।। শায়খুল হাদীস আল্লামা শেখ আহমদ ।।
নামাযের প্রকৃত স্বাদ ও ফযীলত পেতে হলে খুশুখুযূ খুবই জরুরি। খুশুখুযূর সাথে নামায পড়ার অর্থ হলো, নামাযী ব্যক্তি নিজের সম্মুখে মহান আল্লাহকে হাযির নাযির কল্পনা করে এমনভাবে নামায আদায় করবে যে, তার হৃদয় থাকবে আল্লাহর প্রেম ও ভালবাসায় ভরপুর এবং তাঁর প্রতি ভয়, তাঁর বড়ত্বের চিন্তায় বিগলিত। কোন অপরাধী আসামী বিজ্ঞ কোন বিচারক বা সম্রাটের সামনে যেভাবে দাঁড়ায়, নামাযী ব্যক্তি তার নামাযে ঠিক এভাবেই দাঁড়াবে।
দাঁড়ানো অবস্থায় নামাযী মনে মনে ভাববে যে, আমি আল্লাহর সম্মুখে দ-ায়মান এবং আমি তাঁরই প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি। এভাবে রুকূতে গিয়ে সে চিন্তা করবে যে, আমি কেবল আল্লাহ তাআলার সম্মুখেই আমার মস্তক ঝুঁকিয়ে দিচ্ছি। এমনিভাবে সিজদায় সে ভাববে যে, আমি আল্লাহর সামনেই সিজদাবনত হচ্ছি, তাঁরই সামনে নিজের সকল অনুনয় বিনয় প্রকাশ করছি। উত্তম হলো, নামাযে যেসব সূরা কিরাত ও তাসবীহ পাঠ করা হয়, তার অর্থ বুঝে পাঠ করা।
বস্তুত নামাযের প্রকৃত স্বাদ তখনই পুরোপুরিভাবে লাভ করা যায়, যখন নামাযী নিজের পঠিত কথা ও বাক্যগুলোর অর্থ বুঝে বুঝে পাঠ করে। নামাযের মধ্যে খুশুখুযূ রক্ষা করা এবং আল্লাহর দিকে অন্তর্দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে একাগ্রচিত্তে মনোযোগী হওয়াই নামাযের প্রাণ এবং নামাযের মূল রূহ। আল্লাহর যে বান্দা এ রূহ সমৃদ্ধ নামায পড়তে সচেষ্ট থাকেন, পারলৌকিক জীবনে তার নাজাত ও সমূহ সফলতা অর্জন অবশ্যম্ভাবী।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- “সফল ও স্বার্থক সে সকল মু’মিন বান্দারা যারা নিজেদের নামাযগুলোতে খুশুখুযূ রক্ষা করে আদায় করে”। (সূরা মু’মিনূন- ১০২)।
একটি হাদীসে প্রিয়নবী (সা.) বলেন, “আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি এ নামায আদায়ের লক্ষ্যে ভালোভাবে অযূ করে, যথাসময়ে নামায পড়ার জন্য দাঁড়ায়, রুকূ, সিজদা যথাযথভাবে আদায় করে, তার জন্য আল্লাহ তাআলা অঙ্গীকার করেন যে, তিনি তাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর যে ব্যক্তির নামায এই মানের হয় না, তার জন্য আল্লাহর কোন অঙ্গীকার নেই। ইচ্ছে করলে ক্ষমা করতে পারেন এবং ইচ্ছে করলে ক্ষমা না করে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন”।
পরকালের আযাব ও শাস্তি থেকে মুক্তি ও নিরাপত্তা পেতে হলে বর্ণিত হাদীসের মর্মার্থ অনুযায়ী পাঁচ ওয়াক্ত নামায ভালোভাবে খুশুখুযূ’র সাথে সুন্নাত তরীকায় আদায় করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।
বেনামাযীদের কতিপয় অজুহাত
অনেক মুসলমান নামায পড়েন না। কারণ জিজ্ঞেস করলে বিভিন্ন ধরনের অজুহাত, ওযর-আপত্তি দেখিয়ে থাকেন। যেমন, সমাজের নেতৃত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, অসুখ-বিসুখ ইত্যাদি।
যারা সমাজের নেতৃত্ব বা সাম্রাজ্যের কারণে নামাযে অলসতা করেছেন, কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলার সামনে তারা উযর পেশ করে বলবেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে নেতৃত্ব বা হুকুমত দিয়েছিলে। সে কাজে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে, মাথা হেলানোরও সময় পাইনি। আবার নামায পড়ব কিভাবে?
