পরিচালকের চিঠি- তোমাদের প্রতি…
হে রাসূল, আপনার প্রতি হাজারো জান কুরবান!
বন্ধুরা, আমরা সকলেই জানি, গত কিছুদিন পূর্বে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ, ভারতের হিন্দুত্ববাদী এক উগ্রপন্থী রাজনৈতিক দলের একজন দুষ্টু নেত্রী ও নেতা আমাদের সকলের প্রাণের চেয়েও প্রিয় নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.)কে নিয়ে কটূক্তি করেছে।
এই ঘটনাটা বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে গভীরভাবে আঘাত করেছে। সমগ্র বিশ্ব নবীজির ভালোবাসায় ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান নবীজির ভালোবাসার নজরানা পেশ করার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে। কী আলেম সমাজ, কী সাধারণ সমাজ। মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের প্রত্যেক শ্রেণির মুসলমানগণ ভারতের সেই দুষ্টু নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। সর্বস্তরের মুসলমানদের এই নযিরবিহীন প্রতিবাদ প্রমাণ করে, মুসলমানরা ইসলামের বিধান পালনের ক্ষেত্রে অনেক সময় দুর্বলতার পরিচয় দিলেও কিন্তু তারা প্রিয় নবীজিকে ভালোবাসেন তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান এমনকি নিজের জানের চেয়েও বেশি।
নবীজিকে নিজ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসা, এটা ঈমানের দাবি। যে হৃদয়ে নবীজির মুহাব্বত নেই, সে হৃদয় মরা। সেই হৃদয়ে আছে শুধু নিফাক। নবীজিকে অবশ্যই ভালোবাসতে হবে। কারণ নবীজিই হলেন আমাদের পথের দিশা। তিনি হলেন রাহমাতুল লিল আলামীন। তিনিই আমাদের নেতা, আমাদের আদর্শ, আমাদের অনুপ্রেরণা। নবীজির শানে বেআদবি করে কেউ পার পাবে না, ইনশাআল্লাহ।
বন্ধুরা, নবীজির মুহাব্বতের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, প্রতিটি কাজে কর্মে তাঁর অনুসরণ করা। কারণ নবীজির আদর্শের অনুসরণের মাঝেই রয়েছে প্রকৃত শান্তি ও হিদায়াত। আমরা নবীজিকে হৃদয় থেকে যেভাবে ভালোবাসি, তদ্রুপ আমাদের প্রতিটি কাজে নবীজির সুন্নাহকে অনুসরণ করে বাস্তব অনুসরণের প্রমাণ দিতে হবে। সবশেষে বলি, হে রাসূল, আপনার উপর হাজারো জান কুরবান হোক। যারা নবীজির শানে বেআদবি করে তারা ধ্বংস হোক। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
– ইতি তোমাদের পরিচালক ভাইয়া।
বাবার উপদেশ
– আমীর মুহাম্মদ
আরবের বিখ্যাত পণ্ডিত ‘যুল ইসবা আল-আদওয়ানি’ ছিলেন জাহিলি যুগের অন্যতম কবি। ‘যুল ইসবা’ তার উপনাম। মূল নাম হারসান বিন মুহরিস বিন হারিস আল আদওয়ানি। কথিত আছে তার পায়ে আঙ্গুল ছিলো পাঁচের অধিক। তাই ‘যুল ইসবা’ (আঙুলওয়ালা) নামেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
কবির জীবনসন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। একমাত্র ছেলে উসাইদ বাবার মৃত্যুশয্যায় বসে আছে। অশ্রুতে চোখ তার টলমল করছে। নীরব কান্নায় উসাইদ বাকরুদ্ধ। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে বাবার দীর্ঘশ্বাস। হঠাৎ সচকিত হলো উসাইদ। ‘বাবা!’ ডাক শোনে উসাইদ ঝিম মেরে বসে। বাবা কিছু বলতে চাচ্ছেন। হতে পারে ইহাই বাবার মুখ থেকে শোনা শেষ কথা।
