নামায ত্যাগ করার পরিণাম

।। শায়খুল হাদীস আল্লামা শেখ আহমদ ।।

পবিত্র হাদীসের আলোকে জানা যায় যে, মহানবী (সা.) নামায না পড়াকে কুফ্রী এবং কাফিরদের নীতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি নামায পড়ে না, দ্বীন ইসলামে তার কোন অংশ নেই”।
সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে বর্ণিত আছে যে, ইসলাম ও কুফরির মাঝে ব্যবধান হল নামায। অর্থাৎ কোন মানুষ যদি নামায পরিত্যাগ করে তাহলে কার্যত, সে কাফির দলের সঙ্গে মিশে গেল এবং তার এ কাজটি কাফিরদের কাজের মতই হল। অপর একটি হাদীসে আছে, “ইসলামে সে ব্যক্তির জন্য কোন অংশ নেই যে নামায পড়ে না”।

নামায যে কত বড় সম্পদ এবং কত বড় সৌভাগ্যের বিষয়, আর নামায না পড়া যে কত বড় ক্ষতি ও দুর্ভাগ্যের বিষয়; তা ভালভাবে অনুধাবন করার জন্য প্রিয়নবী (সা.)এর নি¤েœাক্ত হাদীসটির প্রতি লক্ষ করুন।

একদা রাসূল (সা.) নামায পড়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করে ইরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি যথাযথভাবে নিয়মিত নামায আদায় করবে, কিয়ামত দিবসে তার জন্য এ নামায একটি নূরের আকার ধারণ করবে, তার পক্ষে দলীলের কাজ দেবে এবং তার নাজাতের উসীলা হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি যথাযথভাবে মনোযোগ সহকারে নিয়মিত নামায পড়বে না, কিয়ামত দিবসে তার জন্য নূরের কোন ব্যবস্থা থাকবে না, তার পক্ষ সমর্থনে কোন দলীল থাকবে না। তার নাজাতের কোন উসীলাও থাকবে না। অধিকন্তু পরকালে কারুন, হামান, ফিরাউন, উবাই ইব্নে খাল্ফ প্রমুখের সঙ্গে তার হাশর হবে”।

সুতরাং আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা দরকার, যদি আমরা ভালভাবে নিয়মিত নামায পড়ার অভ্যাস না করি, তাহলে আমাদের আখিরাত, আমাদের হাশর ও শেষ পরিণাম কী হবে।

বেনামাযী লোকেরা কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে কঠিন শাস্তি ও অপমানের সম্মুখীন হবে, তা পবিত্র কুরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে-

“গোছা পর্যন্ত পা খোলার (সঙ্কটময়) দিনের কথা স্মরণ কর, সেদিন তাদেরকে সিজদা করতে আহ্বান জানানো হবে, অতঃপর তারা সক্ষম হবে না। তাদের দৃষ্টি অবনত থাকবে, তারা লাঞ্ছনাগ্রস্ত হবে। অথচ যখন তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল, তখন তাদেরকে সিজদা করতে আহ্বান জানানো হতো।” (সূরা ক্বলম- ৪২, ৪৩)।

আলোচ্য আয়াতের সারকথা হল, কিয়ামতের সে কঠিন দিনে যখন জগতের সর্বকালের সকল মানুষ একই মুহূর্তে একই ময়দানে সমবেত থাকবে, তখন আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ তাজাল্লী প্রকাশিত হবে। আর সে সময় উচ্চঃস্বরে ঘোষণা দেওয়া হবে যে, তোমরা সকলে আল্লাহ তাআলার সামনে সরাসরি সিজদায় লুটিয়ে পড়। তখন যেসব ভাগ্যবান মুসলমান দুনিয়ায় নামায আদায়ে অভ্যস্ত ছিলেন এবং আল্লাহকে সিজদা করতেন, তারা অদৃশ্যের এ ঘোষণা মতে আল্লাহর কুদরতি পায়ের উপর সিজদা দিবেন।

আরও পড়তে পারেন-

আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
মুমিন জীবনে নামাযের গুরুত্ব
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি

