের শরীরকে পথপ্রদর্শন করতে পারবে। এটি এমন একটি সুন্নাত, যার উপর আমল করলে রয়েছে আমাদের জন্য কল্যাণ এবং যা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বড় উপকারী।

কায়লুলা করা: রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পবিত্র অভ্যাস ছিল দুপুরে খাওয়ার পর কিছু সময়ের জন্য (প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট) শুয়ে থাকা। যাকে আরবিতে কায়লুলা বলা হয়। কায়লুলার উপকার এই যে, প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ যখন দুপুরের খাবার গ্রহণ করে, তখন তাদের পাকস্থলীতে অল্প পরিমাণের এলকোহল তৈরি হয়। এ অবস্থায় যদি মানুষ চলাফেরা করে, তাহলে মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, অথবা মাতালের মত অবস্থা তৈরি হতে পারে। এ কারণেই আপনি দেখবেন যে, দুপুরের খাবার গ্রহণ করার পর নিজেকে টায়ার্ড অনুভব হয়। যদি আমরা কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়ি, তাহলে পাকস্থলীতে তৈরি হওয়া এলকোহল আমাদের শরীরে প্রভাব ফেলতে পারবে না। এবং শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর কার্যক্ষমতা ঠিক থাকবে। আমরা যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাব। এছাড়া এই সুন্নাতের উপর আমল না করলে শারীরিকভাবে অনেক ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে। যেহেতু এ বিষয়টি গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত, তাই অধিকাংশ রাষ্ট্রে দুপুরের বিরতি এক থেকে দুই-তিন ঘণ্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে। যাতে করে মানুষ দুপুরের খাবার গ্রহণ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারে। আজ সমগ্র ইউরোপ নবীজির সুন্নাতকে গ্রহণ করেছে। তারা দুপুর থেকে নিয়ে তিনটা পর্যন্ত বিরতি গ্রহণ করে। তারা নবীজির সুন্নতের উপর গবেষণা করে তা গ্রহণ করে নিয়েছে এবং আমাদের চেয়েও অনেকগুণ সুস্থ জীবন যাপন করছে।

আরও পড়তে পারেন-

খাওয়ার পূর্বে ফল পরিবেশন করা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় সময় খাবার গ্রহণের পূর্বে ফল খেতেন। খাবারের পর ফল খাওয়া নবীজির অভ্যাস ছিল না। বিভিন্ন ফলে ৯০ থেকে প্রায় ৯৯ শতাংশ পরিমাণে পানি থাকে। যেহেতু নবীজি খাবারের পর পানি পান করতে অনুৎসাহিত করতেন এবং খাবারের পূর্বে পানি পান করার উৎসাহ দিতেন এবং যেহেতু ফলের মধ্যে অধিক পরিমাণের পানি পাওয়া যায়, তাই খাওয়ার পূর্বে ফল খেলে শরীরে বিশেষভাবে পাকস্থলীতে শক্তি সঞ্চার হয়। খাওয়ার হজম করার ক্ষেত্রে পাকস্থলীর ভূমিকা যেহেতু বেশি তাই ফল খাওয়ার দ্বারা এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। এ বিষয়টি বিজ্ঞান দ্বারাও প্রমাণিত যে, ফলের মধ্যে খাবারের যে উপাদান পাওয়া যায়, তা খালি পাকস্থলীর জন্য অনেক উপকারী।

খাওয়ার পর পানি পান না করা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাওয়ার পর কখনো পানি পান করতেন না। আজকাল গবেষণার মাধ্যমে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা দ্বারা বুঝা যায় যে, এই পবিত্র সুন্নতের উপর আমল না করার কারণে আমরা এত বেশি পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি, যা কল্পনাও করা যায় না। আমরা যখন খাওয়ার পর পানি পান করি, তখন খাবারে যে পরিমাণের ফ্যাট থাকে তা পানি পান করার কারণে খাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকস্থলীর উপরের অংশে চলে আসে। অবশিষ্ট খাবারগুলো হজমের দ্বিতীয় পর্যায়ে চলে যায়। এভাবে পাকস্থলীতে থেকে যাওয়া ফ্যাট ও প্রোটিনগুলো মারাত্মক পর্যায়ের ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি করে। অথচ এই ফ্যাটগুলো খাবারের সাতে মিশ্রিত হয়ে হজমের দ্বিতীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল।

খাবারের পর আমরা যদি পানি পান করি অথবা ফল গ্রহণ করি, তাহলে ফ্যাটগুলো আমাদের শরীরের ক্ষতি করার জন্য পাকস্থলীতে থেকে যাবে। সুতরাং খাবার গ্রহণ করার পর (কমপক্ষে পৌনে এক ঘন্টা পর্যন্ত) পানি পান না করা উচিত। কারণ, তা পেটে শুধু গ্যাসই তৈরি করে না; বরং বদহজমিসহ আরো অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি হার্টের অনেক সমস্যা এই সুন্নাতের উপর আমল না করার কারণে হয়। [চলবে]

[ড. আবদুল কাদির খান (১৯৩৭ – ২০২১), পাকিস্তানের প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ও দৈনিক জং পত্রিকার কলাম লেখক]

ভাষান্তর- আম্মার ইয়াসের

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।