‘উসাইদ, তোমার বাবা আজ জীবন সন্ধিক্ষণে। জানি না আমার জীবনঘণ্টা আর কত সময় স্থায়ী হবে। শোনো বাবা, তোমাকে কয়েকটি কথা বলে যাই। এগুলো মেনে চললে আমার মতোই তোমার জীবন হবে আলোকিত। তোমার ব্যক্তিত্ব হবে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য।’
এ কথাগুলো বলে চোখ মুছে নেন কবি আদওয়ানি। ফের বলতে শুরু করেন, ‘বাবা উসাইদ, তোমার চারপাশের সবার সঙ্গে বিনয়ী এবং নম্র ব্যবহার করবে। সাধারণ জীবনযাপন করবে। নিজের স্বার্থে কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না। ছোটদের স্নেহ করবে। বড়দের করবে সম্মান। গরিবকে দান করবে অকাতরে। হাত ভরে। দুঃস্থের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। শোনাবে সান্ত¡নার বাণী। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। অতিথির কদর ও মূল্যায়ন করবে। তাহলে বাবা উসাইদ, সবাই তোমাকে ভালোবাসবে। মাথায় তুলে রাখবে। তোমার প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে সচেষ্ট থাকবে। এমনকি তোমাকে সকলের নেতা ও মুখপাত্র মেনে নিতেও কারও দ্বিমত ও দ্বিধা হবে না…’।
কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো উসাইদ। থমথমে পরিবেশ। বাবা-ছেলের আবেগঘন ভাব-বিনিময়ে ছেদ পড়লো হঠাৎ। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়লো কবি আদওয়ানির দেহ। ছেলে উসাইদের জন্যে কবি পার্থিব তেমনকিছু রেখে যেতে না পারলেও রেখে গেছেন সুমহান আদর্শ। মানবজীবনে আদর্শের চেয়ে বড় উত্তরাধিকার আর কী হতে পারে!! [একটি আরবি রিসালা থেকে অনূদিত এবং ঈষৎ সংযোজিত]
শিক্ষার্থী: (উচ্চতর দাওয়াহ ও ইরশাদ) আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
রোযনামচা
সকাল আটটার দিকে রওয়ানা হলাম মুহাম্মদপুর। এই একমাসে কোথাও যাওয়া হয়নি। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট, যানজট সবই অজানা। অচেনা-অজানা পথ ধরেই হাঁটা ধরলাম গন্তব্যে। প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে মুহাম্মদপুরের বাস পেলাম।
খুব একটা সময় লাগল না। আসাদ গেইট নেমে সোজা হাঁটা ধরলাম। দশ মিনিটের রাস্তা। মায়েদান রেস্টুরেন্টের লাগোয়া ছোট গলি দিয়ে ঢুকেই সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা ‘জামিয়া কাশিফুল উলূম’ মাদ্রাসা। ওখানেই তারেক পড়ে। এতো কষ্ট করে সকালের ঘুম না ঘুমিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। বড়ভাই ফোন করে বললেন, মাদরাসায় “অভিভাবকদের মিলনমেলা”। পরিবারের একজন থাকা আবশ্যক। ব্যস্ততার কারণে তিনি যেতে পারছেন না।
এই ধুলোবালির শহরে নির্বিঘেœ যাতায়াত প্রায় অসম্ভব। যদিও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না মোটেও। অগত্যা যেতে হলো ভাইয়ার কথা রক্ষার্থে, আর তারেককে এক নজর দেখার আশায়।
অবশেষে দেখা হলো। দীর্ঘ সময় ওর সাথে মাদরাসা সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে কথা হলো। আসর পর্যন্ত ছিলাম সেখানে। অভিভাবক হিসেবে আপ্যায়নেও কোনোরকম কমতি ছিল না। মেহমানদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
‘মিডলাইন’ বাসে করে ফের যাত্রার মোড় ঘুরালাম। রাজধানীর উন্নত এলাকা ‘ধানমন্ডি’ হয়ে রাত আটটার দিকে এসে মাদরাসায় পৌঁছলাম।
– সালাহুদ্দীন খান তাফহীম
