।। মুনির হাসান ।।
মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সা.)কে এই পৃথিবীতে শান্তির বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি পরিবার, সমাজ ও দেশের সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন চেষ্টা-সাধনা করে গেছেন। আর এক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফলও হয়েছেন। তৎকালীন আরবে অবহেলিত ও নিষ্পেষিত নারীদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। আল্লাহ তাআলার কাছে নারী ও পুরুষের মর্যাদা নির্ধারণে আমলই বিবেচিত হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের কর্মনিষ্ঠ কোন ব্যক্তির কর্মকে বিনষ্ট করব না, সে পুরুষ হোক বা নারী’। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত- ১৯৫)।
এই আয়াত থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আমলের দিক থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সবাই সমান। সে পুরুষ হোক বা নারী, তাতে কিছু যায় আসে না।
নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। সর্বত্রই নারীরা আজ নির্যাতিত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই নারী নির্যাতনের সংবাদ পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই। যৌতুকের দায়ে নারীকে হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, চুল কেটে ফেলা, টুকরো টুকরো করে লাশ ফেলে দেয়ার খবরে এখন আর কেউ কান দেয় না। সবাই জানে, এসব এখন নিয়মিত ঘটনা। এ ছাড়া নারীরা তো প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেই। নারীরা যেন আজ কোথাও নিরাপদ নয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারীরা যেন এক মহা আতঙ্কে দিনাতিপাত করে। ইসলাম একজন নারীকে যে কী পরিমান উচ্চ মর্যাদা দান করেছে, আজ তা সবাই ভুলতে বসেছে। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে নারীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তাতে মনে হয় আমরা আবার সেই আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে প্রবেশ করেছি।
একটু চিন্তা করুন, ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীর মর্যাদা কেমন ছিল। পুরুষরা নারীদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করত। রাতের বেলায় নারী, মদ ও গান-বাদ্যের মহোৎসব বসত। সে যুগে কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়াকে তারা অমর্যাদাকর ও চরম লজ্জাস্কর মনে করত। নারীকে অস্থাবর সম্পত্তি জ্ঞান করত। তাদের অধিকার বলতে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। কিন্তু মানবতার মুক্তির দূত, নবীকূল শিরোমণি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর আবির্ভাবে নারীরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা লাভ করে। তাঁর (সা.) প্রতি অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ আসমানী গ্রন্থ কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা শিক্ষা দিলেন, ‘তারা তোমাদের জন্য এক প্রকারের পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য এক প্রকারের পোশাক’। (সূরা বাকারা- ১৮৭)।
এখন দেখুন, পোশাকের কাজ কি? পোশাকের কাজ হচ্ছে নগ্নতাকে ঢেকে দেয়া। তাই আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, তোমরা স্বামী-স্ত্রী অবশ্যই একে অপরের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে। কেননা, পোশাক সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণও হয়ে থাকে। এখানে নারী-পুরুষকে একে অপরের সহযোগী আখ্যায়িত করা হয়েছে।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য জমিন স্বরূপ’ (সূরা বাকারা- ২২৩)। একজন ভাল কৃষক যেভাবে সর্বদা নিজের মূল্যবান জমিনের হেফাজত করে, পরিশ্রমের মাধ্যমে জমিনের পরিচর্যা করে, জমিকে ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে, তেমনিভাবে ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, পুরুষরা যেন জেনে রাখে যে, নারীরা তাদের অমূল্য সম্পদ। সঠিকভাবে তাদের হেফাজত করা, তাদের ভাল-মন্দের দিকে দৃষ্টি রাখা এবং তাদের সঙ্গে উত্তম দাম্পত্য-জীবনযাপন করতে যেন কোন ত্রুটি ও অবহেলা না করে।
নারীদের প্রতি উত্তম আচরণের ব্যাপারে মহানবী (সা.) বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন। তিনিই (সা.) পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নারীর উত্তরাধিকার কায়েম করেছেন। বস্তুত কুরআনে করীমের মাঝেই ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে মা, স্ত্রী, কন্যা, স্বামীর সম্পত্তির এবং বিশেষ অবস্থায় ভাই-বোনদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামের পূর্বে পৃথিবীর বুকে আর কোন ধর্মই এভাবে মীরাসী সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি।
একইভাবে, তিনি (সা.) নারীদেরকে নিজ স্বামীর সম্পদের মালিকানা দান করেছেন। স্বামীর এ অধিকার নেই যে, স্বামী হওয়ার কারণে তিনি নিজ স্ত্রীর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করবেন। নারী তার সম্পদ খরচ করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে।
নারীদের আবেগ-অনুভূতির প্রতিও তিনি (সা.) যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন। একবার নামায পড়াবার সময় তিনি (সা.) এক বাচ্চার কান্না শুনতে পেলেন। এ জন্য তিনি তাড়াতাড়ি নামায পড়ানো শেষ করলেন। পরে বললেন, একটি বাচ্চা কাঁদছিল, আমার মনে হলো, ওর মায়ের মনে নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে। কাজেই, আমি তাড়াতাড়ি নামায শেষ করলাম, যাতে বাচ্চাটার মা তার বাচ্চার খবর নিতে পারে’। (বুখারী, কিতাবুস সালাত)।