তখন আল্লাহ তাআলা হযরত দাঊদ ও হযরত সুলাইমান (আ.)কে ডেকে পাঠাবেন। তাঁরা দরবারে উপস্থিত হলে বেনামাযীকে বলবেন, দেখ, এরা দু’জন বাদশাহ ছিলেন। এদের সাম্রাজ্য তোমার হতে বেশি বিস্তৃত ছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এঁরা কখনও নামায পরিত্যাগ করেননি। সুতরাং তুমি মিথ্যা বলছ। নেতৃত্ব আর সাম্রাজ্যই যদি নামায পড়ায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াত, তাহলে এরাও নামায পড়তে পারতেন না। তুমি বরং গাফলতী, অলসতা ও উদাসীনতার কারণে নামায পড়েনি। হে ফেরেশতারা! যাও, একে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো।
আরেকজন আসবেন অসুস্থতার ওযর নিয়ে। বলবেন, হে খোদা! আমি অসুস্থ ছিলাম। কষ্টের কারণে নামায পড়তে পারিনি। তখন আল্লাহ তাআলা হযরত আইয়ুব (আ.)কে উপস্থিত করে উক্ত বেনামাযীকে বলবেন, বলতো! তুমি বেশি অসুস্থ ছিলে, না আমার আইয়ুব বেশি অসুস্থ ছিল?
বছরের পর বছর ধরে তাঁর পুরো শরীরে কিড়া লেগেছিল। সারা শরীর ঘায়ে দগদগ করত। কিন্তু তিনি তো এক মুহূর্তের জন্যও আমার স্মরণ থেকে গাফেল হননি। অসুস্থতাই যদি আমার স্মরণ থেকে বাঁধা হয়ে দাঁড়াত, তাহলে আমার আইয়ুবের জন্যও বাধা হয়ে দাঁড়াত। সুতরাং তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি বরং অলসতা ও উদাসীনতার কারণে নামায পড়েনি। ফেরেশতারা! যাও, একে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো।
অন্য একজনকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি নামায পড়োনি কেন? উত্তরে সে বলবে, হে আল্লাহ! আমার সন্তান-সন্ততি ছিল অনেক। তাদের খেদমত ও জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করতে করতে দিন কেটে যেত। নামাযের সময় পেলাম কোথায়? তখন আল্লাহ তাআলা হযরত ইয়াকুব (আ.)কে ডেকে পাঠাবেন। তিনি দরবারে উপস্থিত হলে তাঁকে দেখিয়ে আল্লাহ বলবেন, তোমার সন্তান-সন্ততি বেশি ছিল, না আমার ইয়াকুবের বেশি ছিল? তুমি সন্তানের চিন্তায় চিন্তিত ছিলে আর আমার ইয়াকুব ইউসুফ (আ.)এর বিরহে বছরের পর বছর কেঁদে কেঁদে দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন। বার্ধক্যের কারণে কোমর বাঁকা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও নামায থেকে গাফেল হননি। হে ফেরেশতারা! যাও, একেও নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো।
আরও পড়তে পারেন-
পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
একজন বেনামাযী মহিলা আদালতে ইলাহীতে উপস্থিত হবেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি নামায পড়নি কেন? জবাবে মহিলা বলবেন, হে খোদা! আমার স্বামীর কাজ করতে করতে নামাযের সুযোগ পাইনি এবং তার ভয়ে এই ফরয দায়িত্ব আদায় করতে পারিনি। তখন হযরত আসিয়াকে ডেকে পাঠানো হবে। হযরত আসিয়া দরবারে উপস্থিত হলে আল্লাহ তাআলা ঐ বেনামাযী মহিলাকে বলবেন, তোমার স্বামী বেশি যালিম ছিল, না আসিয়ার স্বামী ফিরআঊন বেশি যালিম ছিল? মহিলা বলবেন, হে আল্লাহ, ফিরআঊন বেশি যালিম ছিল। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, দেখ, আসিয়া এমন যালিম, অত্যাচারী নরাধমের স্ত্রী হয়েও কেমন ইবাদতকারীনী ছিলেন। কোন স্বামীর অত্যাচারই যদি নামাযের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াত, তাহলে হযরত আসিয়ার জন্য অবশ্যই বাঁধা হয়ে দাঁড়াত।