মায়েদের সুখ
সেদিন দুপুরবেলায় চারিদিক আঁধার করে আকাশ ভেঙে হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছে। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি। অনেকক্ষণ হলো থামার নাম-গন্ধ নেই। বারান্দায় বসেছিলাম, মাটিতে পালের গরুর ক্ষুর লেগে ধুলি উড়ে যেমন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, বৃষ্টিতে তেমনি আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারিদিক। মাদরাসার উঠানে দীর্ঘক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মা। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পঞ্চম তলায় হেফজখানার বারান্দার দিকে। মাথার উপর ছাতাটা এই মুষলধারা নিরোধ করতে পারছে না কিছুতেই। বৃষ্টির ছাটে গা ভিজে সারাটা ছোপ ছোপ করছে। তবুও অবিচ্ছিন্ন দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটি টিফিনবক্স নিয়ে অখ- নীরব অপেক্ষায়! বৃষ্টিতে না ভিজে আশ্রয় নেয়ার যথেষ্ট জায়গা ছিল নিচের বারান্দায় কিন্তু ততোক্ষণে সোনামণিটা এসে যদি দেখতে না পায়, বোধহয় রাগ করবে তখন।
অনেকক্ষণ পর বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। দূরে কোলাহল শোনা যাচ্ছে ছেলেদের। ক্লাস ছুটি হয়েছে এখন? ওই তো সিঁড়ি ভেঙে বাচ্চারা আসছে একেক করে। ছেলেটা এসে হঠাৎ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল মাকে। মহিলা চমকে উঠলেন! দু হাতে চিবুক তুলে চুমু খেলেন ছেলেকে। সামান্য কী যেন কথা হলো মা-ছেলে দু’জনে। ছেলেটা হয়ত অনুযোগ করে বলেছে, কী দরকার ছিল বৃষ্টিতে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার মা! এখন ঠান্ডা লেগে জ্বর উঠবে তখন বুঝবে মজা! কিন্তু কে বুঝবে যে, সন্তানের অপেক্ষায় বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকাতেই মায়েদের সুখ!
যেতে যেতে হাত উঁচিয়ে বিদায় জানালেন ছেলেকে। বাবু! ফি আমানিল্লাহ্। ছেলেও একইভাবে হাত নেড়ে বিদায় জানাল মাকে। এমন করে রাতে আবার খোলা উঠানে টিফিন হাতে অপেক্ষায় থাকবেন মা। ছেলে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে দুহাতে জড়িয়ে কপালে চুমু খাবেন, আমার সাত রাজার ধন!
প্রতিনিয়ত দিনে তিনবেলা এমন ঘটতেই থাকবে।
ছেলেরা কি মনে রাখবে এসব ‘তুচ্ছ’ ঘটনা!
– আহমাদ তাবিন
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- মাহে রমযান: সিয়াম সাধনা, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
ছোট্ট হাজীর ‘হজ্জ সফরনামা’
২০০৩ সনের কথা। আমার বয়স একেবারে হাতেগোনা পাঁচবছর। সবেমাত্র আমার নূরানীর আঙিনায় বিচরণ শুরু হলো। আমি আলিফ তে আল্লাহ আর বাতে বায়তুল্লাহ বলা একটা ছোট্ট বাচ্চা। বায়তুল্লাহকে কালো গিলাফে আবৃত ঘর ভাবতাম। নুরানীর শিক্ষকগণ বাইতুল্লার কালো গিলাফের প্রতিচ্ছবি আমাদের অন্তরে এঁকে দিয়েছিলেন। দাদু ভাইয়া দুবছর আগে হজ্জের সফর থেকে ফিরে ছিলেন। তিনি আমাদেরকে বায়তুল্লাহ আর মসজিদে নববীর গল্প শুনাতেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাগণের গল্প বলতেন। বুড়িমার কাঁটা বিছিয়ে দেয়া আর অসুস্থ বুড়িমাকে দেখতে যাওয়ার গল্প। বদর, উহুদ, খন্দক ও মক্কা বিজয়ের গল্প। আরো কত্তো ঘটনা শুনাতেন!