পক্ষান্তরে যারা সুস্থ, সবল ও হৃষ্টপুষ্ট দেহের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ায় নামায পড়তো না, সে দিন তাদের কোমরগুলো সোজা কাষ্ঠ খ-ের মত শক্ত ও কঠিন করে দেওয়া হবে। ফলতঃ এদেরকে কাফিরদেরই ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সেদিন তারা মহান আল্লাহর কুদরতী পায়ের উপর সিজদা দানের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকবে। ইত্যবসরে কঠিন অপমান ও মারাত্মক লাঞ্ছনাজনক আযাব তাদেরকে ঘিরে নিবে। সেদিন তাদের দৃষ্টি নুইয়ে পড়বে এবং চোখ তুলে কোন কিছু দেখার মত শক্তি থাকবে না। দোযখের আযাব শুরু হওয়ার পূর্বে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার এ আযাব ময়দানে হাশরের সূচনালগ্নেই আপতিত হবে।

বস্তুতঃ বেনামাযী মানুষ আল্লাহদ্রোহী শয়তানের পতাকা উত্তোলনকারী। কাজেই এহেন বিদ্রোহজনিত অপরাধে তাকে যতই অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হোক না কেন আর যতই কঠিন শাস্তিতে তাকে নিক্ষেপ করা হোক না কেন, নিঃসন্দেহে বেনামাযী এসবের পুরো হকদার এবং উপযুক্ত।

মুজতাহিদ কতিপয় আলেমগণের মতানুসারে বেনামাযী লোকেরা দ্বীনের গ-িবহির্ভুত। তারা ধর্মত্যাগীর ন্যায়ই মৃত্যুদ- পাওয়ার উপযুক্ত। সুতরাং আমাদের সকলকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা দরকার যে, নামায পড়া ব্যতিরেকে নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করা একটি মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও যুক্তিহীন কথা বৈ কিছু নয়। বস্তুতঃ নামাযের মাধ্যমেই আল্লাহর সাথে বান্দার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। ফলে সে আল্লাহর রহমত, বরকত ও কল্যাণ লাভে ধন্য হয়।

জামাআতে নামায পড়ার তাকীদ ও ফযীলত

হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)এর হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, নামাযের প্রকৃত ফযীলত ও বরকত অর্জন করার পূর্ব শর্ত হল, নামায জামাআতের সাথে আদায় করা। জামাআতে নামায পড়ার বিষয়টি শরীয়তে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, যারা অলসতা বা উদাসীনতার কারণে জামাআতে এসে শরীক হয় না, তাদের ব্যাপারে একবার প্রিয়নবী (সা.) বলেন, “আমার মন চায় এসব লোকদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিই”।

বর্ণিত হাদীস থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, জামাআত পরিত্যাগ করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দৃষ্টিতে কতটা অপছন্দনীয়।

অপর এক সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে, জামাআতের সাথে নামায পড়ার সাওয়াব একাকী নামায পড়া অপেক্ষা ২৭ গুণ বেশি। নিয়মিত জামাআতের সাথে নামায আদায় করার ফলে পারলৌকিক কল্যাণ ও সাওয়াব অর্জন ছাড়াও আরো অনেক উপকার এতে বিদ্যমান।

যেমন, নিয়মিত জামাআতের সাথে নামায আদায় করার ফলে নামাযী ব্যক্তির মধ্যে সময়ের নিয়মানুবর্তিতা রক্ষার সুন্দর এক যোগ্যতা গড়ে উঠে। জামাআতের পাবন্দী করার দ্বারা নামাযের উপর দৃঢ়তা ও পাবন্দী লাভ করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যারা জামাআতের প্রতি তোয়াক্কা করে না, তাদের অধিকাংশকে দেখা যায় যে, তাদের অনেক নামায ছুটে যায় কিংবা কাযা হয়ে যায়।