মহানবী (সা.)এর কোন সফরে যখন মহিলারা থাকতেন, তখন সকলকে তিনি ধীরে ধীরে চলতে বলতেন। একবার এরকম এক অবস্থায় যখন মুজাহিদরা তাদের ঘোড়া ও উটগুলোর লাগাম ঢিলা করে দিয়ে জোরে তাড়া করতে শুরু করল, তখন তিনি বললেন, ‘আরে তোমরা করছ কি! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখ! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখ! অর্থাৎ, করছ কি! মেয়েরাও তো সঙ্গে আছে। তোমরা যদি এভাবে উট দাবড়াতে থাকো, তাহলে তো ওই কাঁচগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে’। (বুখারী, আদাব অধ্যায়)।
আরও পড়তে পারেন-
- পাশ্চাত্য শিক্ষা বনাম কওমী শিক্ষা
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- ইসলামে সংশয়প্রবণতা এবং সংক্রামক রোগ
একবার এক যুদ্ধের ময়দানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার কারণে উট ও ঘোড়াগুলোকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। রাসূল কারীম (সা.) পর্যন্ত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক মহিলাও পড়ে গিয়েছিলেন। এক সাহাবী পেছন থেকে রাসূল (সা.)এর সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পা তখনও রেকাবের মধ্যে আটকে ছিল এবং তিনি ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি (সা.) তাড়াতাড়ি পা ছাড়িয়ে নিজকে মুক্ত করলেন এবং ওই সাহাবীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমাকে ছাড়ো, ঐদিকে, মেয়েদের দিকে যাও’।
রাসূলে কারীম (সা.)এর ওফাতের সময় যখন ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি (সা.) সব মুসলমানদের সমবেত করে যে সব ওসিয়্যাত করেছিলেন। তার মধ্যে একটি কথা এই ছিল যে, ‘আমি তোমাদেরকে আমার এই শেষ ওসিয়্যাত (উপদেশ) করছি যে, নারীদের সঙ্গে সর্বদা উত্তম আচরণ করো’। এ কথাও তিনি প্রায়ই বলতেন যে, ‘যার ঘরে মেয়েরা আছে এবং সে তাদের লেখাপড়া শেখায় এবং ভালভাবে তরবিয়ত করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার জন্য দোযখ হারাম করে দিবেন’। (তিরমিযী শরীফ)।
সাধারণ আরবদের মধ্যে একটি রেওয়াজ ছিল যে, স্ত্রীরা যদি কোন ভুল-ত্রুটি করত, তবে তাদের প্রহার করা হত। রাসূল কারীম (সা.) যখন বিষয়টা জানতে পেরে বললেন, ‘নারীরা আল্লাহ তাআলার দাসী, তোমাদের নয়। তাদের কখনই মারধর করবে না’। তিনি (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে না কিংবা তাকে মারধর করে, তার সম্পর্কে আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি যে, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে সৎ বলে বিবেচিত হবে না’।
রাসূলুল্লাহ (সা.)এর অনুগ্রহে প্রথমবারের মতো নারীরা মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার ফিরে পাওয়ার স্বাদ গ্রহণ করে। (আবু দাউদ, কিতাবুন নিকাহ)। হযরত মাবিয়া আল কুশায়বি (রাযি.) বর্ণনা করেন, ‘আমি রাসূলে কারীম (সা.)কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার কী?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে খেতে দাও, আল্লাহ তোমাকে যা পড়তে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে পড়তে দাও এবং তাকে থাপ্পড়ও মেরো না, গালিও দিও না এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না’। (আবু দাউদ)।
মহানবী (সা.) বলেছেন, নারীদেরকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তুমি যদি একবারে এটিকে সোজা করতে যাও, তবে ভেঙ্গে ফেলবে। অর্থাৎ তাদের স্বভাবে কিছুটা বক্রতা রাখা হয়েছে। কিন্তু এটিই নারীদের সৌন্দর্য। তাদের যদি একবারেই সোজা অর্থাৎ সংশোধন করার চেষ্টা করে কঠোর ও রূঢ় পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তবে সেটি কখনও সংশোধিত হবে না। আর এভাবে সেই হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে, অর্থাৎ নারীরা বিগড়ে যেতে পারে। প্রেম-ভালবাসা, সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদেরকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে।
একটি মুসলিম পরিবারে নারীর ভূমিকা কতই না গুরুত্বপূর্ণ। নারী পরম ধৈর্যের সাথে সন্তান জন্মদেয়, লালন-পালন করে, শিশুকালে আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষা দিয়ে সভ্য ও ভদ্রভাবে গড়ে তোলে, স্বামীর সেবাযতœ করে তাকে কর্মোদীপ্ত করে তুলতে ও পরিপার্শ্বিক হতাশা কাটাতে সহায়তা করে, সর্বোপরি সংসারকে গুছিয়ে ও আগলে রাখে। এমনকি নারীর দায়িত্বশীলতা ও ভূমিকার উপরই একটি পরিবারের সামাজিক মর্যাদার তারতম্য অনেকটা নির্ভর করে। সুতরাং একজন মুসলিম নারীর ভূমিকা কোন অংশেই কম তো নয়ই, বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলতে হবে।
ইসলাম এমন একটি পবিত্র-ধর্ম, যা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অধিকার খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান রাখার কথা ঘোষণা করে। তাই এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, ইসলামের নবী (সা.) নারীর যে মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা জগতে কেউ করতে পারেনি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে নারীদের এ মর্যাদা উপলব্ধি করে রাসূল (সা.)এর সুন্নাহ মোতাবেক আমল করার তাওফীক দান করুন। আমিন।
লেখিকা: পরিচালক, রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদ্রাসা, উত্তরা, ঢাকা।
মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/