আমার ছোট্ট হৃদয়ে নানান কৌতুহল জাগে নবীজির দেশ দেখার। এবছর আমার মনের আকুতি আল্লাহ তাআলা কবুল করলেন। আমাদের পুরো পরিবারকে নিয়ে হজ্জের বরকতময় সফর শুরু হয়। আমার আব্বু-আম্মু আমি ও আমার বড় আপু। সবাই হাটহাজারী বড়মাদরাসায় আমার খালুজান মাওলানা মুহাম্মদ ওমর কাসেমীর কামরায় অবস্থান করছিলাম। আমাদের কাফেলা মাদরাসা থেকে রওয়ানা করে। আমার খালুজানসহ মাদরাসার বেশ কজন উস্তাদ আমাদের হজ্জের সফর সঙ্গী হন। আব্বু আলেম-উলামাকে ভালোবাসেন, তাই তাঁদের সাথে এই মোবারক সফরে যাওয়ার নিয়ত করেন।
মাদরাসার উস্তাদগণ আর আমরা কিছু আমজনতা মিলে মাদরাসার শাহীগেইট থেকে একটি বাসে করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওয়ানা করি। এরপর আকাশ পথের দীর্ঘ সফর শেষে আমরা বায়তুল্ল¬ায় পৌঁছি। আমাদের হোটেলের নীচতলাতে উঠেছিলেন শায়খুল ইসলাম আল্ল¬ামা আহমদ শফী (রহ.) হুজুরের সাথে দেখা করতে আব্বু আমাকে সাথে নিয়ে যান। আমাকে দেখে হুজুর দুআ-কালাম পড়ে ফুঁক দেন। আমাকে তখন থেকে ছোট্ট হাজী ডাকতেন।
আমরা মক্কায় এসে ওমরাহ পালন করে হজ্জের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। আটে যিলহজ্জ আমরা মিনায় চলে যাই। মিনার তাবু ঘর আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। ভাবতাম যদি আমাদের দেশে এরকম কোনো ঘর থাকত। মিনায় সকালের নাস্তার কথা এখনো মনে পড়ে। পাউরুটি, বান দিয়ে মধু আর বাটার। সাথে জনপ্রতি কফি। আব্বু-আম্মু ইবাদাত করতেন। আমি আর আপু খেলা করতাম। শুভ্র ইহরামের কাপড়ে গলা উঁচিয়ে আল্লাহু আকবার বলতাম। ৯ তারিখ আরাফার মাঠে বালি-পাথরের জমিতে অনেক খেলাধুলা করেছি। বিভিন্ন ভ্যানে করে খাবার পানীয় ইত্যাদি নিয়ে আসতো হাজী সাহেবদের মেহমানদারীর জন্য। আমিও সেখান থেকে মিনি লাচ্ছি আর চিপসের থলে নিয়ে আসতাম। তাঁবুতে এসে কাউকে দিতাম না। যদিও এত্তগুলো খাওয়াও আমার জন্য সম্ভব না। তাই প্রায় বড় আপুর সাথে আমার লাগতো।
কুরবানির পর মিনায় থাকাকালীন এক ভদ্রলোক হাজীদের কোল্ড ড্রিংস দিচ্ছিলো। আমিও সুযোগ পেয়ে দুটা নিয়ে নিলাম। আমাদের তাঁবুতে এক ভদ্র মহিলা আমাকে ফুঁসলিয়ে একটা নিতে চাচ্ছিলেন। আমার রাগ উঠায় বোতলের মুখ খুলে উনার মাথায় ঢেলে দিই। পরে যাহওয়ার তাই হলো। অনেক বকাঝকা শুনলাম। তবে হজ্জে প্রাণিকে আঘাত করা নিষেধ। তাই হয়তো আম্মুর মার থেকে পিঠ বেঁচে গেলো। জামরায় পাথর নিক্ষেপের সময় আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো শয়তানকে পাথর মারার। যাতে মানুষকে এই শয়তান আর ডিস্টার্ব না করে। কিন্তু হজ্জে মানুষের অতিরিক্ত ভীড় থাকায় আব্বু আর চাচ্চু ফুফা মিলে আমাদের পক্ষ থেকে তারাই পাথর নিক্ষেপ করেন। আমরা রাস্তার এক পাশে ছায়ায় পাটি বিছিয়ে বসেছিলাম।