জামাআতের সাথে নামায আদায়ের সবচেয়ে বড় ফযীলত হল, জামাআতের সাথে নামায আদায়কারীদের প্রত্যেকের নামায সে জামাআতের একটি অংশ বলে পরিগণিত হয়। আর একথা নিশ্চিত যে, জামাআতের মধ্যে সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও ভাল মানুষ উপস্থিত থাকেন। যার নামায উন্নত মানের ‘খুশুখুযূ’ সমৃদ্ধ, তার নামায আল্লাহর কাছে গৃহিত হয় এবং নিষ্ফল হয় না। তাই আল্লাহ তাআলার করুণাময় তার শান থেকে এ আশা মোটেই অবান্তর নয় যে, তিনি যখন জামাআতের কতিপয় মানুষের নামাযকে কবুল করবেন, তখন তাদের সাথে সাথে অন্যদের নামাযও কবুল করে নিবেন। অতএব আমাদের প্রত্যেকের একটু ভেবে দেখা উচিৎ যে, নামাযের জামাআত পরিত্যাগ করতঃ আমরা কতখানি বরকত থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

জামাআতে নামায ও সামাজিক সংহতি

একাকিত্ব মানব জীবনের জন্য মৃত্যুতুল্য। যে ব্যক্তি একাকী জীবন যাপন করে, সে ইসলামী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং কারো নসীহত শ্রবণ করার সুযোগ তার হয় না। যার কারণে শয়তান তার উপর সহজে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই তাকে গোমরাহ করে ফেলে।

মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, শয়তান মানুষের জন্য বাঘ সমতুল্য। বাঘ ঐসকল ছাগল ও ভেড়াকে ছিনিয়ে নেয়, যারা পাল থেকে দূরে থাকে। এমনিভাবে শয়তান ঐসকল লোকদেরকে সৎপথ থেকে সরিয়ে নেয়, যারা জামাআত বহির্ভূত থাকে। এজন্য তোমরা মুসলমানদের বড় জামাআতের সংগে থাকবে এবং নিয়মিত মসজিদে উপস্থিত থাকবে।

নামায দ্বারা আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতির সকল শ্রেণীর লোকদের একে অপরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। শাসককে শাসিতের সাথে, ধনীকে গরিবের সাথে, ছোটকে বড়র সাথে, বিদেশীকে দেশীর সাথে।

মসজিদে নামায পড়ার দ্বারা মুসলমানদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক মুসলমান তার পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে আলাপ করে বা সাক্ষাত করে তার অবস্থা ও সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারে এবং তাকে সাহায্য-সহযোগিতা ও সমবেদনা প্রকাশ করতে পারে।

ইসলাম বিশ্বধর্ম। আল্লাহ তাআলা মানব কল্যাণের উপর এর ভিত্তি রেখেছেন। যাতে এর অনুসারীরা শৃঙ্খলার সাথে সংঘবদ্ধ হয় এবং প্রশস্ত অন্তর, উদার মানসিকতা ও ধৈর্য-সহিষ্ণুতার গুণে গুণান্বিত হতে পারে। মুসলিম জাতির মাঝে এসকল গুণাবলী সৃষ্টি করা এবং স্থায়ী রাখার জন্য এমনভাবে জামাআতের সাথে নামায আদায় করা হয়, যাতে ধনী-গরীব, ছোট-বড় সকল শ্রেণী এক ইমামের পেছনে কাতারবন্দী হয়ে তার নেতৃত্বে নামায আদায় করে থাকে।

এভাবে জামাআতে নামায আদায়ের দ্বারা একদিকে যেমন ঐক্য ও সংঘবদ্ধ জীবন স্পন্দন সৃষ্টি হয়, অপরদিকে তেমনিভাবে ফুটে উঠে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও সমতার সহজ সরল ও চিত্তাকর্ষক দৃশ্য- এক কাতারে শামিল শাসক-শাসিত, ধনী-দরিদ্র, বৃদ্ধ-যুবক, শেখ-সৈয়দ ও পাঠান সকলেই দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে!

এর দ্বারা নিজের বড়ত্ব নিঃশেষ হয়ে একমাত্র আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব প্রকাশ পায় এবং তাঁর ঘোষণা “সকল মু’মিন ভাই ভাই”-এর বাস্তব রূপের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। অনেক নিষ্ঠাবান ও নিরপেক্ষ মানসিকতার অধিকারী অমুসলিমও জামাআতের সাথে নামায আদায়ের জীবন্ত চিত্র দেখে ইসলামের সত্যতাকে স্বীকার করে নেয়।

লেখক: প্রখ্যাত আলেমে-দ্বীন ও শায়খুল হাদীস, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।