হে বেনামাযী! স্বামীর যুলুম- এটা তোমার মিথ্যা বাহানা। আসলে তুমি নিজেই ছিলে গাফেল। তোমার গাফলতী আর অসলতার কারণে তুমি নামায পড়নি। ফেরেশতারা! যাও, একে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো।
সুতরাং বুঝা গেল যে, কোন অজুহাত বা বাহানায় নামায পরিত্যাগ করার অবকাশ নেই।
উপসংহারঃ নামাযের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রভাব ও কার্যকারিতা বিদ্যমান। কেউ যদি যথাযথভাবে নামায আদায় করে এবং আল্লাহকে হাযির নাযির জেনে পূর্ণ ধ্যান ও বিনয় সহকারে নামায পড়ে, তাহলে এ নামাযের ফলে তাঁর অন্তরাত্মা পরিচ্ছন্ন হতে থাকে। তার অন্তর ইলাহী নূরের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হতে থাকে ক্রমান্বয়ে। তার জীবনযাত্রা হতে থাকে সঠিক ও মার্জিত। যাবতীয় দোষত্রুটি তার জীবন থেকে বিদূরিত হতে থাকে। অন্তরে সততা ও সদাচারের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হতে থাকে, জন্ম নিতে থাকে আল্লাহর ভয় ও তাকওয়া। এক সময় তার গোটা জীবনধারা সকল পাপাচার ও অবাধ্যতার ময়লা থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নির্মল-নিষ্কলুষ হয়ে যায়।
হযরত রাসূলে কারীম (সা.) একটি সুন্দর উপমা দ্বারা বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন, “আচ্ছা বলো তো! তোমাদের কারো বাড়ীর পাশে যদি কোন নদী থাকে আর তাতে সেই ব্যক্তি দৈনিক পাঁচবার গোসল করে, তাহলে তার দেহে কোন প্রকার ময়লা থাকবে কি? লোকজন উত্তরে বললেন, কোন রকম ময়লাই থাকতে পারে না। তখন প্রিয়নবী (সা.) বল্লেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের উদাহরণ এরূপই। আল্লাহ তাআলা এই নামাযসমূহের বরকতে মানুষের গুনাহসমূহকে এভাবেই মিটিয়ে দেন।”
একারণেই ইসলামে যাবতীয় ফরয ইবাদতগুলোর মধ্যে নামাযের প্রতিই অধিক তাকীদ করা হয়েছে। যখনই কোন ব্যক্তি মহানবী (সা.)এর কাছে এসে ইসলাম কবুল করত, তখনই তিনি তাকে একত্ববাদের শিক্ষাদানের পর সর্বপ্রথম নামায আদায় করার উপর অঙ্গীকার গ্রহণ করাতেন।
এ পৃথিবীতে আগমনের পূর্বে রূহের জগতে মানুষ স্বীয় স্রষ্টা ও মালিকের কাছে একথার অঙ্গিকার করেছিল যে, আপনিই আমার প্রভু। আর মৃত্যুর পর কবরেও তাকে প্রশ্ন করা হবে যে, বল, কে ছিলো তোমার প্রভু? নামায এই অঙ্গীকার ও বিশ্বাসকে জীবন্ত রাখে এবং দুনিয়াতে খোদা প্রদত্ত বিধানাবলীর প্রতি লক্ষ্য রেখে জীবন যাপন করার শক্তি যোগায়।
নামাযই একমাত্র এমন প্রিয় ও নূরানী ইবাদত, যা তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে প্রকৃত সফলতার অধিকারী বানায়, জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করে এবং জান্নাতে প্রবেশ করায়।
বস্তুত যাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে-ই প্রকৃত সফলকাম। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যুর স্বাদ। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই হবে সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ধোঁকার সামগ্রী বৈ কিছু নয়।” (সূরা আলে ইমরান- ১৮৫ আয়াত)।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রকৃত সফলতা অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন॥
লেখকঃ প্রখ্যাত আলেমে-দ্বীন ও শায়খুল হাদীস, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/