হজ্জে সব চেয়ে ভয় ও কষ্টের বিষয় হলো, হারিয়ে যাওয়া। আমার দাদুরা যখন জামরায় পাথর নিক্ষেপ করতে আসেন, তখন দাদাভাই দাদিকে আর আব্বুর ফুফিমাকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরে অনেক কষ্টে তাদের পেয়েছিলেন। তাই আমরা একটা জায়গায় গেড়ে বসেছিলাম। জামরার কাজ শেষে আমরা তাওয়াফে যিয়ারাহ এর জন্য মক্কায় আসি। হাজী সাহেবদের প্রচুর ভিড়ে আমরা চাচ্চুর কাঁধে চড়ে তাওয়াফ করি। তখন খাটিয়া করে অনেক বয়োবৃদ্ধকে তাওয়াফ করাতে দেখেছিলাম। এগুলো এখন আর চোখে পড়ে না। আব্বু কুরবানি করতে আমাদের চারজনের জন্য চারটা বকরি নেন। তারপর যবাইয়ের স্থানে নিয়ে যবাই করে রেখে আসেন। কুরবানির যবাইকৃত পশুগুলো সৌদি সরকার প্যাকেজিং করে গরিবদের মাঝে বিতরণ করে দেয়।
মিনায় আমরা তিনদিন অবস্থানের পর মক্কায় আমাদের হোটেলে ফিরে আসি। তারপর আব্বু-আম্মুর সাথে মসজিদুল হারামে ইহরাম ছাড়া বায়তুল্লার চত্বরে দৌড়াদৌড়ি করি। হোটেলে আসা-যাওয়ার পথে কবুতর চত্বর আমার অনেক প্রিয় ছিলো। সেখানে আসলে ইয়া দৌড় দিতাম। আর কবুতরও আমার সাথে উড়ে যেতো। সবার সাথে গম দিতাম। তবে আইসক্রীমের দোকান আর খেলনার দোকানের সাথে আব্বু-আম্মুকে সেই প্যারা দিতাম। মক্কায় আমাদের সময়শেষ হয়ে আসছিলো।
বিদায়ী তাওয়াফ করে আমরা কাফেলার সাথে মদিনায় চলে যায়। মদিনাতুর রাসূলে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। হসপিটালের বেডে আমার চার/পাঁচ দিন সময় কেটে যাই। এসময় আমি একপ্রকার মৃত্যুশয্যার মতো হয়ে যায়। এরপর আল্লাহ তাআলা সুস্থতা দান করেন। আমার আম্মু মদিনায় অবস্থান করেও মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করতে না পারায় খুব আফসোস করতেন। আমার খালু মাওলানা মুহাম্মদ ওমর সাহেব এসে আম্মুকে সান্ত¡না দেন। আর অসুস্থ ছেলের সেবা করার ফজীলত বলেন। হসপিটালের স্মৃতি ছাড়া মদিনার আর কোনো স্মৃতি আমার স্মরণে নেই। দুআ করি আল্লাহ তাআলা যেনো আমাকে আবার এসব পবিত্র জায়গায় নিয়ে যান।
– তামীরুল ইসলাম
নিয়ন্ত্রণহীন রাগ কখনো ভালো নয়…!
রাগ হলো মানবচরিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ, জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য বিষয়। বিরক্তি, অসন্তুষ্টি বা বিরোধিতার তিক্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশই হলো মানুষের রাগ। এই অনুভূতি সবার মাঝে বিদ্যমান। তাই রাগ ছাড়া মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রায় সবার রাগ আছে। সকলেই রাগান্বিত হয়।
রাগ বিষয়টা নিন্দনীয়। তবে ব্যাপকভাবে সব রাগ নিন্দনীয় নয়; বরং কিছু ক্ষেত্রে রাগ শুধু বৈধই নয়; প্রশংসনীয়ও বটে। যেমন একজন মুসলমান যখন দেখে, আল্লাহ তাআলার নাফরমানী হচ্ছে, দ্বীন ইসলাম বা নবীজির অবমাননা হচ্ছে, অন্যায়ভাবে কোন মুসলিমের উপর জুলুম হচ্ছে। তখন সে ক্রুদ্ধ ও রাগান্বিত হবে, এটাই তার ঈমানের দাবি।
এক্ষেত্রে রাগ নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। ক্ষেত্র বিশেষে রাগের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সামগ্রিক দৃষ্টিতে রাগ কিন্তু ভালো গুণ নয়। দীর্ঘদিনের তিলে তিলে গড়ে তোলা অর্জন অপরিণামদর্শী রাগের কারণে নিমিষেই ধ্বসে পড়ে। রাগ মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে। রাগ জ্ঞান, বিবেক ও দ্বীনের পথ থেকে বিচ্যুত করে মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। রাগের কারণে নিজের সুখ ও সফলতা বিনষ্ট হয়ে জীবনে নেমে আসে কঠিন বিপর্যয়। স্বপ্নময়সাজানো জীবনকে কলুষিত করে তিমিরাচ্ছন্ন জীবনে পরিণত করে। রাগের ফলে অন্তর্দহন সাময়িক সময়ের জন্য নির্বাপিত হলেও পরিণতিতে চিরস্থায়ী লাঞ্ছনা ও অনুশোচনার শিকার হতে হয়।
চারপাশে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাবো, মানুষের পরস্পরের ঝগড়া-বিবাদ মারামারি হানাহানির পেছনে অনেকটা নিয়ন্ত্রনহীন রাগই ছিল মূল কারণ। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে রাগের বশবর্তী হয়ে সাত-পাঁচ না ভেবে মানুষ এমন কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। রাগে অগ্নিশর্মা হয়েই তো খুনি হত্যাকা- ঘটায়। স্বামী হুট করে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে সংসার জীবনের ইতি টানে। অনুগত সন্তান অবাধ্য হয়ে গলায় ফাঁস পর্যন্ত দেয়। এসবই রাগের ক্ষতি আর পরিণতি।
ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন, সবখানে নিষ্কলুষ জীবন-যাপন করতে হলে আমাদের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। রাগের আগুন নির্বাপিত করে মানুষকে ক্ষমার চাদরে আবৃত করতে হবে। তাহলে আল্লাহ তাআলা ও আপনাকে ক্ষমা করে রহমতের চাদরে ঢেকে নিবেন। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে আসো, যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য। যারা স্বচ্ছলতা এবং অভাবের সময় ব্যয় করে,যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে। বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান আয়াত- ১৩৪)
রাগ নিয়ন্ত্রণ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে। যে ব্যক্তি রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সে আধ্যাত্মিক ও জাগতিকভাবে পুরস্কৃত হয় এবং আত্মতৃপ্তি লাভ করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি চরিতার্থ থাকা থাকা সত্ত্বেও ক্রোধ সংবরণ করে, আল্লাহ তাআলা তাকে কেয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যেকোনো হুর বেছে নেয়ার অধিকার দিবেন। (ইবনে মাজাহ- ৪১৮৪)।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে প্রতিদান রয়েছে তা অন্য কোন কিছুতে নেই।( ইবনে মাজাহ- ৪১৮৯)
অন্য এক হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে, শয়তানকে তৈরি করা হয়েছে আগুন থেকে। আর একমাত্র পানি দ্বারাই আগুন নেভানো সম্ভব। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রাগান্বিত হয়, সে যেন তৎক্ষণাৎ ওজু করে। (আবু দাউদ)
রাগকে সর্বদা নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হবে। লাঞ্ছনা, অনুশোচনা, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক অনেক ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। তাই রাগ পশমিত করে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করি।
– মুহাম্মদ ইরশাদুল্লাহ
ছড়া: আমরা শিশু
– তাফাজ্জুল শফিক
আমরা শিশু, আমরা কচি
করছি আজ এই পণ।
সাহাবীদের ন্যায় গড়বো মোরা
মোদের এই জীবন।
হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যাবো
থাকবো সবাই মিশে,
সুখশান্তির সবটুকুই
আসবে তবে দেশে।
আমরা কলি, ফুল হবো
আর ছড়াবো ঘ্রাণ।
শিক্ষা নিয়ে উঠবো বেড়ে
রাখবো দেশের মান।
আল্লাহর বিধান করবো পালন
রাখবো তাঁকে খুশি।
তিনি রাজি থাকলে পরে
সুখ পাবো অহর্ণিশি।
সৌভাগ্যবান শিশু…
২১ হিজরীতে মদীনা শহরে এক বাচ্চার জন্ম হয়। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)এর খেলাফতের তখনো শেষ দুই বছর অবশিষ্ট আছে। বাচ্চার মা ছিলেন হযরত উম্মে সালমা রাযি. এর বাঁদি। উম্মে সালমার এই বাঁদি যখন নিজের কাজ করার জন্য যেতেন, তখন এই বাচ্চাটি কান্না করলে, উম্মে সালমা রাদি. তাকে কোলে নিতেন। এভাবে বাচ্চাটি উম্মে সালমা স্নেহ ও আদরের ছায়ায় পালিত হতে লাগল। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য স্ত্রীগণের ঘরেও এই বাচ্চা আসা যাওয়া করতে লাগল।
হযরত উসমান ইবনু আফফানের শাসনামলে এই বাচ্চা ১৪ বছর বয়সে পৌঁছে গেল। তখনো তার উম্মুল মুমিনীনদের ঘরে আসা যাওয়া ছিল। সেসময় সাহাবাগণের বড় একটি সংখ্যা মদীনায় অবস্থান করতেন। বড় বড় বুজুর্গ সাহাবীদের সাহচর্যে ধন্য হলো সেই বাচ্চাটি। ইসলামী শিক্ষার এক সোনালি যুগ ছিল তখন। ইসলামী শিক্ষা অর্জন করে সেই বাচ্চা নিজের বাহুকে সমৃদ্ধ করে নিল।
তোমরা হয়ত চিন্তা করছ, সেই শিশুটি কে? তার নাম কী ছিল?
তাহলে জেনে রাখো, সেই শিশুর নাম হাসান বসরী (রহ.)। আমরা তার কথাই বলছি। তিনি কুরআন কারীমের ইলম অর্জন করেছিলেন। ইলমে হাদীসে তিনি ছিলেন এক কূলহীন সাগরের মতো। তাঁর শিষ্য সংখ্যা ছিল অগণিত। তিনি ফিকহের ইমাম ছিলেন। ইরাকের বসরা শহরের প্রধান মুফতি ছিলেন। কাতাদাহ (রহ.) বলেন, হযরত হাসান বসরী (রহ.) হালাল-হারাম বিষয়ে সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন। তিনি হযরত আলী (রাযি.) থেকেও ইলম অর্জন করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন। আমাদেরকে তাঁর মতো হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
– আহমদ আব্দুল্লাহ
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/